পাঁচদিনে তিনজন অধ্যক্ষ মেডিক্যাল কলেজ বিগত একশ আশি বছরে পেয়েছে বলে মনে হয় না। প্রথমজন, প্রফেসর উজ্জ্বল কুমার ভদ্র, নতুন হস্টেলের সিট বিতরণ এবং সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম করে সমস্যা সৃষ্টি করলেন, তারপর ছাত্রদের দাবি ও প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে, “আমি অথরিটি, আমার যা ইচ্ছে আমি করতে পারি”, জাতীয় কথা বলে, মাত্র ঘণ্টা ছয়েক শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘটের জেরে পুলিশ ডেকে ছাত্রদের পিটিয়ে সমস্যাটিকে জটিল করলেন এবং ছাত্ররা আমরণ অনশনে বসার পরেও তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে সমস্যাটিকে অতি জটিল করে তুলে তর্কযোগ্য অসুস্থতার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেন।
তাঁর জায়গায় পরপর দুজন অধ্যক্ষ এলেন। এঁদের মধ্যে প্রথমজন ইএনটি বিভাগের প্রধান প্রফেসর রমানুজ সিনহা কোনো সমাধানসূত্রে পৌঁছতে না পেরে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। সরে যাওয়ার কারণ হিসেবে বললেন, একুশে জুলাই শহীদ দিবস উদযাপন করতে আসা বহিরাগত মবকে ব্যবহার করে অনশনরত আন্দোলনকারী ছাত্রদের আক্রমণ করা হতে পারে এবং তাঁর পক্ষে তখন ছাত্রদের রক্ষা করা সম্ভব হবে না। অতএব পদত্যাগ।
আপাতত ২০ জুলাই রাত এবং সম্ভবত ২১ জুলাই সারাদিনের জন্য অধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছেন প্রফেসর অশোক ভদ্র। তিনি সুবক্তা এবং দক্ষ নিগোশিয়েটর হিসেবে পরিচিত। আজ প্রথমে নিজেদের মধ্যে এবং পরে ছাত্রদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের শেষে রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ ঠিক হল ছাত্রদেরই দাবি এবং সমাধান সবকিছু কাগজে লিখে দিতে হবে এবং তা নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তার সঙ্গে আলোচনা হবে ২১শে জুলাই। সেই আলোচনায় ছাত্রদের দুজন প্রতিনিধিকে উপস্থিত থাকার সুযোগ দেওয়া হবে, এটা ভালো কথা। খারাপ কথা হল, কেউ শীঘ্র সমাধানের উদ্যোগ দেখাচ্ছেন না। সিদ্ধান্তকে “আগামীকাল”-এর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এমন সময়ে যখন অনশন ২৫০ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। টানা দশ দিনের বেশি অনশনরত ছাত্রদের রক্তচাপ কমে যাচ্ছে, রক্তে শর্করা এবং জলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, অভুক্ত থাকার কারণ ফ্যাট থেকে তৈরি হচ্ছে কিটোন বডি, যার দরুণ রক্তে অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ছে। “সন্তানতুল্য” ছাত্রদের প্রতি এই “বিপিতৃসুলভ” আচরণ বিস্ময়কর।
এখানেই খটকা লাগার কথা। একজন প্রিন্সিপাল খারাপ হতে পারেন, কিন্তু সকলেই কি একইরকম খারাপ হবেন? প্রফেসর উচ্ছল কুমার ভদ্র যে পরিমাণ অন্যায় এবং ক্ষমতার আস্ফালন লাগাতার করে গেছেন, তাতে তাঁকে নাহয় ব্যক্তি হিসেবে অপছন্দ করা গেল, অধ্যক্ষ পদের অনুপযুক্ত ভাবা গেল, কিন্তু পরের দুজন? মনে করার কারণ আছে যে এঁরা দুজনেই বুঝতে পারছেন যে ছাত্রদের প্রতি অন্যায় হচ্ছে, তাই একটা ফ্লোর এই ছাত্রদের দেওয়া জাতীয় সমাধানের ভাবনা ভেবে ছাত্রদের নৈতিক অবস্থানকে প্রকারান্তরে সমর্থন জানিয়ে ফেলেছেন ইতোমধ্যে, কিন্তু দায়িত্ব হাতে পেয়ে এঁরা কিন্তু দ্রুত সমাধানের পথে হেঁটে অনশনরত ছাত্রদের প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করছেন না। বরং সময় নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে অনশনরত ছাত্রেরা আরো অসুস্থহয়ে পড়ে এবং অনশন ভেঙে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়। এই জেদী ছাত্রেরা যে কিছুতেই মাথা নোয়াতে রাজি হচ্ছে না এবং চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করতে করতে মরেও যেতে পারে, সেটা বোঝার মতো শারীরবিদ্যা শিক্ষা এঁদের আছে। তা সত্ত্বেও কেন তাঁরা এতখানি ঝুঁকি নিচ্ছেন বা নিষ্ঠুর হচ্ছেন? সম্ভবত তাঁরা প্রবল চাপে আছেন। কারো অঙ্গুলিহেলনে অতি আতঙ্কের মধ্যে তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে এবং তাঁরা পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন। চাপের কারণ এবং উৎস প্রায় সকলেরই জানা এবং তা নিয়ে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সমস্যা হল, এভাবে সবাই কিছুটা সময় নিয়ে দায়িত্ব থেকে পালালে ছেলেগুলো মরে যাবে। এটাকে অবশ্য সকলে সমস্যা মনে করছেন না, অনেকে প্রকাশ্যে এদের মৃত্যুকামনাও করেছেন, কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে এটা সত্যি বড় সমস্যা। সত্যি অঘটন কিছু ঘটলে আজকের আনন্দিত মৃত্যুকামনাকারীদের পক্ষেও এটা বড় মাপের সমস্যা হয়ে উঠবে আগামী দিনে।
মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধির পর ছাত্রাবাস নিয়ে কি প্রবল সমসস্যার সৃষ্টি হয়েছে, ২০১৬ থেকে বিধিসম্মত হস্টেল কাউন্সেলিং বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা, দূরবর্তী এলাকা থেকে আসা নিম্নমধ্যবিত্ত ছাত্রদের তিন বছর বিনা হস্টেলে থাকার দরুণ কঠিন আর্থিক সমস্যা তথা পড়াশুনার অসুবিধা, নবনির্মিত এগারো তলা ছাত্রাবাসে কাদের কীভাবে রাখা হবে তা নিয়ে ঘোর অনিয়ম এবং এই হস্টেলে সব বিধি ভেঙে এক অতি অনভিজ্ঞ এবং প্রথাগত যোগ্যতামান না পেরোনো ব্যক্তিকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ইতিহাসের বিচারে নিয়োগ করা, ইত্যাদি সমস্যা, অর্থাৎ বর্তমান নিয়ে আমরা অনেকেই ইতোপূর্বে বিভিন্ন জায়গায় লিখেছি। সেসব কথা নতুন করে লিখব না, কারণ এতদিনে আন্দোলনের প্রেক্ষিতটা অনেকেই জেনে গেছেন। যাঁরা স্পষ্টভাবে জানেন না, তাঁরা গুরুচণ্ডা৯ ওয়েবসাইটে সায়ন্তন মুখুটির লেখাটি পড়লে সংক্ষেপে যাবতীয় তথ্য পেয়ে যাবেন। ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাঙলায় মেডিক্যাল ছাত্রদের বাসস্থানের বাস্তব চিত্র সচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। কিছু ছবি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে। সেসব দেখলেও বুঝতে পারবেন, এমনকি যেসব ছেলে হস্টেল পেয়েছে, তারাও পুরনো হস্টেলগুলোতে কেমন আছে। বিস্তারিত পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ছাত্রেরা রীতিমত খারাপ অবস্থায় আছে এবং বর্তমানে কর্তৃপক্ষের বেআইনি কার্যকলাপ, ঔদ্ধত্য আর নিষ্ঠুরতা সহ্য করে মুখ বুজে পড়ে থাকার ক্ষমতা হারিয়েছে। অনশনের পথ বেছে নিয়েছে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার পর এবং দশদিন অনশনের পরেও কর্তৃপক্ষের তরফে অসহযোগিতা, নিয়ম মেনে কাউন্সেলিং করা এবং হস্টেল সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট নিয়োগ করার মতো সামান্য ও ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে অনীহা এবং প্রবল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টির ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে আন্দোলনকারী ছাত্ররা এমনকি আমাদের অনুরোধেও দাঁতে কুটোটি কাটতে রাজি নয়, নারাজ গ্লুকোজ ইঞ্জেকশন নিতেও।
এসব সত্ত্বেও অবশ্য রাজনৈতিক নোংরামি থেমে নেই। বস্তুত থামার প্রত্যাশাই মূঢ়তা এখন। কলেজের শিক্ষক স্থানীয় এক ব্যক্তির রাজনৈতিক চরিত্র এত বড় হয়ে গেল যে তিনি নিজের চিকিৎসক সত্তা এবং শিক্ষক সত্তাকে অনায়াসে হত্যা করে বলে ফেললেন, অনশনে দুচারজন মরে গেলেই ভালো, তাতে পপুলেশন কমবে। মরার পর মালা দিয়ে আসবেন বলে ঘোষণা করেন তিনি। মেডিক্যাল কলেজের অভ্যন্তরে এই অমানবিকতা স্তম্ভিত করেছিল ছাত্র-চিকিৎসক সকলকেই, কিন্তু কলেজের বাইরে, নিদেনপক্ষে ফেসবুকে চোখ রাখলে দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত ইন্টারনেট স্যাভি মানুষের মধ্যেও এভাবে বিবেক বন্ধক রাখা বিরল নয়। রাজ্য এবং কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দুটি দলের সমর্থক বেশ কিছু পুরুষ এবং মহিলা অনশনরত ছাত্রদের মৃত্যুকামনা করেছেন প্রকাশ্যে, নানা অজুহাতে। কেউ কেউ মিথ্যা গল্প ফেঁদে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মানুষের মন বিষিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। কারো বা হাসি পাচ্ছে এই পরিস্থিতিতে; টিটকিরি দিয়ে মজা পাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু এই প্রকটভাবে মনুষ্যত্ব খোয়ানো মানুষের সংখ্যা কত? কয়েকশ? কয়েক হাজার? এর বাইরেও তো বিপুল সংখ্যক মানুষ আছেন, যাঁরা এই দলদুটিকে ভোট দিয়েছেন। তাঁদের বেশিরভাগ নীরব আছেন। তাঁরা অনেকেই অন্যায়টা বুঝছেন, কিন্তু আনুগত্য অথবা ভয়ের কারণে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারছেন না। কেউ কেউ ব্যক্তিগত পরিসরে লজ্জা পাচ্ছেন এবং এসব উগ্র অমানবিকতার জন্য ক্ষমা চাইছেন। এই বর্বরতার অংশ হতে চান না তাঁরা। আজ তাঁরা চুপ আছেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাঁরা বিরক্ত। এই বিরক্তি ক্রমশ ক্ষোভে পরিণত হবে সভ্য মানুষের মনে। এই বিপুল পরিমাণ নীরব সমর্থকের মাটি ভিতের নীচ থেকে সরে গেলে কিন্তু ভেঙে পড়তে পারে যেকোনো ইমারত।
গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান রাজ্য সরকারের ভূমিকা জনমানসে বিরূপতার জন্ম দিয়েছে। ছাত্র, চিকিৎসক এবং রোগীসাধারণ, তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যেই ক্ষোভ ও উত্তেজনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ এটুকু বলে থেমে গেলে বস্তুত অর্ধসত্য বলা হয় এবং সরকারের প্রতি অন্যায় করা হয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ আদর্শ না হলেও প্রশংসনীয়। স্বাস্থ্যখাতে ভারতের গড় সরকারি ব্যয়ের তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি। বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু হাসপাতাল বিল্ডিং খাড়া করে বেশ কয়েক হাজার বেড বাড়িয়েছেন এই সরকার। সরকারি উদ্যোগে বা পিপিপি মডেলে ডয়ালাইসিস থেকে শুরু করে ইন্টেনসিভ কেয়ার জাতীয় বিভিন্ন পরিষেবা আরো বেশি সংখ্যক মানুষকে দেবার মতো পরিকাঠামো তৈরি করার ক্ষেত্রে খানিক এগিয়েছেন। এগুলো অস্বীকার করে কেবলমাত্র সরকারকে দোষারোপ করার রাজনীতি করতে চাই না। সমস্যা হল ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে এবং পরিকাঠামোতে নজর দিয়েও স্বাস্থ্যবব্যস্থার প্রকৃত উন্নতি সম্ভব হল না পরিকল্পনার অভাবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উন্নত এবং ব্যয়বহুল প্রযুক্তি নির্ভর ইন্টেন্সিভ কেয়ার বা অন্য কিওরেটিভ চিকিৎসার পিছনে অর্থব্যয় বেড়েছে, কিন্তু রোগ প্রতিরোধ, পুষ্টি, ইত্যাদির ওপর তত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অথচ একথা প্রমাণিত যে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়নের মাধ্যমে সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক উপকার করা সম্ভব এবং সেটাই সরকারের মূল কাজ। আবার চিকিৎসা সংক্রান্ত পরিষেবা প্রদানকারীদের (চিকিৎসক, নার্স, প্রভৃতি) উপর অবদমন চালিয়ে এবং এঁদের বিরুদ্ধে জনগণকে খেপিয়ে দিয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, যার মধ্যে আন্তরিক পরিষেবা দান করতে পারছেন না অনেকেই। এর ওপর আছেন অসংখ্য ছোট-মেজো-বড় মাপের নেতা ও মধ্যসত্ত্বভোগী, যাঁরা ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য রাজ্যের রাজা-প্রজা সকলকেই ঠকাচ্ছেন। ফলে সরকার নিজেদের তরফে যেটুকু চেষ্টা করেছিলেন, সেটুকুর জন্য প্রাপ্য প্রশংসা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। হঠকারিতা বিসর্জন দিয়ে আরেকটু নমনীয়, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করলেই কিন্তু এই মুহূর্তে সরকার সম্বন্ধে মানুষের মনোভাব হত অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল।
মেডিক্যাল কলেজের উদাহরণটাই দেখা যাক। একটি এগারো তলা হস্টেল নির্মাণ করা হয়েছে, এটা সরকারের পক্ষের খবর হতে পারত স্রেফ নিয়ম মেনে হস্টেলের আসন বিতরণ করলে। অথচ কর্তৃপক্ষের আনাচারে তা আজ এক বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রে। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে জনৈক হঠকারী নেতার ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা নৈরাজ্যের ফলে আবার সরকারের মুখ পুড়ল, যেমন পুড়েছিল কুকুরের ডায়ালিসিসের পর। কোনো সরকারই এমন অপমান চান না, আমার বিশ্বাস। প্রশ্ন হল, কেন বারবার এমন হওয়া সত্ত্বেও সরকার এরকম কিছু সংখ্যক কালিমালিপ্ত স্বার্থান্ধ নেতাকে সংযত করতে পারছেন না? এই “করতে না পারা” কিন্তু মানুষের চোখে “করতে না চাওয়া” হিসবে প্রতিভাত হচ্ছে, যা সরকারের ভাবমূর্তির পক্ষে ক্ষতিকর। আশা করি সরকার তা বুঝছেন।
মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের পাশে সাধারণ মানুষ আজ এসে দাঁড়িয়েছেন, শুধু এরা মরতে বসেছে বলেই নয়, এদের দাবিকে সবাই সঙ্গত মনে করছেন বলেও বটে। বস্তুত মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ এই ছাত্রদের দাবির সাথে নিজেদের সমস্যাকে মেলাতে পারছেন, তাঁদের মনে হচ্ছে, এই বাচ্চা ছেলেগুলো আসলে অনেকের হয়ে কথা বলছে। বাসস্থানের প্রয়োজন এক অতি মৌলিক প্রয়োজন। তাছাড়া সরকারি বণ্টনব্যবস্থা থেকে নিয়ম অনুসারে নিজের প্রাপ্যটুকু পাবার অধিকার অতি গুরুত্বপূর্ণ, যার ওপর বস্তুত নির্ভর করে বহু লক্ষ মানুষের জীবন নির্ভর করে। এঁদের অনেকেরই বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে, কীভাবে তাঁদের প্রাপ্য সস্তার চাল বা গৃহনির্মাণের টাকা কিছু নেতা ও মধ্যসত্ত্বভোগী লুঠ করে নেন। সুতরাং মেডিক্যাল কলেজের সমস্যার সমাধান এখনি না করলে যেকোনোদিন এই আন্দোলন এক বৃহত্তর গণ আন্দোলনে পরিণত হতে পারে।
এই আন্দোলনে জনগণেশের অংশগ্রহণ যেমন জরুরি, তেমনি জনগণের প্রতি নজর দেওয়াও আমাদের, অর্থাৎ নাগরিক কেন্দ্রে অবস্থিত মানুষের পক্ষে জরুরি। যাদবপুর বা মেডিক্যাল কলেজের পাশে আমরা যেভাবে থাকছি, সেভাবেই সমর্থন দিতে হবে মালদহ বা পুরুলিয়ার ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবিকেও। অবশ্যই ন্যায্য দাবিকেই। পরীক্ষাইয় ছাত্রছাত্রীদের পারফরম্যান্স খারাপ হলেও সকলকে নব্বই শতাংশ নম্বর দেবার দাবিতে অধ্যক্ষকে ঘেরাও করার মতো ঘটনা এই সুস্থ রাজনীতির অংশ হবে না অবশ্যই। আবার কোনো ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের দাবি অসাংবিধানিক বা ভুল হলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁদের বোঝানোও চলবে অবশ্যই, কিন্তু অনামী বা দূরবর্তী মফস্বলের প্রতিষ্ঠানগুলিকে অবজ্ঞা করার প্রবণতা বদলাতে হবে। একমাত্র তাহলেই সর্বত্র ছাত্রদের অধিকারকে সম্মান দেবার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পাবে। তাহলে ভবিষ্যতে এভাবে ছাত্রদের পদপিষ্ট করার কথা কেউ ভাববেন না। নইলে অখ্যাত স্থানের ছাত্রদের উপর জুলুম করার বদভ্যাস উপচে উঠে মাঝেমাঝে কোলকাতার আলোকপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এসে পড়বে, পড়তেই থাকবে। এগোতে হবে ক্রমশ সুস্থতর রাজনৈতিক ভবিষয়তের দিকে।
এই স্বপ্নের ভালো কথাটুকু বলতে গিয়েও এক ঘোরকৃষ্ণ বাস্তবকে অগ্রাহ্য করতে পারছি না। মেডিক্যাল কলেজের অনশনরত ছাত্রদের প্রতি প্রশাসকদের আচরণ এই কদিনে কলোনিয়াল শাসকদের কথা মনে করিয়েছে। হয়ত এঁরা শেষ অব্দি মেনে নিতে বাধ্য হবেন, যেমন মেনে নিয়েছেন যাদবপুরে, কিন্তু এই দশদিনের অমানবিকতা অকল্পনীয় ছিল দশদিন আগেও। ভাবতে হচ্ছে, সত্যি কি সুশ্ততর রাজনীতির কথা ভাবার সুযোগ আছে আমাদের?
আমরণ অনশনে মানুষ বসে মরে যাবার সম্ভাবনার কথা জেনে, কিন্তু মরে যাবার ইচ্ছা নিয়ে নয়। এটা একধরণের সত্যাগ্রহ, কথা বলার মরিয়া চেষ্টা। যে ছাত্র অনশনে বসছে প্রশাসকের দরজায়, সে তখনো প্রশাসকের মনুষ্যত্বে বিশ্বাস হারায়নি আসলে। তখনো ভাবছে, এই কর্তৃপক্ষ বা সরকার আদতে তার অভিভাবক, বাবা-মায়ের মতোই। কিছুটা অবুঝ, অহংকারী, নির্দয় অভিভাবক, কিন্তু একেবারে অমানুষ বা শত্রু নন। এতদিন ন্যায্য কথায় কান না দিলেও অন্তত না খেয়ে থাকতে দেখলে কথাগুলো শুনতে রাজি হবেন, মরে যেতে দেবেন না। শাসকের মনুষ্যত্বে এই আস্থা গণতন্ত্রের তথা আলোচনাপন্থী লিবারেলিজমের ভিত্তি। এই আস্থাটুকুও নষ্ট করে দিলে কী হবে ভেবে দেখেছেন কি? যখন কর্তৃপক্ষ “সন্তানতুল্য” ছাত্রদের ঠাণ্ডা মাথায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন এবং তাঁদের কেউকেউ প্রকাশ্যে মৃত্যু কামনা করছেন, তখন এই আস্থাটুকুও ভেঙে পড়তে বাধ্য। এই বিবেকহীনতাকে শুধুমাত্র তৃণমূল কংগ্রেসের বৈশিষ্ট্য বললে অন্যায় হবে। পৃথিবী জুড়ে ক্রমশ অবিবেকী, চরম নির্দয় এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হচ্ছে, চরিত্রগতভাবে যাদের অনেকেই আমাদের রাজ্য সরকারের চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। এই পরিস্থিতিতে মানুষ কার সাথে নেগোশিয়েট করবে এবং কীভাবে? অনশন বা সত্যাগ্রহ কীভাবে এক অনুপস্থিত বিবেকের দরজাইয় কড়া নাড়বে? র্যাডিকাল বামপন্থীরা আমাদের মতো আলোচনা ও অহিংসায় বিশ্বাসী মানুষদের এমনিতেই রাজনৈতিকভাবে ভ্রান্ত মনে করেন, ঠাট্টা করেন এবং সন্দেহের চোখে দেখেন। তবু মানুষের শুভবুদ্ধিতে আস্থা না হারিয়ে আমরা শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আমাদের হয়ত মাথা নীচু করে মেনে নিতে হবে যে সত্যিই আমরা ভুল ভাবছিলাম, একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক আলোচনার কোনো পরিসর নেই।
রাজ্যের, দেশের, পৃথিবীর রাজনৈতিক বাতাসে চরম বিষাক্ত দূষণ যাঁরা ছড়াচ্ছেন, তাঁদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করি আরেকবার। আমরা নাহয় ভ্রান্ত প্রমাণিত হব, মাথা নীচু করে সরে যাব চিরকালের মতো, কিন্তু গণতন্ত্র এবং আলোচনা মুছে গেলে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে মূর্তিতে প্রকাশ পাবে জনরোষ, তার অভিঘাত থেকে কেউ কি বাঁচবে? সুস্থতর গঠনমূলক রাজনীতির দিকে এগোতে গেলে আগে অবদমন বন্ধ করে সংবেদনশীল হতে হবে, সম্মান দেওয়া এবং আলোচনার টেবিলে বসা অভ্যেস করতে হবে, অন্যের কথা শুনতে হবে মন দিয়ে, সাংবিধানিক নিয়মগুলো মানতে হবে এবং মানুষকে দিতে হবে তাঁদের প্রাপ্য ন্যূনতম অধিকারটুকু।
সুস্থতাকে বাঁচাবার জন্য লড়ছে রাজ্যের প্রাচীনতম মেডিক্যাল কলেজ। যদি অনশনরত একজন ছাত্রেরও মৃত্যু হয়, তবে এই রাজ্যে রাজনৈতিক সুস্থতার মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবী।