নিম্নচাপের শঙ্কা ছিল আগের দিন থেকেই। ১০ আগস্ট দুপুরে যা তুমুল বৃষ্টি নামল, তাতে ভন্ডুল হয়ে যেতে পারত পুরোটাই – কিন্তু নির্ধারিত সময়, বিকেল তিনটের ঠিক মিনিটদশেক আগে বৃষ্টি ধরে এল।
মৌলালির রামলীলা পার্কের সামনে জমায়েত বাড়তে শুরু করল গুটিগুটি। ছোট্ট মঞ্চের সামনে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে কিছু আধবুড়ো লোক এসে বসলেন। মঞ্চে তাঁদের মধ্যে কয়েকজন একেএকে উঠে কিছু বলতে শুরু করলেন, যা শোনার জন্যে ভিড় বাড়তে শুরু করল অচিরেই। সেই ভিড়ের অধিকাংশই বিভিন্ন বয়সের তরুণ-তরুণী। পুলিশ এসে রাস্তার অর্ধেক মত ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে দিল, যাতে এই সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানটি ঠিকমত চলতে পারে।
জানা গেল, এই তরুণ-তরুণীদের অধিকাংশই বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী, বেশ কয়েকজন তার মধ্যে গবেষক – বিভিন্ন বয়সের – পোস্ট ডক ফেলো থেকে পিএইচডি স্টুডেন্ট। মঞ্চের চারপাশের আধবুড়ো জনতার অধিকাংশ বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা-সংস্থার শিক্ষক-বিজ্ঞানী। ভিড়ে স্কুলের খোকা-খুকুও চোখে পড়ছিল কিছু।
বিকেল ৪টের কিছু পরে, মঞ্চের ঘোষণা অনুযায়ী, এঁরা দলে দলে ভাগ হয়ে – হাতে প্ল্যাকার্ড, নয়তো সামনে ব্যানার নিয়ে – শৃঙ্খলাবদ্ধ হাঁটা শুরু করলেন। সমবেত জনতার পদক্ষেপ দৃপ্ত হলেও, ভঙ্গি শান্ত, ভদ্র। স্লোগানিং নেই, কোনো কল্পিত কালো হাত ভেঙে বা গুঁড়িয়ে দেওয়ার আস্ফালন নেই – মিছিলের সামনে একটু এগিয়ে চলা পুঁচকে ট্রাক থেকে মহিলাকণ্ঠে শান্ত গলায় মিছিলের উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যা আর এদিক-ওদিক চঞ্চল কিছু ফোটগ্রাফারের খচাৎ ছাড়া আর কোনো ‘উৎপাত’ নেই। তবুও, মিছিলের চারপাশ ঘিরে রাখল পুলিশ, অনেক পুলিশ। ‘দ্য প্রিন্ট’-এর খবর অনুযায়ী[1], এই মিছিলের অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৫০০-র কাছাকাছি। জনা পাঁচশ’ বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক আর বিজ্ঞান-অনুরাগীকে সামলানোর আশঙ্কা নিশ্চয়ই তাঁদের ছিল না। সন্দেহ হয়, এ ছিল বাকি শহর কী করতে পারে – তা না জানার ফল।
এই মিছিলের নাম, ‘India March for Science’[2]। কেন এই মিছিল?
এ বছর নতুন নয়। ২০১৭ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানসমাজ তাঁদের দেশের সরকারকে বারংবার অনুরোধ করছিল, যেন অবৈজ্ঞানিক চিন্তা, কুসংস্কার, ইত্যাদির, সরকারি খরচে প্রসার রদ করা হয় এবং বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা করা হয়। সরকারি নীতি – তা সে পরিবেশ বিষয়কই হোক, বা স্বাস্থ্যসম্পর্কিত, যেন বিজ্ঞান-অনুসারী ও কল্যাণকামী হয়। ভারতের বিজ্ঞানকুলও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এঁদের দাবি ছিল, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার ও প্রচার, সংবিধানের 51(A) ধারা অনুযায়ীই, আমাদের কর্তব্য। এই সব দাবি নিয়ে এবং বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান-আন্দোলনের সমর্থনে ভারতও হাঁটতে থাকে প্রতি বছর, ২০১৭ থেকে ২০১৯।
২০২০ আর ২১-এ কোভিড ছিল, তাই মিছিল হয়নি। সেই সময়েই দেখা গেছে, সময় থাকতে বিজ্ঞানীদের কথা না শোনায়, কত বড় দাম গুণতে হয়েছে সারা পৃথিবীর ‘রাজনৈতিক’ নেতাদের। ভারতেরও আশা হয়তো ছিল, টনক নড়বে। কিচ্ছু নড়েনি, উলটে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অধিবেশন পরিণত হয়েছে একটি গোময়লিপ্ত তামাশায়, ২০২০-র National Education Policy-র মধ্যে Indian Knowledge System নাম দিয়ে অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা একেবারে স্কুল-কলেজের সিলেবাসে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী নানা আসন্ন, অথবা আগত বিপর্যয় – যা অনেকাংশেই বিজ্ঞানের কথা কানে না তোলার ফল – যেমন, বিশ্ব পরিবেশের উষ্ণায়ন, মানুষের ক্রিয়াকলাপের ফলে বাস্তুতন্ত্রের ওপর ক্রমাগত বেড়ে চলা চাপ, মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা, ছড়িয়ে পড়া বিজ্ঞানবিরোধী মতবাদ (যেমন কিনা টিকা-ভীতি, কিছু মানুষের মনে মৃত্যুভয়কেও ছাপিয়ে গেছে দেখা যায়) – এইসব সমস্যার সঙ্গে তাই দেশের নিজের অনেক সমস্যা নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়ে ভারতের বিজ্ঞানসমাজ। দু’বছর পর, ২০২২-এ, সারা ভারতের বিভিন্ন শহরে আবার হাঁটলেন তাঁরা। কলকাতাও হাঁটল সঙ্গে, ১০ আগস্টের দুই বৃষ্টির মধ্যের এক বিরল শুকনো সময়ে – মৌলালির রামলীলা পার্ক থেকে এসপ্ল্যানেড। দাবি করল[3],
১) যেন সংবিধান মেনে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার হয়,
২) NEP-র অংশ হিসেবে ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’-এর নামে বিজ্ঞানবিরোধী চিন্তাধারার প্রসার যেন অবিলম্বে বন্ধ করা হয়,
৩) দেশের মোট বাজেটের ১০% এবং রাজ্যের বাজেটের ৩০% যেন ধার্য হয় শিক্ষাখাতে
৪) দেশের বাজেটের অন্তত ৩% যেন নির্ধারিত হয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার জন্যে
৫) পরিবেশ রক্ষা ও উষ্ণায়ন রোধের জন্যে সরকার থেকে যেন সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের পকেট ভরার জন্যে যেভাবে দেশের পরিবেশের লুঠ চলেছে, তা যেন বন্ধ হয়
শুধু কলকাতা কেন? ছোট ছোট করে হওয়া এমন সব সভা-মিছিলের সাক্ষী থাকল শিলিগুড়ি, বালুরঘাটও।
শুনল কি কেউ? সে তো শুনলই। একগাদা শান্ত লোক মিছিল করে পেরিয়ে যাচ্ছে রাস্তা – কৌতূহলী মুখের অভাব ছিল না। এই এখন আপনি পড়ছেন, শুনছেন, শুনছে আরও কিছুসংখ্যক মানুষ। সময়ের সঙ্গে, আরও কিছু মিছিলের পরে, আরও অনেকে শুনবেন, জানবেন।
কিন্তু, কতটা বোঝানো গেল? মাথায় থাকল কতটা? সে তো আজকের গল্প নয়, আদ্যিকালের সমস্যা। টবের মাটিতে, যত্নে, আদরে, কোনোক্রমে টিকিয়ে রাখা – বিজাতীয় বনসাইয়ের মত বেঁচে আছে আমাদের দেশের বিজ্ঞান। সমাজে, সংস্কৃতিতে, শিল্পে – মায় রাজনীতিতেও ব্রাত্য সে। স্বভাবতই, খবরে কোথাও নেই এই মিছিল – খবর জবরদখল করে আছে, হয় শিক্ষার বিকিকিনি অথবা শিক্ষিকার বিকিনি[4]। শিক্ষক, গবেষক গোষ্ঠীর হতাশাও তুঙ্গে – প্রোজেক্ট গ্রান্ট, স্কলারশিপ, কর্মসংস্থান – সর্বত্র চলছে সংকোচন। মিছিলের মধ্যেও শোনা যাচ্ছে পরিহাস – “এই সরকার শিক্ষায় দেবে ১০%, ৩০%? চুরি করার জন্য তবে বাকি থাকে কত?”
তবু, নিরন্তর হতাশার নিম্নচাপের মধ্যের ঐ দু’ঘণ্টার বিরতিতেই গতকাল হাঁটল কলকাতা। নেতাদের নিজেদের ইগোর সমান মাপের কাট-আউটের ছায়ায় নয় – শিক্ষিত, সমাজ-সচেতন ও স্বনামধন্য কিছু বাঙালি বিজ্ঞানীর ছবির প্ল্যাকার্ড হাতে।
[1] দ্য প্রিন্টের আর্টিকল
[2]মার্চ ফর সায়েন্সের ওয়েবসাইট
[3] পুরো দাবিদাওয়ার লিঙ্ক
[4] সম্পূর্ণ চুরি, শিল্পী অভীক মৈত্র-র ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে।