১২ সেপ্টেম্বর, রাত আটটা ছত্রিশ মিনিটে হায়দ্রাবাদের ‘নিজামস ইন্সটিটিউট অফ মেডিকাল সায়েন্সেস’ হাসপাতালে জি এন সাইবাবা প্রয়াত হলেন। শোনা যাচ্ছে গলব্লাডারে অস্ত্রোপচারের পরবর্তি জটিলতার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আপাত ভাবে এটা একটি স্বাভাবিক মৃত্যু। কিন্তু সত্যিই কি তাই? মাত্র সাত মাস আগে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। দীর্ঘ প্রায় নয় বছরের কারাবাসে নির্মম, অমানুষিক নিপীড়নের কারণে তাঁর প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রায় বিকল হয়ে গেছিল। এটা বিস্ময়কর যে ধারাবাহিক এই যন্ত্রণাভোগের পরেও তিনি জীবিত অবস্থায় মুক্তি পেয়েছিলেন। তাঁর নিজের কথায়, “কারাগারে অমানুষিক নিপীড়নের কারণে আমার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। বারবার চিকিৎসার জন্য আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আমার শরীর আজ এক ধ্বংসাবশেষ মাত্র। আপনাদের সম্মুখে আমি জীবিত কিন্তু আমার অঙ্গপ্রতঙ্গ চুরমার হয়ে গেছে।”
বাল্যকালে পোলিও আক্রান্ত হওয়ার কারণে তিনি বহুলাংশে বিশেষ ভাবে সক্ষম। পুত্রকে শিক্ষিত করার প্রবল তাগিদের কারণে তাঁর মা তাঁকে বহন করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। মন্ডল কমিশন নিয়ে আন্দোলনের সময় তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং পরবর্তি কালে তিনি ‘অল ইন্ডিয়া পিপলস রেসিসস্ট্যান্স ফোরাম’-এর সেক্রেটারি হন। তিনি অপারেশন গ্রিন হান্ট-এর বিরুদ্ধে সরব হন এবং সেটার বিরুদ্ধে সক্রিয় ভাবে প্রচার করেন। এই সময় থেকে তিনি রাষ্ট্রের নজরে পড়েন এবং সরকার তাঁকে মাওবাদী হিসাবে চিহ্নিত করে। প্রায় একই সময়ে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রামলাল আনন্দ কলেজে ইংরাজির অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন।
২০১৪ সালে প্রথম বার যখন তিনি গ্রেপ্তার হন তখন পোলিও ছাড়া তিনি আর কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন না। সেইবার পুলিশ তাঁকে চলন্ত গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করে আটক করেছিল। এরফলে তাঁর বাঁ হাতের রগ ছিঁড়ে যায় এবং কারাগারে এর কোনও চিকিৎসা না হওয়াতে সেটি প্রায় অকেজো হয়ে যায়। সেই শুরু। এরপর থেকে তাঁকে শারীরিক ভাবে বিপর্যস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। একজন মানুষ সামান্য দৈনিক কাজ করার জন্যও যাঁর অন্যের সাহায্য প্রয়োজন হয় তাঁকে বারবার অন্ডা সেলে একাকি বন্দি করে রাখা হয়। এমনকি যে হুইলচেয়ার ছাড়া তাঁর চলাফেরা প্রায় অসম্ভব সেটাও কারাগার কর্তৃপক্ষ তাঁকে মাঝেমধ্যে দিতে অস্বীকার করে।
২০১৭ সালে ইউএপিএর নানা ধারা চাপিয়ে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। তাঁর আইনজীবীর মতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা যাবতীয় অভিযোগ ভুয়ো। পুরো মামলাই সাজানো এবং তাতে বিস্তর ফাঁকফোকর। তদন্তকারী অফিসার তাঁর কেস সাজানোতেও বিশেষ মন দেননি কারণ হয়তো তিনি জানতেন এই মামলার রায় পূর্ব-নির্ধারিত। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রধান প্রমাণ তাঁর কম্পিউটার ও অন্যান্য ডিভাইস থেকে প্রাপ্ত তথ্য। যে সাক্ষীকে আদালতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খাড়া করা হয় তিনি বলেন ডিভাইসগুলো যখন বাজেয়াপ্ত করা হয় তখন তিনি উপস্থিত ছিলেন না। তিনি স্বীকার করেন বাজেয়াপ্ত হওয়া সামগ্রীতে তাঁর সই ছিল না এবং এটাও কবুল করেন যে সাক্ষী দেওয়ার জন্য তাঁকে সতেরো দিন পুলিশের অতিথিশালায় এনে রাখা হয়েছে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার তদন্তকারী অফিসার বলেন যে বাক্সে ডিভাইসগুলি রাখা ছিল তা হারিয়ে গেছে এবং আদালতে পেশ করা যাচ্ছে না। একজন সাক্ষীকে ক্ষেতমজুর বলে আদালতে হাজির করা হয়। অভিযুক্তের আইনজীবী প্রমাণ করে দেন যে তিনি একজন হোমগার্ড যাঁকে বিভিন্ন মামলায় সাক্ষী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আমেরিকার ‘ফ্রী সাইবাবা কোয়ালিশন’ এর অশোক কুম্বামু জানাচ্ছেন শেখান-পড়ান বাইশ জন পুলিশ অফিসারের জবানবন্দীর ভিত্তিতে তাঁকে ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’র জন্য অভিযুক্ত করা হয় এবং মাননীয় বিচারপতি তাঁকে কঠোরতম শাস্তিতে দন্ডিত করেন।
কারাগারে অধ্যাপকের স্বাস্থ্যের উত্তরোত্তর অবনতি হয়। তিনি অন্তত দুবার কোভিডে এবং একবার সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হন। বারবার তাঁর মেডিক্যাল জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়। একটি চিঠিতে তিনি তাঁর ছাত্র ও অন্যান্য শিক্ষকদের লিখছেন, তীব্র ব্যথায় আমার শরীর কেঁপে ওঠে; আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি একে একে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে; আমি কঠিন হৃদরোগে আক্রান্ত; মাঝেমধ্যেই আমার ব্ল্যাকআউট হয়ে যায়, আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি; আমার প্যাঙ্ক্রিয়াটাইটিস আছে; আমার কিডনিতে পাথর জমে গেছে; আমি জীবনের কিনারে বেঁচে আছি। জানা যায় তিনি ষোলোটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। ‘ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন এগেন্সট টর্চার’-এর একটি শাখা সংগঠন ( তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। তাঁরা বলেন তাঁর মস্তিষ্কে সিস্ট আছে, তাঁর হৃৎপিণ্ডের অবস্থা ভালো নয়, এছাড়া তাঁর হাইপারটেনশন এবং শ্বাসকষ্ট আছে। তাঁর বাঁ হাতের আঘাত ডান হাতকেও সংক্রামিত করে যার ফলে তার পক্ষে লেখালেখি বা অন্য কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ২০১৮ সালে রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা ভারত সরকারের কাছে শারীরিক কারণে তাঁর মুক্তির আবেদন জানান। ২০২০র জুন মাসে কোভিডের প্রকোপের কারণে বিশ্বের প্রায় শতাধিক বুদ্ধিজীবী (নোয়াম চমস্কি, গুগি থিওয়াঙ্গা, জুডিথ বাটলার, পার্থ চাটার্জী, হোমি ভাবা এবং অন্যান্য) রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এস এ বোব্দের কাছে সাইবাবা এবং কবি ভারভারা রাওয়ের মুক্তির জন্য আবেদন করেন।
গ্রেপ্তার হওয়ার পাঁচ বছর বাদে ২০২২-এর ১৪ অক্টোবর বোম্বে হাই কোর্ট পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে সাইবাবাকে মুক্তি দেয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ঠিক যখন অধ্যাপক ও তাঁর পরিবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন তখন মহারাষ্ট্র সরকার তড়িৎ গতিতে সুপ্রিম কোর্টে এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে। অভুতপূর্ব তৎপরতার সাথে আদালতের ছুটির দিন শনিবারে শুনানির ব্যবস্থা করা হয় এবং একটি বিশেষ বেঞ্চ হাই কোর্টের রায় খারিজ করে দেয়। সাইবাবার অসুস্থতা বিচার করে তাঁর আইনজীবী তাঁকে গৃহবন্দি করার আর্জি জানান, আদালতকে আশ্বস্ত করেন যে তাঁর সব যোগাযোগ, সব টেলিফোন লাইন ছিন্ন করে দেওয়া হবে। কিন্তু বিচারকরা তাঁদের সিদ্ধান্তে অটল! তাঁরা বলেন অধ্যাপক শারীরিক ভাবে কতটা অসুস্থ এটা বিচার্য বিষয় নয়, একজন সন্ত্রাসবাদীর ক্ষেত্রে তাঁর মস্তিষ্কটাই গুরুত্বপূর্ণ। স্পষ্টতই বোঝা যায় রাষ্ট্র/সরকার/শাসক সাইবাবার মস্তিষ্ককে ভয় পায়। আইনজীবী মিহির দেশাই বিস্ময় প্রকাশ করেন, “আমি কখনো এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখিন হইনি। মুক্তির রায়ের ওপর কী করে স্থগিতাদেশ হতে পারে!”
অথচ ৫ই মার্চ, ২০২৪ যখন তিনি মুক্তি পেলেন বিচারকরা বলেন যে তাঁকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার অস্পষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাস্তবে এরকম কোন তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি যার কারণে বলা যায় যে তিনি কোন চক্রান্তের প্রস্তুতি করছিলেন। যাঁরা ওনার সাথে একই মামলায় অভিযুক্ত, হতে পারে তাঁরা পরস্পরকে চেনেন, কিন্তু সেটা কিছুই প্রমাণ করে না। এছাড়া অধ্যাপক কী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে যুক্ত সেটা বর্ণনা করা হয়নি। অতএব মুক্তি! দীর্ঘ নয় বছর ধরে রাষ্ট্র এক বিশেষ ভাবে সক্ষম নির্দোষ মানুষকে আলোবাতাসহীন একটি নির্জন কুঠুরিতে নরকবাস করতে বাধ্য করেছে। তিল তিল করে যন্ত্রণা দিয়ে তাঁকে শারীরিক ভাবে অক্ষম করে দিয়েছে। তাঁর মায়ের অসুস্থতার সময়, তাঁর মৃত্যুর পরে, তাঁর শেষকৃত্যের সময় তাঁকে জামিন দিতে অস্বীকার করেছে। এই ভাবে তাঁরা তাঁকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত্য করে দিয়েছে। পুরো পর্যায়টা ভেবে দেখুন, আদৌ কি অধ্যাপক গোরাকোন্ডা নাগা সাইবাবার প্রয়াণ একটা স্বাভাবিক মৃত্যু?
অধ্যাপক তাঁর কবিতার বইয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, আমার পথকে এতো ভয় কেন তোমার?
তিনি লিখছেন আমি তো নাস্তিক নই যে ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রচার করে; আমি তো অজ্ঞাবাদী নই যার মস্তিষ্কে নানা সংশয় গিজগিজ করে; আমি সেক্যুলার নই যে সমস্ত ধর্মের চৌমাথায় দাঁড়িয়ে থাকে; আমি যুক্তিবাদী নই যে নিখাদ যুক্তির ভিত্তিতে ন্যায়-অন্যায় বিচার করে; আমি ধর্মদ্রোহী নই যে তোমার সাবেকি জীবন, পুজাপাঠকে বানচাল করার চেষ্টা করে। আমি তো ভালোবাসা বিতরণ করি, তাহলে আমার পথকে এতো ভয় কেন তোমার?
কেন ভয় সেটা আমরা জানি, সেই মস্তিষ্ক নাকি দ্রোহের সৃষ্টি করতে পারে। এক নব্বই শতাংশ বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষ মায়ের মৃত্যুতে দু দিনের জামিন পেলেও নাকি দাবানল সৃষ্টি করে দিতে পারেন। কিন্তু সাইবাবার মতো মানুষদের প্রাণ তো অক্ষয়। তাই তিনি লিখতে পারেন,
এখনো আমি মৃত্যুকে প্রত্যাখ্যান করি।
কিন্তু হায়
তারা তো জানে না আমায় কীভাবে হত্যা করতে হবে