দমবন্ধ হয়ে আসছিল।
ভাবলাম, যাই একটু ময়দানে ঘুরে আসি।
সেখানেও দেখি মেলা ভিড়।
হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ের দিকে এগোই।
ওই তো নদী।
আহ।
মন ভালো হয়ে যায়।
নদীর ধারে বাঁধানো চৌতালে বসতে যাব, দেখি একটা মার্সিডিজ এসে ব্রেক কষল।
কী ব্যাপার?
সাব বুলা রহে!
উর্দি পরা চালক বলেন।
সাব মানে সাহেব, আমাকে?
বিস্মিত হই।
বিস্মিত হতে পারো, কিন্তু বিস্ময় দেখাতে নেই।
আধুনিক শাস্ত্র মতে তাই সিদ্ধ।
বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব করে এগোই। ততোক্ষণে দরজা খুলে গেছে গাড়ির।
দেখি দেখি চেনা চেনা লাগে।
কী রে ব্যাটা বমকে গেছিস? চিনতে পারছিস না?
ন্না মানে এই রকম দেখতে একজনকে চিনতাম, স্কুলে পড়তো। কিন্তু সে তো শুনছি, বিদেশে থাকে?
নাম কী?
ভোলা।
ওরে ব্যাটা, আমিই সেই। এই দেখ ঘাড়ে লাল জরুল।
সব নকল করলেও জরুল তো নকল হবে না।
ঠিক ঠিক-- বলতেই হয়।
আয় উঠে আয়।
আমি?
তুই না তো আর কে আছে?
আমি একটু হাওয়া খেতে এসেছিলুম।
চল, আমি তোকে ভালো হাওয়া প্রেজেন্ট করবো। গ্যারান্টেড মাল।
হাওয়া আবার মাল হলো কবে? ভাবি।
এইসব ভাবতে ভাবতে আবিষ্কার করি, আমি মার্সিডিজে উঠে বসেছি।
গাড়ি চলছে।
গান বাজছে, টুম্পা সোনা।
ব্রিগেডে আসি। গাড়ি থামে।
দাঁড়া একটু হাওয়া মাপি। ভোলা বলে।
হাওয়া খায় শুনেছি, হাওয়া মাপি কী জিনিস?
ও-সব পরে বলবো?
নদীর ধারে দেখলি কতো লোক হাওয়া ভরছে!
হাওয়া ভরা? বাপের জন্মে শুনিনি।
তবু ঘাড় নাড়ি। পাছে বোকা ভাবে। -ওই যে বড় বড় ট্যাঙ্কার দেখলি না।
আমি ভাবলাম, তেলের।
একটু বুদ্ধি খাটা। শুধু তেলে দুনিয়া আর চলে না।
কী সে চলে?
সে পরে বলবো। এখন একটু গবেষণা করতে হবে।
বলেই ভোলা দাঁড়িয়ে হুকুম দেয় -- লে আও।
অমনি দেখি পেছনের গাড়ি থেকে পাঁচ সাতজন লোক নেমে কী সব যন্ত্র ফিট করে দেয়।
ভোলা মনোযোগ দিয়ে দেখে চোখের সামনে যন্ত্র ধরে।
বলে, চলবে।
তবে একবার গিয়ে ল্যাবে দেখতে হবে দুদিনের জনসভার হাওয়ার সঙ্গে আজকের হাওয়ার তফাৎ কতোটা।
তবে আজ দশ ট্যাঙ্কার ভরে তো নাও।
অমনি সবাই ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আও জলদি আও।
আমার ঘুমানো রোগ।
ঘুমিয়ে পড়ি। ভোলার ঠ্যালায় উঠি। চোখ কচলাই, নামি।
ভোলা ফিসফিস করে বলে, এখানে ভোলা বলবি না,বলবি মি. সায়েন্টিস্ট।
বিজ্ঞানী তুই?
তুই না অঙ্কে শূন্য ছাড়া পেতিস না।
তুই সেকেলে রয়ে গেলি রে, তাই নদীর ধারে হাওয়া খেতে যাস। ছি ছি।
এখন ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলেই ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ম্যাথ কিছুই লাগবে না।
বায়োলজি পড়ে বিজ্ঞান গবেষণা হয় না?
তাও ঠিক।
লিফটের সামনে আসি।
দারোয়ান লিফটম্যান সেলাম ঠোকে ভোলা ওরফে মি. সায়েন্টিস্টকে।
১০ তলায় লিফট থামে। লিফট ম্যান দরজা খুলে দেয়।
একটা ঝাঁ চকচকে ঘরে ঢুকি।
দরজায় দেখি লেখা, ড. এম এম মল্লিক, এম ডি।
মনে পড়লো ভোলার আসল নাম ছিল, মদন মোহন মল্লিক।
স্যাররা বলতেন, বেল্লিক।
কী খাবি?
স্কচ হুইস্কি না ?
আমি ওসব খাই না।
আরে খা, দেখ কেমন লাগে। জীবনটাকে ভোগ করতে শেখ।
জল হবে?
জল? এই সাহেবকে ডাব ওয়াটার দাও।
সুদৃশ্য গ্লাসে ডাবের জল আসে।
গ্লাসের গায়ে বিজ্ঞাপনের মতো লেবুর টুকরো আটকানো।
লেবু দিয়ে ডাবের জল বাপের জন্মে খাই নি। না খেলে যদি ব্যাকডেটেড ভাবে।
চোঁ চোঁ করে মেরে দিই।
#
ভোলা থুড়ি মি. এম ডি থুড়ি মি. সায়েন্টিস্ট বলে, আবে এ-রকম করে খাচ্ছিস কেন পেঁচি মাতালের মতো।
তোর আবে মনে আছে।
শোন বে সব মনে আছে, শ্লা এখানে হিন্দি বা ইংরেজিতে গাল দিয়ে মুখ পচে গেছে।
তা বাংলায় দিস না কেন?
তাহলে ভাববে আমি ইঞ্জিরি জানি না।
ঠিক আছে। তোর কোম্পানির ব্যবসাটা কী?
দেখবি?
হ্যাঁ।
চল।
#
বাইরে আসি।
১০ তলা সুদৃশ্য শপিং মল।
সারি সারি দোকান। নিওন আলো। কিন্তু কোনো খদ্দের নেই।
জিজ্ঞেস করি, এতো বড়ো শপিং মলে একটাও খদ্দের নেই? কেন?
আছে তো। গিজগিজ করছে।
কই?
আছে, তুই দেখতে পাচ্ছিস না।
সে কী করে হয়। পরিষ্কার দেখছি কেউ নেই।
তোর অর্থাৎ আমাদের পুরানো কারা বেশ্যাখানায় যাস তুই কি জানিস? জানিস না। এর মানে কেউ যায় না নয়। তুই গেলে জানতে পারতিস। তুই ঘুষ খাস না। খেতে চাইলেও তোকে কেউ দেবে না। কারণ তোকে দিয়ে লাভ নেই। তুই ঘুষ চক্রে ঢুকলেই দেখবি সাদা শুভ্র নেতারাও বিজ্ঞাপনের নামে দলের নামে মেলার নামে পত্রিকার নামে টাকা তোলে। কেউ দাঁত দেখিয়ে কেউ চোখ নাচিয়ে কেউ একটু হেসে। ব্যাপারটা আদতে উনিশ আর বিষ।
এখানে তো আমি আছি।
'রক্তকরবী' নাটক দেখেছিস?
রক্তকরবী-- ভোলার মুখে।
ভোলা বুঝতে পারে, আমার বিস্ময়।
শোন আমাদের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মিশতে হয়। আমরা পয়সা দিই আর ওরা জ্ঞান দেয় -- যাতে পেটোবাজি না করেও পেটবাজি করতে পারি। পেট এবং ইংরেজি পি ই টি। বুঝা গেল কি গেল না!
আমি মিনমিন করে বলি, রবি ঠাকুরের 'রক্তকরবী' কীভাবে শপিং মলে এলো?
রঞ্জন কে নাটকে দেখা যায়? যায় না। কিন্তু একজন দেখে নন্দিনী। তুই নন্দিনী হ, রঞ্জন পাবি।
কীভাবে?
দেখ।
ভোলা থুড়ি মি. এম ডি থুড়ি.. ইশারা করেন, অমনি তিনজন ছুটে আসে।
স্যার।
একে দলে ভেড়াও।
অমনি তিনজন ছুটে আসে। আমাকে একটা সাদা পোশাক পরায়, সামনের চকচকে কাচে দেখি, আমাকে মনে হচ্ছে করোনা ওয়ার্ডের কর্মী অথবা চন্দ্রযানের অভিযাত্রী।
একটা সুইচ আছে, জ্যাকেটে ওটা টিপতেই আমার চোখের সামনের চশমায় আলো জ্বলে।
আমি দেখি গিজগিজ করছে লোক। দর করছে কিনছে।
ভোলা আমার ভার সঁপে দেয় একজন কর্মীর হাতে।
আমার একটা মিটিং আছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আর রাষ্ট্রসঙ্ঘের সচিবের সঙ্গে।
দেখা শেষ হলে ঘরে আয়।
গুল দিচ্ছে নাকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আর রাষ্ট্রসঙ্ঘের সচিবের সঙ্গে মিটিং।
কীরে বিশ্বাস হচ্ছে না।
নিজের চোখে দেখে যা।
ভার্চুয়াল মিটিং। ভোলার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ বোঝা যায়, তাকে সবাই গ্রিট করে, যায় প্রেসিডেন্ট ও সচিব।
আমি বের হয়ে আসি মি এক্সের সঙ্গে। মি এক্স এখানে নিরাপত্তা বিভাগের কর্মী। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়।
দেখি কোথাও লেখা আছে, গরম হাওয়া, পাশেই বিশুদ্ধ ঠাণ্ডা হাওয়া, হালকা অতি মাঝারি সব হাওয়ার দোকান।
কী ব্যাপার সেই হাওয়া আপনিও ব্যবহার করতে পারেন, যখন যেমন তখন তেমন।
হাওয়া তো খুব সাবধানে ব্যবহার করতে হয়। আপনি হাওয়া মিটারও পাবেন। সস্তায়। বলে দেবো।
কী কাজে লাগবে?
নির্বাচনে এ-সব লাগে। যার যেমন দরকার কিনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়।
হাওয়া গরম বা ঠান্ডা হয়ে যায়।
নতলায় শুধু উত্তরীয়।
এখানেও সেই গরম ঠান্ডা হালকা অতি মাঝারি নানা কথা লেখা।
এগুলোর মানে কী?
নির্বাচনের বাজারে কতো জায়গায় বলতে হয় নেতাদের। এলাকা বুঝে বলতে হয়। কোথাও গরম কোথাও নরম কোথায় হালকা শাসানি কোথাও চরম ঝাড়পিট পেটো বোমা।
এই উত্তরীয় পরলেই বক্তব্য তেমন বের হবে। বক্তার মুড ও মুখের কথা সেট করে দেবে বিষয়ভিত্তিক উত্তরীয়।
আমার মাথা বনবন করতে থাকে।
মি. এক্স বলেন পরের তলায় যাই?
না গেলেই নয়?
না যাওয়া ভালো শিখবেন। ওখানে রেডিমেড সাংবাদিক ও কলামিস্ট পাবেন উগ্র মৌলবাদী নরম চরম ফ্যাসিবাদী গণতান্ত্রিক উভয়তান্ত্রিক --যেমন চান, লিখে দেবেন।
তারপর?
টিভি চ্যানেল স্যার! ওই এক ফর্মুলা। গরম ঠান্ডা হালকা অতি মাঝারি বিশ্বস্ত বেইমান-- সব ধরনের। খালি চুক্তি করতে হবে। অন্তত তিনমাসের।
পরের তলায় পাঁক পাবেন। যতরকমের দরকার।
আপনার পছন্দমতো মাখিয়ে দেবে অপছন্দের লোককে। ট্রাই করবেন নাকি স্যার?
আমি ভয় পেয়ে দৌড়াতে থাকি। সঙ্গে সঙ্গে শত শত লোক দৌড়াতে থাকে।
কেউ জানতে চায় না, কেন দৌড়াচ্ছি।
কেউ বলে আগুন লেগেছে?
কেউ বলে ভূমিকম্প?
কেউ বলে, বিদেশি আগ্রাসন।
কেউ বলে দাঙ্গা লেগেছে।
আমি কিছুই বলি না।
শুধু বলি বুদ্ধি চাই বুদ্ধি।
অমনি মনে পড়ে পোশাক ও চশমা খুলে ফেল।
আমি অ্যাপ্রন খুলে ফেলি। চশমাও। কেউ নেই কিচ্ছু নেই।
শুধু আমি আর মি. এক্স।
একই রকম বিগলিত।
.