লোকটা ছোটো ওই মাচার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সাদা দাড়ি গোঁফে মুখ ঢাকা, চোখ প্রায় দেখা যায় না। গায়ে মলিন, রং ধরতে না পারা একটা জোব্বা মতো। পায়ে বেমানান সৈনিক জুতো। মানুষটি যেন ওখানে দাঁড়িয়ে আছে -সময়কালহীন। সামনে গাঢ় সবুজ থেকে নীলচে ধূসর, দূর দূর পর্যন্ত পাহাড়শ্রেণী।তরঙ্গের পর তরঙ্গ।পৃথিবীও এখানে সময়কালহীন।
আমার হাতে দূরবীন-নীচের ওই ঘন সবুজের মধ্যে আমার চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে মাণিক্যপুরের সবুজগ্রাম। জানি এতো উঁচু থেকে ধরাছোয়াঁ যায় না।তবে আছে সে।তার পদ্মপাতায় ঢাকা অতল জল, পাথরের মধ্যে মধ্যে দিয়ে ছুটে চলা চঞ্চল ঝর্ণা, ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া চা বাগান,
সবুজ মায়াবী গালচেতে ঢাকা টিলা, সাদা পশমি ভেড়ার পাল, খেটে খাওয়া মানুষ -তাদের আশা, খুশি, বিষাদ, বিবাদ, সবকিছু নিয়ে।
তবে সত্যিই কি ঐরকম সবুজগ্রাম? নাকি আছে আমার মাথায়? তা আমি জানি না। আমি শুধু গ্রামটার নাম শুনেছিলাম। মাণিক্যপুরের কথা শুনেছিলাম। দূর শহরে থেকে, সারা দেশের সংবাদ সংগ্রহ করাই আমার পেশা। সবুজ গ্রামের কথা আমি জানতে পারি, বেশ কয়েকবছর আগের একটি পুরোনো খবরে।যখন ঘটনাটা ঘটে তখন আমি বেশ ছোট। আসলে সবুজগ্রামের খবর না, এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ওই ঘটনাটা ঘটার কিছু মাসের পর থেকেই। সেটাই আমাকে টেনে এনেছে। কতদিন থেকে খুঁজছি..খুঁজতে খুঁজতে দিন, মাস পেরিয়ে গেছে আমার জুতোজোড়া এই জায়গার কাদায়, পাথরে, জলে, ক্ষয়ে গেছে। কাঁধে পিঠে ভারী ঝোলার ক্লান্তি। খাওয়া থাকার অনিশ্চয়তায় চোখের নীচে কালি, জামা কাপড় ঢলঢলে হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারি।
ওই পুরোনো খবরটাতেই জানতে পারি মাণিক্যপুরে থাকতো দুরকম মানুষ, আঁখি আর নয়ন। প্রথমে সবাই বেশ মিলে মিশেই থাকতো, তারপর তাদের ধর্ম আলাদা হলো, এলো বিচ্ছেদরেখা । সেকি বাইরের মানুষের জন্য? কে জানে? আঁখি চা চাষ করে, নয়ন ধান। আঁখি ভেড়া পোষে, নয়ন গরু। আঁখি গাঁজা খায় তো নয়ন তামাক। রাত্রে নিজেদের বানানো নেশাটুকু খেয়ে আঁখি নাচ গান করে, নয়নও । আর তাদের মধ্যে লড়াই চলতেই থাকে। সীমানা নিয়ে লড়াই, ধর্ম নিয়ে লড়াই,চাষের জমি, জল, মাণিক্যপুরে নতুন কি হবে সব কিছু নিয়ে লড়াই।
লড়াই, লড়াই, লড়াই।
যেমন হয়- লড়াই শুরু করলে তো শেষ হয় না।
বড়ো কষ্ট করে পৌঁছেছি এখানে আজ । অনেক চড়াই ভেঙে পাহাড়ের মাথায় এসে পৌঁছেছি। শুনেছি এই পাহাড়ের ওপর থেকে উত্তর পূর্ব দিকে তাকালে নীচে সবুজগ্রাম দেখতে পাওয়া যায়, হরিৎগ্রাম আর ধানীগ্রামও ।কিন্ত অবিচ্ছিন্ন সবুজ ছাড়াতো আর কিছু আমি দেখতে পাচ্ছিনা।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, মাচানের একদিকে পিঠের বোঝা নামিয়ে বসলাম।
এখন বুড়ো মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
"আচ্ছা আপনি বলতে পারবেন সবুজগ্রামে পৌঁছবো কেমন করে"?
কোনো হেলদোল হলো না বুড়োর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, একইভাবে। যেন জানতেন এই প্রশ্নই করবো আমি। ঠিক এইখানে দাঁড়িয়ে।এই সময়টাতেই।
আর এই জন্যই এখানে অপেক্ষা করছেন উনি।
"কেন"? বলে উঠলেন উনি।
"আমি খবর খুঁজি। পেলে ছড়িয়ে দিই। অনেক দূর শহর থেকে এসেছি।"
"কিন্তু সবুজগ্রামের কথা তো কেউ জানে না। জানতে চায় না আর.."
"আমি সবুজগ্রামের কথা জানি ।আঁখি আর নয়নদের কথা। ওদের যুদ্ধ । তারপর ওই ভয়ঙ্কর দিন। কিন্তু তারপর থেকে যেন ওই গ্রামগুলো….কোথায় যেন.."
বুড়ো কিছু বলার আগেই আমি হড়বড় করে এতগুলো কথা বলতে থাকলাম।
"রেলগাড়িতে টিকিট কেটে আসতে দুদিন।মাঝখানে একবার গাড়ি বদল। তিনদিনের দিন ভোরবেলা জিনিষ গুছিয়ে পিঠে বেঁধে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি।ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে এলো সবুজগ্রাম । কেউ নেই কোথাও।গাছপালার মধ্যে ছোট প্ল্যাটফর্ম ..ভিজে ঘাস পাতায় ভরা। থামলো না রেলগাড়ি। এক নিমেষের মধ্যে পেরিয়ে গেলো। ঐভাবেই ঘাসে, আগাছায় ছেয়ে যাওয়া প্ল্যাটফর্ম, আর লতাপাতায় জড়িয়ে থাকা বোর্ড নিয়ে পেরিয়ে গেলো হরিৎগ্রাম, ধানীগ্রাম -থামলো না রেল।তারপর থেকে তো খুঁজেই চলেছি। সরাইখানায় থেকে, গৃহস্থ বাড়িতে থেকে-সড়ক পথেও খুঁজেছি। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে কাঁটাতার দিয়ে রাস্তা বন্ধ। পাহারায় রাজার সৈন্য-আর এগোনো যায় না।অনেক দূর থেকে খবর পেয়েছি, এই পাহাড়ের মাথায় পৌঁছলে…কিন্তু কৈ কিছু তো …"
আমার কথাগুলো হঠাৎ ভেসে আসা হাওয়ার মধ্যে ফুলের রেণু রেণু পরাগ হয়ে উড়ে গেলো।আলো ঝলমলে দিন আজ-ভেসে যাওয়া একটা মেঘের ছায়া পড়লো নীচের উপত্যকায়।
সবুজগ্রাম
“সবুজগ্রাম ছিল নয়নদের গ্রাম।” বুড়ো বলে উঠলেন।
“আভা, প্রভা আর কিরণ তিন সখী থাকতো এপার ওপার বাড়িতে। আভা প্রভা দুই বোন তার মায়ের সাথে ছোট্ট একটা মুদিখানার দোকান আছে, সেখানে বসতো। সকালে ইস্কুল। দুপুরে মা ঘুমোলে, যখন দোকানে খদ্দের আসতো, আভা প্রভাকে ঠেলতো, প্রভা আভাকে।
‘ওঠ না, কি ঘুম ঘুমোতে পারিস।”
‘আমি কাল দুপুরে দুবার উঠেছি, একবার তো শুধু জিরে আনতে এসেছিলো।’
‘কে’?
‘কে আবার? যেন জানো না’?
প্রভার মুখে হাসি। চাঁপা ফুলের মতো নরম বালিকা মুখে চিকচিকে অভ্রকণার মতো দুষ্টু হাসি। আভা রেগে লাল।তার আয়নার মতো চকচকে কপালে কপট রাগের আঁচড়।
‘আবার বাজে কথা বলছিস’?
‘হিহি আমাকে দেখে রতনের মুখটা একদম কালো হয়ে গেছিলো।’
‘দাঁড়া তোর হচ্ছে!’
তারপর সারা ঘর বারান্দা উঠোনে ছুটোছুটি, মায়ের রেগে যাওয়া, চেঁচামিচি। এক জন বেচারি মুখ করে পুকুরের দিকে চলে গেলো, আর একজন গেলো দোকান সামলাতে। বাবার আসতে আসতে অন্ধকার।
তাদের গ্রাম যেন সবুজ পাহাড়ের মাঝখানে এক টলটলে মণি।
তাদের গ্রামের শেষ প্রান্তে পাহাড় উঠে গেছে ধাপে ধাপে।সেখানে শুধু হয় আনারসের চাষ। তাদের গ্রামে বেশির ভাগ মানুষ ছিল আনারস চাষী-সারা দেশে যায় বাইরে কাঁটা, ভেতরে টক-মিষ্টি, উজ্বল সোনালী রসে ভরা তাদের পরিশ্রমের ফসল।
তাদের বন্ধু কিরণও আজকাল ক্ষেতে কাজ করতো, অর্ধেক দিন ইস্কুল আসতো না।তাদের বাড়ির সব লোক কাজ করতো আনারস ক্ষেতে। বিকেল হবার আগে তারা তিনজন দীঘির ধাপে, ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে,আর শীতে তাদের দোকানের সামনে গল্প করতো ...অন্ধকার হয়ে যেত, জোনাকির আলোর মতোই অন্ধকারে ভেসে উঠতো তাদের কথা, টুপটাপ -আবার মিশে যেত। জারানো শুকনো আম, আমলকি, আনারস খেতে খেতে..যতক্ষন না বাড়ি থেকে ডাক পড়ে ।তারা কিরণের বাড়ি যেত, কিরণ আসতো তাদের বাড়ি। ক্ষেতে কাজ করে কালচে দাগ পড়ে যেত কিরণের হাতে, সেই হাতে আভা প্রভার মা যত্ন করে লাগিয়ে দিতেন গাছগাছালির স্নেহ প্রলেপ। ফুঁ দিয়ে শুকিয়ে দিতেন। কিরণের দিদি তাদের তিনজনের চুল যত্ন করে আঁচড়ে ঝুলিয়ে দিতো বিনুনি। তিনটি সূর্যমুখী ফুলের মতো ছিল তারা- বাড়ির কাজ করে, একটু লেখাপড়া করে,ফাঁকি মেরে, গান গেয়ে, গৃহপালিতদের যত্ন নিয়ে,গ্রামের দিদিমা দাদুদের আদর কেড়ে,ছেলেদের বুকে মিঠে হাওয়া বইয়ে বেড়ে উঠছিলো তারা।
ওদিকে আঁখি আর নয়নদের মধ্যে লড়াই বেড়ে চলেছে।আঁখিদের গ্রাম গুলির সীমানায় বিদেশ । ওদিক দিকে চোরাপথে আসছিলো অস্ত্রশস্ত্র, আসছে মানুষকে বশ করার নেশা। সেই নেশার ফলের গাছ বুনছে আঁখিরা।পাঠাচ্ছে বিদেশে, টাকা আসছে, আর তার এক অংশ যাচ্ছে রাজার কোষাগারে। তাই এই লড়াইতে রাজা চুপ। মন্ত্রী চুপ। রাজসভা চুপ। আঁখিদের এখন দরকার আরো জমি, পাহাড়ি জমি হলে ভালো হয়। তাই তারা অমিত শক্তিতে একটু একটু করে দখল করতে থাকে নয়নদের জমি। একটা একটা করে গ্রাম। নয়নরা বাধা দিতে গিয়ে লড়াই করে। সন্ত্রাস বাড়তে থাকে দশ মাথাওয়ালা রাবণের মত..অর্থে আর অস্ত্রে, হিংসার হাতে তখন অমিত শক্তি। তার সামনে নয়নদের লড়াই প্রায় কিছুই ছিল না। এইভাবে সন্ত্রাস একদিন এসে পৌঁছোয় সবুজগ্রামের দোরগোড়ায়। পাহাড়ের মধ্যে লুকোনো সবুজগ্রামে”।
“নয়নরা জানতো না?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“জানতো..কিন্তু তেমনভাবে নয়, ওদের গ্রামটা ছিল পাহাড় দিয়ে ঘেরা ..বাইরের পৃথিবীর লোক আর খবর তেমন পৌঁছতো না; আর গরীব ছিল তো, খাবার ব্যবস্থা করতে করতে কেটে যেতো সময়।”
কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে এলো চারপাশ..সামনের জঙ্গলে, উপত্যকার চারদিকে আকাশছোঁয়া গাছ- কেমন যেন নিঃঝুম। কোথা থেকে একটা মেঘ উড়ে এসে ঢেকে দিলো সূর্য্যকে।
“আমাদের মাণিক্যপুরের মেয়েরা জানো আঁখি হোক বা নয়ন, জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো স্বাধীন প্রাণীর মতো। আকাশের পাখি, ওই ঝর্ণার মতো -তারা ঘর বাঁধে, বাচ্চা পালে, শিকার করে, চাষ করে, রান্না করে, যুদ্ধ করে- তারা সব পারে। তাদের শরীরের ওপর লাঞ্ছনা অত্যাচার করা, এসব রাজার সাম্রাজ্যে অন্য জায়গায় হয়তো হয়..কিন্তু আমাদের মাণিক্যপুরের মেয়েরা জানতো না। এমনটা হয়। এমনটা হতে পারে...
ওই শান্ত বিকেলটাতে আভা, প্রভা, কিরণ - ওদের দোকানের পেছনে ধাপ কাটা জায়গাটাতে বসে গল্প করছিলো,শিকারী বাজের মতো নয়নরা ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো ওদের,সারা গ্রামের সামনে একটা একটা করে পাখা, একটা একটা করে পালক ছিঁড়ে, দলে, পিষে, টুকরো করে….
বুড়োর গলা বন্ধ হয়ে গেলো।
“যে কাদায় মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলো ওদের, রক্ত, কালসিটে, ক্ষতে ভরা শরীর -সেখানেই থেকে গেলো ওরা ...মিলিয়ে গেলো মাটির মধ্যে যেন..ওদেরকে বাইরে কোথাও আর দেখা গেলো না। ছাই রঙের এক থমথেমে অন্ধকার ঘিরে ধরলো সবুজগ্রামকে,পাখি ডাকলো না, গৃহস্থ বাড়িতে, জঙ্গলে সব প্রাণীরা চুপ করে গেলো। মানুষরা কোনোরকমে দিনযাপন করতে লাগলো, আঁধার ঘনাতে না ঘনাতেই যে যার বাড়ি- গৃহস্থের ঘরে সন্ধ্যের বাতিটুকুও জ্বলতে দেখা গেলো না।
“তারপর”?
বুড়োর প্রায় নিভে আসা গলায় একটা অন্য সুর উঠে এলো।
হরিৎগ্রাম
“আঁখিদের গ্রাম ছিল হরিৎগ্রাম।
সেখানেও মেয়েরা ঘরকন্না করে, বাচ্চা পালে, চাষ করে, পশুপালন করে, ব্যবসা করে। হরিৎ গ্রামের মেয়েরা আবার খাবারের উচ্ছিষ্ট, গরুর গোবর, মরে যাওয়া গাছ গাছালি জড়ো করে তাকে পচিয়ে কি বানাতো বলো তো?”
“কি “?
”ফসলের সার। সেই সারে ফলতো দেখবার মতো তরকারী, ফুল, আর সবচেয়ে ভালো ফসল ছিল এক রকমের ধান- তার থেকে যে ভাত হতো, তার রং মিশমিশে কালো। সবাই বলতো ওই ভাত খেলে মানুষের কোনো রোগ বালাই হয় না। ভেবে দেখো ওই ভালো জমিতেও গ্রামের পুরুষরা, রাজার কথায় নেশার চাষ করতে চাইছিলো। মায়েরা তো রেগে আগুন।তাছাড়া গ্রামের পুরুষরা তো অস্ত্রের খোঁজে ঘুরছে, সারাক্ষন শুধু জড়ো হয়ে কি ফিসফাস, ষড়যন্ত্র, সারাক্ষন তাদের মুখ চোখ লাল, উত্তেজিত। কিরকম একটা বিষ ঘনিয়ে আসছিলো।”
“তো হরিৎগ্রামের মেয়েরা বোঝেনি? কিছু বলেনি?”
“রাগ করলেও বা কিছু একটা ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পারলেও তা কতটা ভয়ঙ্কর, সেটা বোঝেনি। তাছাড়া তারা জানতো নয়নরা তাদের শত্রু। রাজার শত্রু, অতএব দেশদ্রোহী। তাদের সাথে লড়াই করে রাজার আর দেশের উপকার করছে তাদের পুরুষরা। জানতো রাজার হাত আছে তাদের মাথার ওপর।
মারীকথা
তবে সেদিন যেন, হরিৎগ্রামের মেয়ে, মা, দিদিমারা পাহাড় পেরিয়ে আসা অমঙ্গলের আশংকা দেখতে পেয়েছিলো। ছোট ছোট মেয়ে মুনিয়া, দোয়েল, টিয়ারা খেলতে খেলতে, ক্ষেতে সবজি তুলতে তুলতে দেখেছিলো মাটি থেকে পিঁপড়েরা বেরিয়ে আসছে-ঘন বর্ষায় যেমন হয়। তাদের মা মাসি চাঁপা,কুন্দ, মালতীরা শুনেছিলো টিয়ার ঝাঁকদের কর্কশ গলায় চিৎকার, গোয়াল থেকে গাভীদের আর্তরব। দিদিমা, শুক্লা কৃষ্ণারা বিস্ময়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন-আকাশের রং এমন কালচে কমলা কেন, গ্রহণ হয়েছে যেন।
তাদের ছেলে, বাবা, স্বামীরা -আঁখিদের পুরুষরা সবুজগ্রাম থেকে ফিরলো -যেন আধজ্বলা।খুব ধিকি ধিকি আঁচে গাছ পুড়লে যেমন হয়-তেমন।সবাই যে যার ঘরে ঢুকে পড়লো, লুকিয়ে পড়লো প্রায়। খবরটা কিন্তু বেরিয়ে এলো…প্রথমে চাপা ফিসফিসানিতে তারপর, বিষাক্ত বমির মতো গলগল করে -কালো দমবন্ধ করা ধোঁয়ার মতো চেপে বসলো গ্রামের বুকে।কৃষ্ণা, শুক্লা, চাঁপা, কুন্দরা শুনলো। তাদের সমস্ত শরীর বধির হয়ে গেলো। তারপর কয়েকদিন হরিৎগ্রামের উঠোনে, ঘরের অন্ধকার কোণে, পুকুরে, ক্ষেতে কিছু প্রাণহীন মহিলাদের খোলসরা নড়ছিলো, চড়ছিলো - কাজ করছিলো।এমন চললো কয়েকদিন… তারপর এক সকালে,গ্রামের দিদিমা ঠাকুমা শুক্লা কৃষ্ণারা নিশ্চুপে ক্ষেতে কাজ করতে করতে নিজেদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ - নির্নিমেষ।তারপর তাদের হাতের কাজ ফেলে গায়ের মাটি ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন আশেপাশে যারা কাজ করছিলেন তারা সবাই। তারা হাঁটতে শুরু করলেন একসাথে।মনে হলো যেন মাটিতে পোঁতা গভীর শিকড় উপড়ে উঠে দাঁড়ালো প্রাচীন গাছেরা।ছেড়ে চললো তাদের জমি।”
বুড়ো চুপ।তার মাথাটা একটু একটু নড়ছে।একটু একটু কাঁপছে হাতগুলো।মুখের কুঁচকোনো চামড়া কাঁপছে থিরথির।আকাশে সূর্য ঢলে পড়েছে একটুখানি।জোব্বা হাতড়ে হাতড়ে কি যেন খুঁজলেন। আমি বসে আছি চুপচাপ।মাথার অনেক ওপর দিয়ে চিল ঘুরছে চক্রাকার।
“কি হলো তারপর? ওরা কি করলো”? আর ধৈর্য্য আমার ধরছে না।
“দুদিন কাটলো। তারপর ঘটলো এক আশ্চর্য ব্যাপার। হরিৎগ্রামের পরিবারগুলোতে অনেক প্রজন্মের লোকেরা একসাথে থাকে।এই পরিবারটি সবথেকে বড় আর পুরোনো পরিবার,গ্রামের মাথা মতো।বাড়িতে চার থেকে আশির মেয়েরা।সবাই মান্য করে। দরকারে অদরকারে তাদের কাছে যায়।উৎসবে তাদের বাড়িতে খাওয়া, নাচ গান। এই বাড়ির দুই ছেলে সেদিন গেছিলো সবুজগ্রামে। এসে থেকে তারা সেঁধিয়ে ছিল বাড়ির ভিতরে।
সেদিন সকাল। ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বাড়ির সব মেয়েরা, রান্নাঘরে, উঠোনে, পুকুরে তাদের দিন শুরু হলো।সবাই নগ্ন। কারোর গায়ে একটি সুতোও নেই।”
“কি”? আমার হাত উঠে চাপা দিলো মুখ।
“হ্যাঁ”
“মানে?”
“বাড়ির পুরুষরা তো বেশ কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে বসে রইলো, যেন তাদের নড়ার শক্তি টুকুও নেই। তারপর তারা প্রায় একসাথেই ছুটে এলো।
বাড়ির দিদিমা খুব শান্ত স্বরে বললেন ‘ সকাল থেকে অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু কাপড় পরতে পারছি না।’
“মানে”? আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।
“বাড়ির সব মেয়ে বললো, কাপড় পরার চেষ্টা করলে কে যেন তাদের কাপড় টেনে খুলে দিচ্ছে।”।
“মানে? তারপর”?
“দুদিন ধরে তারা মেয়েদের ঘরে বন্ধ করে রাখলো। নিজেদের হাতে কাপড় পরালো। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই যে কে সেই, আবার। কতদিন ঘরে বন্ধ রাখবে ওদের? সংসার চলবে কি করে?”
“তারপর কি হলো”?
“ঐভাবেই থাকতে শুরু করলো তারা। বাড়ির মধ্যে, বাড়ির পুরুষরা, না থাকতে পেরে প্রায় বাড়ির বাইরে থাকতে শুরু করলো। কিন্তু যাবে কোথায়?”
“কেন”?
“শুধু তাদের বাড়ি তো নয়, মারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। সারা পাড়াতে।একে একে গ্রামের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে।ধীরে ধীরে মেয়েরা ক্ষেতে, পুকুরে, মাঠে যেতে শুরু করলো। নগ্ন।”
“কি হলো তবে”?
“কি আবার হবে? সালিশ বসলো।বাচ্চা থেকে বুড়ো, সব মেয়েরা একবাক্যে বললো, যেভাবেই পরাক, কিছুতেই থাকছে না, কে যেন তাদের কাপড় টেনে খুলে নিচ্ছে।”
“তো লোকেরা এসব শুনে করলো কি”?
বুড়ো একটু অপ্রকৃতিস্থের মতো হেসে উঠলো।
“লোকেরা? যারা ছিঁড়ে খুঁড়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলো সবুজগ্রামের মেয়েগুলোকে তাদের মধ্যে একজন গলায় দড়ি দিলো, আর একজন পাহাড়ে না জঙ্গলে কোথায় হারিয়ে গেলো-তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। বাড়িতে বাড়িতে বাবারা তাদের নগ্ন কিশোরী মেয়েদের দিকে দেখে প্রায় অন্ধ হয়ে গেলো।ছেলেরা তাদের মা, মাসি, দিদিমাদের নগ্ন শরীর দেখতে দেখতে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেলো। তারা পাহারা বসালো গ্রামের বাইরের কেউ যাতে ভেতরে না আসে।তাদের মেয়েদের দেখতে না পায়।কিন্তু কি জানো, পাখির মুখে বয়ে নিয়ে যাওয়া,জলে ভেসে ভেসে যাওয়া বীজের মতো এই রোগ, এই মহামারী ছড়িয়ে যেতে শুরু করলো- চারদিকে আঁখিদের গ্রামে, নয়নদের গ্রামেও।আগাছার মতো নষ্ট করে দিতে লাগলো জীবনদায়ী জমি,ধীর দাবানলের মতো মতো সুখ শান্তি পুড়তে শুরু করলো। খবর গিয়ে পৌঁছলো তোমাদের দেশের রাজার কানে। রাজা ভয় পেলেন।”
“রাজা ভয় পেলেন”?
“হ্যাঁ গো ভয় পেলেন।প্রথমে পাননি। কিন্তু যখন এইভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো, তখন সৈন্য পাঠালেন”।
“সৈন্যরা কি করলো ”?
“সৈন্যরা ঢুকতেই পারলো না।আঁখি, নয়ন সব পুরুষরা যার যার গ্রামের বাইরে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সৈন্যরা যাতে তাদের মেয়েদের দেখতে না পায়।
তারপর সৈন্যরা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দিলো গ্রামগুলোকে।যাতে বাইরের কেউ না আসতে পারে। যাতে গ্রামের কেউ বেরোতে না পারে। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।
কেউ পৌঁছতে পারলো না, বাইরের পৃথিবী আস্তে আস্তে ভুলে গেলো সবুজগ্রামকে।”
আবার এক দীর্ঘ নৈঃশব্দ্য।
“আচ্ছা সত্যি কি ওখানে ঐরকম হয়? মানে হরিৎগ্রাম, সবুজগ্রামে মেয়েদের শরীর থেকে কেউ কাপড় খুলে নেয়”?
“আমি কি করে জানবো? কেউ জানে না”।
আমি চুপ করে রইলাম। বুড়ো তার প্রাজ্ঞ চোখে দেখছে আমাকে, কি যেন বুঝে নিতে চাইছে।চোখে ঝিকমিক করছে সূর্যের আলো।
“আমি বুঝতে পেরেছি,, কে কাপড় পড়তে দেয় না। আপনিও জানেন”। বলে উঠে দাঁড়ালাম।
“আমি যাবো। আমাকে আপনি পথ বলে দিন”।
বুড়ো আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“তুমি তরুণী।ওই গ্রামে গেলে হয়তো তোমাকেও.. .”
“আমি প্রস্তুত। আমি পৌঁছবো। ওরা যদি আমাকে ওদের গল্প বাকি পৃথিবীর কাছে পৌঁছতে দেয়, আমি ফিরে আসবো। নয়তো ভেবে দেখবো।”
বুড়ো আমার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে এলো পাহাড়ের ধারে।
“ঐখান দিয়ে সোজা নেমে গেলে পাইন বনের মধ্যে দিয়ে শুঁড়ি পথ তারপর দুটো ঝর্ণা পেরিয়ে বাঁদিকের একটা বন। তার শেষ দিয়ে সবুজগ্রামে একটা রাস্তা যায়।ওখানে পৌঁছলে হরিৎগ্রামে যাবার রাস্তাও পেয়ে যাবে।”
নীচে তাকিয়ে আছি আমি- ওনার বাড়ানো আঙুলে শুধু অতলান্ত সবুজ।
“কিছু বোঝা যাবে না, কিন্তু আছে গ্রামগুলো, ওখানে আছে। ওরা এখন শুদ্ধ হয়ে গেছে। তুমি যাও ”।
.