মূলত পেটের ওপর দিয়ে গেছে। পাঁজরের নীচের দিকের খানিকটা অংশ নেই বললেই চলে। মেরুদন্ডের ডরসাল বারো এবং এগারো নম্বর হাড় অথবা লাম্বার এক নম্বর আদৌ কোনোকালে ছিল কিনা নিশ্চিত ভাবে বলার উপায় নেই এখন, যদিও ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়, যেহেতু মানুষ একটি মেরুদন্ডী প্রাণী। পেট ছাড়া ডান হাতটা। কবজির খানিক ওপর থেকে আলাদা হয়ে দুই লাইনের মাঝখানে পড়ে ছিল। ওপরের অংশটা যথারীতি ডান কাঁধের সাথে লেগে আছে, যে ডান কাঁধ এখনো শরীরের ওপরের দিকের সাথে সংযুক্ত। পড়ে যাবার মুহূর্তে বাঁ হাতটা মাথার দিকে উঠে থাকায় সেটা লাইনের বাইরে ভূমিলগ্ন হয়ে বিস্ময়করভাবে বেঁচে গেছে। পেটের নীচের অংশটা, কোমর এবং অক্ষত একজোড়া পা সমেত, ডান হাত থেকে কিছুটা দূরে সমান্তরাল ইস্পাত-রেখা দুটির মাঝখানে।
পাঁজরের ওপর চাপ পড়ায় দুই ফুসফুস আর হৃদপিন্ডের খানিকটা থেঁৎলে গেছে। যকৃৎ আর প্লীহা কষ্ট করে চিনে নিয়ে ভিসেরা হিসেবে সংগ্রহ করা হল। পাকস্থলী নেওয়া হল বটে, কিন্তু ফাটা বেলুনের ভেতর থেকে সব বেরিয়ে পড়ায় ভেতরের হজম না হওয়া খাবার বিশেষ নেওয়া গেল না। স্পষ্ট রেলে কাটা কেস এবং গাদা গাদা প্রত্যক্ষদর্শীর নথিভুক্ত বয়ানের প্রভাবে খাদ্যকণা সংগ্রহে কারো বিশেষ আগ্রহ ছিল না। নেহাৎ করতে হয়, তাই পোস্টমর্টেম। নির্লিপ্ত এবং অভিজ্ঞ রতন ডোম ঘ্যাঁচ করে বুকের মাঝবরাবর চিড়ে ফেলে নিজেই ছেঁড়া লাংস, ফাটা হার্ট, ইত্যাদি বের করে নির্দিষ্ট পাত্রে রাখছিল। পেটটা এমনিতেই হাঁ হয়ে থাকায় কাজের সুবিধে হয়েছে। ডাক্তার ততটা নির্লিপ্ত হতে না পেরে ভাবছিল, মালটা উপুড় না হয়ে চিত হয়ে পড়ল কী করে? লিংক-চেনে পা বা শরীর আটকে গেলে একটা মানুষ কেমন করে চিত হয়ে যেতে পারে, তার পড়ে যাবার স্লো মোশন পুনঃপ্রচার দূরদর্শনে দেখালে, তার সাথে ডাইভিং প্রতিযোগিতার উঁচু পাটাতন থেকে আড়মোড়া ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়া রুশী ষোড়শীর শরীরী বিভঙ্গের কতটা মিল থাকবে, সেই সব জটিল প্রশ্ন তাকে ব্যতিব্যস্ত করছিল ক্রমাগত। ঝাঁপের কথা মনে হতেই চিন্তা হল, এ কি নিছক নিপাতনে সিদ্ধ পরিণতি, নাকি সচেতন ঝাঁপ? অবাস্তব। দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির নীচে কেউ ঝাঁপ দেয় না, তাও আবার দুই কামরার মাঝখানে।
কম করে তিরিশজন দেখেছে, ১৬ই সেপ্টেম্বর দুপুর একটা নাগাদ মাঝেরহাটের দিক থেকে একটা সুন্দর দেখতে মালগাড়ি আসছিল ভেঁপু বাজিয়ে। বেশ নতুন ছাদখোলা ওয়াগন। কোথাও রঙ চটে যায়নি, মরচে ধরেনি। সাবেক মালগাড়ির মতো দুঃখী, বিগতযৌবন নয়। তার চলার আওয়াজেও ছিল না লকড়-ঝকড় বাতগ্রস্ত হাঁটুর ক্লান্তি। ঢাকুরিয়া ব্রিজের তলা দিয়ে গুঁড়ি মেরে খানিকটা গিয়ে সে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে পড়ে সেইখানটায়, যেখানে রেল-লাইনে বাজার বসে। “মালট্রেন, মালট্রেন” বলে কয়েকজন সতর্ক করতেই শেষ মুহূর্তে দোকান, চাটাই এবং চটি উঠিয়ে সরে দাঁড়ায় সবাই। রোজকার কাজ।
ওইখানেই আছে ভাঙা পাঁচিল। সেই ফাঁক গলে রেল লাইন পেরিয়ে এদিকের গলি থেকে ওদিকের গলিতে যাওয়া যায়। পিনাকী দাঁড়িয়ে ছিল পঞ্চাননতলার দিকের বাজারটার মুখে মাছের আঁশের গন্ধের পাশে, লাইন ঘেঁষে। ওপারে যাবার তাড়া ছিল। কিছুক্ষণ উসখুস করে দুই কামরার ফাঁক দিয়ে যাবার চেষ্টা করল। আগেও গেছে। কামরা জোড়া দেওয়া লোহার আংটার তলা দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু পিনাকী সেটার ওপর দিয়ে টপকানোর চেষ্টা করল। পারল না। লোকজন হইহই করতে পা নামিয়ে আংটা আর ঝুলে থাকা পাইপটার ফাঁক দিয়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু চেঁচামেচির কারণটা বুঝতে পারল না। ততক্ষণে গাড়ি নড়াচড়া শুরু করেছে। জ্বলন্ত অগ্নিবলয়ের ভেতর দিয়ে লাফিয়ে পেরোনো সার্কাসের বাঘের মতো চলন্ত লৌহছিদ্র গলে সেও এক খেল দেখাবে বলে ভেবেছিল কিনা, সে কথা এখন আর তাকে জিজ্ঞেস করা সম্ভব না। কিন্তু খেলাটা শেষ পর্যন্ত দর্শকের হাততালি কুড়োতে পারেনি, যদিও ভিড় জমিয়ে দেখেছিল অনেকেই। খবর রটে যেতে আরো অনেকে এসেছিল। দুজন বমিও করেছিল। অবশ্য ট্রেনের ল্যাজের দিকে কাটা পড়ায় মাত্র তিনটে বগি তার পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে।
পিনাকীর অকালপ্রয়াণে কোনো শোকসভার আয়োজন হল না প্রত্যাশিত ভাবেই। সভা বা জটলা করার মতো যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ তার মৃত্যুতে শোকার্ত হবে, এমন কল্পনা পিনাকীও করেনি। কারো বিশেষ অসুবিধেও হবার কথা নয় পিনাকী মরায়, বিধবা মা আর তিন্নি ছাড়া। তিন্নি পিনাকীর বউ। দুঃখের প্রয়োজনীয়তা তর্কযোগ্য; কিন্তু গরীব বাড়িতে রোজগেরে স্বামী হঠাৎ মরলে কিছু বাস্তব সমস্যা হতেই পারে। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, তিন্নির কিছু সমস্যা হয়েছিল এবং পিনাকীর মৃত্যুতে “দৈনন্দিন জীবনে স্বামীর উপযোগিতা” বিষয়ে ছোটখাটো রচনা লেখার মত কিছু শিক্ষা সে অর্জন করেছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ষোলো তারিখ দুপুর দুটোয় রেললাইনের ধারে পুলিশের সামনে একবার এবং ঐদিন সন্ধে সাড়ে ছটায় মহল্লার লোকজন এবং এলাকার কাউন্সিলরের খাস চামচা বাবলুর উপস্থিতিতে আরো একবার তাকে চিৎকার করে, “এ কী করলে গো...” বলে কাঁদতে শোনা এবং দেখা গেছে।
এছাড়া কেঁদেছিল মান্তু। মান্তু স্বপনের বউ। কিন্তু তার প্রকাশ্যে কাঁদার উপায় ছিল না। সুতরাং বস্তির লোকের জ্ঞানমতো সে কাঁদেনি, ঠিক যেমন সে পিনাকীর সাথে কোনোদিন শোয়নি। খবর শুনে সেও লাইনের ধারে এসেছিল। ছেঁড়া শরীরের আকর্ষণীয় প্রদর্শনী দেখার ঠেলাঠেলি ভিড়ের মধ্যে সে বিশেষ পাত্তা পায়নি। কোনক্রমে খানিক রক্ত আর কাটা ডান হাতটা দেখতে পেয়েছিল। সেটুকু দেখে ফিরে এসে সে পায়খানায় যায়। দরজা বন্ধ করে উবু হয়ে বসে থাকে দশ-বারো মিনিট। কোষ্ঠকাঠিন্য ছিল না; এতক্ষণ সময় লাগার কথা নয়। তাছাড়া এই সময়ে অন্যদিন সে যায় না। কাটা হাত দেখে গা গুলিয়ে বমিও সে করেনি। কিন্তু পায়খানা থেকে বেরিয়ে কলঘরে গিয়ে তাকে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিতে হয়েছিল। জোরে জল ছেটানো, অতিরিক্ত কচলানো বা অন্য কোনো কারণে চোখের কোণ একটু লালচে দেখাচ্ছিল, বিশেষত ডান দিকেরটা।
সফল মুদি দোকানি স্বপনের পয়সা বেশী থাকলেও মাজার জোর কম। আনন্দ কম। পিনাকী ফুট করে ফুটে গেল এবং তার সাথে সেই সব সুখ। এখন আবার কে তার জায়গা নেবে? এইসব জরুরি প্রশ্ন পায়খানায় বসে মান্তুর মাথায় আসেনি। সে শুধু পিনাকীর কথাই ভাবছিল। তার বেঁচে থাকার কথা। তার মরে যাবার কথা। চোখ রগড়াতে গিয়ে মান্তু হঠাৎ টের পেল, সে পিনাকীকে, সম্ভবত, ভালবাসত। প্রায় সমবয়সী, শারীরিক এবং মানসিকভাবে পরিচিত, বেকার এবং গতিশীল প্রতিবেশী পিনাকীকে বতিল করে লব্ধপ্রতিষ্ঠ মুদি, সুস্থিত এবং স্থানু স্বপনকে সে বিয়ে করেছিল, সে কথা সত্যি, কিন্তু একমাত্র সত্যি নয়।
অবশ্য আরো দুটো কারণ ছিল শোকসভা না হবার। একঃ ২০১৫ সালে অন্যের মৃত্যুতে শোক করার বিলাসিতা কেউ করে না। দুইঃ পিনাকী যে পাড়াতে থাকত, সেখানে সভা বলতে নির্বাচনের আগে মাইকবাজি দু-একবার। মানুষ মরলে শ্রাদ্ধ হয়, ও নিয়ে কেউ বক্তৃতা দেয় না।
অপঘাত মৃত্যু বলে তেরাত্তির পেরিয়ে কাজকম্ম সব চুকে-বুকে গেল। এই কারণে পিনাকীকে অনেকেই মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে থাকতে পারে, বিশেষত পরিবারের সদস্যরা। রোগে বা অনাহারে স্বাভাবিক মৃত্যুর বদলে অপঘাত বেছে নেওয়ায় অশৌচের ঝঞ্ঝাট তেরোদিন টানতে হল না। দশদিন আগে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারা কম কথা নয়। আধুনিক সার্জেনরা সেই কথাই বলেন। পেট না কেটে ক্যামেরা দিয়ে অপারেশন করে দিলেই দুই দিনে বাড়ি যাবেন, চারদিনে অফিস। বড় মূল্যবান স্বাভাবিক জীবন, যেটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর হাত ধরে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে।
আরো একটা কারণে পিনাকীর ধন্যবাদ প্রাপ্য। পিনাকীর ভূত কাউকে জ্বালায়নি। রেলে কাটা ভূত অনেকসময় ঝামেলা করে। বিরাটির দিকে সেই যে তিনজন কাটা পড়েছিল, তার মধ্যে একটা তো... ওরেব্বাপ! সে কি চিৎকার! সন্ধে সাতটা পেরোনোর জো নেই। পাড়া-প্রতিবেশীর রাস্তায় বার হওয়া বন্ধ। শেষে খুব বড় পুরুত ডেকে এনে জব্বর করে শ্রাদ্ধ দিয়ে তাকে চুপ করানো গেল। “খরচা আছে কপালে,” অনেকেই বলেছিল তিন্নিকে। কিন্তু পিনাকীর আত্মা, যে সম্ভবত পেট দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, বিশেষ ভদ্র আচরণ করায় স্থানীয় ছোকরা পুরুত দিয়ে নম নম করে পার করা গেছে। বেশী খরচা করতে পারবে না বলে জানিয়েই দিয়েছিল পিনাকীর বউ আর মা। পাবে কোথায়? রোজগার এমন কী বা ছিল পিনাকীর? সেটুকুও তো গেল। এবার পেট চালানোই মুশকিল। পেটের ওপর দিয়েই গেল রেলের চাকাগুলো।
একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে পিনাকীর মা আতান্তরে পড়েছিলেন। জোয়ান রোজগেরে ছেলে, সে তার আয় যেমনই হোক না কেন, এভাবে হুট করে গেলে সামলাতে জান যায়। ব্যাঙ্ক-পোস্টাপিসের কাজ তো সেই দেখত বাপ যাবার পর থেকে। তখন কতই বা বয়স? উচ্চ মাধ্যমিক পরের বছর। রোজগারটাও বাড়ছিল দিনে দিনে। বিয়ের পর থেকে খুব খাটছিল ছেলে। যদিও ঠিক কী কাজ সে করত, তা জানে না মণি। ঐ নামেই ডাকত পিনাকীর বাপ। তার রুচি ছিল, পেটে বিদ্যে ছিল। বাপের বাড়ির খেন্তি নাম সে কখনো মুখে আনেনি। ছেলের নাম রেখেছিল পিনাকী। শিবঠাকুর। শম্ভু, ভোলা, শিবু নয়; কেমন সুন্দর নাম! ডাক নাম পিঙ্কু, সে তো মানদাপিসি বানিয়েছিল ভাল নাম ছেঁটে। বাপ সে আমলের স্কুল ফাইনাল পাশ হবার এই এক মস্ত সুবিধে। স্কুল ফাইনাল কি সহজ কথা ছিল? সর্বস্ব খুইয়ে মায়ের হাত ধরে এপারে পালিয়ে এসে বড় কষ্টে লেখা-পড়া শিখেছিল লোকটা। একার মেহনতে সংসার টেনে, ভাল জায়গায় বাড়ি ভাড়া করে উঠে গেছিল খাল পাড়ের বস্তি থেকে। ছেলেটাকে লেখা-পড়া শেখাচ্ছিল। সোয়ামীর মতো সোয়ামী, বাপের মতো বাপ।
সে-ই বাপ গেল রাতদুপুরে হঠাৎ। সকালে চা নিয়ে ডাকতে গিয়ে মণি দেখে মরে পড়ে আছে। কাঠ। কেন মরল, সে-ই জানে। ভদ্রস্থ ভাড়া বাড়িটা ছাড়তে হল। কম পয়সায় এই বাসা খুঁজে দিয়েছিল জীবনকাকা। থাকার মধ্যে সম্বল ছিল ছেলেটা। সেও গেল ভরদুপুরে হঠাৎ। কেন গেল, সে-ই জানে। কত কষ্টে বি-কম অব্দি তার পড়া টেনেছিল মণি! সে কি এই দিন দেখার জন্য? সারাজীবন লালন-পালন করে শেষ জীবনে মানুষ যে একটু সুদের আশা করে, সেটুকুও দিলে না বিধাতা ব্যাঙ্ক থেকে!
তিন্নিরও যে অসুবিধা হয়নি, তা নয়। প্রথম দিন দুবার এবং পরবর্তী কদিনে আরো কয়েকবার কাঁদা ছাড়াও, হঠাৎ করে তার পোশাক, খাওয়া-দাওয়া গেল বদলে। বাধ্যতামূলকভাবে মুখ ব্যাজার। তাছাড়া কাগজ-পত্র বুঝে নেবার এবং জমা দেবার যে এত ঝকমারি, তা সে আগে ভাবেনি। ভাবার উপলক্ষই বা কী ছিল? মাত্র কটা টাকার এলআইসি। সেটাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। অপঘাতে নাকি দিতে চায় না। এরাও পাঁজি-শাস্তর মানে নাকি?
একটা সুবিধা অবশ্য হয়েছে। এখন আর নির্মলের সাথে থাকতে গেলে পালিয়ে যেতে হবে না। নির্মল এখন ঘরে আসতে পারে। সান্ত্বনা দিতে পারে। শ্বাশুড়ী লোক ভাল। এইটুকু মেয়ে সারাজীবন বিধবা সেজে বসে থাকবে, তেমন চান না। নির্মল ছেলেটাকে তাঁর ভালই লাগে। বিয়ের নিদান যদি তিনি নিজে থেকে দেন, তাহলে সবদিক রক্ষা হয়। কিন্তু সেটা নিয়ে এখনই তাড়াহুড়ো করা যাবে না। এখন আগের মতো যেমন চলছিল চলুক। আগের মতোই সাবধানে সব সারতে হবে। ধরা পড়ে লোক জানাজানি হলে ভাল শ্বাশুড়ী মন্দ হয়ে যেতে পারে। হাজার হোক পরের মা; বিগড়োতে কতক্ষণ? তখন ছেলের বউ হয়ে যাবে ঘরজ্বালানী। অমন তাজা ছেলেটাকে খেলে গো! রাক্কুসী! তখন দুজনে পালানো ছাড়া পথ থাকবে না। অবশ্য নির্মল যদি দিল্লী না গুরগাঁও কোথাকার চাকরিটা বাগাতে পারে, তাহলে ভয় নেই। তবু একটা লোকসান হয়েই গেল। সামনে পুজো। পিনাকী বাইরে কি কাজে যাবে বলেছিল হপ্তা দুইয়ের জন্য। সেই সময়টুকু চেটে-পুটে খেতে পারত তিন্নি আর নির্মল। আহা! পুজোর কোলকাতা। আনন্দের হাটবার যেন। সেই সময়টাতে মুখভার করে বসে থাকতে হবে। একটু সাজলে, একটু হাসলে কারো সইবে না। কি বেহায়া মেয়ে গো! সবে স্বামীটা গেল, এরই মধ্যে সেজেছে যেন মক্ষীরাণী!
পাশেই বাবুবাগানে বিশাল মৌচাক তৈরী হচ্ছে। প্যান্ডেল। তার ভেতর রাণী হয়ে দেবী বিরাজ করবেন। রাণী মৌমাছি হলেন সর্বেসার্বা। তাঁকে যে সুখ দেয়, সে কুম্ভকর্ণ পুরুষ। খায়-দায়, সুখ দেয় আর ঘুমোয়। এসব কাজ ফুরোলে মরে যায়। কোনো কথা বলে না, প্রশ্ন করে না, রাজত্ব চায় না। রাণী আর তাঁর সন্তানদের সেবা যারা করে, তারা খোজা শ্রমিক। সারাদিন উড়ে বেড়ায়। শুধু কর্মযোগ। নিষ্কাম। এমনিতে নিরীহ, কারণ মাত্র একবারই তারা কামড়াতে পারে। তারপরই মৃত্যু। এমন কিছু মানুষও থাকে, কামড়ানোর কথা ভাবলেই যারা মরে যায়। যেমন পিনাকী। পিনাকী যখন মরে গেল, বাবুবাগানে তখন রাণীর বাড়ি তৈরী হচ্ছে।
পিনাকী যখন কাটা পড়ে, তার ঠিক আড়াই মিনিট আগে ইংরিজি সাহিত্যের স্নাতোকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের কৃতী শিক্ষার্থী ও নির্মিয়মান বুদ্ধিজীবি শমীক আর ত্রিবেণী ঢাকুরিয়া স্টেশনে নামে। শরৎ ঘোষ গার্ডেন রোডের দিকে একটা ছোট কাজ ছিল। সেটা সেরে তারা ঠিক করল সেপ্টেম্বরের দুপুরে গলি-বাজার-বস্তি, টিনের চালা-টালির চালা-আস্তাকুঁড়, পুরোনো বনেদী কয়েকঘর, নব্য মধ্যবিত্ত দেশলাই বাক্স, আট বাই আট ফুট এক কামরা টানাটানির গেরস্তালি... এসবের মধ্যে দিয়ে হেঁটে একবার লেকের দিকে যাওয়া কর্তব্য। ওখানে এরকম দুপুরে তাদের প্রিয় এক যুগন্ধর কবি চিৎ হয়ে শুয়ে থাকেন। তাছাড়া এই সংক্ষিপ্ত ট্রেক রুটে নাগরিক কোলকাতার যে অসামান্য বৈচিত্র উন্মোচিত হবে, মেছো-এঁদো-আটপৌরে সংকীর্ণতার কন্দর থেকে বিশ্বায়িত উদার সৌন্দর্যে উন্নয়ন... যার শীর্ষে আছে ক্যালকাটা এবং বেঙ্গল রোয়িং ক্লাবের অভিজাত সুশীলতা... সাহিত্য শিশিক্ষুর পক্ষে সে এক পরম প্রাপ্তি। ঢাকুরিয়া স্টেশন রোড ধরে অটো চড়ে গেলে সেই উপলব্ধি সম্যক হবে না। যেতে হবে এ টি চ্যাটার্জি রোড ধরে বজবজ লাইন পেরিয়ে পঞ্চাননতলা রোড বরাবর। সেখান থেকে উড়ালপুলের নীচ দিয়ে কবি ভারতী সরণী, যার লেক রোড নামধারী ব্রিটিশ শরীর কাটা পড়েছে লোহার গেটে। গেট পেরিয়ে গাড়ি যায় না, কিন্তু পদাতিকের গতায়াত অবাধ। সাহিত্যিকের সেটাই পথ।
বজবজ লাইনের ধারে এসে তারা দেখল পুলিশে পুলিশারণ্য। পুলিশের বৃত্ত ঘিরে নানারকমের পাতি লোক, অর্থাৎ যাদের জন্য আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া বেআইনি। পুলিশের জটলার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ত্রিবেণী ও শমীক দেখতে পেল, যদিও এটা সরোবর বা উদ্যান নয়, তবু এখানেও ভর দুপুরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে একটা লোক, যার কবি প্রতিভা সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। উপরন্তু লোকটার মাথার সাথে ডান হাত এবং পাকস্থলির সাথে মলদ্বারের কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই।
ভিড় ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে যেতে ত্রিবেণীর মনে হল, লোকটা বিড়ি ছাড়া অন্য কিছু খাবে কি করে? একমাত্র বিড়ির ধোঁয়া যাবে ফুসফুসে, যেটা ফাটা হলেও মাথা এবং মুখের সাথে সংযোগ বজায় রাখতে পেরেছে। কিন্তু অন্যান্য খাবার যেখানে যাবার কথা, সেটা খাদ্যনালীর ঊর্দ্ধাংশ থেকে প্রায় ফুট তিনেক দূরে। ভাবতে ভাবতে সে একটা সিগারেট ধরাল। জটিল বিষয়ে ভাবার সময় তার এটা প্রয়োজন হয় এবং এর অভাবে পরীক্ষার হলে মাথা কাজ করে না।
সমস্যার সমাধানে শমীক কোনো সাহায্য করতে পারল না। শারীরবিদ্যা তার প্রিয় বিষয় ছিল না কখনো। তার মনে তখন অন্য সংশয়, অন্য হতাশা। ট্রাম লাইনের বদলে রেল লাইন বেছে নেয় কেন এরা? মেঠো ইঁদুরের মতো মরে, কিন্তু নিম পেঁচার জন্যে কোথায় প্রতীক্ষা করতে হয় জানে না! “হুম! ট্রাম লাইন উড হ্যাভ গ্লোরিফায়েড হিম ইন ডেথ,” ত্রিবেণী স্বীকার করে।
এরা কেউ খেয়াল করল না যে মহান মৃত্যুর সাথে তুলনীয় হবার বিকল্প অনুষঙ্গ, অন্যান্য প্রায় সব মৃত্যুর মতোই, উপস্থিত পিনাকী গুহর মৃত্যুতেও। ১৬ই সেপ্টেম্বর যেমন তেমন দিন নয়। বাবুবাগানের অত্ত বড় পুজো যেখানে হয়, সে তো আদতে শহীদ তারকেশ্বর সেন স্মৃতি উদ্যান। ওয়ার্ড ৯২, বরো ১০, কোলকাতা পুরসভা। লেখা আছে। আরো লেখা আছে, তারকেশ্বর সেন ওরফে সেনগুপ্ত নিহত হন ১৯৩১ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরের খড়গপুরের নিকটবর্তী হিজলি জেলে নিরস্ত্র রাজবন্দীদের উপর ব্রিটিশ পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণের ফলে। সেই উদ্যানের সামান্য দূরে ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০১৫, নিহত হলেন শ্রী পিনাকী গুহ। কিন্তু তাঁর স্মৃতিতে একটা ফুলগাছও লাগানো হবে না, কারণ তিনি, সঙ্গত কারণেই, শহীদ নন। একে তো স্বাধীন দেশে এমনকি পুলিশের গুলিতে মারা গেলেও সরকার স্বীকৃত শহীদ হওয়া যায় না, তায় আবার মালগাড়ি! তাছাড়া তারকেশ্বর সেন নিহত হন মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে। অপরপক্ষে মৃত্যুকালে পিনাকী বয়স হয়েছিল সাতাশ বছর নয় মাস সাত দিন। সেই অর্থে অকালপ্রয়াণ বলা চলে না।
অবশ্য রেলে কাটা পড়ার ফলে পিনাকী সম্বন্ধে কিছু আলোচনা হল বাজারে। এমন অনেকেই তাতে অংশ নিল, ১৬ তারিখ সকালেও যাদের কোনো উৎসাহ ছিল না পিনাকীর বিষয়ে। এটা একরকম সাফল্য নিঃসন্দেহে, ঠিক যেমন সাফল্য বা বিরল সৌভাগ্য হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে চাপা দেবার জন্য অজস্র কুৎসিত মালগাড়ির বদলে এক সুদর্শন নবীন মালট্রেনের আগমন। সৌন্দর্যচেতনা না থাকায় উৎসাহের সঙ্গে মালগাড়ির রূপবর্ণনা করল না কেউ। একমাত্র বিশুর চা-দোকানের কর্মচারী কাত্তিক দুবার উল্লেখ করেছিল গাড়িটার যৌবনে ভরপুর গতরের কথা, কিন্তু তাকে কেউ বিশেষ পাত্তা দেয়নি। অথচ জীবনের অন্তিম যোগাযোগ যার সাথে, সে মানুষ হোক, সারমেয়রূপী ধর্মরাজ বা মালবাহী লৌহশকট, তার সুন্দর হওয়া মানুষের সারাজীবনের স্বপ্ন ও প্রার্থনা হতেই পারত।
আরো কিছু গুরত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এইসব আলোচনায় উঠে এল না, যেমন, সেদিন মিনিট কুড়ির মধ্যে পিনাকীকে দুবার বজবজ লাইন পেরোতে দেখা গিয়েছিল। নইলে যেখানে তার বাড়ি, সেখান থেকে ঢাকুরিয়া স্টেশন যেতে গেলে আদৌ লাইন পেরোনোর দরকার হয় না। প্রথমবার সে আসে অটো স্ট্যান্ড পেরিয়ে ঢাকুরিয়া ব্রিজের পাশ ঘেঁষে থাকা পাঁচিলের ফুটোটা গলে। খুব ব্যস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। যেন কোনো জরুরি কাজ আছে। কিন্তু পঞ্চাননতলা মোড় পেরিয়ে হনহনিয়ে গোলপার্কমুখো খানিকটা গিয়ে কোনো কাজ না করেই সে ফিরে আসে। ফ্লাইওভারের ফুটপাথ ধরে খানিকটা চড়াই উঠে এসে আবার পিছন ফিরে নেমে যায়। শেষে পঞ্চাননতলা রোড ধরে হাঁটতে থাকে। সেই রাস্তায় ইতস্তত বার দুই-তিন ঘোরাফেরা করে বাজারের সরু গলিটা দিয়ে পৌঁছায় রেললাইন এবং মালগাড়ির ধারে। তখনো তার তাড়াহুড়ো শেষ হয়নি। এসব কেউ নজর করে দেখেনি। নাহলে দেখতে পেত তার মুখমন্ডল ঈষৎ লালচে, চোখের তারা বড় বড়, হৃদপিন্ড ছুটছে যেন তরুণ তুরঙ্গ। শরীর উষ্ণ, কিন্তু সেপ্টেম্বরের দুপুরে একবিন্দু ঘাম নেই। ত্বক শুষ্ক। গলা শুকনো। জিভ কাঠ। এসব কেউ দেখেনি বা বলেনি। প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে শুধু মালগাড়ি, যে দাঁড়িয়ে থেকেও হঠাৎ চলতে শুরু করেছিল। তাই পেট থেকে ছড়িয়ে পড়া খাদ্যকণা যত্নে সংগ্রহ করেনি কেউ। ফরেন্সিক ল্যাব তেমন করে খুঁজে দেখেনি ধুতরো বীজের চিহ্ন।
নিহত ব্যক্তিকে আদৌ কোনো মাথা বিগড়ে দেওয়া ‘স্টুপিফাইং এজেন্ট’ খাওয়ানো হয়েছিল কিনা, বা হয়ে থাকলে কে খাইয়েছিল, সেসব অবান্তর প্রশ্ন। ধুতুরা, বেলাডোনা কিম্বা কল্কে ফুলের বিষক্রিয়া অথবা অতিরিক্ত পরিমাণ সিদ্ধি-বাটার প্রভাব, যদি থেকেও থাকে, তবে সে নিমিত্ত মাত্র। মৃত্যুর প্রাগমুহূর্তের এহেন দ্রুততা ছিল পিনাকীর উপযুক্ত। আসলে সে অশ্ব জাতীয়। ঘোটক। লম্বাটে মুখ, লম্বাটে চুল। তিন্নি বলত ঘোড়ামুখো। তাড়াহুড়ো ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছিল তার জীবনে। বাপ মরে গেল, তখনো স্কুল পেরোতে বাকি। টানল তবু বি-কম অব্দি। প্রেমে না পড়লে আরেকটু পড়াশুনা হত। আরেকটু ভাল নম্বর। বাপ মরা ঘোড়ামুখো ছেলের সব বিলাসিতা পোষায় না, সে কথা মাথায় আসেনি তখন। মা খাওয়াচ্ছিল। গতর খাটিয়ে আর ভাঁড়ার ফুটো করে খাওয়াচ্ছিল। পড়া থামল। চাকরি জুটল না। তারুণ্য পেরিয়ে অল্প অল্প বেঁচে রইল বালক বয়স। একদিন হঠাৎ মাথার বয়স বাড়ল মান্তুর বিয়ে হবার পর। বিয়ের দিন সকাল অব্দি পিনাকী নিঃসন্দেহ ছিল অনেক অনেক সিনেমার ক্লাইম্যাক্সের মতো মান্তু পিঁড়ি ছেড়ে, মালা ছিঁড়ে, দৌড়ে চলে আসবে তার কাছে। অতঃপর আলিঙ্গন এবং সানাই। কিন্তু ভাল ক্যামেরার অভাবে এসব কিছুই হল না। স্বপনের বিয়ে হয়ে গেল এবং দেখা গেল ঘোমটার আড়ালে বৌটা, কি আশ্চর্য, মান্তুই।
মান্তুর বিয়ের চারদিন পর সকালবেলা ঘুম ভাঙতে ঘরের ঝুলওয়ালা ছাদের দিকে তাকিয়ে পিনাকীর মনে হল সে রূপনারায়ণের তীরে ঘুমোচ্ছিল। এইমাত্র মান্তুর ঠেলা খেয়ে জেগে উঠল এবং উঠেই জানতে পারল যে জগতটা স্বপ্ন নয়। এই কবিতাটা পিনাকী তার স্কুল ফাইনাল পাশ বাপের মুখে মাঝে মাঝে শুনত। রক্তের অক্ষরে নিজের নাম দেখতে পাওয়ার ব্যাপারটা গোড়ার দিকে রোমাঞ্চকর লাগলেও সত্য সর্বদাই কঠিন এবং কঠিনকে ভালবাসতে হবে, এই প্রস্তাবদুটো তাকে বিরক্ত করত। বাপ মরে যাবার পরেও এই বিরক্তি তার মনে থেকে গিয়েছিল। মান্তুর শরীর দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলতে ফেলতে তার মনে হত, পৃথিবীটা কি নরম! নরমেরে ভালবাসিলাম। বঞ্চনা বিষয়ে কোনো ভাবনা ছিল না সেসব সময়ে। তখন সত্যযুগ। মানুষ শুধু ভালবাসত। পৃথিবী ছিল নরম আর খাওয়া-দাওয়া ছিল ফ্রি। রূপনারায়ণ বয়ে যেত শতেক মাইল দূর দিয়ে।
কিন্তু শেষ অব্দি জেগে উঠে সেই নদীর ছায়ায় নিজের মুখ দেখতে পেল পিনাকী। লম্বাটে মুখ। ঘাড়ে উড়ছে বাদামী কেশর। নাসা বিস্ফারিত। পা টগবগে। নিজের পিঠে নিজেই চেপে বসে চাবুক মেরে ছুটিয়ে দিল। দৌড় দৌড়। স্বপন মুদির চেয়ে বেশী পয়সা করতে হবে। হাট-বাজার, বন-বাদাড় ডিঙিয়ে ছুটতে ছুটতে সে ঢুকে পড়ল এলোমেলো ধোঁয়াটে বাতি-নেভা অলি-গলিতে। কী করিস রে সারাদিন এত জায়গা ঘুরে? অর্ডার সাপ্লাই। এর চেয়ে বেশী কোনো বক্তব্য ছিল না তার নিজের পেশা সম্বন্ধে। আলো-আঁধারিতে ছুটতে ছুটতে হয়ত নিজেই ঠাহর পায়নি এর চেয়ে বেশী। মাল দেয়, পয়সা নেয়। যার যেমন পছন্দ। যে মালের যা দাম। সেই দামের সামান্যই তো সে পায়। তাতে খিদে মেটে না। ওইটুকু পয়সা নিয়ে স্বপন মুদির বউয়ের সামনে দাঁড়ানো যায় না। ওর নরম বিছানায় শুলেই গা কুটকুট করে। মান্তুর গলা থেকে, কান থেকে সোনা ঝুলে পড়ে পিনাকীর বুকে, মুখে। ঘোড়ার পিঠে সপাং! ঘোড়া অস্থির হয়ে ওঠে। মৈথুনকালে চাঁদের দিকে চেয়ে সামনের দু’পা তুলে আর্তনাদ করে ওঠে “চিঁহিঁইইই...” থরথর কেঁপে ওঠে। সব অঙ্গ শিথিল হয়ে আসে। কঠিনতর হয় শুধু পা। বিদ্যুতের পা। মুদির বউকে গোলাপী বিছানায় অতৃপ্ত ফেলে জানালা গলে লাফিয়ে বেরোয় এক আগ্নেয় ঘোড়া। যার চোখ নেই, শির নেই, লিঙ্গ নেই... আছে শুধু নাল বাঁধানো খুর।
তিন্নির সাথে দুম করে বিয়ে হয়ে যাবার পর ঘোড়াটা একটু জিরোবে ভেবেছিল। যেসব বন্দরে সে বাণিজ্যে গেছে এতদিন, সেই সমস্ত জায়গা থেকে একেবারে ফিরে আসা যায় না। বারে বারে যেতেই হয় নতুন আনাজ নিয়ে। কিন্তু সে মুদির বাড়ি যাওয়া বন্ধ করল। মানে একপ্রকার বন্ধ করল বললেই চলে। মুদির বউ অনেক করে ডাকল। একদিন খুব গালি দিল। ঘোড়া আপনমনে ঘাস চিবোতে চিবোতে তার খিড়কি-দোর দিয়ে চলে গেল হ্রেষারবটুকু না করে। শুধু তাই নয়, চুল্লু মদনার ঠেকে বোতল ছুঁয়েছে সে গত এক বছরে মাত্র ছ’দিন। রাত বাড়ার আগে ঘাড়ের লোম আদুরে বেড়ালের মতো ফুলিয়ে আস্তাবলে ফিরে আসত এক ঘোড়া। রাস্তা-ঘাট তাকে টিটকিরি দিয়ে বলত ‘জরু কা গুলাম’। ঘোড়া কান নামিয়ে, ঘাড় নামিয়ে নিজের বাসার চৌকাঠের গন্ধ নিত আর নরম গলায় বলত ‘চিঁহিঁ’।
এটা যেন অন্য একটা ঘোড়া। গৃহপালিত। মুদির বাড়ির জানালা গলে যে দুর্দান্ত জানোয়ার দৌড়ে গেছিল খিদিরপুর মুখো, এ সে নয়। এই ঘোড়াটা টিমটিমে আলোয় তিন্নিকে দেখে। তার কাঁধে আলতো করে সামনের দু’পা তুলে দিয়ে তার চোখের মধ্যে কী যেন খোঁজে! তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, “চিঁহিঁ... চিঁহিঁ...চিঁহিঁ...।” ঘোড়ার শ্বাস শিমুল তুলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে মেয়েটার ঘাড়ে। দু-চারটে চুল একটু উড়ে ফের স্থির হয়। তিন্নির ভাল লাগে না। ঘোড়া তার পছন্দ নয়। সে মহিষদলনী। পায়ের কাছে আশ্রয় দেবার মতো একটা পুষ্ট প্রশ্নহীন মোষ সে খুঁজে পেয়েছে নির্মলের মধ্যে।
আস্তাবলে ডাঁশের কামড় খেয়ে ঘোড়াটা ফের রাস্তায় বেরিয়ে এল। তাকে বাণিজ্যে যেতে হবে। সপ্তডিঙা ডুবিয়েও আনতে হবে নীলকান্ত মণি, গজমোতির মালা। বিয়ে করা বউটাকে বোধহয় সে ভালবেসেছিল, নিদেন পক্ষে পেতে চেয়েছিল, কিম্বা তিন্নির মধ্যে সে হয়ত মান্তুকে খুঁজেছিল, অথবা খুঁজেছিল আশ্রয়, প্রশ্রয়, নিজের পৌরুষের স্বীকৃতি বা অন্যকিছু। অভিষ্ট যাই হোক, আরো দৌড়লে সেটা পাওয়া যাবে, তার মনে হল। গা-ঝাড়া দিয়ে, ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে সে ছুটল। সেই পুরোনো ঘোড়াটা, যে মান্তুর ঘর থেকে ঠিকরে পড়েছিল রাস্তার অল্প আলোয়। তার মস্তিষ্ক অবশ হয়ে এল, কলজে ক্লান্ত, কষ বেয়ে ফেনা গড়াতে লাগল, কিন্তু পা থামল না। এমনি ছোটাছুটির ফাঁকে ফাঁকে ভীরু ও প্রত্যাশী চোখে মাঝে মাঝে এক নারীর মুখের দিকে চেয়ে বলত “চিঁহিঁ... চিঁহিঁ...”। নিরুত্তর চোখ দেখে তার সন্দেহ হত তার গতি এখনো তুরঙ্গসুলভ নয়। আরো যেতে হবে। সফল মুদি স্বপনের মতো লোকমান্য হতে হবে তাকে। তবে পুরুষ। তবে তার ঘর হবে।
এমনি একদিন ভীরু ঘোড়া অসময়ে ঘরমুখো এসে দেখে তার আস্তাবলের জায়গায় ছোট্ট একটা নিরিবিলি গোয়াল। হলুদ ফুল-ছাপ নিকোনো খড়ের গাদায় ফোঁস ফোঁস করে প্রবল নিঃশ্বাস ফেলছে এক অসামান্য কৃষ্ণসার মহিষ। তার শ্বাসের তালে তালে জয়পতাকার মতো উড়ছে দু’গাছা মেয়েলি চুল। ঘোড়া বুঝল, তার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। এতদিনে সে স্বপন মুদিকে ছুঁয়ে ফেলেছে। মুদির বউ ঘোড়ায় চড়তে ভালবাসত। ঘোড়ার বউ মোষ-পালিকা।
অনেকখানি উজান বেয়ে সে ফিরে যায় দীর্ঘ গলি পথের অন্য প্রান্তে। এই গলিটা এত লম্বা, এত দুর্লঙ্ঘ্য, তা সে আগে টের পায়নি। গলি পেরিয়ে দেখে সমুদ্দুর। যাবার জায়গা নেই। ডোবার নোনা আয়োজন বিপুল। ডুবতে ডুবতে, ভাসতে ভাসতে সে চলল। আবর্জনার ভ্যাট পেরিয়ে, গলি পেরিয়ে, বাসি বাসা আর নতুন ঘর পেরিয়ে ওয়ার্ড ৯২, বরো ১০, কোলকাতা পুরসভার তারকেশ্বর সেন স্মৃতি উদ্যানে পৌঁছে দেখে সেখানে মৌচাক তৈরী হচ্ছে। বিশাল প্রাসাদ রাণীর। সেখানে এক রাণী, এক পুরুষ, অগণিত খোজা শ্রমিক। তার মৌমাছি হতে ইচ্ছে করল। পুরুষ মৌমাছি। একান্ত ক্লীব যদি, তবে শ্রমিক। নারীকে সে পায় না, কিন্তু তারও হুলে আছে বিষ। মৃত্যুর আগে একবার সেও দংশন করতে পারে। মোষের শিঙ আছে। অশ্বের শুধু গতি। যে দিকে মুখ, সেদিকে ছুটতে পারে শুধু। সাফল্যের দিকে মুখ করে দাও তো সেদিকে, নইলে ব্যর্থতার দিকে। তার দাঁত নেই, শিঙ নেই। এর চেয়ে মৌমাছি ভাল। এমনকি খোজা মৌমাছি। মৃত্যুর আগে একবার দংশন করতে পারে, আর তাতেই চমকে ওঠে সঙ্গমরত মহিষ। মৌমাছি হবার কথা ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরল ঘোড়া।
ইচ্ছেটা প্রবল হতে থাকল মিনিটে মিনিটে। প্রবল ইচ্ছা স্বয়ংপ্রকাশ। লুকিয়ে রাখা যায় না এমনকি রাতের আকাশ ঢাকা দিয়ে। রাত্তিরে ভাতের থালায় বসে বউকে সে জিজ্ঞেস করেই ফেলল নির্মলের ব্যবসা কেমন চলছে। হঠাৎ নির্মলের কথা শুধোয় কেন এই লোক? এমনি এমনি। পুরোনো বন্ধু, আসা-যাওয়া আছে। তা ভাল খবর সব নিশ্চয়। বিয়ে-থা করে না কেন? অমন নধর জোয়ান! মোবাইল রিপেয়ারের ব্যবসা তো এখন সুপারহিট। নতুন সেট বেচতেও লেগেছে শোনা যায়। এবার ঘর পাতলেই হয়।
খাবার পর নিতাইকে ফোনে ধরে পিনাকী। “নির্মলকে থাকতে বলিস তো কাল বিকালে। কাল হবে না? তাইলে বুধবার সকাল। আচ্ছা এগারোটা ঠিক আছে। বলবি কিন্তু, কাজ আছে। অ্যাঁ! কী কাজ? সে সেদিন বলব। চিল্লাস কেন?” ফের নির্মলের নাম শুনে চমকে ওঠে তিন্নি। কী কাজ তার সাথে? তাহলে কী...? অনেক দিন পর সেই রাতে অনেক অনেক আদর। ঘোড়া শ্বাস ফেলছে আর ফুর-ফুর উড়ছে দু’গাছা মেয়েলি চুল। মেয়েটা আজ উৎসাহ দেখায়। তার শরীর সাড়া দেয়। সেই শরীরের ভেতর অস্থির হয়ে ওঠে একটা মন। সে তখন ভাবছে, তাহলে কী...?
ষোলো তারিখ বুধবার রোজকার মতো সকাল ন’টার মধ্যে ভাত খেয়ে বেরিয়ে গেল পিনাকী। দুপুরে বাড়ি আসে না, সকালেই খাওয়া সেরে নেয়। প্রথমে একবার যাবে যাদবপুর। সেখান থেকে নির্মলের দোকান। একবার দাঁড়াতে হবে মুখোমুখি হুল উঁচিয়ে। ইলিয়াস বা মদনকে বললে অবশ্য দু-চারটে মোষ নিঃশ্বব্দে গায়েব হয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপার নয়। কেমন ভাবে আস্ত মোষ অদৃশ্য হয়, ম্যাজিশিয়ানরা বলে না। কিন্তু মোষ খ্যাদানো বড় কথা নয়। বড় কথা হল অপমানিত পরাজিত লিঙ্গের পু্নরুত্থান। হেরো পুরুষ বলে কিছু হয় না। হেরে যাবার পর আর পুরুষ থাকে না। তার কুন্ডলিনী অনন্ত শয্যায় শায়িত হয় মূলাধারের চৌবাচ্চায় জিলিপির মতো বেবাক পেঁচিয়ে। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখে, মণিপুর চক্রে দশ পাপড়ি নীল পদ্মের ওপর দাপাদাপি করছে এক কৃষ্ণকায় মোষ। কী বলিষ্ঠ তার গড়ন! মোষ নাচছে, পদ্মের পাপড়ি দুলে উঠছে। শ্বাস ফেলছে আর মেঘের মতো জেগে উঠছে দু’গাছা মেয়েলি চুল। ঘুমের মধ্যে সে কঁকিয়ে ওঠে, কিন্তু বাধা দিতে পারে না। মোষ তার দিকে মুখ ফেরায়। তেড়ে আসে। বাঁকানো শিঙ দুটো হঠাৎ সোজা হয়ে যায়। তাদের দেখায় ইস্পাতের ফলাযুক্ত বর্শার মতো, সুপ্তোত্থিত লিঙ্গের মতো। প্রতিস্পর্ধায় নিজের বর্শা উদ্যত করতে গিয়ে সেটা আর খুঁজে পায় না পিনাকী। তার উত্থানশক্তিরহিত বল্লমহীনতা দেখে হেসে ওঠে চৌষট্টি যোগিনী। শীতল শক্তিরূপিনীকে যে জাগাতে পেরেছে উত্তাপে, সে-ই পুরুষ। সে-ই মোষের মতো মোষ। স্বয়ং দেবীর চরণে তার স্থান। পরাজিত পুরুষ বলে কিছু হয় না এই গ্রহে। তার চেয়ে ক্লীব লিঙ্গ ভাল। মৃত্যুর আগে অন্তত একবার সে দংশন করতে পারে। না, একবার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে হুল উঁচিয়ে। নিজেকেই দাঁড়াতে হবে একা। অন্যের মাজার জোরে পুরুষ হওয়া যায় না। এমনকি স্বপন মুদিও তা পারেনি।
যাদবপুর বাজারে নীরেনের দোকান থেকে বেরিয়েই মনে হল রোদটা আজ খুব চড়া। চোখে লাগছে। তেষ্টাও পাচ্ছে। জ্বর আসবে মনে হচ্ছে। অথচ অন্যদিন ঘাম হয় বেশী। আজ বোধহয় শুকনো দিন। বাইক চালাতে অসুবিধে হচ্ছে খুব। রোদের মধ্যে চোখ খুলে রাখা দায়। মাথাটাও ঝিম-ঝিম করছে। এভাবে গাড়ি চালাতে নেই। ফিরে এসে নীরেনের দোকানেই বাইকটা রেখে বাস ধরল পিনাকী। শেষ অব্দি নির্মলের দোকানে যখন পৌঁছাল, তখন প্রায় বারোটা। কী যেন একটা কাজ ছিল নির্মলের সাথে। নিমো কই? নির্মল নেই দোকানে। তার ভাই বিমল বসে হেড-ফোনে গান শুনছিল। “দাদা নেই। কী দরকার?”
দরকারটা ঠিকমতো মনে করতে পারে না পিনাকী। মাথা নেড়ে কিছু দূর চলে যায়। আবার ফিরে আসে। “নিমো কই?” আবার জিজ্ঞেস করে সে।
“নেই বললাম তো। কী চাই?”
“অ, নেই? আচ্ছা।” ফের খানিক এগিয়ে যায় ঘোড়া। ফের পিছিয়ে আসে।
“কী চাই বলবা তো!” বিমল অসন্তুষ্ট।
“ঢিল ছুঁড়বি না।” এতক্ষণে বক্তব্য রাখে পিনাকী। তার চোখের সামনে অনেকগুলো বিমল। অথবা অনেকগুলো টুকরো টুকরো নির্মল হতে পারে, ঠিক ঠাহর করতে পারে না।
“কে ঢিল দিল?”
“নিমো, ঢিল ছুঁড়বি না কয়ে দিলাম। মৌচাক চিনস? শালা, এমন কামড় দিব না!”
“কী যাতা বকতেছ? যাও তো। কামের সময় মাতাল সব...”
ঘোড়া ছুটতে আরম্ভ করে। তার চোখ বুজে আসে রোদে। বালির ওপর মরুভূমির হাওয়া গরম হয়ে ঢেউ খেলছে। সামনের মানুষ দুলছে। জিভ জড়িয়ে আসছে। কোথায় যেন যেতে হবে? জ্বরের ওষুধ দিয়েছিল গতবার মার জন্যে। সেটা কোথায় ফেলে রেখেছে কে জানে? গোলপার্কের দিকে রেখেছে কি ওষুধটা? না লেক গার্ডেন? গোলপার্কেই হবে। হ্যাঁ হ্যাঁ! ওখানেই তো যেতে হবে প্রেশারের ওষুধটা কুড়োতে। এখনই তিন্নিকে প্রেশারের ওষুধটা দিতে হবে। এখনই না খেলে হবে না; জব্বর খিদে পেয়েছে। বমিও পাচ্ছে। রাস্তাটা কই গেল? ঐ তো রাস্তা। নদীর তলা দিয়ে কী সুন্দর যাচ্ছে। শালা, এই গরমেও কোলকাতার জল শুকোয়নি মাইরি! কর্পোরেশন ভাল কাজ করছে বলতে হবে। চুল্লু মদনা তো বলেই দিয়েছিল, একবার মোদীজি বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছে যখন, এবার দেখ না পঞ্চায়েত পুরো রাস্তা-ঘাট ইয়ে করে দেবে। কী যেন করে দেবে? যা পারে করুক গে, চুলোয় যাক। এখন গড়িয়াহাট গিয়ে কলের মিস্তিরিকে পেলে হয়। কলটা না লাগালে চলছে না। খুব তেষ্টা পেয়েছে।
ভাবতে ভাবতে প্রথমবার বজবজ লাইন পেরিয়ে ঘোড়া চলল পঞ্চাননতলা মোড় ছাড়িয়ে গোলপার্কমুখো। খানিক গিয়ে তার মনে হল কার সাথে যেন দেখা করার কথা ছিল এবেলা। কী একটা বোঝাপড়া ছিল! সে তো এই জায়গায় নয়। তাহলে এখানে সে কী করছে? উল্টো দিকে হাঁটতে হাঁটতে ফ্লাইওভারে উঠে পড়ে তার মনে হল টিকিট তো কাটা হয়নি! এখনই চেকার ধরবে। সার্কুলার রেলের একটা মান্থলি কেটে নিলে হয়, নাহলে রোজ রোজ এতবার... শালা খাটে উঠতে গেলেও মেয়ে পুলিশটা টিকিট চায়। নইলে শোবে না, জলও খেতে দেবে না। খুব তেষ্টা পাচ্ছে। ঐ গলিটার মধ্যে কুঁয়োটা না? ওটাই তো। ঘোড়া পঞ্চাননতলা রোডে ঢোকে। কিন্তু সেখানে কিছুতেই পুকুরটা খুঁজে পায় না। লেক ভিউ হাই স্কুলের পাশে ঝিলটা খুঁজে না পেয়ে, হতাশ হয়ে এদিক ওদিক দেখে। বড় তেষ্টা। একটা জামরুল গাছও যদি থাকত! হঠাৎ মনে পড়ে, গলিটা পেরোলেই তো গঙ্গা। আরে! কি বেকুবের মতো বালতিটা খুঁজছে, সামনে নদী থাকতে। গলির মাথায় গিয়ে দেখে বাজার। বাজারের সীমান্তে মালগাড়ি। নদীটা ওদিকে সরে গেছে তাহলে? কী যে করছে সরকার? একটা জলের বালতি ঠিক জায়গায় রাখতে পারে না। মাঝখান থেকে এতগুলো ডিবে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। দুই কামড়ার মাঝখানে যায় সে। তার মগজ দাপিয়ে কুলুকুলু বয়ে যাচ্ছে জল। ঐ তো পুরকুরটা ওদিকে। মহরম মাসের দশ তারিখ আসুরার দিন হোসেন মিঞা কতটা আকুল ভাবে কারবালা থেকে ইউফ্রেটিসের দিকে যেতে চাইছিলেন, সে কথা জানে না পিনাকী। আপাতত সে পুকুরটা দেখতে পেয়েছে। এই বেড়াটা টপকাতে হবে। ডিবেগুলো একটু সরিয়ে রাখে না কেন?
ঠিক এরকমই ঘটেছিল কিনা, তা পিনাকীকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। তার পেটের খবর তার মাথা এখন জানে না। মাথা যা ভাবছে, ডান হাত তা লিখতে পারবে না। সুতরাং মৃতের বয়ান নথিভুক্ত করলেও তাকে বাঁ হাতে সই করতে হবে, যা না মেলার সম্ভাবনা প্রবল। সেক্ষেত্রে মৃত্যুপরবর্তী জবানবন্দী আদালতে গ্রাহ্য হবে না। সুতরাং সেসব ঝামেলায় না গিয়ে ঘোটকচরিত সংক্ষেপে বুঝে নিলেই হয়।
ঘোড়া এবং মোষের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। মোষ নির্মল হয়, কিন্তু নির্মূল হয় না। বধ হবার পরেও সে চিরস্থায়ী হয় দেবীর পায়ে। তার উপস্থিতি, তার প্রতিষ্ঠা অমোঘ। দেবীর জীবন থেকে তাকে কেউ সরাতে পারে না। অপরপক্ষে তুরগজন্ম ক্ষণিকের। জীবনের সব পথ সে পার হয় অতি দ্রুত। অন্তিমে পৌঁছায় তাড়াতাড়ি। অশ্বমেধের ঘোড়াটি সারা দুনিয়ায় সাড়া জাগিয়ে ফিরে এলেও ফেরার মতো করে ঘরে ফিরতে পারে না। সে বলিপ্রদত্ত। বধ হবার জন্যেই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল। বলি দেবার জন্যেই তার এত অভ্যর্থনা। তার মাংস পবিত্র, তাই অবশ্যভক্ষ্য। তার মেদ গলিয়ে হবে গেরস্তের প্রদীপের তেল। তার অস্থি থেকে বজ্র তৈরী হবে না, কারণ সে দধিচী নয়, প্রকৃত পুরুষও নয়। তার হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো মিশিয়ে দেওয়া হবে পাটের ক্ষেতে। তারপর হু-হু করে বেড়ে উঠবে ঘন অন্ধকার পাটবন। কিন্তু তাকে কেউ নেবে না। চটকলে তালা পড়ে গেছে। ঘোড়ার হাড়ে সার দিয়েছিলি কেন হতভাগা? নে মর এবার। জানিস না, দেবীর ঘোটকে আগমন, ফল ছত্রভঙ্গ? পাটচাষী ষষ্ঠীর সন্ধেবেলা গলায় দড়ি দেবে মৃত ঘোড়ার উদ্দেশে বিদায় অভিশাপ উচ্চারণ করে। পাইকার উঠিয়ে নিয়ে যাবে ছেড়ে যাওয়া খোলস। এভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে একটি প্রাক্তন ঘোড়া অথবা ঘোড়ামুখো নির্বিষ মৌমাছি। দেবীপক্ষে কোনো মৌচাকে, প্রাসাদে, উদ্যানে রাণীর ত্রিসীমানায় তার কোনো হদিস থাকবে না।
তাতে অবশ্য কারো কিছু যায় আসে না। পিনাকীর পেট কাটা পড়ার কিছুক্ষণ পর, সেইদিনই, অর্থাৎ আমেরিকায় ষোলো তারিখ হতেই, এক বিমর্ষ মার্কিন যুবক অন্য এক রাণীকে চিঠি লিখেছিলেন, “হে ইংল্যান্ডেশ্বরী, আমাদের ফিরিয়ে নিন আঁচলের তলায়।” অধীনতার কোমল ছায়া ফিরে পাবার এই আকুলতা কি শুধুই রাণীর পায়ে স্থান পাবার অনাদি মহিষ-স্বপ্ন? নাকি পিনাকীর মৃত্যু কোনো সূত্রে বাড়িয়ে দিয়েছিল এক অচেনা মার্কিনের হতাশা, যেভাবে ব্রাজিলের জঙ্গলে প্রজাপতি ডানা ঝাপটালে ঝড় উঠতে পারে ইথিওপিয়ায়? যেভাবে নক্ষত্রেরা নিয়ন্ত্রণ করে পরস্পরের চলন? কিন্তু সেদিন পিনাকী ছাড়াও আরো অনেকে মারা গিয়েছিল দুনিয়া জুড়ে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ, ধরে নেওয়াই যায়, অপঘাতে। নাইজেরিয়া, ইরাক, কঙ্গো, সিরিয়া, কাশ্মীর, নাগাল্যান্ডে ঐদিন কোনো মানুষ খুন হয়নি, এমন হতেই পারে না। কে না জানে মানুষ অথবা বাঘের হাতে খুন হওয়া লাশের মর্যাদা মালগাড়ির শিকারের চেয়ে বেশী। অতএব পিনাকীর এই ফালতু গল্প, ব্যক্তিগত হেরে যাওয়া এবং মরে যাওয়া, ইত্যাদির মধ্যে কোনো সার পদার্থ নেই। মহাজাগতিক প্রেক্ষিতে দেখলে শোকসভা না হওয়াটাই এরকম খুচরো মৃত্যুর একমাত্র যুক্তিযুক্ত পরিণতি বলে বুঝতে অসুবিধে হয় না। বরং তিন্নি ও মান্তুর, যথাক্রমে প্রকাশ্য ও গোপন, কান্নাকেই খানিক বাড়াবাড়ি মনে হয়।
এইসব শুধুমাত্র নিজেরটুকু নিয়ে বেঁচে থাকা এবং মরে যাওয়া গল্পগুলো, সেইসব কাহিনীর ভেতরের কাহিনী বা তার সত্যাসত্যের চেয়ে, ইতিহাসের চোখে, অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল টাইমিং আর প্লেসমেন্ট। ক্রিকেট খেলার মতো। কাল এবং স্থান। যেমন, ছাব্বিশ বছরের চেয়ে কম বয়সে মরতে ব্যর্থ হওয়া এবং শহীদ তারকেশ্বর সেনের স্মৃতি উদ্যানের নৈকট্যের দরুণ পিনাকীর মৃত্যু অকালপ্রয়াণ হিসেবে গণ্য হবার যোগ্য বিবেচিত হল না। দেশ-কালের আপেক্ষিকতায় পিনাকী তখন পরিণত বয়স্ক, যার মৃত্যু হতেই পারে। তা বলে, তার সময়জ্ঞান নেহাৎ খারাপ বলা যায় না। অজস্র বুড়ো, মাজা-ভাঙা, ময়লা মালগাড়ির বদলে একটি সুদর্শন তরুণ ট্রেনের সাথে তাল মিলিয়ে ঠিক একই সময়ে একই জায়গায় পৌঁছে যেতে পারা... ঠিক সেইখানে গিয়ে ঈষৎ থমকানো, যেখানে লাইনের ধারে পেঁয়াজের স্তুপ সাজিয়ে লাইনকেই পিঁড়ি বানিয়ে রোজ বসেন সন্ধ্যা মালাকার, আর “মালট্রেন... মালট্রেন...” চিৎকার শুনলে উঠে যান... এই অসামান্য টাইমিং আর প্লেসমেন্ট সামান্য দেশ-কাল জ্ঞানের খেলা নয়। পা এবং চাকার ঠিক একই সময়ে থামা এবং একই সাথে চলতে শুরু করা, এও কি স্রেফ এলোমেলো পাশার দান ফেলা?
তাও যদি সন্দেহ থাকে, তাহলে পাঁজি মিলিয়ে দেখে নিন, বধ হবার দিনটি মন্দ বাছেনি ঘোটকাসুর। ২৯ ভাদ্র ১৪২২ বঙ্গাব্দ, ইং ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫, বুধবার, শুক্লা তৃতীয়া। জন্মে কন্যারাশি বৈশ্যবর্ণ রাক্ষসগণ। মৃতে দোষ নাই।