বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে এমন একজন মানুষকে প্রার্থী করা হয়েছে, যিনি এক বছর আগে অবধি নাগরিকপঞ্জির সমর্থক ছিলেন, এক বছর আগেও যিনি মনে করতেন মুসলমান মানেই বাংলাদেশি, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। এক বছর আগে যখন ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’, এই প্রচারকে সামনে রেখে তৃণমূল কংগ্রেস তার নিজের ‘খেলা’ সাজাচ্ছে, সেই সময়েও ‘মেয়েদের বিদায় দিতে হয়’, এই জাতীয় কথা তিনি বলেছেন সামাজিক মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, তিনি কলকাতার একজন নামী বাচিক শিল্পীকে ‘তৃণমূলের যৌনদাসী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এহেন একজন মানুষের নাম বাবুল সুপ্রিয়, যিনি কিছুদিন আগেই দলবদল করে বিজেপির গেরুয়া উত্তরীয় ছেড়ে সবুজ হয়েছেন। তা, সবুজ তিনি হতেই পারেন, তাতে আমরা আপত্তি করার কে? কিন্তু আপত্তি করছে তো সাধারণ মানুষ। তাঁদের বক্তব্য, যে মানুষটির নাম কিছুদিন আগেও আসানসোলের দাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাঁকে প্রার্থী করার মধ্যে দিয়ে আসলে একুশের গণরায়কে তৃণমূল অস্বীকার করতে চাইছে।
কেন তৃণমূল ‘এই বাবুলকে একটি ভোট নয়’ স্লোগানকে ভয় পাচ্ছে?
আজ অবধি বহু বিষয় নিয়ে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কাজের বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে, মিটিং হয়েছে। কিন্তু যে মিছিল বা জমায়েতে ওদের অসুবিধা হতে পারে সেই মিছিল কিছুতেই সরকার হতে দেবে না। বহু সংখ্যক মিছিলও যদি হয় মৌলালি থেকে বা কলেজ স্কোয়ার অঞ্চল থেকে, তাতে সরকারের খুব বেশি গায়ে লাগে না। কারণ এই মিছিলগুলোর প্রভাব খুবই যৎসামান্য। কিন্তু যে মিছিল বা মিটিংয়ের মধ্যে দিয়ে মানুষজনের কাছে ন্যূনতম কোনও বার্তা পৌঁছতে পারে, সেই মিছিলের অনুমতি কি সরকার দিতে পারে? এই মিছিলের আগে সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেকভাবে সংশ্লিষ্ট প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে, বালিগঞ্জের সংখ্যালঘু মানুষজনদের মধ্যে। হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি ও বাংলায় প্রচার করা হয়েছে। তার মধ্যে দিয়েই একটা বার্তা রাজ্যের শাসকদলের কাছে পৌঁছেছে যে বাবুল সুপ্রিয়র জন্য এই আসনটি খুব বেশি স্বচ্ছন্দের হবে না। তিনি হাসতে হাসতে নাও জিততে পারেন। আর যেহেতু এই মিছিলটির যাত্রাপথটি বেশিরভাগ সংখ্যালঘু অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে হবে, তাই এই মিছিলকে গোড়াতেই বন্ধ করতে হবে। আসলে রাজনৈতিক কাজ যত নিবিড়ভাবে করা যাবে, তত তা শাসকদলের জন্য বিপদজনক। বামপন্থী মানুষজন আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যেভাবে কাজ করতেন, সেইটাই একমাত্র পদ্ধতি রাজনৈতিক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার। আর কোনও বিকল্প পথ নেই। অন্য যে কোনও মিছিলে শাসকের কিছু যায় আসে না, মিডিয়ার এক কোনায় খবর হওয়া না হওয়ার মধ্যে খুব বেশি তফাত হয় না। কিন্তু এই ধরনের প্রচার শাসকের ঘুম কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
‘বাবুলকে ভোট নয়’ মিছিল কেন আটকানো হল?
গতকাল যখন পার্ক সার্কাসের একটি খাবারের দোকানের সামনে জমায়েত হচ্ছিলেন বেশ কিছু এনআরসি বিরোধী কর্মীরা, তখন পুলিশ এসে বলে ওই স্থানে জমায়েত করা যাবে না। কারণ, ওই জমায়েতের নাকি কোনও অনুমতি নেই। অথচ নির্বাচন কমিশনের থেকে প্রাপ্ত অনুমতিপত্র দেখানো হলেও তাঁরা বলেন, অনুমতিতে বলা নেই যে ঐ স্থানে জমায়েত হয়ে মিছিল শুরু করা যাবে। আর কথা বাড়ালে গ্রেপ্তার করা হবে। কোনও কথা বাড়ানোর সুযোগই দেওয়া হল না, সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হলো প্রসেনজিত বসু, মনজর জমিল, ইমতিয়াজ আলি মোল্লা, অমিতাভ চক্রবর্তী-সহ দশজনকে। ঘটনাচক্রে আমরা কয়েকজন তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে। পুলিশ এসে আমাদের বলল, এইখানে জমায়েত করা যাবে না। আমরা উল্টে বললাম, দু’জন মানুষ কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে কথা বলাও অপরাধ নাকি? এটা কি উত্তরপ্রদেশ? যে কথা বলারও অধিকার নেই, সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করবারও অধিকার নেই? পুলিশ বলল, অত কিছু জানি না, এখান থেকে চলে যান, না হলে আপনাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। আমরা এগিয়ে গেলাম সামনের কোয়েস্ট মলের দিকে, ওখানে তখন উপস্থিত আরও পুলিশ। তাঁদের প্রশ্ন করা হল, এখান থেকে কি মিছিল করা যাবে? তাঁরা বললেন না, এখান থেকেও কোনও মিছিল করা যাবে না। আপনাদের মিছিল করতে হলে, ওই আগের জায়গা থেকেই করতে হবে। আমরা বললাম, ওখানে তো জমায়েতই করতে দিচ্ছেন না আপনারা। সেসব জানি না, এই কথা বলতে বলতে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং সিপিআইএমএলের রাজ্য কমিটি সদস্য অমিত দাশগুপ্তকে গ্রেপ্তার করা হল। আসলে পুলিশের কাছে নির্দেশ ছিল, কোনওভাবেই যেন এই মিছিল করতে না দেওয়া হয়। তাঁরা মিছিলের মূল উদ্যোক্তাদের গ্রেপ্তার করে মিছিলটিকে সংগঠিত করার প্রক্রিয়াই বানচাল করে দিলেন।
সামাজিক মাধ্যমে কী চলছিল তখন?
যে সময়ে এই ঘটনা ঘটছে, সেই সময়ে প্রসেনজিত বসু-সহ কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনা খুব দ্রুত প্রচার করে দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে পড়েছে বামেদের এক শ্রেণির বাহিনী। তাঁরা মজা করা শুরু করলেন, এই তো যাঁরা ‘বিজেপিকে ভোট নয়’ বলে ২০২১-এর নির্বাচনের আগে প্রচার করেছিলেন, আজ ‘বাবুলকে ভোট নয়’ এই প্রচার করেছিলেন, তাঁরাই আজ আক্রান্ত। আসলে বিতর্ক লেফট অফ সেন্টার থেকে রাইট অফ সেন্টারের দিকে সরে যাচ্ছে। একটি দক্ষিণপন্থী দলকে আটকাতে গিয়ে আর একটি দক্ষিণপন্থী দলকে আনা হয়েছে, যাঁরা স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করছে, যাঁরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির কোনও ধার ধারছে না। সুতরাং রাজ্যবাসীকে এর মাশুল দিতে হবে। স্পষ্টতই ওঁরা মনে করছেন এ রাজ্যের মানুষ শুধুমাত্র মাশুলই দিয়ে যাবেন, লড়াই বা প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন না। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইও যে চলছে সেটা তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন না। এছাড়াও, তৃণমূলের মতো একটি দক্ষিণপন্থী দলকে সর্বতোভাবে শক্তিশালী করে অপ্রতিরোধ্য করে তোলা হয়েছে বলেই তাঁদের যত সমস্যা। অর্থাৎ তৃণমূলের আধিপত্যে ধাক্কা লাগলেই এনারা খুশি, সে ধাক্কা যেই দিক না কেন! এখানে বামেদের নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই কিন্তু! বামেদের কি হল না হল সেই নিয়ে মাথাব্যথা থাকলে ২০১৯ নিয়ে তো আগে কথা হতে হয়। সে নিয়ে কিন্তু কোন কথা হয় না! কথা হয় না ঐ একটিই কারণে ২০১৯-এ তৃণমূলের আধিপত্যে ধাক্কা লেগেছিল! সে ধাক্কা যে বামেরা নয়, বিজেপি দিয়েছিল এবং বামেদের বিপুল ভোট নিয়ে বিজেপি সেটা করেছিল তা নিয়ে এনাদের কিছু যায় আসে না। তাঁরা এখনও মনে করেন, নিজেরা না পারলেও বিজেপি যদি তৃণমূলের আধিপত্যে ধাক্কা দেয়, তো সেটাই লাভ। কিন্তু ২০১৯ সালে তো ‘বিজেপিকে ভোট নয়’ এই প্রচার ছিল না, সেই বছরেই বামেদের ভোট সবচেয়ে কমে এসে সাত শতাংশে দাঁড়ায়, তাহলে তার জন্য কে বা কারা দায়ী? এই নিয়ে কেন কোনও আলোচনা হয় না?
এখন কী করণীয় তবে?
পুরোনো সব বিতর্ক সরিয়ে রেখে, এই মুহূর্তে বিরোধী পরিসরটা বামেদের দখল নেওয়া আজ সময়ের দাবী। তৃণমূলকে আক্রমণ করতে হবে আলাদাভাবে, বিজেপিকে আলাদাভাবে। যে যতই বলুক, তৃণমূল এবং বিজেপি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ নয়। সুতরাং তৃণমূলের স্বৈরাচারের বিরোধ করাটা যেমন জরুরি কাজ, বিজেপির কাজের বিরোধিতাও আলাদা করেই করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে সমস্যাগুলো আলাদা করে, নিবিড়ভাবে লেগে পড়ে থেকে, সামাজিক মাধ্যমের বিতর্কের বাইরে বেরিয়ে ছোটো ছোটো স্তরে সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ছোটো করে কাজ করতে করতেই মানুষের বিশ্বাস অর্জন করাটা জরুরি। যে বামেরা ২০১৯ সালে নিজের নাক কেটে তৃণমূলের যাত্রাভঙ্গের কাজ করতে চেয়েছিল, সেই বামেদের যদি আবারও মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হয়, তাহলে এই নিবিড় অনুশীলন করা দরকার। কিন্তু বামেরা কি এই কাজ করতে আগ্রহী? সেইটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।