দুজনেই দরজাটা খুঁজেছিল। খোঁজাই স্বাভাবিক। সম্ভবত দুজনের কেউ দরজাটা খুঁজে পায়নি। অথচ এমনটা হবার কথা নয়। ঐটুকু ঘরে প্রবেশ ও প্রস্থানের একটিমাত্র সবুজ কপাটওয়ালা দরজা খুঁজে না পাওয়া শিশু, বৃদ্ধ বা অন্ধের পক্ষেও নিতান্ত কঠিন। সেই কঠিন কাজটা দুটি মানুষ একই সময়ে একই সাথে, সম্ভবত যৌথ উদ্যোগে করে দেখাল কেমন করে, সেটাই রহস্য। সেই রহস্য উন্মোচনের জন্যেই পুলিশ। বাকি কাহিনী স্বয়ম্প্রকাশ।
সকাল সকাল দুজন উঠোনে শুয়ে। এক বৃদ্ধ, এক কিশোরী। পুবদিক থেকে এক টুকরো এবড়ো-খেবড়ো বাঁজা জমি বিপুল উৎসাহে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু এক গাঁ মানুষের কাঁধ ছাড়িয়ে মাথা তুলতে পারেনি। অবশ্য নতুন করে দেখার কী বা আছে তার? দেখা ছাড়া তার জীবনে আছেই বা কী? বর্ষা যায়, শরৎ যায়, তার শরীরে কেউ লাঙল দেয় না। আগাছা বুকে নিয়ে সারা দিনমান সে হাউ হাউ চেয়ে থাকে দূরের ধানক্ষেত সর্ষে ক্ষেতের দিকে। ক্রমশ গরু-বাছুর ফিরে গেলে তার বুক মাড়িয়ে সন্ধ্যা হেঁটে যায়। কাঁটা উঁচিয়ে রাত্রির বাড়ি ফেরা দেখে একমাত্র বামন খেজুর গাছটা। তারপর সেও ঘুমিয়ে পড়ে। মাঠ জেগে থাকে। সারারাত দেখে আর শোনে। পাশের বাড়িতে সবুজ কপাটওয়ালা দরজা বন্ধ করে রাত ফিসফিস করে।
সকাল অবশ্য এসেছিল বিশালত্বের সম্ভাবনা নিয়েই। চোখ-মন-ডানা উড়ে যেতেই পারত কোটর ছেড়ে বিশ্বের আকাশে। দৈনিক কাগজ লিখেছে উরি নামে কোনো এক ঘুমন্ত কাশ্মীরে গুটি চারেক লোক নাকি সতের জন সেনা জওয়ানকে কোতল করেছে। এত বড় ঘটনাটা, যা নিঃসন্দেহে এই গ্রামের যাবতীয় ঘটমানতা এবং সম্ভাবনার থেকে অনেক বড়, পরবর্তী দীর্ঘ সময়কালের প্রধান আলোচ্য হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সন্ধের মতো ঊষালগ্নও তো প্রহেলিকামাত্র, কারণ ক্রন্দসীর কাছাকাছি আকাশের রক্তের শরীরে তখন সত্যি কোনো সূর্য নেই। সন্ধ্যার পিছু পিছু আসে যে রাত, অথবা ভোরের পরে যে সকাল, তারাও প্রহেলিকার সন্তান। অতএব তাদের সূর্যহীনতা বা রৌদ্রমানতার ঘোষণা বিশাল অক্ষরে বিস্ফোরণোচিত ছাপা হলেও স্বপ্ন বা দৈনন্দিনের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। মনুষ্যজীবনের অবলম্বন সকাল নয়, সংবাদ নয়, বিশ্ব-নাগরিকত্ব নয়, টুকরো টুকরো মুহূর্তের ট্রিভিয়া... কিছুটা ব্যক্তিগত, কিছুটা নিকট-অপর সম্পর্কিত। তাই সন্ত্রাসী হানা, সম্ভাব্য ভারত-পাক যুদ্ধ (যা কিনা ঠিকমতো খেললে ক্রিকেটের চেয়েও বেশী আকর্ষণীয় হতে পারে), সব ফেলে একটা গ্রাম জড়ো হয় একরত্তি উঠোনে, যেখানে এক বৃদ্ধ শুয়ে আছে এক কিশোরীর পাশে। প্রতিটি গ্রামের নিজস্ব বৃদ্ধ থাকে, নিজস্ব কিশোরী থাকে, তাদের রাত্রি পেরিয়ে ঘুম না ভাঙা থাকে, আর থাকে রাতের গল্প। দেশ কাঁপানো খবরের সকালে সেই সব গল্প ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে একেকটা গ্রাম। তাই রাষ্ট্রের ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো সুপ্রভাতে কোনো সমসত্ত্ব নেশনের জন্ম হয় না... যুদ্ধের আগেও না, যুদ্ধের পরেও না।
টুনি, ওরফে দুর্গা, বয়স চোদ্দ। তার মুখে রক্ত, গলায় গুটি তিনেক আঙুলের ছাপ। মৃত্যুর কারণ সম্ভবত শ্বাসরোধ, কিন্তু সেটা শুধুমাত্র গলা টেপার ফলেই হয়েছে কিনা বলা সহজ নয়। দুর্গা নামটা কেমন মসৃণভাবে দুর্গাটুনটুনি পাখীর ঠোঁটে কুটোর মতো উড়তে উড়তে টুনি হয়ে যায়... সেই স্নেহ, গালটেপা শৈশব, অবজ্ঞা, ক্ষুদ্রতা আর ক্ষুদ্রায়নের কাহিনী পুলিশ সাধারণত সুরতহাল রিপোর্টে লেখে না। তারা গলাটেপা কৈশোরটুকু জানে।
হরিহর দাস, ওরফে টুনির দাদু, বয়স প্রায় সত্তর। তার কপালের বাঁ দিকে আঘাতের চিহ্ন। মুখে এবং গলায় আঁচড়ের দাগ। চোখ ঘোলাটে। মৃত্যুর কারণ সম্ভবত রক্তক্ষরণ। কিন্তু পুলিশের নোটবুকে আর জনতার গুঞ্জনে মূল খবর হল, মৃত্যকালে তিন মেয়ে, এক ছেলের বাপ হরিহরের কোনো লিঙ্গ ছিল না। বৃদ্ধের সেই ছেলেমেয়েরা আপাতত সামনে নেই। শুধুমাত্র থুতনির কাছে অল্প অল্প গজিয়ে ওঠা দাড়ির ভরসায় তাকে পুরুষ হিসেবে নথিভুক্ত করেছে পুলিশ।
বহু ব্যবহারে জীর্ণ সত্তর বছরের পুরানো লিঙ্গটি সাবধানে চিমটে দিয়ে তুলে পলিথিনের প্যাকেটে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বিকল্প দাবিদারের অভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে সেটি হরিহরের। মহাদেশ থেকে ছিটকে পড়া একান্ত নির্জন এক বৃক্ষ-গুল্মহীন পাথুরে দ্বীপের মতো পলিথিনের স্বচ্ছতা ভেদ করে শূন্যে তাকিয়ে আছে সেই প্রত্যঙ্গ। তার এই স্পষ্ট উপস্থিতি এমন সংকটে ফেলে দিল রক্তমাখা লুঙ্গি পরিহিত হরিহর দাসকে, যা তার সাত দশকের পৌরুষের কেরিয়ারে কখনো আসেনি। জীবন এবং পুরুষাঙ্গের মধ্যে সম্ভবত পুরুষাঙ্গটি সে আগে হারিয়েছিল, ফলত মৃত্যুর মুহূর্ত অব্দি নিজের পৌরুষের সম্পূর্ণতা সে বজায় রাখতে পারেনি। এই সত্য তার বন্ধু তথা যৌবনের প্রতিদ্বন্দী রাখাল মণ্ডলের চেয়ে তাকে ম্যারাথনের একদম শেষ ল্যাপে কয়েক পা পিছিয়ে দিল। তাছাড়া এই বিচ্ছিন্ন অঙ্গটি তার জীবনের শেষতম কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে এমন একটি নিরুচ্চার ছোটগল্প বলে গেল, যা তার জীবনকাহিনীতে উপন্যাসপ্রতীম হয়ে উঠবে যুক্তিবিজ্ঞানের সরল নিয়মে।
এই উঠোন, এই একলা বাড়ি আর তার পাশের পরিত্যক্ত জাহাজের মতো একটুকরো বেখাপ্পা অর্থহীন গা ছমছম মাঠের ওপর রোজকার মতো সন্ধে নামছিল কাল ছ’টার কাছাকাছি। এই বাড়িটা বাঁশঝাড়ের এপাশে হওয়ায় বংশীদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা তফাতে। অন্য পাশে সেই মাঠ, যে মাঠে কেন কে জানে কিছুই ফলে না এবং কেউ বাসাও বাঁধে না ইঁদুর আর সাপ ছাড়া। উঠোন পেরিয়ে মেটে রাস্তা, আর তার ওপাশে সরকারদের বাগান। রাস্তায় ইটের টুকরো ফেলা হচ্ছে। পাল বাড়ির মুখটা অব্দি বাঁধানো হয়ে গেছে, এদিকটাও হবে। বাড়িটার সামনের উঠোনে উত্তর-পুব কোণ ঘেঁষে একটা জাম গাছ। পিছনে একটা কাঁঠাল, একটা নিম। একটা ছোট পেয়ারা গাছও আছে। আর সবজিদের যৌথ পরিবার। সকলে এত জটলা করে আছে যে কারো ফলন ভাল হয় না। বাড়িটার মধ্যে দুখানা ঘর, একটা রান্না ঘর। সাবেকি স্নানঘর-কলতলা বাইরে। পায়খানাটা স্নানঘরের পিছনে ছ-সাতটা মানকচু গাছ দিয়ে ঘেরা। খাকি উর্দি পরা রাঢ়ী বামুন সমরেন্দ্র ঘোষাল নোট নিচ্ছিল।
বাড়ির ভেতর একটা বেড়াল থাকত, থাকে। এক বুড়ো, নাম হরিহর দাস। আর থাকত এক দুর্গাটুনটুনি। হরিহর দাসের ছেলে আর ছেলে-বউ থাকত এককালে। তারা একাদিক্রমে কেটে পড়েছে। গ্রাম ছেড়ে, ধানক্ষেত ছেড়ে বর্ষা চলে যাবার পর যেমন পড়ে থাকে ভেজা বাতাস, তেমনি থেকে গেছে বেড়াল, দুর্গা আর তার ঠাকুরদা, যাকে মেয়েটা আশৈশব দাদু বলেই ডেকেছে। সোঁদা গন্ধটিও রয়ে গেছে কর্দমের জীবনবৃত্তান্ত হয়ে। বাড়িটার ভেতরে-বাইরে শ্যাওলা। মাচায় চালকুমড়ো পাতার ফাঁকে সবুজ ও চিকন লাউডগা সাপ। একমাত্র তার আর বেড়ালটার গায়ে শ্যাওলা জমে না। বাকি সব আবাসিক মানুষ, টিকটিকি, পলেস্তারা খসা দেয়াল, কলতলা আর রান্নাঘরের গায়ে বটল-গ্রিন মস আর ছত্রাকের প্রাক-উদ্ভিদ ভেলভেট ক্রমশ ঘন গাঢ় প্যালিওলিথিক হতে থাকে। বাঁশঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ক্রমশ একলা হতে থাকে দাসবাড়ি।
ঘরের দরজাটা হরিহর দাস নিজে হাতেই লাগিয়েছিল। টুনটুনির ঘরে যখন সে প্রবেশ করে, ঐ নির্বিকল্প সবুজ দরজা দিয়ে, রাত তখন প্রায় একটা। পাশের ঘরে ঘন্টা দুই পাশ ফেরাফেরি ব্যয়াম ঘুমের বদলে ক্রমশ অস্থিরতা এনেছে শরীরে। মশা, দার্শনিক ভাবনা, স্মৃতিজর্জরতা এবং নারী দ্বারা আক্রান্ত হরিহর দাস শেষ পর্যন্ত উঠে বসে পৌনে একটা নাগাদ। মূলত শেষতম বাহিনী ... যার নেতৃত্বে রাধারাণী, লক্ষ্মী ও শেফালি ... হরিহর কে শরীরে মনে বিষতীরবিদ্ধ করতে লাগল।
রাধারাণী হরিহরের স্ত্রী, যে যৌবন পেরোনোর আগেই এলাহী পুজো-আচ্চা, দিনে তিনবার স্নান,ঘন ঘন হাত ধোয়া, বাসনের কোণায় লেগে থাকা ডালের দাগ আবিষ্কার,ঘর মোছামুছি এবং শেষ পর্যন্ত এক গুরুবাবা ধরে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে এবং দুই কুড়ি পেরোনো মাত্র দুরারোগ্য “কাশ রোগে” আক্রান্ত হয়। এক পৌষের রাতে পুঞ্জিভূত কফ ঠেলে তার শ্বাস আর বেরোনোর রাস্তা খুঁজে পায় না। বদলে চোখদুটো প্রায় বেরিয়ে আসে। তাকে পুড়িয়ে বাড়ি ফিরতে ভোর হয়ে গেছিল। সে রাত্রে আর অন্য কোথাও যায়নি হরিহর। সেই রাত থেকে এই বাড়িটার প্রতিটা দেয়ালের শ্লেষ্মার ধাত।
লক্ষ্মী টুনির মা। তারকের বৌ, ছিল। লক্ষ্মীর অনেক ছিল, সে সার্থকনামা। সে স্বামীকে দিত, শ্বশুরকেও। বাপের সমান একটা মানুষকে অভুক্ত রাখার নিষ্ঠুরতা সে শেখেনি। কিন্তু তারকটা দুর্দান্ত মাতাল। একদিন সন্ধে সন্ধে বাড়ি ফিরে অপ্রস্তুত আপনজনদের দেখতে পেয়ে আহত পৌরুষ, চুল্লুর সময় পেরিয়ে যাচ্ছে বলে খিঁচড়ে থাকা মেজাজ আর দরজার পাশে পড়ে থাকা পুরোনো বাঁশের লাঠির ত্র্যহস্পর্শে উন্মাদ হয়ে রণহুঙ্কার দিয়ে উদবাহু প্রলয় নাচন শুরু করল। এমন মারল যে বাপ এক সপ্তাহ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না... রক্তের মধ্যেই মল-মূত্র-কফ, আর বৌ দুদিনের মাথায় জ্বর গায়ে, ফাটা মাথায় পাতলা অপরিষ্কার ন্যাকড়া জড়িয়ে সোহরকে ছেড়ে দোসরের বাড়ি চলে গেল। টুনি তখন বছর বারো। জানালার সেই ফুটোটায় চোখ রেখে বাপের তান্ডব দেখেছিল টুনি, যেটা দিয়ে দাদু আর মাকে দেখত, বিপুল কাকাকে দেখত।
টুনি বড় হয়ে যাচ্ছিল। টুনি জানত মা দাদুকে চায় না, কিন্তু দাদু বিপুল কাকার কথা জানে। টুনি জানত মার শরীর মাকে ছেড়ে চলে গেছে... কিছুটা বাবার কাছে, কিছুটা দাদুর কাছে, কিছুটা বিপুল কাকার কাছে। ফুটোয় চোখ রেখে তার মনে হয়েছিল মা এইবারে ঠিক মরে যাবে। এরকম তার মাঝে মাঝে মনে হত মাঝরাতে মায়ের কঁকিয়ে ওঠা শুনে... বিকেল থেকে তিন নম্বর পুরুষটিকে নিতে গিয়ে মায়ের সেই অপর হয়ে যাওয়া শরীর পঁচাত্তর কিলো রোমশ ঘাম আর চোলাইয়ের গন্ধের নীচে চাপা পড়ে হাড় জিরজিরে বৃদ্ধ খাটিয়ার মতো ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ করত... সেই শরীরের আওয়াজে মরে যাওয়া ছিল। সকালবেলা মায়ের চোখে মৃত্যু দেখতে পেত। কিন্তু মা মরত না। বাঁশের বাড়ি খেয়ে সারা শরীর ফুলে ওঠার পরেও মরল না, হয়ত শরীরটা অনেক আগেই তাকে ছেড়ে গিয়েছিল বলে।
দুদিনের মাথায় মা চলে যাওয়ায় টুনি খুশি হয়েছিল। জাম গাছের নীচে কাঁদতে কাঁদতে গা থেকে কাঠ পিঁপড়ে ঝেড়ে ফেলার মুহূর্তে নিজের হঠাৎ একাকিত্বের মধ্যেও সেই খুশিটাকে খুঁজে পাচ্ছিল সে। মা মরে যেতে পারেনি, কিন্তু শেষ অব্দি পালিয়ে যেতে পেরেছে। জানালার ফুটোটার ওপাশে অথবা একই ঘরের মধ্যে রাতের অন্ধকারে মায়ের তাড়াতাড়ি পুরোনো হয়ে যাওয়া শরীরের তেল না পাওয়া কলকব্জা আর ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দে জ্যৈষ্ঠ দুপুরের একাকী টিউবওয়েল হয়ে উঠবে না।
মাস খানেক পর হরিহরের শরীর যখন আবার খানিক জেগে উঠল, সে আবার শেফালির বাড়ি যাতায়াত শুরু করল। শেফালি তার পুরোনো মেয়েমানুষ। আসলে শেফালি তার নয় বা অন্য কারো নয়। শেফালি মেয়েমানুষ। নিজের নয় বলেই তার কাছে আবার ফিরে যাওয়া যায় যে কোনোদিন। শেফালির শরীরেও প্রৌঢ়ত্ব আসছে। বয়স আসছে বলেই সে হরিহরের পৌরুষের বয়ঃক্রমকে মেনে নেয়, লতিকার মতো হাসাহাসি করে না। বরং দুই নিবু নিবু মানুষের মধ্যে লেনদেনের হিসেব ছাড়িয়ে পরস্পরকে খুশি করার ইচ্ছে জমে উঠছিল। কিন্তু ক্রমশ হরিহর বুঝতে পারছিল, প্রশ্রয়শীল অভিজ্ঞা প্রৌঢ়ার পক্ষেও সে ক্রমশ বিরক্তিকর হয়ে উঠছে। তারক তার মাজা ভেঙে দিয়েছে। ধীরে ধীরে শেফালির থেকেও দূরে থাকতে থাকতে হরিহর দার্শনিক হতে আরম্ভ করে। হরি দিন তো গেল, পরপারের পারানির কড়ি, অবিনশ্বর আত্মা ইত্যাদি তার ভাবনায় পেলব বুকের নরম গন্ধের চেয়ে বেশী করে উপস্থিতি জানাতে শুরু করে। যৌবন শরীর ছেড়ে যাবার পরবর্তী কয়েক মাসে বার্ধক্য মনের দখল নিতে থাকে। হরিহর হেরে যায় একটু একটু করে।
কদিন আগে তারক বাড়ি ছেড়ে তার জৌগ্রাম নিবাসী নতুন বৌ রহিস বিধবা সুষমার কাছে চলে যাবার পর হরিহর হঠাৎ খানিকটা নির্ভয় যৌবন ফিরে পায়। পারত্রিক পারমার্থিক ভাবনা ঠেলে তার ভাঙা কোমর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ঠিক সেই সময় অভূতপূর্ব ক্রাইসিস তার মাথায় আছড়ে পরে। জ্বর, বমি আর দাস্ত নিয়ে মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল শেফালি। কাল মারা গেছে। ডাক্তার নাকি বলেছে খারাপ রোগ ছিল।
এরকম অসহায় মুহূর্তে যা হয়, অস্থির মস্তিষ্ক উপচে যাবতীয় উপলব্ধি, জীবনদর্শন, সংশয় ও সংকট শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ক্রমশ তলপেটে এসে থিতোয়। শেফালি চলে যাওয়ায় তার ভাঙা মাজা জোড়া দেবার আর কেউ রইল না ভাবতে ভাবতে মূত্রনালি আর তার আশেপাশে শিরশির করে ওঠে। এইসব অস্থিরতা, যা ঘুমোতে দেয় না, শরীরে বা মনে দীর্ঘ সময় ধারণ করতে নেই। তাতে মন বিক্ষিপ্ত হয়, শাস্ত্রে বলেছে। ঠাকুরদার তাই মনে হল, নাতনির সাহায্য চাওয়া উচিত।
টুনি ঘুমিয়ে পড়েছিল। ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে বলে, “কী চাই তোমার, এত রাতে?”
-ঘুম আসে না।
-ঘুম আসে না, তার আমি কী করব?
-তোর সাথে একটু শুই?
-না। নিজের ঘরে যাও।
-ক্যান? সকলের লাইগা দরদ, শুধু নিজের জনের জন্য নাই?
বলতে বলতে লুঙ্গি গোটাতে থাকে হরিহর।
-কও কী এসব? দাদু? তুমি এই কও?
-ক্যান? বাপেরে দিস নাই? নতুন নাগর জুটছে নাকি?
-খবরদার এদিকে আইবা না।
খানিক ফুঁসে উঠে অনেকটা পিছিয়ে যায় টুনি। কিন্তু দুর্বল মানুষের ছোট মাপের ঘরে পিছোনোর জায়গা বড় অল্প। পিছনে পথ রোধ করে থাকে দেওয়াল, আর তার অমোঘ বুকে পিঠ ঠেকে যায় পলায়নের শুরুতেই।
-খবরদার? আমারে খবরদার করস? খানকির বেটি খানকি? তুর কথা, তুর বাপের কথা, তুর মায়ের কথা সক্কলেরে কয়া দিমু। ক্যামনে বাইড়াস রাস্তায় দেখি? মরণের তাল পাবি না।
টুনির ফণা নেমে আসে। টুনি টুনির মা হয়ে যায়। দাদু যেন তাকে বিপুল কাকার সাথে দেখে ফেলেছে। আর তার উপায় নেই। এইবার তার শরীর দাদুর কাছে বাঁধা পড়ে গেল। এইবার তার সবকিছু যেন অন্যের কাছে বাঁধা পড়ে গেল। বুকের কাছে হাত জড়ো করে দেওয়ালের গায়ে মৃত টুনির ফ্রেম-বাঁধানো ফোটোর মতো শ্বাসরুদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকে হেরে যাওয়া চোদ্দ বছর। দাদু তাকে এবার সস্নেহে ডাকে, “আয়। কাছে আয়।“ আদর করে শোয়ায় তাকে। মমতামাখা হাতে ফ্রকের কয়েদখানা থেকে মুক্ত করে তার কোমর, পেট ও বুক। তারপর বাঁশের বাড়ি খাওয়া সত্তর বছরের কোমর বাগিয়ে আরেকবার পুরুষ হবার চেষ্টা করে। শেফালি নেই, যৌবন গেছে, কিন্তু শিবরাত্রি চিরন্তন।
এক তরফা শারীরবৃত্তীয় সোহাগের চেষ্টা, যা প্রায় শবসাধনার সমকক্ষ, তাতে বহু পুরুষের মতোই প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জন করেছে হরিহর। সর্বাঙ্গ দিয়ে টুনিকে সে অধিকার করার চেষ্টা করে এবং প্রায় সফল হয়। এইসব মুহূর্তে কীভাবে শরীরের প্রতিটি পেশীতে অপ্রতিরোধ এবং স্পন্দনহীনতা গড়ে তুলতে হয়, তার প্রশিক্ষণ আছে টুনির। মৃতকল্প শুয়ে থাকে সে। অভিজ্ঞতায় দেখেছে, তাতে ব্যথা সবচেয়ে কম লাগে।
একাকী তালগাছের মুখে চুম্বন ছুঁড়ে দেয় বজ্র যেমন, আলিঙ্গনে যেমন আদর ঢেলে দেয় ময়াল, তেমনি আশ্লেষে প্রাণপণ প্রেম-প্রচেষ্টায় টুনিকে না হলেও নিজেকে জাগিয়ে তুলতে সমর্থ হয় হরিহর। বাঁশের বাড়ি খেয়ে মাজা ভাঙা বৃদ্ধ অজগর অজাগর নয় জেনে হরিহর অনন্য পুলকে শরতের বাতাসে সজনে পাতার মতো ঝিরিঝিরি কেঁপে ওঠে। রোম-কূপ জাগানো শিহরনের মুহূর্তে শরীর আর শরীর থাকে না, প্রাণপ্রবাহের প্রতীক হয়ে ওঠে। হরিহর ক্রমশ মূর্তি থেকে লিঙ্গ হয়ে উঠল। লিঙ্গ মানে চিহ্ন, নিরাকার পরম সত্য আর সাকার জগত প্রপঞ্চের মাঝামাঝি অবস্থা... সীমার মাঝে অসীম। লিঙ্গই শিব। লিঙ্গই পরম পুরুষ। হরিহর নিজ মস্তিষ্ক থেকে অবতরণ করে, তারপর বুক থেকে, হাত-পা থেকে নিজের সমগ্র সত্তাকে সংকুচিত করতে করতে ক্রমশ স্বীয় লিঙ্গে একাগ্র হয়। শাস্ত্রমতে একাগ্র মন যখন নিরুদ্ধ অবস্থায় পৌঁছায়, তখন আর জ্ঞাতা ও জ্ঞাতব্যের, দ্রষ্টা ও দৃশ্যের, পথিক ও গন্তব্যের পার্থক্য থাকে না। সাধক তখন স্বয়ং আরাধ্য হয়ে ওঠেন। এইভাবে হরিহর ক্রমশ মানুষ থেকে লিঙ্গে পরিণত হয়। চিত হয়ে পড়ে থাকা দুর্গা তার বুক ও পেটের ঠিক ওপরেই অপর একটি শরীরের মধ্যে ঘটে যাওয়া অসুর থেকে শিবত্বে উত্তরণের এই অসম্ভব মেটামর্ফসিসের কিছুই জানতে পারে না।
আসলে দুর্গা তখন নিজের শরীরের মধ্যে উপস্থিত ছিল না। এই নির্গমন ও অনুপস্থিতি সে তিলে তিলে শিখেছিল। দাদু টুনির শরীর জুড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সাথে সাথেই দুর্গা তার মায়ের কাছে বেড়াতে গেছিল। মায়ের পাশে বসে সে দেখতে পাচ্ছিল টুনির দাদু এত বছর চেষ্টা করেও কী যেন পায়নি, যেটা সে এখন টুনির শরীরে খুঁজছে। অথচ কী খুঁজছে, তা নিজেও জানে না বলে টুনিকে সম্পূর্ণ ভক্ষণ করলেও তার বৃদ্ধ শরীর-মন বুভুক্ষু থেকে যাবে। এই পর্যন্ত দেখে, ব্যাপারটা নেহাৎ একঘেয়ে এবং দুই প্রজন্মের পুরুষের মধ্যে শারীরিক শক্তির তারতম্য ছাড়া আর বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকে না, এই দুটি সত্য অনুধাবন করে, দুর্গা ঘটনাস্থল থেকে চোখ ফিরিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকায়। তার মা,যে এরকম অগুন্তি রাত, সন্ধ্যা ও দুপুরে কিছুতেই মরে না যাবার নিদারুণ শিল্পটি শ্বাসগ্রহণের মতো সহজ নৈপুণ্যে রপ্ত করেছিল, একটি তৃতীয় সত্য জানত... শারীরিক সহ্যশক্তির তারতম্য ছাড়া দুই প্রজন্মের নারীর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকে না। লক্ষ্মী মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। স্রেফ বেঁচে থাকার প্রয়োজনে যথাসময়ে মরে যাবার কৌশল তার ছোট্ট টুনি মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে এমন শিখে ফেলেছে দেখে গর্বে তার বুক ও চোখ উথলে ওঠে। শেষ বর্ষার মতো আর্দ্র মায়ের স্নেহের ভেতর মুখ লুকিয়ে থাকার ফলে দুর্গা দেখতে পায় না হরিহরের স্বাধিকার অর্জন। মানুষ থেকে লিঙ্গে রূপান্তরিত হবার মাধ্যমে টুনির দাদু দুর্গার ন্যায্য শিবে পরিণত হন, যা শাস্ত্রসম্মত। টুনি বা দুর্গা তা দেখতে বা বুঝতে না পারলে লিঙ্গের কিছু যায় আসে না। অতএব সেই লিঙ্গ, যা কিছুক্ষণ আগে হরিহর ছিল, উপযুক্ত মুহূর্তে গৌরীদেহে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়।
এই অব্দি ঠিক চলছিল, যেমন হওয়া উচিত... যেমন হলে সংসারে শান্তি বজায় থাকে এবং গ্রামসমাজ সুস্থিত থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ কসরৎ করে হরিহর বুঝতে পারে, তার দ্বারা হবে না। এ কাজ যথার্থ পারত তারক, যে তারক তার মাজা ভেঙে দিয়েছে তার সায়াহ্নকালীন লক্ষ্মী বিতাড়নের সাথে সাথে।
তারক সাজোয়ান মরদ, সন্ধে পেরোলে ধান্যেশ্বরীর প্রসাদে দুর্দম। লক্ষ্মী চলে যাবার পর তার মেজাজ আরো তিরিক্ষে হল। হপ্তা না ঘুরতে এক রাতে... বাপের মতো বেটারও সেই ঘুম না আসার গল্পেই পরবর্তী গল্পের শুরু... টুনির বাপ অন্ধকারের মধ্যেই মেয়েকে খুঁজে বার করল, এমনকি হ্যারিকেন বা টর্চলাইট ছাড়া। তারপর চুলের মুঠি ধরে তাকে তার মায়ের আসনে বিধিমতে অধিষ্টিত করল। পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাবে প্রথমদিন টুনি প্রতিরোধ করেছিল, যা তখনকার মতো এক থাবড়ায় প্রশমিত হয়েছিল। জানালার ফুটোয় চোখ রেখে টুনি যা শিখেছিল, সেই সব পঠন-পাঠনের স্মৃতি একটিমাত্র ভালুক-থাবার আঘাতে জাগরুক হওয়ায় দ্বিতীয় আঘাতের প্রয়োজন হয়নি সে রাতে। কেবল ভালবাসা হয়েছিল।
বাপ ঘুমিয়ে পড়ার পর অন্ধকার স্নাত বারো বছর কলতলায় গিয়ে লাউডগা সাপের পাহারায় টিপকলের হাতলে চাপ দিতে দিতে, শরীর থেকে ব্যথা ধুতে ধুতে, রক্ত ধুতে ধুতে রাতারাতি বড় হয়ে গেল। পরবর্তী দু’বছরে সে ধীরে ধীরে মরে যেতে শিখল এবং বেঁচে থাকতে শিখল। শিখল অপ্রতিরোধ, অসহযোগ, অনুপস্থিতি, অমনোযোগ ও অবজ্ঞা। ক্রমশ তারককে মেনে নিতে, অগ্রাহ্য করতে এবং প্রায় ক্ষমা করতে শিখে গেল টুনি।
এইভাবে মেয়েরা মা হয়। দুর্গা শান্ত হয়ে বসতে শেখে লক্ষ্মীর আসনে। ক্রমশ সে অন্নপূর্ণা হয়ে ওঠে। উপবাসদীর্ণ শিবকে কোলে নিয়ে স্তন্যদান করার মুহূর্তে সে উপলব্ধি করে বাপ-স্বামী-সন্তান সবই এক, নানারূপে পৌরুষের প্রবাহ মাত্র। জঠর, যোনি, স্তন, সবই তাকে দান করতে হয়। ধরা যাক, অনেক বছর বাদে, জরাগ্রস্ত ক্লীব হয়েছে তারক... তার লিঙ্গ এবং মেরুদণ্ড, উভয়ে উত্থানশক্তিরহিত... তার মাড়ি আছে, দাঁত নেই... দুর্গা স্বাস্থ্যবতী, শিল-নোড়ায় অনায়াসে মানুষের মাথা বাটতে পারে... সেই মেয়ে, সেই শক্তিমতি মেয়ে বুড়ো হয়ে যাওয়া, অসুস্থ, ধর্ষণে অক্ষম বাপের মাথাটি কোলে নিয়ে ঝিনুক-বাটিতে দুধ খাওয়াচ্ছে তাকে! সম্ভব, সম্ভব... এও সম্ভব। সৃষ্টির ইতিকথা জানে, আসলে এটাই সম্ভব। বাপ তো বুড়ো ছেলে আসলে... তাকে দুধ দিতে হয়, কোল দিতে হয়, শরীর দিতে হয়। সময় এলে মেয়েকেই মা হতে হয়... নিজের মা এবং বাপের মা।
কিন্তু হরিহর তারক হতে পারে না। সে বুঝতে পারে, তার দ্বারা আর হবে না। এই বুঝতে পারার মুহূর্ত থেকে বিপর্যয়ের সূত্রপাত। যেই না হরিহরের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের বোধ ফিরে এল, অমনি সে লিঙ্গ থেকে ফের মূর্তিতে পরিণত হল। তার সত্তা শিবত্বচ্যুত হল এবং তার লিঙ্গটি সামান্য শিশ্নতে রূপান্তরিত হল। লিঙ্গ মানে চিহ্ন, লিঙ্গ মানে জ্ঞান, কিন্তু শিশ্নের সে চৈতন্য নেই। হরিহরের হীনবল শরীরের আশ্রয়ে সে নগণ্য প্রত্যঙ্গ মাত্র, অনাদি অনন্ত দার্ঢ্য তার আয়ত্বে নেই। লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয়ে অপমানিত সে থরথর কেঁপে ওঠে এবং নিজের সীমা অতিক্রম করে আস্ত হরিহরকে নিদারুণ অসহায়তার দিকে ঠেলে দেয়। বিপন্ন হরিহর মরিয়া হয়ে টুনির নাক চেপে ধরে এবং তার মুখ হাঁ হয়ে গেলে “নে শালি, খা এবার” মন্ত্রোচ্চারণে মুহ্যমান শিশ্নটিকে সেই বিকল্প পথে প্রবেশ করায়। শেষ পর্যন্ত কোথাও একটা প্রবেশ করতে পেরে শিশ্ন ও হরিহর পরম প্রশান্তি লাভ করে এবং নিজেদের মধ্যে পরবর্তী কাজ ভাগ করে নেয়, প্রত্যঙ্গটি গা ঝারা দিয়ে ক্লাইম্যাক্সের জন্য প্রস্তুত হয় আর হরিহর সর্বশক্তি দিয়ে নাতনি মাথাটা নিজের শরীরে চেপে ধরে। শাস্ত্রমতে এখন স্খলনে দোষ নেই। অব্যর্থরেতা চেদিরাজ উপরিচর বসু আকাশপথে রেতঃপাত করেন এবং তা ভক্ষণ করে গর্ভবতী হয় মৎসরূপী অপ্সরা, জন্ম নেয় মৎস্যগন্ধা, যে ক্রমশ হয়ে ওঠে সত্যবতী। বাকিটা মহাভারত। অতএব এই প্রবেশ, এই স্খলন শাস্ত্রসিদ্ধ। হরিহর পুণরায় মনঃসংযোগ করে লিঙ্গে রূপান্তরিত হতে চেষ্টা করে।
আচমকা শ্বাসরোধে দুর্গা মায়ের কাছ থেকে হরিহরের শরীরের নীচে ফিরে আসে। এসে তার মনে হয়, এবার সে নির্ঘাৎ মরে যাবে। ঘৃণায়, গলায় আঙুল দেবার মতো অনুভূতির ফলে এবং বাতাসের অভাবে তার গা গুলিয়ে ওঠে। অথচ শরীর মুচড়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া বমি বাইরে বেরোনোর রাস্তা খুঁজে পায় না। বালিকা বয়স থেকে দেখে শেখা এবং ঠেকে শেখা যাবতীয় যন্ত্রণার পাঠ তার শরীর জুড়ে ঘনিয়ে ওঠে। আচ্ছন্ন হতে থাকা মাথার ভেতর অন্তিম বোধ জেগে ওঠে, মরে যাবার কৌশলটা অবলম্বন করে আর বোধহয় বাঁচা যাবে না। তার কানের কাছে মুখ এনে অন্ধকার বাতাস আর অভিজ্ঞ সাপের নিঃশ্বাস বলে, “এভাবে হবে না।“ সেই অন্ধকারের বিষ-শরীরে ক্রমশ প্রবেশ করে তার মা, কাটা জিভ বের করে হিসহিস সবুজ উচ্চারণে বলে, “ছোবল... ছোবল।” জ্ঞান হারানোর প্রাকমুহূর্তে টুনি বিষদাঁত খুঁজে পায় এবং দাঁত ও দুর্গা নিজেদের মধ্যে পরবর্তী কাজ ভাগ করে নেয়, দুর্গা হরিহরকে এবং দাঁত তার লিঙ্গকে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে।
দুজনেই দরজাটা খুঁজেছিল। খোঁজাই স্বাভাবিক। মুখের ভিতর গলার কাছে আটকে যাওয়া একটি ধরহীন শিশ্নকে বমির সাথে, কাশির সাথে, থুতুর সাথে বের করে দিয়ে শ্যাওলা-দেওয়ালের চৌহদ্দির বাইরে রাতের বাতাসে প্রাণপণ শ্বাস নেওয়া টুনির পক্ষে ছিল একান্ত জরুরি। সদ্য পুংচিহ্ন হারানো হরিহরের পক্ষেও আর্ত-চিৎকারে পাড়া কাঁপিয়ে নিজের রক্তাক্ত উপস্থটিকে ঘরের বাইরে বাঁশ-ঝাড়ের ওপাশে সাহায্যের সন্ধানে নিয়ে যাওয়াই ছিল স্বাভাবিক, অন্তত প্রতিবর্ত প্রেরণায়। লোকলজ্জার চেয়েও বড় যে অনুভূতি, তার নাম মৃত্যুভয়, অন্তত শরীরের কাছে... অন্তত হরিহরের কাছে । বাদ সাধল বাতাস আর বিষ। সবুজ লিকলিকে প্রতিহিংসা থেকে মুহুর্মুহুঃ নির্গত চেরা জিভ থেকে ভেসে আসা দুর্গার মায়ের নিঃশ্বাস তখনো তখনো বলে চলেছে, “ছোবল... ছোবল...ছোবল...”
বাতাসের চেয়ে, কলতলার অন্ধকারের চেনা আশ্রয়ের চেয়ে, কান্নার চেয়ে, নিজের প্রাণের চেয়ে হঠাৎ বড় হয়ে উঠল জিঘাংসা। চোদ্দ বছরে ঢের জীবন দেখে ফেলেছে টুনি। বাঁচার লোভ অনেক আগেই শেষ করেছে তার নিজের বাপ। এই মুহূর্তে এক অন্য লোভ তাকে পেয়ে বসে। খানিক আগে নিজের মুখের ভিতর অন্য মানুষের অনুপ্রবেশ ছাড়াও সে খুঁজে পেয়েছে একান্ত নিজস্ব সম্পদ... দাঁত, যা শুধু সিংহের থাকে না, দুর্গারও আছে। সহসা আত্মপরিচয় লাভ করা সেই দাঁত যে কাজটুকু করে ফেলতে পেরেছ... জীবনে প্রথমবার কিছু একটা পারা... তাকে পূর্ণতা দিতে হবে। দুর্গা নিজের শরীরে অনেক কিছু খুঁজে পায়... দুটো হাত, দুটো পা, একটা কলজে, এক যোজন আগুন, চার হাজার বছর ধরে চেপে রাখা চিৎকার। সবকিছু নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে দাদুর ওপর। তার শ্যাওলা ধরা জীবনের রাত পোহানোর ঘরটুকুতে প্রবেশ ও প্রস্থানের একমাত্র দরজা হরিহর নিজে হাতে বন্ধ করেছিল। ঢোকার আগে সে অনুমতি নেয়নি। বিনা অনুমতিতে তাকে যেতে দেবে না টুনি। হরিহর তার গলা চেপে ধরে, ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আশে কিশোরী নাগপাশ। কিন্তু হরিহর আর জীবনে পলায়নের সবুজ দরজাটা খুঁজে পায় না। মেঝেতে লুটানো চোদ্দ বছর, তার মুখে রক্ত, গলায় জমে থাকা রক্ত অনেকটা মানুষের আঙুলের মতো চেহারার, তার বুকে যোজন যোজন নিষধ... সেই নিষেধ পেরিয়ে হরিহর কোনো দরজার কাছে যেতে পারে না। দরজা পেরিয়ে, বাঁশঝাড় পেরিয়ে তার চিৎকার অন্য কোনো নাতনির দাদু অব্দি পৌঁছাতে পারে না।
উঠোনে শোয়ানো অসমবয়স্ক দুই প্রাক্তন গ্রামবাসীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে জনতা মূলত হরিহরের লিঙ্গ বিষয়ে আলোচনা করছিল। কে না জানে, যা কিছু হারিয়ে গেছে কাল রাতে, তার মধ্যে ওটাই সবচেয়ে দামি? আলোচনা করতে করতে দশ বছরের বেশী বয়সের প্রত্যেক পুরুষ নিজের নিজের লিঙ্গ বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। যারা উপস্থের নানারকম উত্তেজনার সঙ্গে ততদিনে পরিচিত, তারা টের পায় সেই ধরণের অনুভূতি যা সন্ধ্যারাতে সহসা সাপের গায়ে পা পড়লে হয়ে থাকে। উপস্থিত মহিলাদের সামনে লিঙ্গের হন্যমানতা এভাবে উন্মোচিত হওয়ায় তারা বিপন্ন বোধ করে এবং মনে মনে হরিহরকে গালি দেয়, তার রিরংসার জন্য নয়, মৃত্যুর জন্য নয়, তার জিম্মায় থাকা একমাত্র শিশ্নটিকে রক্ষা করতে না পারার কারণে।
বিপুল নস্কর হঠাৎ লক্ষ্য করে তার আশ্রিতা এবং বাড়ির সবরকম কাজের দায়িত্বপ্রাপ্তা বিধবা মামাতো বোনটি তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। চোখাচুখি হতেই তার বুক কেঁপে ওঠে এবং আগামী রাত্রিদের প্রকৃত অন্ধকার মনে হয়। থানার এ এস আই সমরেন্দ্র ঘোষাল নোট নিতে নিতে বার বার শায়িত মেয়েটিকে দেখছিল। অল্প বয়সী তাজা এবং তেজী মেয়ে তার বেশ পছন্দ। মেয়েটা মরে না গেলে ওকে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া যেত। কোর্টে চালান করার আগে দুটো দিন দস্তুরমতো জিজ্ঞাসাবাদ করা যেত। বাস্তব সুযোগটা ফস্কে যাওয়ায় সেইসব কাল্পনিক মুহূর্তকে মনে মনে নিজের লিঙ্গের কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে তার খেয়াল হয় মেয়েটির দাঁত আছে। প্রায় নাগালে আসা অর্গাজম থেকে বঞ্চিত ঘোষাল নিজের চমকে ওঠার মধ্যে এক ভয়াবহ ভবিষ্যদবাণী খুঁজে পায়, এই মেয়েটির দাঁত তার জীবনের অনেক প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন জিজ্ঞাসাবাদের মুহূর্তকে তাড়া করবে।
দাঁতের মাহাত্ম্য অনেক, শুধু তার মর্যাদা বুঝতে হয়। সমবেত দাঁত কাজে লাগিয়ে ইঁদুর যেমন লাইব্রেরির জ্ঞান-ভাণ্ডার থেকে ইমারত-উড়ালপুলের সদম্ভ শহরের পায়ের তলার মাটি, সবকিছু খেয়ে ফেলতে পারে। সামান্য আরশোলা মাত্র এক রাতের একক চেষ্টায় খেয়ে ফেলতে পারে দেশের মানচিত্র থেকে রাজধানী শহর বা বিপুল পাহারায় সুরক্ষিত সীমান্ত। একটি মৃত মেয়ের চোদ্দ বছর বয়সে খুঁজে পাওয়া দাঁত শরতের সকালে খেয়ে ফেলল গাঁ সুদ্দু মরদ, মায় গুঁফো পুলিশের আত্মপ্রত্যয়। খেয়ে ফেলল খবরের কাগজের আগ্নেয় মুখ্য সমাচার, সীমান্ত-বোধ, যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ও আশঙ্কা সমেত জাতি জাগরণের সমূহ সম্ভাবনা। সেই দাঁতের খবর টুনির উঠান ছেড়ে গুনগুনিয়ে ফিরে গেল ঘরে ঘরে, সরমা পরদিন স্কুলে বলল পাশের গ্রামের শম্পাকে, খেজুর গাছ বলল মাঠকে, মাঠ বলল বাতাসকে, বাতাস সেই খবর নিয়ে উড়তে উড়তে গেল লক্ষ্মীর বাড়ি।
দুদিন পর লক্ষ্মী জানতে পারল তার মেয়ে... যার দশ হাত ছিল না, ত্রিশূল ছিল না, সিংহ ছিল না... সেই চৌত্রিশ কিলো ওজনের মেয়ে মরার আগে দাঁত খুঁজে পেয়েছিল। শোবার ঘরের তাক থেকে আয়নাটা হাতে নেয় সে, নিজের মুখের মধ্যে খুঁজে দেখে মেয়ের মুখের আদলের সাথে মিল পায় কিনা। তারপর ঠোঁট ফাঁক করে, যেভাবে ঠোঁটের ঢাকনা সরায় কোনঠাসা বেড়াল। লক্ষ্মীকে অবাক করে ঠোঁটের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে, কী আশ্চর্য, সুগঠিত দুই সারি, যেন যূথবদ্ধ, দাঁত! তারও ছিল! কদিন আগে খেয়াল করেনি কেন?
এতক্ষণে তার বুক ভাসিয়ে শাবক হারানো শ্বাপদের মতো অরণ্য কাঁপানো বিকট হিংস্র কান্না আসে।