আমাদের দেশে লাভ অত্যন্ত পলিটিকাল, সদ্য সমাপ্ত কান চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর ফিচার ছবি ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ সম্পর্কে চিত্র পরিচালক পায়েল কাপাডিয়া এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেন। পারিবারিক বাধা বিপত্তি আছে, এছাড়া জাতপাত, ধর্ম ইত্যাদি তো আছেই, তিনি ব্যাখ্যা করেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সাম্প্রতিক ভারতে তাঁর এই কথাটা ভয়ঙ্কর ভাবে সত্যি। ‘লাভ জিহাদ’ শব্দবন্ধটি এক দশক আগেও আমাদের কাছে অপরিচিত ছিল। কত মানুষ এর বলি হল, কত সম্পর্ক অকালে নষ্ট হয়ে গেল, পড়শিদের মধ্যে, সহপাঠীদের মধ্যে, অফিস কলিগদের মধ্যে কত অদৃশ্য, অনতিক্রম্য দেয়াল খাড়া হয়ে গেল। এর মধ্যে আবার অভিন্ন দেওয়ান বিধি (ইউনিভার্সাল সিভিল কোড) এসে গেল; উত্তরাখন্ডে এখন থেকে বিবাহ তো বটেই, লিভ-ইন সম্পর্কও নিবন্ধীকরণ করতে হয়।
‘অল উই ইমাজিন……’ প্রতিযোগিতায় গ্রাঁ প্রি পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছে। সেই কবে ১৯৪৬ সালে প্রথম কান চলচ্চিত্র উৎসবে চেতন আনন্দের নীচা নগর, যা প্রবাদপ্রতিম রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির ‘দ্য লোয়ার ডেপথ’ অবলম্বনে রচিত, গ্রাঁ প্রি পুরষ্কার জিতেছিল। এর পরে ১৯৫৬য় সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট পুরষ্কার পায় এবং ১৯৮৩তে মৃণাল সেনের ‘খারিজ’ জুরি পুরষ্কার লাভ করে। সেই ১৯৯৪ সালে উৎসবের সেরা ছবির পুরস্কার পাম ডি’অর এর জন্য শাজি কারুণের ছবি ‘স্বয়ম’ নির্বাচিত হয়েছিল। তাই তিন দশক বাদে ওই বিভাগে পুরস্কৃত হয়ে পায়েল কাপাডিয়া উচ্ছসিত হয়ে বলে ওঠেন, এই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য কোন ভারতীয় ছবিকে যেন আর তিরিশ বছর অপেক্ষা না করতে হয়।
মঞ্চে পুরষ্কার গ্রহণ করার পর পরিচালক কলাকুশলীদের এবং বিশেষ করে তাঁর তিন প্রধান অভিনেত্রীর অকুন্ঠ প্রশংসা করেন। কিন্তু যেটা তাৎপর্যপূর্ণ তা হল ‘অ্যাকসেপ্টেন্স স্পিচে’র অন্তিমে তিনি যে কর্মীরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এই উৎসব সাফল্যমন্ডিত করেছেন তাঁদের ধন্যবাদ জানান, সর্বোপরি তাঁদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানান। প্রসঙ্গত উৎসবের শুরু থেকেই কর্মরত শ্রমিকদের সংগঠন যার নাম, ‘দ্য পভার্টি বিহাইন্ড দ্য সিনস্’ দুটি মূল দাবীতে আন্দোলন করেছেন ---- কাজের সময় বেড়ে যাওয়ার সাথে সঙ্গতি রেখে পারিশ্রমিক বৃদ্ধি এবং তাঁদের ঠিকা বিনোদন কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি।
পায়েল কাপাডিয়ার ছবিতেও এই রাজনৈতিক সচেতনতার আভাস পাওয়া যায়। তাঁর ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল রাজনীতি আর ব্যক্তিগত জীবন সমান্তরাল ভাবে চলে, এমনও মনে হতে পারে যেন দুটো ভিন্ন কাহিনি। রাজনীতি বলতে দলীয় মিটিং, মিছিল নয়, কোন ইস্যু, বিক্ষোভ, প্রতিবাদকে পূর্বনির্ধারিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা নয়, নির্মোহ ভাবে বৃহত্তর ও ব্যক্তিগত পরিসর কে ফুটিয়ে তোলা। পায়েল আগেও কান উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন, পুরষ্কার জিতেছেন। ২০১৭ সালে তাঁর ‘আফটারনুন ক্লাউডস’ একমাত্র ভারতীয় ছবি যা উৎসবে নির্বাচিত হয়েছিল। ২০২১ সালে তাঁর তথ্যচিত্র ‘আ নাইট অফ নোইং নাথিং’ সেরা ডকুমেন্টারি ছবির জন্য ‘গোল্ডেন আই’ পুরষ্কার পায়। এই ছবিতে ২০১৫ সালে FTII এ মহাভারত-খ্যাত গজেন্দ্র চৌহানকে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ করার প্রতিবাদে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা দেখান হয়েছে। প্রসঙ্গত পরিচালক নিজে এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন যার জন্য তিনি প্রায় সাড়ে চার মাস ক্লাস বয়কট করেছিলেন এবং তাঁর অনুদানও বন্ধ হয়ে গেছিল। ছাত্রদের এই প্রতিবাদ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে এক কলেজের ছাত্রী তার প্রেমিকের অনুপস্থিতি অনুভব করছে। একই চিঠিতে সে লিখছে ক্যাম্পাসে কী হচ্ছে সে বুঝে উঠতে পারছে না, হয়তো স্ট্রাইক করার জন্য তাঁদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। মুসলিম যুবককে চোখ বেঁধে, কোমরে পিস্তল ঠেকিয়ে পুলিশের জিপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, একই সাথে মেয়েটি চিঠিতে তার চারিপাশের বাস্তব, কল্পনা, স্বপ্ন, ফ্যান্টাসি উজাড় করে দিচ্ছে। এই ভাবে পরিচালক পলিটিকাল আর পারসোনালের মধ্যে আন্তসম্পর্ক খুঁজছেন, বোঝার চেষ্টা করছেন।
এমনটা নয় যে পরিচালক রাজনৈতিক ছবি করতেই সিদ্ধহস্ত বা এই ধরনের ছবি করাই তিনি মনস্থ করেছিলেন। ‘আফটারনুন ক্লাউডস’এ প্রৌঢ়া তাঁর মৃত স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে থাকে, তাকে স্বপ্নে দেখে। তার যুবতী পরিচারিকার প্রণয়ী জাহাজে চাকরি করে, সামান্য সময়ের জন্য তাদের দেখা হয়। দুই নারীই নিঃসঙ্গ! সেই অর্থে রাজনীতি বিবর্জিত ছবি। কিন্তু উত্তাল সময়, ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ তাঁকে নির্লিপ্ত থাকতে দেয় না। রাজনীতি ছবিতে ঢুকে পড়ে, ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বের পাশাপাশি জায়গা করে নেয়।
পুরুষের অনুপস্থিতি ‘অল উই ইমাজিন……’ ছবিতেও ফিরে আসে। এটি মূলত দুই নার্স, প্রভা ও অনুর গল্প। প্রভার স্বামী কয়েক বছর হল বিদেশ চলে গেছে, দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ক্ষীণ। হঠাৎ সে একদিন তার থেকে একটা উপহার পায়, একটি রাইস কুকার যেটা তাদের অভাবী রান্নাঘরে বেমানান। একই সময়ে অনু তার প্রণয়ীর সঙ্গে একান্তে সময় কাটানর জন্য একটা ডেরা খোঁজে। প্রভা তাকে ছোট বোনের মতো আগলে রাখতে চায়, নিয়ন্ত্রণ করে। মুম্বাই শহরের কঠিন কঠোর পরিবেশে তাদের গল্প আবর্তিত হয়, শহরটাই কাহিনির একটা চরিত্র হয়ে ওঠে। আখ্যানের তৃতীয় প্রধান চরিত্র পার্বতী যার স্বামী কাপড়ের মিলে কাজ করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে শহরের সব মিল বন্ধ হয়ে যায়, পাশ্ববর্তি রত্নাগিরি থেকে শ্রমিকরা আর মুম্বাইয়ে কাজ করতে আসেন না। মুম্বাই আর শ্রমিকদের পীঠস্থান নয়, কয়েক দশকে শহরের চরিত্র পালটে যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর পার্বতীর বাসস্থান হাতছাড়া হয়ে যায়, সেখানে মল, মাল্টিপ্লেক্স গড়ে ওঠে। পার্বতীর আর সেখানে প্রবেশাধিকার নেই, সেখানে প্রবেশ করতে হলে ‘কাগজ’ চাই। পরিচালক সাক্ষাৎকারে এই কাগজের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন, যেন আজকের ভারতে এই কাগজের গুরুত্বের ওপর তিনি দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন।
তিন মূল চরিত্রের সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে তিনি নারীর মধ্যেকার কলহপ্রবণ সম্পর্ক যা আকছার বাজারি সিরিয়ালে দেখা যায় এবং যেটাকে স্বতঃসিদ্ধ ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় সেটার বিপরীতে, ছবিতে একটা ‘সিস্টারহুড’ গড়ে তুলেছেন। পরিচালকের কাছে বন্ধুত্বর গুরুত্ব অসীম; পরিবার তোমাকে বেঁধে রাখে, কিন্তু বন্ধুত্ব তোমাকে সেই বাঁধন থেকে মুক্ত করে, তিনি বলেন।