করোনা সংলাপ ১
আমাদের গ্রামে পঁচিশটা পরিবার দুদিন না খেয়ে আছে। ওদের রেশন কার্ড নেই, প্রধান ওদের সই করে কুপন দেয়নি, তাই রেশন তুলতে পারছে না। কেরোসিন নেই, গ্যাস কেনার পয়সা নেই, কাঠকুটো দিয়ে রান্না হচ্ছে, তাই এখানে গ্রামের লোকে একবেলা ভাত রাঁধছে। ভাত আর আলুসেদ্ধ খেয়েছে সবাই, এই পয়লা বৈশাখের দিনও। কলকাতার বাজারে নাকি লোকে তিন-চার হাজার টাকার ইলিশ কিনেছে আজ? সত্যি নাকি, দিদি? একজন গেছিল কলকাতার একটা বাজারে, সে বলল। আমরা গ্রামের লোকেরা না খেয়ে মরলে কলকাতার বড়লোকেরা কী খাবে? চাল-সব্জি কিছু ফলাতে তো পারবে না, ওরা তখন টাকা খাবে, কম্পিউটার খাবে, মাউস খাবে।
[দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক নারী সংগঠনের নেত্রীর সঙ্গে]
(সঙ্গের ছবি ওই গ্রামের নয়)
করোনা সংলাপ ২
উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা ব্লকের সুটিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে থাকি। আমার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে, সিঙেরডাঙা গ্রাম আর সুটিয়া বাজারের মধ্যবর্তী জায়গায় রয়েছে আদিবাসী পাড়া। প্রায় ৭২টি পরিবারের বাস। বাসস্থান বলতে দু-একটা সরকারি প্রকল্পের পাকা বাড়ি ছাড়া সবই বাঁশের খুঁটির নড়বড়ে ঝুপড়ি। বেশির ভাগই দিনমজুর, এখন কাজ নেই। গ্রামে ঢুকলেই দেখা যাচ্ছে, চারিদিকে শুধুমাত্র একটু খাবারের জন্য যেন হাহাকার চলছে। এমন ১৬-১৭টা পরিবার দেখলাম, যারা রেশনের চাল ভিজিয়ে খাচ্ছে। কারণ খিদের জ্বালায় হাঁটা-চলার ক্ষমতাও তাদের নেই। রান্না করার কাঠ কুড়োতে যেতে পারছে না।
[জ্যোতিপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গে]
(সঙ্গের ছবি ওই গ্রামের নয়)
করোনা সংলাপ ৩
আজ এক হোটেল বয়ের সঙ্গে দেখা হল। সে বলল, সাফানগর গ্রামে থাকি। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। কেরোসিন নেই। ছোট ছেলে সারাবছর লন্ঠনের আলোয় পড়ে। এখন তেল নেই। তাই কটা মোমবাতি রেশন থেকে দিলে,ছেলেটা আমার পড়া লেখাটা ঠিকঠাক করতে পারত।
তার ছেলে এখন ভোরে উঠে পড়াশুনো শুধু দিনের আলোতেই করছে।
[দক্ষিণ দিনাজপুরের একটি জেলার সরকারি আধিকারিকের সঙ্গে]
(সঙ্গের ছবি ওই গ্রামের নয়)
করোনা সংলাপ ৪
জলপাইগুড়িতে এক ভদ্রলোক এসেছেন। বড় কোম্পানিতে কাজ করেন, মাঝারি একটা হোটেলে ছিলেন। লকডাউন শুরু হতে হোটেল বন্ধ, তাঁকে বার করে দিয়েছে। তিনি এখন পাশে চায়ের দোকানে দুটো বেঞ্চি জোড়া করে রাতে শুচ্ছেন। দুদিন কেবল মুড়ি বিস্কুট খেয়ে ছিলেন, এখন আমরা খাবার দিচ্ছি। জলপাইগুড়ি আর হলদিবাড়ির ৩৮জন মনোরোগী আর ভবঘুরে, যারা রাস্তায় থাকে, তাদের যে খাবার বিলি করছি, সেই খাবারই দিচ্ছি। বুঝলেন, এই সময় টাকা থেকেও লাভ নেই।
এই সেদিন ফোন পেলাম, জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের চত্বরে রয়েছেন কোচবিহার কোর্টে প্র্যাকটিস করা এক উকিল। শিশুপুত্রকে নিয়ে স্ত্রী ভর্তি, দশ বছরের মেয়েকে নিয়ে তিনি হাসপাতাল চত্বরে দুদিন ধরে সামান্য শুকনো খাবার ছাড়া কিছু জোগাড় করতে পারেননি। "ওনাকে খেতে দাও, যত টাকা লাগে দেব," বললেন আমার পরিচিত। আমরা গিয়ে দেখি, দুর্বলতায় তাঁর হাত-পা কাঁপছে, ছোট মেয়েটি নেতিয়ে পড়েছে। আমরা জলপাইগুড়ি সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালে রোগীর আত্মীয়দের রান্না-করা খাবার দিচ্ছি। এ বার সদর হাসপাতালেও কিছু দিন দিতে হল। আমাদের নীতি অনুসারে, সবই বিনা পয়সায়। এখন অন্য একটি সংস্থা সদর হাসপাতালে দিচ্ছে। এই মানুষগুলোর সঙ্গে টাকা থাকলেও খাবার কেনার উপায় নেই, সব দোকান বন্ধ। তাই বলছি, এখন টাকা থাকলেও লাভ নেই।
[গ্রিন জলপাইগুড়ি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অঙ্কুর দাসের সঙ্গে]
করোনা সংলাপ ৫
আমাদের গ্রামে অধিকাংশ লোকই পরিযায়ী শ্রমিক। কেউ কেউ মিডল ইস্টে যায়, বেশির ভাগ কেরল আর বম্বে। আমি একটা সরকারি ব্যাঙ্কের একটা কাস্টমার সার্ভিস পয়েন্ট চালাই গ্রামে। আটটার পরে খুলি। কদিন থেকে দেখছি, ভোর চারটে থেকে লোক লাইন দিচ্ছে। একশো, দুশো, পঞ্চাশ, যে যেমন পারছে তুলে নিচ্ছে। অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি। পাশের ই-ব্যাঙ্কিং সেন্টারে আরেকটা লাইন পড়ছে, জনধন অ্যাকাউন্টে পাঁচশো টাকা ঢুকলো কিনা চেক করার জন্য। সে লাইন ভাবতে পারবেন না, তিনশো-চারশো জন দাঁড়িয়ে থাকছে। পুলিশ দিয়ে লাইন সামলাতে হচ্ছে। লোকের হাতে আর টাকা নেই। যারা চেয়ে খায়, তারা তবু কিছু না কিছু পাচ্ছে। যারা খেটে খায়, তাদের অবস্থা এখন আরও খারাপ।
[কান্দি ব্লকের মহলন্দী গ্রাম পঞ্চায়েতের এক বাসিন্দার সঙ্গে]
(সঙ্গের ছবি ওই গ্রামের নয়)
করোনা সংলাপ ৬
বালুরঘাট ব্লকের কাশমুলাই গ্রামে মানুষ গাছের কচি পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। কখন পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়বে, তবে তাই দিয়ে রান্না হবে। রান্না কী হচ্ছে? ত্রাণ দিতে গিয়ে আমার বন্ধুরা দেখে এসেছে, গরু যে ঘাসপাতা চিবিয়ে খাচ্ছে, তাই সিদ্ধ করে গ্রামের মানুষ খাচ্ছে। মানুষ আর পশুর খাবার এক হয়ে গিয়েছে। গ্রামে বেশ কিছু আদিবাসী পরিবার, তাদের আধার, ভোটার কিচ্ছু নেই, রেশন কার্ডও না। এখন কুপন পেয়ে রেশনের দু কেজি চাল পেয়েছে। কিন্তু রাঁধবে কী দিয়ে, কাঠকুটো, শুকনো পাতা ছাড়া এখন আর কোনও জ্বালানি নেই এই গ্রামে।
[বালুরঘাটের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যের সঙ্গে]
(ছবিটি কাশমুলাই গ্রামের এক বৃদ্ধার)
করোনা সংলাপ ৭
ধুবুলিয়ার দিকে যাচ্ছিলাম, দেখি এক বৃদ্ধা দুপুর রোদে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছেন। জাতীয় সড়ক দিয়ে হেঁটে হেঁটে কোথায় চলেছেন? হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, নাতনির মুখে শুনেছেন, অ্যাকাউন্টে নাকি ৫০০ টাকা দিয়েছে সরকার। খোঁজ নিতে হাসাডাঙা থেকে ধুবুলিয়া সাত কিলোমিটার হেঁটে ব্যাঙ্কে যাবেন বলে বেরিয়েছেন পঁয়ষট্টি বছরের সনকা ঘোষ। কাঠফাটা রোদ থেকে বাঁচতে ময়লা আঁচলটা মাথায় জড়িয়েছেন। ঘরে পাঁচটা লোক, রেশনের দশ কেজি চাল ছাড়া কিছু নেই। রাজনৈতিক দলের লোকেরা কিছু পরিবারকে সাহায্য করেছে, কিন্তু সনকারা পার্টি করেন না, তাই পাননি কিছু। রাস্তায় তখন ট্রাক ড্রাইভারদের খাবার ও জল দেওয়া হচ্ছিল। সনকাদেবীকেও দেওয়া হল।
[কৃষ্ণনগরের এক সাংবাদিকের সঙ্গে]
(ছবিতে সনকা ঘোষ)
[লেখাগুলি ফেসবুকে প্রকাশিত এবং লেখিকার অনুমতিক্রমে গৃহীত]
প্রায় কাছাকাছি কিছু অভিজ্ঞতা হল মহারাষ্ট্রে। মুলশি পিরঙ্গুট চাকন - একই অবস্থা।
ভাষাহীন :/