দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
পাঠকদের উদ্দেশে প্রায়ই লিখতে হয় কথাটা, যখনই কোনও ভুল থেকে যায় খবরে।
আজ লিখতে হচ্ছে সহকর্মীদের উদ্দেশে। আমাদের চিত্রসাংবাদিক কলিগরা, যাঁরা প্রতিদিন আমাদের কাঁধে কাঁধ দিয়ে খবরকে ধরেন। যাঁরা সবার আগে পৌঁছে যান যে কোনও ঘটনায়, সবার আগে মার খান, অনেকে মারাও যান, যাঁরা আর্থিকভাবে সব চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন পুলিশ তাঁদের ক্যামেরা কিংবা বাইক ভেঙে দেওয়ায়। যাঁদের তোলা ছবি এক একটি ছবি সহস্র বাক্যের সমান, তাঁরা নাকি ‘সাংবাদিক’ নন।
এমন রায় দিয়েছে কারা? প্রেস ক্লাবের ১৪৪জন সাংবাদিক সদস্য। ফটো জার্নালিস্টদের সদস্য করার পক্ষে রায় দিয়েছেন ১৩৫জন।
২২ জুলাই কলকাতা প্রেস ক্লাবের ইতিহাসে এক কলঙ্কের দিন। কলকাতার সাংবাদিকদের এক লজ্জার দিন।
এ ফল অভাবনীয়। এর মানে কী, কী করে এমন হল – সে সবের আগে আমাদের সমস্ত ফটো জার্নালিস্ট কলিগদের অন্তর থেকে, অতি সঙ্কোচের সঙ্গে বলি, দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। গৌরকিশোর ঘোষের শতবর্ষে যখন সাংবাদিকের সম্মান নিয়ে এত বড় বড় কথা হচ্ছে, তখন সাংবাদিকদেরই মধ্যে এই চরম সঙ্কীর্ণতা, ক্ষুদ্রতা, সত্যের অপলাপ – মনকে যেন বিকল করে দিল। নিজেকেই ছোট মনে হচ্ছে।
গতকাল বিকেলে ভোট ছিল। সাধারণ সভা বা ‘এজিএম’ ডেকে গোপন ব্যালটে ভোট না করলে ক্লাবের সংবিধান সংশোধন করে ফটোজার্নালিস্টদের সদস্য করা যাবে না, তাই ভোট হল। সভায় যে সদস্যরা কথা বললেন, তাঁরা প্রত্যেকেই বললেন, এ অনেক আগেই হওয়ার কথা, এত দিন কেন হয়নি, সেটাই আশ্চর্য। বললেন, ডিজিট্যাল মাধ্যমের সাংবাদিকদেরও ক্লাবের সদস্য করার সময়ও পার হয়ে গিয়েছে। সেটাও চটপট করা দরকার।
মনে হচ্ছিল, এই ভোট কেবল একটা ফর্ম্যালিটি। ভয় ছিল কেবল নিয়মরক্ষার শর্তপূরণ নিয়ে। কোরাম হতে হবে কি? কত সদস্য দরকার কোরামের জন্য? কত মেজরিটি লাগবে – টু-থার্ড, নাকি সিম্পল মেজরিটি হলেই হবে? প্রবীণ সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায়, আমাদের সবার মধুদা — তো তাঁর দৃপ্ত, তীক্ষ্ণ বক্তব্যের শেষে বলেই দিলেন, আজ চিত্রসাংবাদিকরা প্রেস ক্লাবের সদস্য না হলে তিনি ক্লাবের সদস্যপদ ত্যাগ করবেন।
গল্পগাছা চলছে, আর সবাই চোখ দিয়ে গুনছে, কতজন ঢুকল ভোটের ঘরে। মাঝেমাঝেই কেউ একজন উঁকি দিয়ে খাতাটা দেখে আসছিল, কতজন ভোটদাতার সই পড়ল।
আশঙ্কা কি ছিল না? এক সিনিয়র সাংবাদিক বলছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কোনও ফটোজার্নালিস্ট প্রেস ক্লাবের শীর্ষ পদে বসতে চান বলে রটনা। সেই জন্যই নাকি এই ভোট। বশংবদ লোকেদের সদস্য করা কি ঠিক? তারা যদি সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট হয়ে যায়?
বাইরে তখন প্রেস ক্লাবের মাঠে মস্ত প্যান্ডেলে ডিজে বক্স গুমগুম করছে, গোটা মণ্ডপ সাদা-নীল কাপড়ে তৈরি, সবুজ ঘাস ঢেকে গিয়েছে নীল কার্পেটে। তরুণতর এক সাংবাদিক উত্তর দিলেন, কীসে কী হবে, সে পরের কথা। ফটোগ্রাফার যে সাংবাদিক, সে সত্যটা আগে স্বীকার করতে হবে।
সে সত্যটা স্বীকৃতি পেল না, এই ২০২২ সালেও।
হয়তো আরও কিছু সদস্য বৃষ্টি, ব্যস্ততা ঠেলে ভোট দিতে এলে অন্য রকম হত ফলটা। সে আক্ষেপ বারবার ঠেলা দিচ্ছে চিন্তাকে।
কিন্তু কলকাতার শতাধিক সাংবাদিক যে মনে করেন, চিত্রসাংবাদিকরা সাংবাদিক নন, সে কথাটা ছুরির মত বিঁধছে।
তবে কি ছোঁয়ান্যাপার ভয়ের মত, ক্রমাগত আমরা অন্যকে ছোট করে নিজেকে শুদ্ধ, ভদ্র, সম্মানযোগ্য রাখার চেষ্টা করতে করতে কাণ্ডজ্ঞানকেও ফিনাইল-জলে ধুয়ে ঝেঁটিয়ে বের করে দিয়েছি? ভুলে যাচ্ছি, যোগ্যকে মর্যাদা দিতে না জানার মত অযোগ্যতা আর কিছুতে নেই?
নাকি, প্রেস ক্লাবের এই বিশেষ ভোটের পিছনে কোথাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও ভূমিকা আছে, তেমন একটা কথা শুনে কোনও এক বিরোধী দল-প্রভাবিত সাংবাদিকরা এককাট্টা হয়ে বিপরীতে ভোট দিলেন? তাতে শেষ অবধি কীসের বিরোধিতা করা হল, সে চিন্তার ফুরসত পাননি।
কারণ যা-ই হোক, এই ভোট পড়ছে এমন একটা সময়ে, যখন সাংবাদিকদের গ্রহণযোগ্যতা এসে দাঁড়িয়েছে তলানিতে। সবাই যখন সাংবাদিকদের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে বেঁধে বেঁধে থাকার সময় যখন, তখনই এমন অবিশ্বাস্য ফলাফল আছড়ে পড়ল সাংবাদিক জগতের উপরে।
এই ধরনের চরম অন্যায়ের কুষ্ঠক্ষতের উপর সাধারণত একটা ‘প্র্যাকটিকাল রিয়্যালিটি’-র জ্যাকেট পরানো হয়। যাঁরা অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করেন, তাঁদের প্রতি প্রকাশ্যে সম্মান দেখিয়ে আড়ালে ব্যঙ্গ করেন ‘বাস্তববাদী’-রা। এদের দৌলতেই মহিলা, দলিত, মুসলিম এবং অন্যান্যরা, যারা ঠিক ‘আমাদের মত’ নয়, তাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা সঙ্গত মনে হয়। মনে হয়, এ তো কমন সেন্স।
গলা ভারী করে কথা বলে, বড় বড় ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করে, যেমন অতি খেলো কথাকে কিছু লোক ওজনদার কথা বলে চালাবার চেষ্টা করে, সেই রকম একটা ‘বিজনেস অ্যাজ় ইউজুয়াল’-এর ভাব আরোপ করা হয় জঘন্য বৈষম্যের উপর। এ ক্ষেত্রেও হয়তো সেই চেষ্টা হবে।
কিস্যু হবে না তাতে। আমার ফটোজার্নালিস্ট বন্ধুদের কাছে সারা বিশ্ব থেকে ফোন আসছে। কলকাতা এমন কথা বলতে পারে?
আজ কলকাতা প্রেস ক্লাবের ব্যর্থতার দিন। নেতৃত্বের কাজ কেবল নিয়মরক্ষা নয়, অতীতের ভুলের সংশধোন করে প্রতিষ্ঠানে ন্যায় ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা করাও নেতাদেরই কাজ।
ক্লাবের কর্তারা যে সাংবাদিককে যা ‘পরিষেবা’ দিয়েছেন, সেই সাংবাদিক সেই সব ‘প্রাপ্তি’ মনে রাখবে। জ্যাকেট, শাড়ি, সুলভ টিকিট, তুরন্ত টিকা, পেনশন-প্রশিক্ষণ, বেশ বেশ। কিন্তু কালকের ভোটের যে ফল হল, তা সাংবাদিকের আত্মপরিচয়ের, আত্মমর্যাদার শিকড়ে আঘাত করেছে। সেই ক্ষতি চারটে ভাঙা বিস্কুট ছুঁড়ে পূরণ করা যাবে না।
হয়তো সারা বিশ্বের ফটো জার্নালিস্টদের মধ্যে এ কথা চাউর হয়ে গিয়েছে এতক্ষণে — কলকাতা এক এমন শহর, যা ক্যামেরাকে অসম্মান করে।
গতকাল সকালেই কসবায় নতুন জমিতে ‘ভূমিপূজা’ হয়েছে ক্লাবের। নতুনের ভিত্তি স্থাপন হচ্ছে বস্তাপচা, গা-গোলানো আকচা-আকচির উপরে, এর চাইতে আক্ষেপের কথা আর কী হতে পারে?
কোন দেবতাকে পুজো চড়াচ্ছে প্রেস ক্লাব, ভেবে দেখুক।