ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর পর প্রায় দু’মাস বাদে আজ পিছন ফিরে তাকালে মনে হয় বছর খানেক আগে থেকেই যেন তাঁর অন্তিম প্রয়াণ নির্ধারিত ছিল। দিল্লির বিখ্যাত মানবাধিকার সংগঠন ‘পিপলস ইউনিয়ান ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস’ (পিইউডিআর) সম্প্রতি ফাদারের ওপর একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। ‘ফ্রেমড টু ডাই’ নামক এই পুস্তিকাটিতে তাঁরা ফাদারের জীবনের অন্তিম চার বছরের একটি টাইমলাইন প্রস্তুত করেছেন। এই সময়টাকে দু’টি পর্বে ভাগ করা যায়:
(১) ২০১৭-র জুলাই থেকে ২০২০-র জুলাই, তাঁর নানাবিধ সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজকর্ম – যে সবের কারণে তিনি ধর্মান্ধ কর্পোরেট-ঘেঁষা সরকারের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ান। তাদের ‘উন্নয়ন যজ্ঞে' তিনি হয়ে দাঁড়ান এক হিমালয়সম প্রাচীর। তাঁকে সরানোর জন্য শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র, যে সময়টাকে বলা যেতে পারে তাঁকে ফাঁসানোর প্রস্তুতি পর্ব;
(২) তার পর থেকে ৫ই জুলাই, ২০২১ – যেদিন তিনি প্রয়াত হয়েছেন। প্রথম পর্বটা সংক্ষেপে জানার পরে আমরা অন্তিম পর্বটার ওপর আলোকপাত করব, যে সময়টায় তিল তিল করে এক অশীতিপর মানবদরদী মানুষকে অবধারিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
আদিবাসী, মূলবাসী ও ফাদার
কুড়ি বছর বয়সে তিনি ‘সোসাইটি অফ জেসাস’ এর সদস্য হন। সেই সূত্রে তাঁর বর্তমানের ঝাড়খণ্ডে রাজ্যে যাতায়াত ছিল। ষাটের দশকের শেষ দিকে তিনি চাইবাসায় সেন্ট জেভিয়ার্স হাই স্কুলের হোস্টেল-প্রিফেক্ট হন। ছুটিতে তিনি বাড়ি যেতেন না। একটি হো উপজাতির গ্রামে থাকতেন, তাঁদের ভাষাও তিনি রপ্ত করেছিলেন। তিনি নিয়মিত চাইবাসার হাটে যেতেন। একটি ভিডিওতে তিনি বলছেন, হাটে যে রমণীরা আসতেন, তাঁরা সঙ্গে কোনও না কোনও সামগ্রী নিয়ে আসতেন, যেমন – একটা লাউ, শাকসবজি, একটা মুরগি ইত্যাদি। এর পরিবর্তে তাঁদের যা প্রয়োজন, যেমন – নুন, দেশলাই ইত্যাদি ঘরে নিয়ে যেতেন। একদিন তিনি দেখলেন, এক আদিবাসী নারীর হাতে যে মুরগিটা ছিল, সেটা বাজারের এক দালাল তাঁর থেকে ছিনিয়ে নিল এবং তাঁর দিকে একটা ময়লা পাঁচ টাকার নোট ছুঁড়ে দিল। একটা মুরগির দাম তখন ২৫-৩০ টাকা। মহিলা কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করলেন, তারপর কান্নাকাটি করে ঘরে ফিরে গেলেন। ফাদার অসহায় ভাবে এই দৃশ্যটা দেখলেন, এটাও দেখলেন যে আশেপাশের কোনও লোক এর কোনও প্রতিবাদ করলেন না। ফাদার বলছেন, সেই দিন থেকে তিনি ঠিক করেন যে এই মানুষদের জন্য কিছু করতে হবে।
পরের পঁচিশ বছর তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেন। সোশিওলোজি ও থিওলোজি পড়তে তিনি ম্যানিলা যান এবং খুব কাছ থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত মার্কোস সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেন। জরুরী অবস্থার সময় ব্যাঙ্গালোরের ‘ইন্ডিয়ান সোশ্যাল ইন্সটিটিউট’-এ কমিউনিটি-অর্গানাইজেশন এবং সোশ্যাল-অ্যানালিসিস-এর ওপর তিন মাসের একটি কোর্স চালু করেন। এই কোর্সটির পাঠ্যক্রম মার্ক্সীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে রচিত। ব্যাঙ্গালোরের এই প্রতিষ্ঠানে তিনি দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেন। একইসাথে বিভিন্ন দলিত ও আদিবাসী আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন।
১৯৯১ সালে তিনি চাইবাসা ফিরে যান। ‘ঝাড়খন্ড অর্গানাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটস’ (জোহার), যেটি ১৯৬৯ সালে গঠিত হয়েছিল, সেটিকে তিনি পুনরুজ্জীবিত করেন। জোহার আদিবাসী সমাজে ঐতিহাসিক মুন্ডা-মাঙ্কি ব্যবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করে। এর মূলমন্ত্র হচ্ছে – নিজেদের ক্ষমতার সামর্থ্যে, গ্রাম ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে, স্বায়ত্তশাসন কায়েম করা, স্বাবলম্বী হওয়া ও তা টিকিয়ে রাখা। এই সময় থেকে দেশে উদার অর্থনীতির শুরু। এর সাথে আসে বেসরকারিকরণ – অর্থনীতির ভরকেন্দ্র রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র থেকে কর্পোরেট সংস্থার দিকে ঝুঁকে পড়া শুরু হয়। অধিক মুনাফার তাগিদে আদিবাসীদের জল, জমি, জঙ্গল, বাসস্থানের ওপর আক্রমণ তীব্র হয়। নেতারহাটে ফিল্ড ফায়ারিং প্রজেক্টে এবং কোয়েল-কারো প্রজেক্টের জন্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করতে শুরু করে। প্রথম প্রকল্পটিতে ২৪৫টি গ্রামের প্রায় দু’লক্ষ মানুষকে উৎখাত করা হবে। ফাদার স্ট্যান ছাড়াও এই আন্দোলনে আজও অর্থনীতিবিদ ও সমাজকর্মী জাঁ দ্রেজ জড়িত রয়েছেন। সংবিধানের পঞ্চম শিডিউলে আদিবাসীদের রক্ষাকবচ হিসাবে ‘ট্রাইবস এডভাইসরি কাউন্সিল’ গঠনের নিয়ম আছে। আদিবাসী অঞ্চলে যে কোনও কাজকর্মের জন্য এই কাউন্সিলের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। কিন্তু এটি শাসক-দলের একটি নখদন্তহীন, তাঁবেদার সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ‘পঞ্চায়েত এক্সটেনশন শিডিউলড এরিয়াস অ্যাক্ট’, ১৯৯৬ (পেশা) বিভিন্ন গ্রামের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গ্রামসভার ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেছে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যে কোনও প্রকল্পের কাজ এঁদেরকে না জানিয়েই করা হয়। কিংবা এঁরা কোনও প্রকল্পের বিরোধিতা করলে পুলিশ-প্রশাসন দিয়ে জুলুম করে এঁদের নিদান অমান্য করা হয়। ২০০৬ সালের ‘জাতীয় অরণ্য আইন’ আদিবাসীদের পরম্পরাগত জমির ওপর তাঁদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। সারা ভারতে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ জমির পাট্টার জন্য আবেদন করেন। অর্ধেকের ওপর আবেদন খারিজ হয়ে যায়, বাকি প্রায় ৫ লক্ষ এখনও মুলতবি আছে। এর মধ্যে লক্ষাধিক আবেদন ঝাড়খণ্ডের। এই সময়ই তিনি রাঁচিতে বাগাইচা সেন্টার গড়ে তোলেন। বাগাইচা হ’ল আদিবাসীদের চন্ডীমণ্ডপ – যেখানে তাঁরা মিলিত হন, উৎসব করেন, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এখানে বিরসা মুন্ডার একটা মূর্তি স্থাপন করা আছে এবং একটি পাথরের ওপর ১৭৮৪ সাল থেকে আদিবাসী-মূলবাসীদের আন্দোলনে যত মানুষ শহীদ হয়েছেন, তাঁদের নাম খোদাই করা আছে। ফাদারের মৃত্যুর পর তাঁর সহকর্মীরা জানান, যে রোজ, দিন শুরুর আগে, তিনি পাথরের এই বিগ্রহের সামনে এসে দাঁড়াতেন এবং কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করতেন।
ফাদার এই পঞ্চম শিডিউল, পেশা এবং অরণ্য-আইন কার্যকরী করার জন্য লাগাতার প্রচার করেছেন। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি যুগান্তকারী রায় দেয়। তাঁরা বলেন, কোনও জমির নীচে কয়লা-ব্যতীত অন্য সব খনিজ বা আকরিক পদার্থের মালিকানাও জমির মালিকের। এর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। কোনও জমি অধিগ্রহণ করলে, এর মালিককে জমির মূল্য ছাড়াও, তার নীচের খনিজ পদার্থেরও মূল্য দিতে হবে। ফাদার এই রায়টি কপি করে জনে জনে বিলি করেছিলেন। এইভাবে তিনি মানুষের মধ্যে নিরন্তর চেতনা জাগিয়ে তোলার কাজ করে গেছেন। লক্ষণীয়, তিনি সংবিধানসম্মত সরকারের আইন প্রয়োগ করার জন্যই আন্দোলন করেছেন, কোনও বেআইনি কার্যকলাপ করেননি। এই সময় থেকে রাজ্য সরকার তাঁকে বিভিন্ন ভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করে এবং তিনি ক্রমবর্ধমান পুলিসি জুলুম ও হেনস্থার সম্মুখীন হন।
সরকারের গোঁসা ও প্রত্যাঘাত
২০১৬ সালে রাজ্য সরকার অধ্যাদেশ এনে আদিবাসীদের জমি দখল করার চেষ্টা করে। এর বিরুদ্ধে মানুষ বিদ্রোহ করে ও দিকে দিকে পাথালগড়ি আন্দোলন গড়ে ওঠে। বিভিন্ন গ্রামের প্রবেশ-মুখে পাথর স্থাপন করে আদিবাসীরা তাঁদের দাবি লিপিবদ্ধ করে। যাঁরা সেই দাবিগুলিতে সম্মত হয়, তাঁদের গ্রামে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়, অন্যথা তাঁদের আটকে দেওয়া হয়। অনেক গ্রামে স্বায়ত্ত-শাসন চালু হয়ে যায়। ফাদার এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী রঘুবীর দাস জেসুইট আন্দোলনের তীব্র নিন্দা করেন। তাঁরা মনগড়া ধর্মান্তকরণ-তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন ও রিলিজিয়াস ফ্রিডম আইন চালু করে। সমাজমাধ্যমে এই আন্দোলনের পক্ষে বিভিন্ন পোস্ট করার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়। ২০১৮ সালের ২৮শে আগস্ট ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ঝাড়খণ্ড ও মহারাষ্ট্র পুলিস একত্রে বাগাইচা ক্যাম্পাস রেইড করে। ফাদারের মোবাইল, ল্যাপটপ, বিভিন্ন সিডি, ক্যাসেট তারা বাজেয়াপ্ত করে। কোনও ওয়ারেন্ট ছিল না, মারাঠি ভাষায় লিখিত সার্চ অর্ডার ছিল। বলাই বাহুল্য – তাতে কী যে লেখা ছিল, তা ফাদার বিন্দুমাত্র বুঝে উঠতে পারেননি। তিনি বলেন, অঘোষিত জরুরী অবস্থা চলছে এবং এই ধরণের হেনস্থা বন্ধ করার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের হস্তক্ষেপ দাবি করেন। ২০১৯ এর ১২ই জুন আবার বাগাইচাতে তল্লাশি হয়। তাঁর কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক, পেন ড্রাইভ এবং বিভিন্ন নথি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাঁর ইমেল এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্লক করে দেওয়া হয়। স্থানীয় পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারের ওয়ারেন্ট বের করে। অক্টোবর মাসে খুন্তি পুলিস ২০১৮র রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে এফআইআর অনুযায়ী তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে; সম্পত্তির মধ্যে ছিল দু’টি টেবিল, তিনটি চেয়ার, একটা আলমারি এবং একটা তোশক! ২০১৯-র ডিসেম্বরে রাজ্যে পট-পরিবর্তন হয়, ঝাড়খণ্ড মুক্তি-মোর্চা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে। তাঁরা ফাদার এবং তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে যাবতীয় কেস তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যদিও এখন অবধি তা বাস্তবে কার্যকরী হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
জুন ২০১৯-এ ফাদার একটি নিবন্ধ লেখেন, ‘অত্যাচার করাটা কি পুলিসি জিজ্ঞাসাবাদের এক্তিয়ারে পড়ে?’। তিনি বলেন, একজন ব্যক্তি যখন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সমাজের নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন, তাঁকে যখন শাসক শ্রেণী শাস্তি দেয়, হেনস্থা করে – সেটা কি অত্যাচার নয়? যখন মিথ্যা কেসে ফাঁসিয়ে আদিবাসীদের গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁদের পরিবারকে চরম দুর্দশা ভোগ করতে হয়, সেটা কি অত্যাচার নয়? যখন ভীমা কোরেগাঁও মামলায় একজন স্বনামধন্য আইনজীবীকে পুলিশি হেফাজতে মারধোর করা হয়, সেটা কি অত্যাচার নয়? তুমি যত গরীব হবে, তত তোমার ওপর জেলে অত্যাচার হবে। প্রায় এক বছর আগে থেকে তিনি হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন, যে একই ধরণের অত্যাচারের তিনিও মুখোমুখি হতে চলেছেন।
গ্রেপ্তার ও চার্জশিট
“আমার ব্যাগ গোছানো আছে, আমি যেতে প্রস্তুত” – ৮-ই অক্টোবর গ্রেপ্তার হওয়ার এক দিন আগে ফাদার তাঁর অ্যাক্টিভিস্ট বন্ধু জেভিয়ার ডায়াসকে বলেন। ততদিনে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় পনেরো জন গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং তিনি বুঝতে পারছিলেন, যে তাঁর সময়ও ঘনিয়ে আসছে। এর আগে ২৭শে জুলাই, ২০২১ থেকে ৬ই আগস্ট এনআইএ (নিয়া) ফাদারকে পনেরো ঘণ্টা জেরা করে। অভিযোগ করা হয়, যে মাওবাদীদের সাথে তাঁর যোগসাজশ আছে। তাঁদের থেকে তিনি টাকা পান; শহরাঞ্চলে মাওবাদীদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি করতে তিনি সাহায্য করেন; তাঁদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। তাঁকে মাওবাদীদের কিছু চিঠির কথা বলা হয়, যাতে নাকি তাঁর নামের উল্লেখ আছে। দু’মাস বাদে নিয়া তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং রাঁচি থেকে মুম্বাইয়ে নিয়ে যায় এবং নবি মুম্বাইয়ের তালোজা জেলে কারাবন্দি করে। ৯-ই অক্টোবরের চার্জশিটে বলা হয়, যে একটি চিঠি পাওয়া গেছে - যাতে প্রকাশ্য কাজকর্মে যুক্ত কর্মীদের জন্য বিস্তৃত নির্দেশাবলি দেওয়া আছে। পিইউডিআরের পুস্তিকা থেকে জানা যাচ্ছে, যে একই ধরণের চিঠি রোনা উইলসনের কম্পিউটার থেকেও পাওয়া গেছে, যাতে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামে শহুরে কর্মীদের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চার্জশিটে আরও অভিযোগ, সুরেন্দ্র গ্যাডলিংয়ের কম্পিউটার থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে ‘বিস্তাপন বিরোধী জন বিকাশ আন্দোলন’ (VVJVA) ২০১৬তে একটি অনুষ্ঠান করেছিল, যাতে ভারভারা রাও সাহায্য করেছিলেন এবং মহেশ রাউত উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগ – এঁরা সবাই মাওবাদীদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সচেষ্ট ছিলেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ, এঁরা ২০১২ থেকে মণিপুরের ‘কাংলেইপাক কম্যুনিস্ট পার্টি’র সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন। এর আগের দু’টি চার্জশিটেও (১৫/১১/২০১৮ এবং ১৯/০২/২০১৯) ফাদারকে মাওবাদী বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তিনি সরকার সম্পর্কে অপ্রীতিকর ধারণা (disaffection) ছড়াচ্ছেন, বিভিন্ন গোষ্ঠী- সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করছেন ইত্যাদি।
কম্পিউটার হ্যাকিং ও মাওবাদী অভিযোগ
এখানে কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। প্রথমত, উপরে যাঁদের নাম উল্লিখিত হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত এবং কবি ভারভারা রাও বাদে (যিনি মুমূর্ষু অবস্থায় ফেব্রুয়ারি মাসে জামিন পান) বাকি সবাই বর্তমানে কারাবন্দি। এঁদের প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ – মাওবাদীদের বিভিন্ন চিঠিপত্রে এঁদের নামের উল্লেখ আছে। আমরা সবাই অবহিত আছি, যে পরবর্তীকালে আমেরিকার আর্সেনাল কনসাল্টিং, রোনা উইলসন ও সুরেন্দ্র গ্যাডলিংয়ের কম্পিউটার পরীক্ষা করে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ আনে। তারা জানায় – এঁদের দু’জনের ডিভাইস কয়েক বছর ধরে হ্যাক করা হচ্ছে এবং রোনা ও সুরেন্দ্রর কম্পিউটারে যথাক্রমে ১০টি চিঠি ও ২২টি ডকুমেন্ট প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। নিয়া ফাদারকে যখন চার্জ করে, যে মাওবাদীদের চিঠিতে তাঁর নাম পাওয়া গেছে – তিনিও পাল্টা প্রশ্ন করেন, চিঠি কার লেখা, কাকে লেখা, প্রেরকের নাম কি, চিঠির তারিখ কি; তিনি কিন্তু কোনও সদুত্তর পান না। চিঠিগুলিতে কোনও তারিখ নেই, কারুর সই নেই! তাঁর গ্রেপ্তারের পর জেসুইট সোসাইটির ফাদার সলোমন একটি অনলাইন প্রেস কনফারেন্সে জানান, যে ফাদার স্ট্যান নিশ্চিত – তাঁর চিঠিপত্র বিকৃত করা হয়েছে, শব্দ পালটানো হয়েছে, নতুন শব্দ-বাক্য ঢোকানো হয়েছে – যেমন, জোহার শব্দটিকে লাল জোহার করে দিয়ে তাঁকে অতিবাম প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়েছে।
সংগঠন নিষিদ্ধকরণ
ফাদারের বিরুদ্ধে নিয়ার দ্বিতীয় অভিযোগ – মাওবাদীদের তথাকথিত প্রকাশ্য সংগঠনের সাথে তাঁর যোগাযোগ-সংক্রান্ত। উন্নয়ন ও শিল্পায়নের নামে ঝাড়খন্ডের বিজেপি সরকার আদিবাসী সমাজের কয়েক লক্ষ একর জমি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একটি ‘ল্যান্ড ব্যাংক’ তৈরি হয় এবং বহু MOU সই হয়। আদিবাসীদের এই জমি লুঠের বিরুদ্ধে ফাদার স্ট্যান VVJVA সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাদের শ্লোগান, ‘জান দেঙ্গে পর জমিন নেহি দেঙ্গে’ এমন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল, যে সরকারকে অনেক ক্ষেত্রে পিছু হটতে হয়েছিল। তারা ১৯০৮-এর ‘ছোটোনাগপুর টেনান্সি আইন’ এবং ১৮৭৬ এর ‘সাঁওতাল পরগণা টেনান্সি আইন’ সংশোধনের বিরোধিতা করেছিল, কারণ এই দু’টি সংশোধনই আদিবাসী সমাজ-বহির্ভূত মানুষদের এই সব অঞ্চলে জমি ক্রয় করার অধিকার দেয়। শুধুমাত্র এই কারণে ২০১৭র এপ্রিল মাসে কেন্দ্রীয় সরকার VVJVAকে মাওবাদীদের প্রকাশ্য সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করে। একই নোটিশে সরকার ওড়িশার নিয়মগিরি পর্বতে কুখ্যাত বেদান্ত সংস্থার খননকার্য বন্ধ করার জন্য সংগ্রামরত ‘নিয়মগিরি সুরক্ষা সমিতি’কেও মাওবাদীদের প্রকাশ্য সংগঠন বলে ঘোষণা করে। সরকার ছেঁদো যুক্তি দেয়; বলে, এইসব কাজের বাহানায় মাওবাদীরা ওই অঞ্চলে তাদের ভিত শক্ত করছে। ফাদার আরেকটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন – পারসিকিউটেড প্রিজনার্স সলিডারিটি কমিটি (PPSC)। এই সংগঠন ২০১৫ সালে গঠিত হয় এবং ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগড়, ওড়িশা – ইত্যাদি রাজ্যে বিনা বিচারে এবং ভুয়ো অভিযোগে আটক হাজারো বন্দিদের মুক্তির জন্য কাজ করে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় আরেক অভিযুক্ত প্রখ্যাত আইনজীবী ও সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজও এই সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই বন্দিদের অধিকাংশই আদিবাসী, দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রশ্নটা হল, জোর করে জমি অধিগ্রহণ, আদিবাসী জমিতে মাইনিং, বন্দিমুক্তির দাবি করলেই কি যে কোনও সংগঠনকে মাওবাদীদের ‘ফ্রন্ট’ বলে তকমা মেরে দেওয়া হবে, নিষিদ্ধ করে দেওয়া হবে? কোনও সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার মাপকাঠিটা কি? কোন নীতির ভিত্তিতে সেটা করা হবে? এর কোনও উত্তর নেই। ইউএপিএ আইন এতই মারাত্মক, যে এর সাহায্যে সরকার যে কোনও সংগঠনকে বেআইনি ও সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করতে পারে; কোনও কারণ, প্রমাণ দর্শানোর প্রয়োজন নেই। আদালতে আবেদন করে কোনও লাভ নেই, কারণ কোন বেআইনি সংগঠনকে আইনি ঘোষণা করার এক্তিয়ার বিচার-ব্যবস্থার নেই। যারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, একমাত্র তাদের কাছেই আবেদন করা যেতে পারে; এর অর্থ একমাত্র সরকার স্বয়ং যদি সন্তুষ্ট হয় তাহলে তারাই একটি নিষিদ্ধ সংগঠনকে পুনরায় আইনি ঘোষণা করতে পারে। মৃতপ্রায় অবস্থাতেও, ফাদার দোসরা জুলাই ইউএপিএর এই ধারাকে অসাংবিধানিক বলে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তিনি এ যুক্তিও দিয়েছিলেন, যে এই আইন অসাংবিধানিক – কারণ এতে কোন অভিযুক্তের জামিন পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
নরক যন্ত্রণার বৃত্তান্ত
গ্রেপ্তারের সময় ফাদার স্ট্যানের বয়স ছিল ৮৪। তিনি পার্কিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত ছিলেন এবং প্রায় শ্রবণশক্তিহীন ছিলেন। এছাড়াও তাঁর বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা ছিল। তাঁকে যখন তালোজা জেলে নিয়ে আসা হয়, তখন বরেণ্য কবি ভারভারা রাও প্রবল অসুস্থ, যমে মানুষে টানাটানি চলছে। জেল তখন উপচে পড়ছে; ২১২৪ জন কয়েদি যেখানে থাকার কথা – সেখানে বন্দির সংখ্যা ৪০০০ ছাড়িয়ে গেছে। করোনার কারণে জেল খালি করার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, সেখানে তখনও আরও অভিযুক্তদের ঠুসে দেওয়া হচ্ছে। এই ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে ফাদারকে ঠেলে দেওয়া হল। নিয়া ফাদারের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ভালো ভাবেই অবহিত ছিল, কারণ তারা তাঁকে জেলের ঔষধালয়ে রাখার ব্যবস্থা করল। ফাদার একটা ব্যাগ নিয়ে এসেছিলেন, যাতে তাঁর অত্যাবশ্যকীয় কিছু জিনিস ছিল – চা, জল খাওয়ার জন্য একটা সিপার, কিছু জামাকাপড়, ওষুধ, চশমা, সামান্য টাকাপয়সা এবং ভোটার আইডি কার্ড। গেটে তাঁর সিপারটি বাজেয়াপ্ত করা হয়, তাঁর ব্যাগও গায়েব হয়ে যায়। বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও জেল কর্তৃপক্ষ সিপার ফেরত দেয় না। জেল ক্যান্টিন থেকে বাচ্চাদের স্ট্র কিনে তাঁকে কাজ চালাতে হয়। চশমা ছাড়া তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে যান। কয়েক দিনের মধ্যে ব্যাগ পাওয়া যায়, সিপার পেতে আদালতে আবেদন করতে হয়! ভাবা যায়! কতটা নিষ্ঠুর হলে চুরাশি বছরের এক অসুস্থ বৃদ্ধকে তাঁর পান করার সামগ্রী থেকে বঞ্চিত করা যায়! আদালত টালবাহানা করে, শুনানি পিছায়, অবশেষে প্রায় এক মাস বাদে তিনি নিজের সিপার ফেরত পান। শুধুমাত্র এই ঘটনাই প্রমাণ করে – যে প্রথম থেকেই পরিকল্পিত ভাবে তাঁর জীবন বিপন্ন করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। পিইউডিআর রিপোর্ট অনুযায়ী, এই ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন স্বয়ং জেল সুপারিন্টেনডেন্ট, কৌস্তভ কার্লেকার।
জেল থেকে একটি চিঠিতে ফাদার লিখছেন: আমাকে ১৩ বাই ৮ একটা সেলে থাকতে দেওয়া হয়েছে। আমার সাথে আরও দু’জন সঙ্গী আছেন। সেলে একটা ছোটো বাথরুম আছে, একটা শৌচাগার – যাতে একটা ইন্ডিয়ান কমোড। সৌভাগ্যবশত, আমাকে একটা ওয়েস্টার্ন কমোড চেয়ার দেওয়া হয়েছে। ভারভারা রাও, ভার্নন গঞ্জালভেস এবং অরুণ ফেরেরা অন্য একটি সেলে আছেন। সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা থেকে সকাল ছ’টা এবং দুপুর বারোটা থেকে তিনটে অবধি আমি কুঠুরিতে বন্দি থাকি। যখন সেল খুলে দেওয়া হয়, তখন তাঁদের সাথে দেখা হয়। অরুণ আমাকে জলখাবার এবং লাঞ্চ খেতে সাহায্য করে। ভার্নন আমাকে স্নান করিয়ে দেয়। আমার সেলের দুই সাথি আমার কাপড় কেচে দেয়, রাতের খাবার খাইয়ে দেয়, আমার পায়ের গিঁটে ব্যথা হলে মালিশ করে দেয়। তাদের পরিবার খুব গরিব। প্রার্থনা করার সময় এদের সবাইকে প্লিজ মনে রাখবেন। এত দুর্ভোগ সত্ত্বেও তালোজা জেলে মানবতা উপচে পড়ছে।
২৬শে নভেম্বর ফাদার নিয়া আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করেন। নিয়া যুক্তি দেয় তাঁর ব্যক্তি-স্বাধীনতা, বয়স, তথাকথিত অসুস্থতার চেয়ে সাধারণ মানুষের সুরক্ষা, নিরাপত্তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ – সুতরাং জামিন দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ ৮৪ বছরের একজন মানুষ, যাঁর জীবন নানা ব্যাধির কারণে সংকটাপন্ন – তিনি এতই বিপজ্জনক যে তাঁকে মুক্তি দিলে দেশ, মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। ইতিমধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হতে শুরু করেছে। তিনি আদালতে জানান, প্রথম যখন তিনি জেলে এসেছিলেন, তিনি হাঁটতে চলতে পারতেন, প্রাত্যহিক কাজকর্ম করতে পারতেন, একটু আধটু লেখালেখিও করতে পারতেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর শক্তিক্ষয় হচ্ছে, তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসছে।
তাঁর স্বাস্থ্যের এই অবনতির জন্য জেলের অবস্থা, বিশেষ করে মেডিক্যাল পরিষেবার ঘাটতির ওপর নজর দেওয়া প্রয়োজন। তাঁর মৃত্যুর পর ২১শে জুলাই, জাস্টিস মদন লোকুর সরাসরি অভিযোগ করেন যে জেলবন্দিদের ওপর ‘সফট টর্চার’ করা হয়। তিনি মূলত তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন: (১) অতিমাত্রায় ভিড়, ঠাসাঠাসি অবস্থা, (২) অস্বাস্থ্যকর, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, (৩) শৌচালয়ের ভয়ানক অপ্রতুলতা এবং সেগুলির ভয়ঙ্কর পঙ্কিলতা। মানবাধিকার কমিটির রিপোর্টটিতে জানা যাচ্ছে, তালোজা জেলে তিনজন আয়ুর্বেদিক ডাক্তার ও দু’জন কম্পাউন্ডার আছেন, তাঁরাই অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা করেন! ফাদার এবং তাঁর বন্ধুরা জেলে একজন MBBS ডাক্তার রাখার জন্য দাবি করেন। জেলে ওঁকে পার্কিনসন্সের জন্য যে ওষুধ দেওয়া হচ্ছিল, তা কারাবন্দি হওয়ার আগে উনি যা ওষুধ খেতেন তার থেকে আলাদা। সুপারিন্টেনডেন্ট কার্লেকারকে যখন এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি বক্তব্য রাখেন: একজন ভিজিটিং মনস্তত্ত্ববিদ পার্কিনসন্সের চিকিৎসা করেন, তবে তিনি যেহেতু ডাক্তার নন, এর বেশি তিনি কিছু বলতে পারবেন না; মনে হয় ঝাড়খণ্ডে তাঁর যে প্রেসক্রিপশন ছিল সেই অনুযায়ী চিকিৎসা হচ্ছে; প্র্যাক্টিশনার্স আইন অনুযায়ী আয়ুর্বেদিক ডাক্তার এলোপ্যাথি ওষুধ দিতে পারে; তিনি তো নিয়োগকর্ত্তা নন তাই MBBS ডাক্তার কেন নেই সেটা সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারবেন না!
২২শে মার্চ ফাদার আবার জামিনের জন্য আবেদন করেন। নিয়া আদালত আবার একই যুক্তি দেয়, যে তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতার চেয়ে সমাজের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা অনেক বেশি জরুরি। নিরুপায় হয়ে ফাদার বোম্বে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন। বলাই বাহুল্য, তাতে কোনও সুরাহা হয় না। যোগাযোগের অভাবে ফাদারের প্রকৃত শারীরিক অবস্থা জানা তাঁর সুহৃদদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। ১৫ই মে জেভিয়ার ডায়াস অভিযোগ করেন, যে তাঁকে ফাদারকে ফোন করতে দেওয়া হয় না – যদিও তাঁর নাম ফাদারের সাথে যোগাযোগ-রক্ষাকারী ব্যক্তি হিসাবে নথিভুক্ত আছে। ফাদারকে কালেভদ্রে ফোন করতে দেওয়া হ’ত, কিন্তু সেটা খুবই কম সময়ের জন্য এবং মুম্বাই আর রাঁচির মধ্যে কানেকশন দুর্বল হওয়ায় অর্থপূর্ণ কথোপকথন খুবই কঠিন ছিল। এর ওপর ফোনে আড়ি পাতা, নজরদারির সমস্যা তো ছিলই। ১৯শে মে, পার্কিনসন্স ডিজিজের দরুন তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হওয়ার কারণে, তিনি মেডিক্যাল জামিনের জন্য আবেদন করেন। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, নিয়া যুক্তি দেখায় – ফাদারের মেডিক্যাল রেকর্ডে পার্কিনসন্সের কোনও প্রমাণ নেই! তিনি অসুস্থতার বাহানা করে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছেন! জেল কর্তৃপক্ষ আরও এক কাঠি এগিয়ে নিদান দেয়, যে তাঁর হৃৎপিণ্ড স্থিতিশীল এবং রক্তের সঞ্চালন উত্তম! মে মাসের মাঝামাঝি তাঁর মধ্যে কোভিডের নানা উপসর্গ দেখা যায় – জ্বর, ডায়োরিয়া, অস্বাভাবিক ক্লান্তি। কর্তৃপক্ষ তবুও গা করে না। ২৮শে মে তাঁর RTPCR টেস্ট হয় এবং তাঁর কোভিড ধরা পড়ে। ফাদার হাসপাতালে যেতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, তিনি জেলের সাথিদের মধ্যে তাঁর অন্তিম দিনগুলি কাটাতে ইচ্ছুক। তাঁর আইনজীবী তাঁকে হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে যেতে রাজি করান। এতেও সরকারি উকিল ফ্যাকড়া বাধানোর চেষ্টা করে। বলে, যে বেসরকারি হাসপাতালে অভিযুক্তকে নিয়ে যাওয়া একটা ক্ষতিকর নজির সৃষ্টি করবে। নিয়া এবং বিচারকরা এতটাই নীচ, যে তারা জানিয়ে দেয় – বেসরকারি হাসপাতালের খরচ অভিযুক্তকেই বহন করতে হবে। ৩০শে জুন তাঁকে ICUতে স্থানান্তরিত করা হয়। ৩রা জুলাই, মুমূর্ষু হওয়া সত্ত্বেও, ফাদার ইউএপিএর ধারা 43D(5)-কে অসাংবিধানিক আখ্যা দেন, কারণ এই ধারা জামিন পাওয়ার জন্য অলঙ্ঘ্য বাধা সৃষ্টি করে। তিনি এই ধারাটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেন। ৫ই জুলাই তাঁর হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যায়। নিষ্ঠুর, অমানবিক, প্রতিহিংসাপরায়ণ, জনবিরোধী একটা ব্যবস্থার শিকার হয়ে একজন মানবপ্রেমী, মেরুদণ্ড-সম্পন্ন মানুষ ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর এই মৃত্যুকে নানা তকমা দেওয়া হয়েছে।
তালোজা জেলে ফাদার স্ট্যান-সহ অন্যান্য ভীমা কোরেগাঁও বন্দিদের ইচ্ছাকৃত অবহেলা ও হেনস্থা করার জন্য জেল সুপারিন্টেনডেন্ট কৌস্তভ কার্লেকারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেছে পিইউডিআর। তারা তাঁদের জামিনের আবেদন বারবার খারিজ করার জন্য এবং আদালতকে তাঁদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিপথগামী করার জন্য নিয়ার উকিলের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেছে। তারা মনে করে, জেলে স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর বিচারবিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত। তাদের দাবি ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া উচিত এবং ইউএপিএ আইন বাতিল করা উচিত।
ফাদারের মৃত্যুর তেরো দিন বাদে তাঁর সাথিরা বাগাইচাতে মিলিত হন। পাথরের ওপর আরও শত শত শহীদের নামের পাশে ফাদার স্ট্যান স্বামীর নামও খোদিত হয়। তাঁরা শপথ নেন, যে তাঁর সংগ্রামকে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তাঁর আদর্শ তাঁদের মধ্যে চিরকাল জীবিত থাকবে।
ঋণ স্বীকার: Framed To Die: The Case Of Stan Swamy—PUDR (Peoples Union For Democratic Rights)