‘জনতা’ শব্দটির ভেতর লেগে থাকে বহুত্বের এক অনুভব। কেউ বলেন বহু জনের একত্র সমাবেশ, ভিড়, মনুষ্যত্ব (বাঙ্গালা ভাষার অভিধান- জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস)। কেউ বা চিহ্নিত করেন জনসমূহ (বঙ্গীয় শব্দকোষ-হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) হিসেবে। অন্যখানে তা আখ্যায়িত হয় লোকের ভিড়, জন-সাধারণ (চলন্তিকা-রাজশেখর বসু) রূপে। ফলে এ সমস্ত শব্দার্থ থেকে স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকে ‘মনুষ্যত্ব’ অভিধাটি। ভিড়ের ভেতর জনতাকে খোঁজা যেতে পারে ঠিকই, কিন্তু দখিনা বাতাসের মতো যে ভিড়ের গায়ে লেপ্টে থাকে মনুষ্যত্ব বা নির্মম রাষ্ট্রীয়–কর্পোরেট ও শ্রেণি শোষণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মনুষ্যত্ব খোঁজার আকুতি থাকে যে জনতার - তাঁদের কাছেই বোধহয় পৌঁছতে চায় ‘জনতার সাহিত্য উৎসব’।
উৎসবের পরিচিতি-পুস্তিকার ভূমিকায় পাচ্ছি, ‘আমাদের সাহিত্য উৎসবে শ্রেণির মানুষ, যাঁদের ‘জনতা’ বলছি, তাঁরা খুব বেশি অংশগ্রহণ করেন না, তাঁদের কাছে অনুষ্ঠানটি বিশেষ প্রচার পায় না-‘। পুস্তিকা পড়ে বোঝা যায়, মূলত শ্রমজীবী জনতাকেই উদ্দেশ করতে চায় এই সাহিত্য উৎসব। তবে স্বীকার করতেও ভোলে না শ্রমজীবী জনতার পক্ষে ‘রোজ’ নষ্ট করে সাহিত্য উৎসবে যোগ দেওয়া বিলাসিতা মাত্র। কেননা সেই ‘রোজ’-এর ওপরেই নির্ভর করে একটি শ্রমিক পরিবারের প্রতিদিনের অস্তিত্ব।
তাই এই পরিচিতি-পুস্তিকার ভূমিকায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়, আর তা অনুসরণ করে আসে সিদ্ধান্তও, ‘তাদের (শ্রমজীবী) দৈনন্দিন জীবন যাপনের সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে কোন রকমের কোন ভূমিকা কি সাহিত্য রাখতে পেরেছে? ক্রমাগত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের চেতনাপূর্তির জন্য সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎপাদন ঘটে চলেছে, শ্রমজীবী মানুষের চিন্তাচেতনাকে সামন্তবাদী-সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির হাতে সঁপে দিয়ে। এমনকি প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মীরাও এই দোষে বোধহয় দুষ্ট।’
ঠিক কী চায় এই উৎসব? সাহিত্যের স্বরূপ সম্পর্কে তার ধারণাটি ঠিক কী?
পরিচিতি-পুস্তিকার শরণ নেওয়া যাক, ‘এই সময়ে দাঁড়িয়ে শ্রেণি রাজনীতির সাহিত্য, শ্রেণি সংগ্রামের সাহিত্য উৎপাদনের ও প্রচারের প্রয়োজন বলে আমরা মনে করছি, যেখানে স্পষ্টতা থাকবে, দিশা থাকবে, শোষণ যন্ত্র ও ফ্যাসিবাদকে চিহ্নিত করার, ধ্বংস করার মালমসলা থাকবে। অত্যাচারিত হয়ে কাঁদুনি গাওয়া আর রাষ্ট্রীয় যুক্তিকাঠামোয় উঞ্ছবৃত্তি করে আত্মপরিচয় ভিত্তিক খোপে সমস্যাগুলি ঢুকিয়ে প্রবঞ্চনা করার ফাঁদ থেকে আমাদেরও বেরোতে হবে-’।
এবং, ‘সাহিত্য জনতার মুখে বিদ্রোহের হাতিয়ার হয়ে উঠুক, এই ফ্যাসিবাদী লক্ষণে মোড়া সমাজকে ধাক্কা দিক, এই আকাঙ্ক্ষা রয়েছে আমাদের।’
গত ২০ মার্চ শ্যামবাজারের বীরেন্দ্র মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল চতুর্থ জনতার সাহিত্য উৎসব। ২০১৮ থেকে প্রতি বছর দু’দিন ধরে হয়ে চলেছে এই উৎসব। এবছর করোনা অতিমারীর কারণে কর্মসূচি ছিল এক দিনের। আয়োজক, বস্তার সলিডারিটি নেটওয়ার্ক (কলকাতা)।
এ বছর শুরুর কথা ও সদ্য প্রয়াত তরুণ গণ-সাংস্কৃতিক কর্মী রাজা বিশ্বাসকে স্মরণ করে শুরু হয় উৎসব। ‘বস্তার সলিডারিটি নেটওয়ার্ক (কলকাতা)’-এর সদস্য না হয়েও শুরু থেকেই রাজা বিশ্বাস এই উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এ বছর তাঁকে অকালে হারানোর গভীর বেদনা লেগে রইলো উৎসবের অঙ্গে।
‘লাল লণ্ঠন’ পরিবেশন করে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘আমরা তো ভুলি নাই শহিদ- এ কথা ভুলবো না, তোমার কল্জার খুনে রাঙাইল কে আন্ধার জেলখানা…’ উদ্বোধনী সঙ্গীত। ১৯৫০ সালে এক কৃষক শহিদের স্মৃতিতে এই গান রচিত হয় বলে জানিয়েছেন সলিল চৌধুরী। উৎসবের মূল সুরের সঙ্গে মিশে যায় গান। কেননা কারাগারের সাহিত্য, কৃষক আন্দোলনের সাহিত্য ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাহিত্য ছিল উৎসবের আলোচনার বিষয়।
‘গারদের আঁধার ফুঁড়ে’ শিরোনামে আলোচিত হয় কারাগারের সাহিত্য। আলোচক নীলাঞ্জন দত্ত, রূপেশ কুমার সিং এবং কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। সংযোজনায় ছিলেন প্রবুদ্ধ ঘোষ। কারা-সাহিত্য বিষয়ে সংযোজকের ঋদ্ধ আলোচনা সমৃদ্ধ করে শ্রোতাদের।
ঝাড়খণ্ডের প্রগতিশীল সাংবাদিক রূপেশ কুমার তাঁর জেল জীবনের অভিজ্ঞতা লিখেছেন ‘কয়েদখানার আয়না’ গ্রন্থে। তাঁর বক্তব্যে জানা যায় বিহারের জেলে লেখা-পড়া করা নিষিদ্ধ। কর্তৃপক্ষ মনে করে জেলের মধ্যে কাগজ-কলম ঢোকা মানেই বন্দির জেল-পালানোর ছক। তিনি এক সহবন্দির কথা উল্লেখ করেন যিনি সাতাশ- আঠাশটা গান রচনা করেছিলেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের রোষ থেকে বাঁচতে সেসব গান কোথাও লিখে না রেখে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। জনতার সাংবাদিক রূপেশ সাংবাদিকের দায়িত্ব বিষয়েও কথা বলেন। তাঁর মতে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকরাই জন জীবনের আসল তথ্য তুলে আনার সাহস দেখান। সেই সাংবাদিকতার জন্যই ২০১৯ সালে মিথ্যে মামলায় ছ’মাস জেল খাটতে বাধ্য হন রূপেশ।
কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোচনায় উঠে আসে তাঁর সত্তরের দশকের জেল জীবনের নানান অভিজ্ঞতা। কখনও যৌনকর্মীর কাছে উপকৃত হওয়া, কখনও তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর অত্যন্ত অত্যাচারী পুলিসের হাত থেকেও রেহাই পাওয়া, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নকশাল হিসেবে শ্রদ্ধা পাওয়া ইত্যাদি নানান ঘটনার কথা তাঁর আলোচনা থেকে জানতে পারেন শ্রোতা। নারী জীবনের খুব স্বাভাবিক ঘটনা ঋতুস্রাব ঘটত বন্দি মেয়েদের জীবনেও। জেল জীবনে রাষ্ট্রের নৃশংসতা কতটা হতে পারে ঋতুস্রাবকালে টের পেতেন মেয়েরা। এই সময় বন্দি মেয়েরা নোংরা ছেঁড়া চটের বস্তা ব্যবহার করতে বাধ্য হতেন। তবু জেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে পরিষ্কার কাপড় বরাদ্দ করে মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষার প্রাথমিক তাগিদটুকুও দেখা যেত না।
কল্যাণী ভট্টাচার্যের অধুনা দুষ্প্রাপ্য বই ‘জীবন অধ্যয়ন’ নিয়ে আলোচনা করেন নীলাঞ্জন দত্ত যেখানে লেখিকা পাঁচের দশকে তাঁর জেল জীবনের সহবন্দিদের ওপর অত্যাচার, বন্দিদের মুক্তির স্বপ্ন প্রভৃতি উল্লেখ করেছেন। রাজনীতি সচেতন কল্যাণী নিজের কথা না লিখে অন্যান্যদের কথা লিখেছেন। আলোচক নীলাঞ্জন দত্ত মনে করেন বইটির পুনর্প্রকাশ জরুরি।
‘কাস্তেটা শান দিও বন্ধু’ শীর্ষক আলোচনার গতিমুখ ছিল সাহিত্যে কৃষক আন্দোলন বিষয়ে। আলোচক ছিলেন ওড়িশার কবি লেনিন কুমার, পশ্চিমবঙ্গের লেখক সুপ্রিয় চৌধুরী ও লুৎফর রহমান। এই বিভাগের সংযোজক মানস ঘোষ। কিন্তু লেনিন কুমার ছাড়া কেউই কৃষক আন্দোলনের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও বর্তমান নিয়ে তেমন কিছুই উল্লেখ করলেন না। বরং ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির আনন্দ-ক্ষোভ, আক্রমণ- প্রতি আক্রমণই মুখ্য হয়ে উঠল। ব্যক্তিগত ক্ষোভ হয়তো খুবই প্রাসঙ্গিক। সে বিষয়ে আলোচনাও জরুরি। কিন্তু তার থেকেও বোধহয় জরুরি ছিল দিল্লির চলমান কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কৃষক আন্দোলনের অতীত-বর্তমান খুঁড়ে দেখা। এই বিভাগের আলোচনার বিষয় থেকে তাই দৃষ্টিকটুভাবেই সরে গেলেন কয়েকজন আলোচক।
আলোচনার শেষে দর্শক আসন থেকে কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন, সাহিত্যের আলোচনায় মেয়েদের কথা সেভাবে আসে না কেন? আলোচকরা এই সত্য মেনে নেন।
দর্শক আসন থেকেই সব্যসাচী দেব সাবিত্রী রায়ের ‘পাকা ধানের গান’ উপন্যাসের কথা উল্লেখ করেন। বোঝা যায় বাঙালি আলোচকদের কেউই এ উপন্যাসের কথা শোনেননি। অথচ ‘সাহিত্যে কৃষক আন্দোলন’ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে হাজং বিদ্রোহের পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাসটির কথা জানা অত্যন্ত জরুরি। উপন্যাসে পাহাড়পুরের সাধারণ মানুষের জমিদারের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধের কাহিনি লেখেন সাবিত্রী। উপন্যাসের নায়ক পার্থ হাজং জনগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে কৃষক বিদ্রোহের শরিক হয়ে মিলিটারির গুলিতে শহিদ হয়।
কোনও রাজনৈতিক বৃত্তেই মেয়েদের সমস্যা-সম্ভাবনা যথোচিত গুরুত্ব পায় না, সে বৃত্ত প্রগতিশীল হলেও। মূল ধারার সাহিত্য ক্ষেত্রে পুরুষ সাহিত্যিকের আধিক্য। সমান্তরাল সাহিত্য ক্ষেত্র বলে প্রায় কিছু নেই। যদি হয়ও সেখানেও মেয়েরা কতটা প্রাধান্য পাবেন জানা নেই। যে পার্টির আদর্শে আপ্রাণ কাজ করেছেন সাবিত্রী রায়, সেই কমিউনিস্ট পার্টিই ‘স্বরলিপি’ (১৯৫২) উপন্যাসে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বের কাহিনি লেখার অপরাধে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তাঁর লেখা। আজও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি অন্তরালেই থেকে গেছেন।
এরপর আলোকচিত্র শিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক রনি সেন ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শিল্প ও শিল্পী’ শিরোনামে নিজের ও বিদেশি ক’জন বিখ্যাত মহিলা আলোকচিত্রীর ফ্যাসিবাদ বিরোধী কাজ প্রদর্শন করেন। সেসব আলোকচিত্র দেখার পর ফ্যাসিবাদের চরিত্র নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
দিল্লির চলমান কৃষক আন্দোলনের ময়দান থেকে উৎসবে যোগ দেওয়া অতিথিরা বিপ্লবের গান পরিবেশন করেন ‘সংগ্রামের সুর’ বিভাগে। নিক্কি, অঙ্কিত, অর্পণ, নওদীপ কৌর সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় ‘লাল লণ্ঠন’ও।
নওদীপ কৌর-এর বিষয়ে নতুন করে বলবার অপেক্ষা রাখে না। গত জানুয়ারি মাসে দিল্লির কৃষক আন্দোলনকে সমর্থনের জেরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। দেশ বিদেশের বহু বিশিষ্টজন থেকে সাধারণ মানুষ গ্রেফতারের বিরোধিতা করেন। দেড় মাস বন্দি থাকার পর ছাড়া পান নওদীপ। তিনি গান পরিবেশনের পাশাপাশি সাহিত্য উৎসবের আলোচনাতেও যোগ দেন, যার শিরোনাম ছিল ‘এক গুচ্ছ বুলেটপ্রুফ কবিতা’। এই বিভাগে নওদীপের সঙ্গে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাহিত্য বিষয়ে আলোচক ছিলেন সাদিক হোসেন, অভিষেক ঝা। সংযোজক ছিলেন অরিত্র।
সংযোজক পিনদ্ধ আলোচনায় এগিয়ে নিয়ে যান আলোচনার গতিমুখ। সাদিক হোসেন তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন কীভাবে দৈনন্দিন যাপনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ আমাদের জীবনে হানা দেয়। তিনি উল্লেখ করেন, স্কুলে গিয়ে ‘পানি’ বা ‘গোস্’ না বলে ‘জল’ ও ‘মাংস’ বলা শেখানো হয় তাঁকে। যেন নিজেদের অস্তিত্ব লুকিয়ে রাখার মহড়া চলে। তিনি নিজের মেয়েকে না শেখালেও মেয়েও কী করে যেন শিখে যায় স্কুলে গিয়ে ‘পানি’ বা ‘গোস্’ বলা নিষেধ। ‘ফ্যাসিবাদ আমরা চর্চা করি সিনেমা দেখতে গিয়ে জাতীয় সংগীতের সময় বাধ্যতামূলক উঠে দাঁড়িয়ে’, বলেন তিনি। অর্থাৎ এক ফ্যাসিবাদী আবহের মধ্যেই আমরা জন্ম নিই, বেড়ে উঠি। তাঁর সিদ্ধান্ত, এই প্রবণতারই প্রতিবাদ করতে হবে।
অভিষেক ঝা জোর দিয়ে জানান, ‘একটি গ্রামের ব্রাহ্মণ সন্তান এবং দলিত বা মুসলিম সন্তানের সঙ্গে কোনও তুলনা হয় না। …আমার নাক উঁচু ব্রাহ্মণ্যবাদিতা আমাকে অনেক দিন পর্যন্ত মনে করিয়ে রেখেছিল বাঙালি সংস্কৃতি জানতে গেলে রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, লীলা মজুমদার জানতে হবে। এর বাইরে বিশাল এক বাঙালি সংস্কৃতির জগত পড়ে আছে, যা আমি জানি না।’
তিনি উল্লেখ করেন বাংলা সাহিত্য চর্চার যে সব নিয়মনীতি আছে তার ভেতরেই আছে ফ্যাসিবাদের চর্চা। অনেক শব্দ আছে যা ‘মান্য ভাষায়’ নিষিদ্ধ। সেরকমই একটি শব্দ লেখায় ব্যবহার করতে তাঁর সাতাশ বছর লেগে গিয়েছিল। মালদা জেলার তিস্তা চরের যে গ্রামের স্কুলে তিনি পড়ান সেখানে অধিকাংশই নিম্ন বর্গের শিক্ষার্থী। ক্লাস ইলেভেনের শিক্ষার্থীদের (যাদের ৯০% রাজবংশি বা রাজবংশি মুসলিম ) তিনি দু’পাতা সাহিত্য পড়তে দিয়েছিলেন, একটি সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখা, অন্যটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা। তিনি আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করেন শিক্ষার্থীরা, যাদের পৃথিবী একেবারেই ভিন্ন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পাতার সঙ্গে একাত্ম বোধ করছে এবং সুচিত্রা ভট্টাচার্যের পাতার থেকে সহজ মনে করছে। অথচ প্রচলিত ধারণায় সহজ-কঠিনের মানদণ্ড ঠিক উল্টো।
তিনি আরও জানান, ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করার জন্য যে ন্যারেটোলজি প্রয়োজন সেই ন্যারেটোলজি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ক্ষেত্রে। তাঁর মতে, প্রত্যেকটি ‘মি টু’ ন্যারেটিভ ফ্যাসিবাদ বিরোধী ন্যারেটোলজির আশ্চর্য উদাহরণ। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ন্যারেটিভ রিয়ালিস্ট হবে সেই ভাবনা থেকেও সরে আসার কথা বলেন তিনি। কারণ রিয়ালিস্ট ভাবনাই ফ্যাসিবাদের অস্ত্র। তাই তাকে সম্ভাব্য সমস্ত ন্যারেটিভ সে ভূত, ওঝা যা-ই হোক সব দিয়েই প্রতিহত করার চেষ্টা করতে হবে।
এই আলোচনায় নওদীপ কৌর বলেন, ‘যে ভাবেই ফ্যাসিবাদ আসুক তা গণতন্ত্রের ক্ষতি করে। দেশে পুঁজিপতিদের জন্যই আইন হয় যা জনতা বিরোধী। জনতা এর বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বললে শোনা হয় না। এভাবে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু তার ক্ষতি করা হচ্ছে। যে আইন জনতা বিরোধী তা কোনভাবেই তৈরি হতে পারে না। ফ্যাসিবাদ এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে যে আমাদের কণ্ঠ রোধ করে দিচ্ছে।‘
তিনি আরও বলেন, ‘লোকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনারা দুজনেই (দিশা রবি ও নওদীপ) জেলে ছিলেন। দিশা রবি কথা বলছে ঠিক আছে, আপনি কেন কথা বলছেন? উঁচু শ্রেণির লোকজনের ভয় থাকে যে কথা বললে সমস্যার উদয় হবে। নিজেদের বাঁচানোর জন্য তারা কথা বলতে চায় না। কিন্তু শ্রমিকরা তো এমনিই মৃত, তাকে যখন জেলে বন্দি করা হয় তখন সে আরও শক্তি সংগ্রহ করে জেল থেকে বেরিয়ে আসে। আমাদের কাছে একটাই রাস্তা, হয় মরে যাও না হয় মুখ খোলো। … সব মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা আছে, বুদ্ধি আছে, আছে প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব রাজনীতি। আমরা প্রতিবাদ করবো রাষ্ট্র যাই করুক না কেন। মৃত্যু বার বার নয়, একবারই আসে। মৃত্যু পালকের মতো হালকা এবং লোহার মতো ভারি। আমরা ভারি মৃত্যুকেই বরণ করে নেব। আমাদের মধ্যে মার্ক্স- মাও-লেনিন-ভগত সিং-চারু মজুমদার আছেন। তাঁদের নকশালবাদী, আতঙ্কবাদী, মাওবাদী- যাই বলা হোক না কেন; তাঁরা আজও আমাদের মধ্যে জীবিত আছেন, অমর হয়ে আছেন। এজন্যই আমরা লড়ে যাব।’
সাহিত্যের দুই পন্থা। এক, লিখিত, আরেকটি মৌখিক। মৌখিক সাহিত্য সব সময় ‘চাষাভুষার’, অমার্জিতের সাহিত্য আখ্যা পেয়েছে যা ফ্যাসিবাদের এক চরিত্র। মৌখিক সাহিত্যর সঙ্গে সেই ‘জনতা’ জড়িয়ে আছে যে জনতাকে ছুঁতে চায় এই উৎসব। সাহিত্য উৎসব শুধু লিখিত সাহিত্যে সীমাবদ্ধ থাকলে একটা শ্রেণিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাই মৌখিক সাহিত্য-সংস্কৃতিকেও এই মঞ্চে উপস্থিত করার কথাও ভাবতে পারেন আয়োজকরা।
শুধু অভিষেক ঝা'র বক্তব্যে নতুন ভাবনার রসদ পেলাম।