১৪ই জুন, ২০২৫ এক শতক পরঃ ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে খোলা চিঠি
১৯২৫ এর ১লা মে, মুসোলিনি তখন ক্ষমতায় এসে গেছেন, এক দল ইতালীয় বুদ্ধিজীবী প্রকাশ্যে মুদ্রিত খোলা চিঠির মাধ্যমে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ত শাসনতন্ত্রের সমালোচনা করেন। এই চিঠির স্বাক্ষরকারীরা – বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক, শিল্পীরা - একটি স্বাধীন সমাজের মৌলিক কিছু সূত্রের সমর্থনে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেন – আইনের শাসন, ব্যাক্তিস্বাধীনতা, স্বতন্ত্র ভাবনা, সংস্কৃতি, শিল্প এবং বিজ্ঞান। নিজেদের জীবনের প্রতি প্রবল ঝুঁকি সত্ত্বেও ফ্যাসিস্ত মতাদর্শের স্বৈরাচারী উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের অদম্য প্রতিবাদ প্রমাণ করেছিল যে বিরোধিতা শুধু সম্ভব নয়, প্রয়োজনীয়ও বটে। আজ, একশ বছর পরে, সেই ফ্যাসিবাদের বিপদ, আবার ফিরে এসেছে; তাই আমাদেরও সেই সাহসিকতায় ভর করে পুনরায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
আজ থেকে একশ বছর আগে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ঘটে এবং আধুনিক স্বৈরাচারের সূচনা হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই তা ইউরোপ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানা নামে অথচ একইরকম বৈশিষ্ট্য সহ ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতা দখলের সাথে সাথেই ক্ষমতার বিভাজনকে নস্যাৎ করে স্বৈরাচারের সেবায় নিয়োজিত করে, হিংসাত্মক ভাবে সকল বিরুদ্ধ স্বরকে ধ্বংস করে, গণমাধ্যমকে নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে, নারী অধিকারের অগ্রগতি স্তব্ধ করে দেয় এবং শ্রমিকশ্রেনীর আর্থিক ন্যায়ের সংগ্রামকে বিনষ্ট করে। একে একে করায়ত্ত ও বিকৃত করে বিজ্ঞান, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি চর্চার প্রতি নিয়োজিত সকল প্রতিষ্ঠান। এই মৃত্যুর সাধনা স্তব করতে বসে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও বর্ণভেদ মূলক গণহত্যার, যা বিশ্বকে ঠেলে দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইহুদিনিধন, লক্ষাধিক মানুষের হত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে সংগঠিত অগণিত অপরাধের সরণীতে।
একইসাথে, ফ্যাসিবাদ এবং অন্যান্য স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জমে ওঠা প্রতিবাদ, সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকল্প বিন্যাসের সন্ধানের এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়। একথা অনস্বীকার্য যে বিশ্বজুদ্ধ-উত্তর পৃথিবী – জাতিসঙ্ঘের সনদ, সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের তাত্বিক ভিত্তি স্থাপন, উপনিবেশবাদের বিরোধী আইনী যুক্তি ইত্যাদি সত্ত্বেও ছিল তীব্র অসাম্যে বিক্ষত। তবুও এই সকল প্রচেষ্টার মধ্যে নিহিত ছিল এক আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো স্থাপনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য; বিশ্বব্যাপী শান্তি ও গনতন্ত্রের প্রতি এক বাসনা যার ভিত্তি ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক অধিকার সহ সার্বজনীন মানবিক অধিকারের সংরক্ষণ।
ফ্যাসিবাদ নিঃশেষ হয়ে যায়নি, কিছু সময়ের জন্য সুপ্ত ছিল শুধু। কিন্তু বিগত দু দশক ধরে আমরা দক্ষিনপন্থী রাজনীতির নতুন উত্থান প্রত্যক্ষ করছি, যার সাথে যুক্ত রয়েছে নানা অনস্বীকার্য ফ্যাসিস্ত লক্ষণ। এই সব আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য হল গণতান্ত্রিক অভ্যাস ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আক্রমণ, বর্ণভেদের আদর্শে রঞ্জিত উগ্র জাতীয়তাবাদ, স্বৈরাচারী প্রবণতা, এবং ধর্মীয়, যৌন বা লিঙ্গপরিচয়ের বিভিন্নতার সাথে যুক্ত, রক্ষণশীল ক্ষমতার ঘেরাটোপের বাইরে থাকা সকলের অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা। সারা পৃথিবী জুড়ে, এমনকি দীর্ঘস্থায়ী গণতান্ত্রিক যাপনের দেশেও, এই সব আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছে এবং অসাম্য ও সামাজিক বঞ্চনা দূরীকরণের ব্যার্থতার ফলে পুঞ্জীভূত ব্যাপক ক্ষোভ নব্য স্বৈরাচারীদের দ্বারা বিপদজ্জনক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পুরনো নাটকের সূত্র ধরেই বিপুল জনাদেশ অর্জন করা এইসব নেতারা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের শাসন, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, গনমাধ্যম, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান, বিজ্ঞানসম্মত তথ্য –সবকিছুকেই নির্মূল করতে উঠে পড়ে লেগেছে। তারা বিকল্প সত্য এবং আভ্যন্তরীণ শত্রুর আবিষ্কার করে, নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভীতিকে অস্ত্রের মত ব্যবহার করে এবং সমর্থনের বিনিময়ে বিশেষ সুযোগসুবিধা দানের মাধ্যমে নিজেদের ও অতি-বিত্তশালী ১% মানুষের ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করে ফেলতে চাইছে।
বিশ্বজুড়ে এই প্রক্রিয়ার অগ্রগতি ঘটছে। বেহিসেবী ধরপাকড়, হিংসাত্মক হুমকি, রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার, চিরায়ত এবং আধুনিকতম গণমাধ্যমের প্রবল প্রতাপশালী মালিকদের (কিছু সোৎসাহী টেকনো-ফ্যাসিস্ত, কিছু নির্লিপ্ত ) বদান্যতায় গড়ে তোলা অবিরাম মিথ্যা ও কুৎসার অভিযান সকল বিরুদ্ধ স্বরের কণ্ঠরোধ করে ফেলছে।
গণতন্ত্র নির্ভুল নয়। মিথ্যার আক্রমণের সামনে তারা দুর্বল। এখনও তারা যথেষ্ট সংখ্যক মানুষকে ক্ষমতায়নের অংশীদার করে তুলতে পারেনি। কিন্তু গণতন্ত্র সর্বদাই মনন ও সংস্ক্রিতির বিকাশের উর্বর জমি সৃষ্টি করে এবং সেহেতু সর্বদা উন্নতির পথ খোলা রাখে। গণতান্ত্রিক সমাজে মানবিক অধিকার ও স্বাধীনতার বিস্তার ঘটে, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি সম্ভব হয়, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের অগ্রগতি ঘটে এবং জ্ঞান বিকশিত হয়। তারা বিরোধিতা করার ও ক্ষমতার বয়ানকে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা দান করে, সাংস্কৃতিক ভাবে অস্বস্তিকর তত্বের অবতারণা করার সুযোগ দেয় এবং এভাবেই মানবিক প্রগতির পথ সুগম করে তোলে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলিই সামাজিক অবিচারের মোকাবিলা করার শ্রেষ্ঠ কাঠামো গুলি গড়ে তোলে এবং যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর কর্ম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অধিকার ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং শান্তির অধিকার সম্পর্কিত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে পারে। অন্যথায়, মানবতার পথ অবরুদ্ধ হয়, অসাম্য বেড়ে চলে, নানা বিপর্যয় নেমে আসে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানবজীবন ধ্বংস হওয়ার যে আশঙ্কা, যা কিনা নব্য ফ্যাসিবাদীরা অস্বীকার করে, তারও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটতে থাকে।
আজকের এই অতিসংযুক্ত জগতে গণতন্ত্র একাকী থাকতে পারেনা। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্রের যেমন সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রয়োজন রয়েছে তেমনি আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও গণতান্ত্রিক নীতির সঠিক প্রয়োগ, রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের বহুমুখী আলাপআলোচনা এবং সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য নানা অংশের জনতার সফল অংশগ্রহনের অপর নির্ভরশীল। আইনের শাসন দেশীয় সীমান্ত অতিক্রম করে সর্বত্রই প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন যাতে আন্তর্জাতিক চুক্তি, মানবাধিকার সংরক্ষনের সনদ সমূহ এবং সকল শান্তিচুক্তি যথাযথ ভাবে স্বীকৃত হয়। যদিও একথা সঠিক যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং তাদের পরিচালন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতির অবকাশ রয়েছে, এইসব প্রতিষ্ঠানের অবমাননার অর্থ হল ক্রূর ক্ষমতা, বিনিময়ের যুক্তি এবং সামরিক প্রাবল্যের এক জগতে প্রত্যাবর্তন যা কিনা পৃথিবীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে উপনিবেশবাদ, দুর্দশা এবং ধ্বংসের অধ্যায়ে।
১৯২৫ এর মতোই আজ পৃথিবীর সকল বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং নাগরিকদের কর্তব্য হল ফ্যাসিবাদের উত্থানের সকল নিদর্শনকে ধিক্কার জানানো এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করা। গণতন্ত্রপ্রিয় সকল মানুষের কাছে তাই আমাদের এই আহ্বানঃ
গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষা করুন। গণতান্ত্রিক নীতি ও মানবাধিকার খর্ব করার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করুন। বিনা বাক্যে যে কোন নির্দেশ মেনে নেবেননা।
সমবেত প্রচেষ্টার অংশীদার হন – স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক। সম্ভব হলে অসহযোগিতা এবং ধর্মঘটে সামিল হন। প্রতিবাদ কে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব এবং তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা কে অতিরিক্ত খরচসাপেক্ষ করে তুলুন।
সঠিক তথ্য এবং প্রমাণ তুলে ধরুন। বিশ্লেষণমূলক আলোচনার অভ্যেস গড়ে তুলুন এবং আপনার পরিসরে সকলের সাথে আলাপচারিতায় যুক্ত থাকুন।
এ এক ধারাবাহিক সংগ্রাম। সকল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমাদের বক্তব্য, আমাদের কাজ এবং আমাদের আদর্শ প্রতিবাদের প্রাচীর গড়ে তুলুক। এই বিশ্বাসই হোক আমাদের চিত্তকে ভয়শুন্য এবং শিরকে উচ্চ রাখার পুনরুজ্জীবিত অঙ্গীকার।
স্বাক্ষর করতে আগ্রহী হলে এই লিঙ্ক ব্যবহার করুন:
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।