পাশাপাশি গাঁয়ে থাকে দুই বৈদ্য, ঢিপ কবিরাজ আর ছিপ কবিরাজ। ঢিপ কবিরাজ সকাল থেকে ঘসর ঘসর করে শিল নোড়ায় পাতা-শিকড় বাটে, তার পিছনে এত বড় হাঁড়িতে টগবগ করে কী সব ফোটে, তা থেকে কখনও সবুজ ধোঁয়া, কখনও বেগুনি ধোঁয়া বেরোয়। রোগী যেই তার কাছে গিয়ে বসে, অমনি কালো চাদরের তলা থেকে ডান হাত বাড়িয়ে ঢিপ কবিরাজ তার নাড়ি দেখে, আর আঁতকে ওঠে, ‘ওরে, করেছিস কী, করেছিস কী তুই, কফ ঘন হয়েছে, বায়ু খেপে উঠেছে, হায় হায়, কী হবে রে!’ এই বলেই বাঁ হাতটা দিয়ে নিজের কপালে মারে এক চাপড়। এক এক বার নোড়াটা থেকে যায় হাতে, কপালে লেগে আওয়াজ হয়, ঢিপ।
পাড়ার পাজি ছেলেগুলো সেই আওয়াজ শুনবে বলে রোগীর পিছু পিছু যায়। বাজি ধরে, এ বার ঢিপ হবে, কী হবে না। ঢিপ কবিরাজ রোগী পেলে তিন রকম পাঁচন আর সাত রকম বড়ি না দিয়ে ছাড়ে না। বলে, ‘ওষুধ বাঁচাতে গেলে তুই বাঁচবি না, বাপ। ঢকঢক করে খাস, টপটপ করে খাস।’
আর ছিপ কবিরাজ? তাকে পেতে হলে রোগী যায় শালুকপুকুরে। সেখানে জলে ছিপ ফেলে সারা বেলা বসে থাকে ছিপ কবিরাজ। রোগী যদি কাছে গিয়ে বসে বলে, ‘ও কবরেজ মশাই, পেট কামড়ায়, ঘুম হয় না’ অমনি ছিপ কবিরাজ ফিস ফিস বলে, ‘শশশ্, মাছ পালাবে।’ রোগী বসে বসে, মশার কামড় খেয়ে খেয়ে, শেষে নাকে কেঁদে বলে, ‘ওঁ কঁবরেজ মঁশাই!’ তখন ছিপ কবিরাজ ভুরু কুঁচকে ধমকায়, ‘আঃ, পেট কি তোর পালাবে? যত্ত সব।’ এই বলে আধ মিনিট নাড়িতে আঙুল রেখে বলে, ‘তুই বেটা কামড়ে কামড়ে তেলেভাজা খেয়েছিস, এখন পেট তোকে কামড়াবে না তো কি, হাত বোলাবে? কাল সারা দিন উপোস, রাতে ঝোলভাত, যা পালা।’ ছিপ কবিরাজ ওষুধ দিতে চায় না মোটে। বলে ‘মানুষ ওষুধ খায়, না ওষুধ মানুষ খায়? যত্ত সব।’
কেউ যদি বলে, ‘মশায়, ও পাড়ার কবরেজ মশাই যে ওষুধ খেতে বললেন —’
অমনি ছিপ কবিরাজ বলে, ‘ওকে আগে নিজের হাঁপানিটা ভাল করতে বল। বেটা হেঁপো রোগী।’
আর ঢিপ কবিরাজকে যদি কেউ বলে, ‘ও পাড়ার কবরেজ মশাই তো ওষুধ দিলেন না —’
অমনি ঢিপ কবিরাজ বলবেন, ‘ও নিজের হাতে একটা পাঁচন বানিয়েছে কখনও? বেটা মেছো ভূত।’
এক বার দিকে হয়েছে কী, সে দেশের রাজার ভারী অসুখ করেছে। মুখে হাসি নেই, চোখের তলায় কালি, মাঝেমাঝেই কাতরে কাতরে ওঠে আর বলে, ‘ও হো হো, আমি আর বাঁচব না।’ আমেরিকা থেকে সাহেব ডাক্তার এল। টিপেটুপে দেখে বলল, ‘মহারাজ, বেদনাটা চিনচিন না ঝনঝন, উপর থেকে নীচে, না পাশ থেকে মাঝে?’ রাজা রেগে গিয়ে বলল, ‘সবই আমি বলে দিলে তোমাকে হাওয়াই জাহাজের টিকিট কেটে আনা হল কেন হে?’
তখন রাজার শরীরের ভিতরের এত এত ছবি তোলা হল। ছবি দেখে রাজা বলল, ‘অ্যাঁ, আমার ফুসফুস এত ফোঁপরা? মগজে কালো কালো এত ফাঁক? রানি, ভাবনায় ভাবনায় আমার মাথা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, আমি আর বাঁচব না।’ তাই শুনে সাহেব হেসে ফেলল, বলল, ‘কী যে বলেন স্যর, সবার মাথায় অমন থাকে।’
রাজা খেপে গিয়ে বললেন, ‘তুমি কটা রাজার মাথা দেখেছ হে?’
সাহেব বলল, ‘দেখব কী করে? আমেরিকায় রাজা নেই।’
রাজা বলল, ‘তা হলে যাও বাপু। সবার মাথা আর রাজার মাথা কি এক? ওরে, একে ফেরত পাঠা।’
তারপর যে সব দেশে রাজা আছে, রানি আছে, সুলতান আছে, সে সব দেশ থেকে ডাক্তার-বদ্যি এল। কত ওষুধ খাওয়াল, ছুঁচ ফোটাল, পিঠে মালিশ করল, পেটে সেঁক দিল। বেঁটে, গোল, চৌকো, উঁচু, নীল, সবুজ শিশিতে রাজবাড়ি ভরে গেল।
রাজার ওষুধের খালি শিশি কুড়িয়ে নিয়ে সে দেশের ছেলেমেয়েরা কেউ কাচের গুলি ভরে রাখল, কেউ শিশির ভিতরে কাঠকুটো দিয়ে শুঁয়োপোকা পুষল। তাদের মায়েরা কেউ মাথার তেল রাখল, কেউ জল ভরে গাছ লাগাল। দিনে দিনে সে গাছ লতিয়ে জানলা বেয়ে উঠল, শুঁয়োপোকারা প্রজাপতি হয়ে উড়ে গেল, রাজা আর ভাল হয় না। শেষে রানিমা বলল, ‘ওরে, তোরা গাঁয়ের কবিরাজ ডাক।’
রানিমার হুকুমে রাজার লোকজন ছুটল। তখন শালুকপুকুরে ছিপ কবিরাজ বসে। অনেক দিন পরে একটা পুঁটিমাছ সবে টোপ গিলেছে, কবিরাজ বেশ খেলিয়ে খেলিয়ে তুলছে, এমন সময়ে রাজার বেয়ারাগুলো এসে কবিরাজকে পাঁজাকোলা করে তুলে দে ছুট। একেবারে রাজার সামনে গিয়ে নামিয়ে দিল।
কবিরাজ হাঁউমাউ করে বলল, ‘রাজামশাই, সবে ফাতনাটা নড়েছিল, আর এই ভূতগলো আমাকে তুলে এনেছে। এগুলোকে শূলে দিন!’
কোটাল বলল, ‘চোপ, মাছ বড় না রাজা বড়।’ ছিপ কবিরাজ মুখ হাঁ করে ‘মা-’ বলেই, কোটালের লাল চোখ দেখে ঢোক গিলে কথাটাকে পেটে পাঠিয়ে দিল। তারপর হাত বাড়িয়ে রাজার নাড়ি দেখল। আধমিনিট দেখেই ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘ধুর ধুর, বায়ু একটু বেড়েছে কেবল। ক’দিন গাঁদাল পাতার ঝোল দিয়ে মোটা চালের ভাত খাবেন, সকাল-বিকেল ওঠবোস করবেন। এঃ, শুধু শুধু পুঁটিমাছটা মিস হয়ে গেল, যত্ত সব।’
রাজা কটমট করে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বেদনায় মরছি আর পুঁটি মাছের কথা ভেবে তোমার মন কটকট করছে?’
কোটল বলল, ‘রাজাকে ওঠবোস করতে বলছ, এত বড় সাহস?’
রানিমার সই বলল, ‘রাজাকে মোটা চালের ভাত খেতে বলছে, ম্যাগো।’
ছিপ কবিরাজকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে সবাই পুরে দিল ফাটকে।
রানিমার তাড়া খেয়ে লোকজন ফের ছুটল কবিরাজের খোঁজে। খানিক পরে দেখা গেল, তারা হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে আসছে। তাদের আগে আগে ছুটে আসছে ঢিপ কবিরাজ, এক হাতে খলনুড়ি, আর এক হাতে ইয়া মোটা বই — পাঁচন-সংহিতা। পিছু পিছু ছুটে-আসা লোকেদের কারও হাতে শিলনোড়া, কারো কাঁধে লতা-পাতার বোঝা, কারও মাথায় ডেকচি, কারও কাঁখে চুবড়ি। ঢিপ কবিরাজ সভায় ঢুকেই রাজার নাড়িতে হাত রেখে, চোখ বুজে, একেবারে কাঠ। দশ মিনিট, বিশ মিনিট, কথা নেই। সভার লোকেরা সবাই নট নড়ন চড়ন।
তার পরে চোখ কপালে তুলে কবিরাজ বলল, ‘মহারাজ, করেছেন কী? এ যে দেখি, কফ খফ-খফিয়ে উঠেছে, বায়ু ঘুরনি নাচ জুড়েছে, পিত্ত দাউদাউ করছে! কী ভয়ানক, কী সাংঘাতিক! ওরে তোরা আমাকে আগে ডাকলি না কেন রে?’ এই বলে পাথরের খল-নুড়ি ধরা হাতটা তুলে জোরে মাথা চাপড়াল কবিরাজ, আওয়াজ হল, ‘ঢিপ!’
তারপর ডেকচির জলে লতা-পাতা বেছে, খলনুড়িতে শামুকের খোল গুঁড়ো করে, তাতে এক চিমটি রুপোর তবক দিয়ে, ফুটিয়ে, ছেঁকে, শীতল করে, মেপেজুপে, এক শিশি ভরা ঘন সবুজ ওষুধ রাজাকে দিল। বলল, ‘মহারাজ, এই পাঁচন কাল সকালে খাবেন, বেদনা আর থাকবে না।’
‘সকালে কেন, এখনই খাই,’ বলে রাজা এক চামচ মুখে দিল। খেয়েই ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে লাগল।
ঢিপ কবিরাজ বলল, ‘মহারাজ, ওষুধের গুণ দেখুন, খেতেই বমনধৌতি হয়ে গেল।’
রাজা বলল, ‘বটে! এত গুণ যখন, তুমিও খাও। ওরে কে আছিস, ওই বেটাকে এই পাঁচন খাওয়া।’
অমনি কোটাল গিয়ে জাপটে ধরল ঢিপ কবিরাজকে, আর পাঁচটা লোক এসে কবিরাজের মুখ খুলিয়ে খুব খানিকটা পাঁচন গিলিয়ে দিল। তারপর পুরে দিল ফাটকে।
ফাটকে দুই কবিরাজের অনেক দিন পর দেখা হল। গোড়ায় দু’জনে দুই দেওয়ালের দিকে মুখ করে রইল। তারপর এ ওর দিকে আড়চোখে চাইল। তারপর পাশাপাশি বসল।
ছিপ কবিরাজ বলল, ‘উফ।’
ঢিপ কবিরাজ বলল, ‘ওঃ।’
ছিপ কবিরাজ বলল, ‘এ বার কী?’
ঢিপ কবিরাজ বলল, ‘এই কি শেষ?’
তারপর সারা রাত দুজনে গুজগুজ করল। সকালে দু’জনে কোটালকে ডেকে পাঠিয়ে, অনেক কাকুতি-মিনতি করে, রাজার দেখা পেল। ঢিপ কবিরাজ হাত জোড় করে বলল, ‘মহারাজ, ভুল আমাদেরই। আপনি রাজা, আপনার রোগ যে আর পাঁচজনের মতো নয়, তা বুঝতে পারিনি।’
ছিপ কবিরাজ বলল, ‘আমরা দু’জনে সারা রাত সব বই খুঁজে আপনার রোগটা খুঁজে বার করেছি।’
রাজা বলল, ‘কী নাম রোগের?’
‘এ রোগের নাম নিয়হস্যুং কিং। চিনদেশের রোগ, মহারাজ।’
রানিমা বললেন, ‘ওগো, তখনই বলেছিলাম, চাউ মিন কম খাও। তা কি শুনলে?’
রাজা উঠে বসে বলল, ‘হুঁ, নামের শেষে রয়েছে কিং। কিং মানে তো রাজা। চিনে কি রাজা আছে?’
ঢিপ কবিরাজ বললেন, ‘এখন নেই মহারাজ, তবে অনেক দিন ছিল। রাজাদের রোগগুলো লুকিয়ে চুরিয়ে রয়ে গেছে এখনও। মনে হয় রাজহাঁস বয়ে নিয়ে এসেছে এ দেশে।’
রাজা খুশি হয়ে বললেন, ‘রাজার রোগ কি আর যে সে বইতে পারে, রাজহাঁসেই এনেছে। তো এর ওষুধ কী?’
ছিপ কবিরাজ বলল, ‘সদ্য-পাকা মাখনভোগ কলা, কাতলা মাছের পেট থেকে বার-করা ডিম, আর চাক-ভাঙা নিম ফুলের মধু।’
রাজা বললেন, ‘সে আর কঠিন কী? ওরে কে আছিস —’
দুই কবিরাজ হাঁ হাঁ করে উঠল। ‘নানা মহারাজ, আগে সবটা শুনুন।’ এই বলে ঢিপ কবিরাজের সব চাইতে মোটা পুঁথিটা থেকে ছিপ কবিরাজ সুর করে পড়ল,
রাজা যদি চায় রোগ সারিতং
তবে রাজা গিয়ে কলা পাড়িতং
রাজা মাছ ধরিতং-কাটিতং,
রাজা গাছে মৌচাক ভাঙিতং।
কোটাল বলল, ‘আমরা থাকতে রাজা নিজে কলা পাড়বেন, মাছ ধরবেন? না না, আর কোনও ওষুধ দেখ।’
ঢিপ কবিরাজ বললেন, ‘তুমিই দেখ,’ এই বলে দু’মণি পুঁথিখানা চাপিয়ে দিলেন কোটালের হাতে। কোটাল লেখাপড়ায় বেজায় খারাপ, চিরকাল গুরুমশাইয়ের বেত খেয়েছে। অতবড় পুঁথি ভরা খুদে খুদে লেখা দেখেই তার ঘাম ছুটে গেল। সে তাড়াতাড়ি পুঁথি ফেরত দিয়ে বলল, ‘তাই তো মহারাজ, আর তো ওষুধ নেই। ওই একটাই ওষুধ।’
রাজা উঠে বসে বলল, ‘আমিই যাব তবে ওষুধের জোগাড়ে। চল হে কবরেজ মশাই।’
রাজা বেরোতেই পিছু পিছু পাইক-পেয়াদা এল। রাজা ধমক দিয়ে বলল, ‘আমি কি লড়াই করতে চলেছি? যা ফিরে যা।’
মাখনভোগ কলা যেখানে সেখানে হয় না। সাড়ে চার মাইল দূরের এক গাঁয়ে এক চাষির কলাবাগানে কয়েকটা গাছ আছে। সারা দুপুর হেঁটে হেঁটে বিকেলের দিকে রাজা আর দুই কবিরাজ এসে হাজির সেই গাঁয়ে। চাষি তো রাজাকে দেখে খুশিতে চৌচির। তাড়াতাড়ি চৌপাই পেতে দিল, পাখা নেড়ে নেড়ে হাওয়া করতে লাগল। গাঁয়ের লোক কিছুতেই সে রাতে রাজাকে ছাড়ল না। পুকুরে জাল ফেলে মাছ তুলল, ঘরে ভাঙানো চালের ভাত দিয়ে খেতে দিল। অনেক দিন পর রাজা থালার সবটুকু ভাত খেয়ে ঢেঁকুর তুলল। তাই দেখে দুই কবিরাজও ঢেঁকুর তুলল।
পরদিন এক কাঁদি কলা কেটে দিল গাঁয়ের লোকেরা। আর কেউ কলা বইলে ওষুধে কাজ হবে না। তাই রাজা নিজেই কাঁদি বয়ে বয়ে চলল দু’মাইল দূরের আর এক গাঁয়ে। সেখানে পোনা মাছের চাষ হয়। ছিপ কবিরাজ পিঁপড়ের ডিম, ভেলি গুড়, আমসত্ত্ব, আর কী কী সব মিশিয়ে টোপ তৈরি করল। রাজা ছিপে টোপ গেঁথে বসল পুকুরে। সে দিন মাছ উঠলই না। রাতে সেখানেই এক জেলের বাড়িতে কুচো মাছের টক আর পান্তা ভাত খেয়ে ঘুমোল রাজামশাই।
পর দিন আবার ছিপ নিয়ে বসল রাজা। মুখে কথা নেই, নাওয়া-খাওয়া নেই, চোখ ফাতনার দিকে। পুকুর ঘিরে লোকের জটলা, তাদের চোখ রাজার দিকে। দুপুর দুটোয় ছিপে উঠল ডিম-ভরা কাতলা। সকলের কী হাততালি! শুনে অনেক দিন পরে রাজা হাসল। তাই দেখে কবিরাজ মশাইরাও মুখ টিপে হাসল।
কাঁধে কলার কাঁদি, আর হাতে মাছ ঝুলিয়ে রাজা চলল মৌচাকের খোঁজে। মাইল দেড়েক দূরে মহুয়ার বন। সারা গায়ে কলাপাতা বেঁধে, মাথায় শালপাতার টুপি পড়ে, মহুয়া গাছে উঠে রাজা লাঠি দিয়ে মৌচাক ভাঙল। টপটপ করে মধু ঝরে পড়ল। পাতার ঠোঙায় তা ধরে রাজা নেমে এল। দু’চারটে মৌমাছি হুল ফুটিয়েছে, কবিরাজরা ওষুধ দিতে গেলে রাজা সরিয়ে দিল। বলল, ‘লড়াইয়ে কত কাটাকুটি হয়, এতো কিছুই নয়।’
এ বার ওষুধ তৈরি করতে হবে। কবিরাজদের কথা মতো ইঁটের উনুন তৈরি করল রাজা। বন থেকে কাঠকুটো এনে আগুন ধরাল। কোমরের তরোয়াল দিয়ে মাছের পেট কেটে বার করল ডিম। নতুন কড়াইতে ডিম ভাজল। তারপর কবিরাজদের কথা মতো, মাখনভোগ কলার মাঝে ডিমের টুকরো ঢুকিয়ে, নিম ফুলের মধু মাখিয়ে, চিবিয়ে চিবিয়ে খেল। সে রাতে রাজামশাই অনেক দিন পর নাক ডাকিয়ে ঘুমোল। দুই কবিরাজও নাক ডাকাল।
পর দিন কাক ভোরে উঠে তিন জনে ফিরে এল রাজবাড়ি। পাইক-পেয়াদারা রাজাকে দেখে ছুটে এল। রাজা ভিতর মহলে যেতে যেতে হুকুম দিল, ‘দুই কবিরাজকে ফাটকে পোর।’
ফের ফাটক! দুই কবিরাজের মাথায় হাত। ছিপ কবিরাজ বলে, ‘রাজার তো মেজাজ নয়, পেঁয়াজ। ঝাঁঝ আছে কেবল। যত্ত সব।’ ঢিপ কবিরাজ বলে, ‘তবে কি ফাটকে বসে পাঁচন গিলে বাকি জীবন কাটাতে হবে? হায় হায়!’
সকাল গড়িয়ে যখন দুপুর হল, তখন এক পেয়াদা ফাটকের দরজা খুলে তাদের নিয়ে চলল। দুই কবিরাজের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। ভাবছে, তবে কি গুমঘরে নিয়ে গিয়ে মাথা কাটবে?
খানিক পরে তারা এল বিশাল এক ঘরে। সাদা পাথরের ঝকঝকে মেঝে, তাতে দু’খানি পশমের আসন পাতা, সামনে রুপোর থালা। তাতে জুঁইফুলের মতো ভাত। থালা ঘিরে থরে থরে বাটিতে কত রকম ডাল, তরকারি, মাছ-মাংস, চাটনি-দই। রানিমার সইরা পাখা হাতে বসে।
দুই কবিরাজ খায় আর ভাবে, ‘এই কি শেষ খাওয়া?’
খাওয়ার পরে এল রাজা। দুই কবিরাজ বলল, ‘মহারাজ, কী ভুল করেছি আমরা? কেন আবার ফাটকে পুরলেন?’
রাজা দু’জনের গলায় মোতির মালা পরিয়ে বলল, ‘আপনারা আমার রোগ সারিয়েছেন, এই তার ইনাম। তবে দুজনে মিলে আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছেন, তা কি বুঝিনি? আমার আসলে দরকার ছিল হাঁটাহাঁটি, খাটাখাটি, তাই তো?’
ছিপ কবিরাজ বলল, ‘মহারাজ, রোগীকে সারাতে আমাদের ছলনাও করতে হয়। দোষ নেবেন না।’
রাজা বলল, ‘রাজাকে মিছে বললে সাজা পেতেই হবে। নিয়হস্যুং কিং বলে কোনও অসুখ নেই।’
দুই কবিরাজ এ ওর দিকে তাকাল। তারপর ছিপ কবিরাজ বলল, ‘মহারাজ, মিছে কথা নয়, একটু উল্টে বলেছি শুধু।’
ঢিপ কবিরাজ বলল, ‘আর দুটো অনুস্বর জুড়েছি মহারাজ। বাদ দিলেই বুঝবেন, আমরা মিছে বলিনি।’ বলেই দুই কবিরাজ ছুট দিল রাজবাড়ি থেকে।
রাজা তখন ‘নিয়হস্যুং কিং’ থেকে মনে মনে দুটো ‘ং’ বাদ দিয়ে দেখে, কথাটা হল ‘নিয়হস্যু কি।’
আর সেটা উলটে নিলে হল, ‘কিস্যু হয়নি।’
মহারাজ হো হো করে হেসে উঠল। তাই শুনে কোটাল, পাইক, পেয়াদা, রানিমা, রানিমার সইরা সব ছুটে এল। সবাই বলল, ‘আহা, কী বড় কবিরাজ গো! আমাদের রাজামশাইয়ের রোগ একেবারে সারিয়ে দিয়েছে।’