আলবেয়ার কামু তাঁর রূপকধর্মী ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ফ্যাসিবাদ আসলে একটা ভাইরাস, এমন একটা বিষ যা মানুষের মধ্যে সর্বাত্মক ভাবে গোঁড়ামি, বশ্যতা, ভীরুতা এবং প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে নির্বিবাদে মানিয়ে চলা, বা ‘চলতা হ্যায়’ মানসিকতাকে, মান্যতা দেয় এবং শুধু তাই নয় সেটাকে উৎসাহিত করে। সেই অর্থে এখন আমাদের দেশ দুটি ভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত। একটি সার্স-কোভ-২ যা জীববৈজ্ঞানিক, দ্বিতীয়টি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মান্ধ কর্পোরেট ফ্যাসিবাদ, যা মতাদর্শগত। দুটি কীট পরস্পরের শক্তি বৃদ্ধি করে। যেমনটা হয়েছিলো প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরেই জার্মানিতে যখন দেশটা পরাজয়ের গ্লানি এবং শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ধুঁকছিল। এরই মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো এসে পড়ে ১৯১৮র স্প্যানিশ ফ্লু। বিশ্বব্যাপী এই মারির মারাত্মক দংশনের ফলে দু বছরের মধ্যে তিন লক্ষ জার্মান মারা গেলেন। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর আমাদের দেশে(জনসংখ্যা ১৩৮ কোটি) দেড় বছরে দুই লক্ষ মানুষ মারা গেছেন। জার্মানির সাত কোটি জনসংখ্যার তিন লক্ষ মারিতে, এর সঙ্গে যদি যুদ্ধে যে সতেরো লক্ষ মারা গিয়েছিলো সেটা যোগ হয়, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না অবস্থাটা কতটা ভয়াবহ ছিল। ১৯১৯-এ হিটলার ছিলেন জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির এক সাধারণ সদস্য যিনি তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতার কারণে ঘনিষ্ঠ বৃত্তে জনপ্রিয়তা অর্জন করছিলেন। পরবর্তী দশ বছর তিনি শুধু মানুষ খেপিয়েছেন। তাঁর সমস্ত বক্তব্যের সার কথা উগ্র বিকৃত দেশপ্রেম এবং বিষাক্ত ইহুদি-বিদ্বেষ। ১৯২৪-এর নির্বাচনে তাঁর দল মাত্র ৩% ভোট পেয়েছিল, সেটাই ১৯৩০ এর নির্বাচনে হয়ে দাঁড়াল ১৮%, বাকিটা ইতিহাস!
নিউইয়র্কের ফেডারাল রিজার্ভ ব্যাংকের একটা সমীক্ষা বলছে স্প্যানিশ ফ্লুতে মৃত্যুর সাথে দক্ষিণপন্থী মৌলবাদীদের ভোটের হার বৃদ্ধির একটা সংযোগ আছে। ঐতিহাসিক ভাবে যে সমস্ত জায়গায় মধ্যযুগের প্লেগের সময় ইহুদিদের বলির পাঁঠা করা হতো, সেই সব জায়গায় এই সব দলগুলির বাড়বাড়ন্ত লক্ষ্য করা গেছে। নাৎসিরা এই সব জায়গায় বিদ্বেষ ও ভয়ের চাষ করেছে এবং ‘অপর’ এর সম্পর্কে বিবমিষা সৃষ্টি করতে সফল হয়েছে। অথচ জার্মানরা ছিল শিক্ষিত এবং কৃষ্টি, সংস্কৃতিতেও তাঁরা ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে কোনও অংশেই কম ছিল না। একই সাথে সেই রিফর্মেশনের সময় থেকে তাঁদের একটা ইহুদি বিরোধিতার অস্বস্তিকর ইতিহাসও আছে। এই কারণে অধ্যাপক ও ছাত্রদেরও স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে ইহুদি-নিধন এবং বই পোড়ানোতে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে।
যে কোনও মহামারির শুরুতে শাসকের প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় সেটাকে উপেক্ষা করা, সেটার বাস্তবতাকেই অস্বীকার করা। আলজেরিয়ার সেই শহর ওরানে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের পর সেখানের প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া স্মরণ করুন। এর সাথে তুলনা করুন আমাদের দেশের নেতাদের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সাথে। ৭ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ হর্ষ বর্ধন ঘোষণা করছেন যে আমরা অতিমারির শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি; ৩০ মার্চ বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে; ২৭ এপ্রিল বলছেন সরকার মারির মোকাবিলায় শারীরিক ও মানসিক ভাবে অনেক বেশি প্রস্তুত, সারা দেশে যখন খোলা আকাশের নীচে লাইন দিয়ে চুল্লি জ্বলছে তখন নির্লজ্জ ভাবে মিথ্যা বলছেন যে বেড, অক্সিজেন, ওষুধের কোনও অভাব নেই; ২৯ এপ্রিল গর্ব করছেন মৃত্যুহার সারা বিশ্বে ভারতেই সবচেয়ে কম (১.১১%); পরের দিন আবার গর্ব করছেন যে ২.৬৯ লক্ষ মানুষ আরোগ্য লাভ করেছে, ২.২৮ কোটি মানুষ টীকাকরণের জন্য নাম লিখিয়েছে এবং আবারও নির্লজ্জ ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে কোনও রাজ্য সরকারের কাছে টীকা মজুত নেই। এর সাথে আছে হিমালয়সম দম্ভ, স্বেচ্ছাচারিতা এবং হিরো সাজবার উদগ্র বাসনা। ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বের কাছে ত্রাতা সাজলেন। নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘোষণা করলেন যে, ভারত বহু দেশকে টীকা সরবরাহ করে পৃথিবীকে সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করেছে। তিন মাসের মধ্যে দেখা গেলো টীকার অভাব এতোই প্রকট যে নিজের দেশের বরিষ্ঠ নাগরিকদেরই দু ডোজ দিতে পারা যাচ্ছে না। তিনি এতোই বেপরোয়া, বাংলার মসনদ দখলে এতোই মত্ত যে ১৭ এপ্রিল যখন কোভিড ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তখনো নির্বাচনী সভায় সদম্ভে দাবি করলেন যে এতো মানুষ এর আগে কোনও সভায় তিনি দেখেননি। এই একই সময়ে মারির ভয়ঙ্করতা অগ্রাহ্য করে বিজেপির খবরদারির কারণে যে নির্বাচন চার দফায় শেষ হয় তা টেনে নিয়ে যাওয়া হল আট দফা অবধি। এর ফল এই ভোটপর্বের মধ্যেই বাংলায় সংক্রমণ উল্কার গতিতে ৭৫% বৃদ্ধি পেল।
কোভিড এবং ফ্যাসিবাদ দুটোই ভয় উদ্রেক করে যা সমাজে ওরান শহরের ইঁদুরগুলির মতো তিরতির করে ছড়িয়ে পড়ে। সংক্রমণের ভয়, শাসকের সর্বনাশা, মানুষমারা রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ভয়। সংক্রমণের ভয়ে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়ে, পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, রোগে আক্রান্ত অতি পরিচিত একটি মানুষও তাঁর কাছে অস্পৃশ্য হয়ে পড়ে। সমাজের সংঘবদ্ধতাই হারিয়ে যেতে থাকে, প্রত্যেকে নিজের অজান্তে নিজেকে বাঁচাতেই মগ্ন হয়ে পড়ে। আমরা প্রত্যেকেই হয়ে যাই আলাদা আলাদা দ্বীপ। এই সুযোগটাই অন্য ভাইরাসটি নেয়। ফ্যাসিবাদ আমাদের বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নেয়। তারা মহামারির সুযোগ নিয়ে নিজেদের ক্ষমতা আরও সুরক্ষিত ও দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করে ও হিন্দু কর্পোরেট রাষ্ট্রের পথ সুগম করে। তারা ১২৫ বছরের একটা পুরানো আইন ইতিহাসের গর্ভ থেকে তুলে আনে যা মহামারি রোধ করার ধুয়ো তুলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে মানুষকে দমন করার লাগামছাড়া ক্ষমতা অর্পণ করে। এর ফলে মারির শুরু থেকেই মানুষের মনে ভয় গেড়ে বসে এবং ফ্যাসিবাদ তার অ্যাজেন্ডা পূরণ করার কাজ শুরু করে দেয়। নতুন শ্রম কোড আসে, ইআইএ (এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) খসড়া প্রস্তুত হয়, ব্যাংক, বিমা, রেল, বিমানবন্দর বেচে দেওয়া শুরু হয়, তিনটি কৃষি বিল এনে পুরো কৃষিক্ষেত্রটাই কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। লাভ জিহাদ এর ধুয়ো তুলে সমাজকে আরও বিভাজিত করা হয় এবং মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে রুদ্ধ করার জন্য ভয় ছড়ানো হয়। ভিমা কোরেগাঁও কেসে আনন্দ তেলতুম্বে, গৌতম নাভলাখা, স্ট্যান স্বামীর মতো গবেষক, সমাজকর্মীদের ভুয়ো, মনগড়া অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। মামুলি একটা টুলকিট ব্যবহার করার জন্য দিশা রভিকে ব্যাঙ্গালোর থেকে উড়িয়ে দিল্লি নিয়ে আসা হয়। বিভিন্ন রাজ্যে বিনা কারণে, বিনা ওয়ারেন্টে যে কাউকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। এসব কিছুই করা হয় ঐ ভয় সংক্রামিত করার জন্য; যদি বাড়াবাড়ি করো তাহলে তোমাকেও...
সেই নব্বইয়ের দশকে আঙ সান সু চি লিখেছিলেন ‘ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার’। ভয় থেকে মুক্তি, কারণ এই ভয়ের কারণে মানুষ স্বৈরাচারী শাসকের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে, মেরুদন্ডহীন প্রাণীতে পরিণত হয়। এই ভয় সমাজে সঞ্চারিত করার জন্য শাসক সংবাদমাধ্যমকে নির্মম ভাবে দমন করে। ‘রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস’ জানাচ্ছে যে কোভিড অতিমারির অজুহাত তুলে বিশ্বব্যাপি তথ্যের অধিকার খর্ব করা হয়েছে এবং খবর সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তাঁদের তথ্য বলছে ৭৩টি দেশে সাংবাদিকতা প্রায় স্তব্ধ, এবং ৫৯টি দেশে বাধাপ্রাপ্ত। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকার অন্তিম বছরে সাংবাদিকদের ওপর অন্তত ৪০০টি হামলা হয়েছে, যা সর্বকালীন রেকর্ড, এবং ১৩০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। ইরানে মারিতে মৃত্যুর সংখ্যা যাচাই করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আনা হয়েছে। হাঙ্গেরিতে ভুয়ো খবর বন্ধ করার অছিলায় প্রচলিত সাংবাদিকতাকে দণ্ডনীয় করা হয়েছে। মিশরে সরকার প্রদত্ত মারি-সংক্রান্ত তথ্য ছাড়া আর যে কোনও সূত্র থেকে তথ্য প্রকাশনা বেআইনি ঘোষিত হয়েছে। হাথরসে শুধুমাত্র সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়ার জন্য কাপ্পান সিদ্দিকিকে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁর ওপর কুখ্যাত ইউএপিএ ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে। পা চাটা গোদি মিডিয়া এবং ফেক নিউজ কারখানা সরকারের যে কোনও দমনমূলক পদক্ষেপকে সোল্লাসে বৈধতা দিচ্ছে। সবাইকে নির্বিচারে দেশদ্রোহী, পাকিস্তানি, সন্ত্রাসবাদী ইত্যাদি তকমা লাগাচ্ছে, মিডিয়া ট্রায়াল করে এঁদের দোষী ঘোষণা করছে। কিছু মানুষ এতে অবশ্যই প্রভাবিত হচ্ছে কিন্তু বিপুল সংখ্যক তাদের প্রকট মিথ্যাচার ধরে ফেলছে। বাংলার নির্বাচনে তারা বিধ্বস্ত, কেরালা ও তামিলনাড়ুতে গোল্লা, উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তারা হামাগুড়ি দিয়েছে। এর ওপর যত দিন যাচ্ছে কোভিড ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। দেশে বিদেশে ছাপান্ন ইঞ্চির ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত। গোদি মিডিয়া এখন মরিয়া প্রধানমন্ত্রীকে এর থেকে রক্ষা করতে। তারা রাজ্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছে, আমলাদের দায়ী করছে, বাংলায় নির্বাচনোত্তর হিংসাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
কামু ‘কমব্যাট’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন যা ফ্রান্সে নাৎসি দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলো। নাৎসিরা তখন নির্মম। প্রতিবাদকারীদের খুঁজে বার করার জন্য একটা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। অন্যত্র শহরের মেয়র এবং দুজন সভ্রান্ত নাগরিককে গুলি করে মারে। কামু লিখলেন এই মানুষগুলো তো সহজেই বলতে পারতেন, না বাবা আমরা এইসবে নেই। কিংবা আমি তোমাদের সমর্থন করি, বা তোমাদের সহমর্মী কিন্তু এইসব ঘটনার থেকে আমি শতহস্ত দূরে। কাপ্পান সিদ্দিকি তো বলতেই পারতেন যে হাথরসের মেয়েটির জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমি এসবে নেই। কামু বলছেন তুমি যদি সহমর্মীও হও সেটার জন্যও তুমি খুন হতে পারো, নির্যাতিত হতে পারো, যেন তুমি একজন জঙ্গি। সক্রিয় হও। তোমার ঝুঁকি এতটুকু বাড়বে না, বরঞ্চ তুমি মুক্ত বিহঙ্গের মতো কারাগারে যেতে পারবে। কামু সত্যের দুর্নিবার ক্ষমতার ওপর আস্থা রাখতেন। গোয়েবলস কিংবা গোদি মিডিয়ার মতন একটা মিথ্যা লক্ষ বার বললে সেটার নিশ্চয়ই প্রভাব আছে কিন্তু কয়েকজন মানুষও যদি সত্যটা বারবার তুলে ধরে তাহলে সেই মিথ্যাচার মুছে দিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। তিনি চোরাগোপ্তা সাংবাদিকতার (clandestine journalism) জয়গান গাইছেন, বলছেন এটা সম্মানজনক কারণ এতে ঝুঁকি আছে, এমনকি এও বলছেন যে এটা শুভ এবং স্বাস্থ্যকর যে আজকের রাজনৈতিক বাতাবরণ বিপজ্জনক হয়ে গেছে।
।অবশ্যই সবাইকে পড়তে হবে! অসাধারণ বিশ্লেষণ, এই সময়ের, এই সমাজের ! বাহ্ !!
সমসাময়িক সময়ের সুগভীর বিশ্লেষন
একদম ঠিক। এই মোদী বারবার নানারকম ফন্দী এঁটে এমন কিছু ঘোষণা দেশের সামনে জারি করে যার ফলে মানুষ মূল সমস্যা থেকে সরে গিয়ে অর্থহীন কিছু বিষয় নিয়ে মেতে ওঠে। আর মোদী তার চ্যালা চামুণ্ডাদের নিয়ে দেশের সর্বনাশের দিকে আবার জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই প্রধানমন্ত্রী এবং এই দূষিত দলটাকে কে অতিসত্বর নস্যাত্ করা অত্যন্ত জরুরী।