কখনও একটা গোটা বাজারকে প্রাণভয়ে দৌড়োতে দেখেছেন? আজ তাই দেখতে হলো। আট থেকে আশি সবাই দৌড়াচ্ছে। দেখলাম এ দৌড়ের কোনও জাত নেই, ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, বয়স নেই, লিঙ্গ পরিচয় নেই – কিচ্ছু নেই, বিশ্বাস করুন কিচ্ছু নেই। থাকার মধ্যে আছে কেবল ভয়, প্রাণের ভয়। সবকটা লোক তেড়ে পালাচ্ছে। জীবনে প্রথমবারের মতো গাড়িঘোড়াগুলোকেও ভয় পেতে দেখলাম। অটো-টোটো-রিক্সাগুলো পালাতে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে, কেউ কাউকে যেন জায়গা ছাড়বে না, আগে নিজে পালাবে। রাস্তার কিছু ভয়ার্ত লোক—যাদের অভ্যাস আছে চলন্ত গাড়িতে ওঠবার, তাদের কেউ কেউ ছুটে চলা টোটোতে উঠে পড়েছেন বাঁচার তাগিদে। পেছনে যে জলজ্যান্ত রামনবমী দাঁড়িয়ে আছে। সেই মিছিলে কারা নাকি পাথর ছুঁড়েছে। আর যায় কোথায়! লাগল এবার নারদ নারদ। তখন না পালিয়ে জো আছে? তাই সবাই পড়িমরি দৌড়াচ্ছে। আর প্রত্যেকের ভয়ের ভাষা এক।
আমি তখন একটা গাছের দোকানে। পছন্দ করেছিলাম একটা বাগান বিলাসের গাছ। যার সাদাটে সবুজ পাতাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল পাতায় মিহিন বরফের স্তর পড়ে আছে। কী যে সুন্দর! দোকানদার জেঠু বলল আশি টাকা। দাম মেটাতে যাবো, এমন সময় বাইরে হৈ হৈ শব্দ। জেঠু ঠিক করল—ঝাঁপ ফেলে দেবে। গাছটা দোকানেই রয়ে গেল। আর আমার বাড়িতে এলো না। ঠিক ছিল—ফেরতা পথে মায়ের ওষুধ কিনবো। আমার আর ওষুধ কেনা হলো না। অ্যালার্জির জন্য আজ সারা রাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারবে না।
এই তো দু-দিন আগে পর্যন্ত রাম নবমী নিয়ে আমার একটা মিষ্টি অভিজ্ঞতা ছিল, জীবনে প্রথমবার বামুন ঠাকুর হয়ে অন্য কারোর জন্য পুজো দিয়েছি। পুজো শুরুর আগে সুর করে উচ্চারণ করেছি “ওঁ গঙ্গা গঙ্গেতি যপ্রুয়াৎ...” শেষে কাননবালা ঘোষ, কাশ্যপ গোত্র। বৃদ্ধা কাননবালা যখন বলেছিলেন, “ও ঠাকুরমশাই একটু আশীর্বাদ দ্যান।” অপ্রস্তুত হয়েছিলাম। সংশয়বাদী আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। মুখে বলেছিলাম, “আমি আশীর্বাদ দেবার কে গো মা? আমি বওয়ার কাজটুকু করি মাত্র। এই যে তোমার হয়ে তাঁর কাছে খেয়া বয়ে দিলাম। আশীর্বাদ তো তিনি করবেন।” বৃদ্ধা চোখভরা শান্তি নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। হয়তো বা বিশ্বাসও করলেন আমার কথা। কিন্তু আজ যে আমার অভিজ্ঞতা হলো—বৃদ্ধা কাননবালার চোখে যে শান্তি ছিল, তাকে বদলে যেতে দেখলাম ভয়ে। ঘৃণা হলো আমার পৌরহিত্যে, আমার সদ্য বামুনপনায়।
আমার আর মায়ের ওষুধ কেনা হয়নি।