অন্ধকারের মধ্যে আমি অনেকদিনই ঘুরে বেড়াচ্ছি। চোখ বুজে বা চোখ খুলে, নিরন্তর হাতড়ে হাতড়ে। দিশেহারা থাকা অভ্যেস হয়ে গেছে অনেকটা। এসে হাত ধরার কেউ নেই সেখানে। কিন্তু এখানে আজ সব অন্যরকম হলো। হঠাৎ করে টের পেলাম এতটুকুও স্পর্শ না করেও কেউ একজন চওড়া হাতের মুঠোয় আমার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। শ্রবণ সেখানে স্পর্শের সমান কাজ করে। ক্রিসের শান্ত গলা পেলাম -- "এই যে তোমাকে আমি চেয়ারের সামনে এনেছি। ছুঁয়েছুঁয়ে বুঝে বসো, চেয়ার টানা আছে। এবারে টেবিলে ছুঁয়ে দেখো তোমার ডান দিকে চামচ, কাঁটা। বাঁ দিকে ঘড়ির কাঁটার দশ নম্বর জায়গায় জলের গ্লাস আছে। শুধু গ্লাসটা এখন। জল আমি পরে ঢেলে দেবো। নাহলে হাতের ধাক্কায় উল্টে পড়তে পারে।"
আমার চোখে তখনো আলকাতরার বোঝা ভারী ওজন নিয়ে চেপে বসে আছে। কেমন যেন মনে হয় ফুসফুসের ওপরেও যেন অন্ধকার চেপে আছে। আমি জোরেজোরে শ্বাস নিতে নিতে আন্দাজে হাতড়ে চেয়ারে বসলাম। কিন্তু মাথাটা তখনও টলমল করছে। হেড ইনজুরির পর থেকেই আমার ব্যালান্সের অসুবিধা হয়। চোখে দেখতে না পেলে আরো বেশি। আমি বন্ধুদের গলা শুনতে পাচ্ছি । "এই তো চামচ পেয়ে গেছি", "হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো আমার জলের গ্লাস।" শুনতে শুনতে আমার মনে আরো ভয় ঘনিয়ে আসে -- সবাই সব পেয়ে যাচ্ছে। আমি যে অতলে সেই অতলে। আমি কি হারিয়ে যাচ্ছি?
হারানো ব্যাপারটা অবশ্য কম বার ঘটেনি আমার জীবনে। যেমন বলছিলাম, অনেকটা অভ্যেসও হয়ে এসেছে এখন। অভ্যেসের কথা শুনে আমি আস্তে আস্তে হাত দিয়ে অনুভব করতে থাকি। আঙুলের চোখের সামনে একটু একটু করে ছবি ফুটে ওঠে -- একটা কাপড় ঢাকা টেবিল, এক পাশে চামচ, কাঁটা, তার হাতলে কোনো নক্সা করা আছে। অন্য পাশে একটা স্টেমগ্লাস। ছোট ডাঁটি, মোটা পেট। রেড ওয়াইনের গ্লাসের মত। ঠান্ডা কাঁচ। আঙুলের ছোঁয়া পেয়ে বলে "টিং টুং"। নাঃ, জল নেই, খালির আওয়াজ। আবার ক্রিসের গলার আওয়াজ পেলাম --" শোনো, তোমার হাতটা আমি একটু ধরবো। কারণ তোমার ককটেলের গ্লাসটা আমি এখন তোমার হাতে ধরিয়ে দেবো।" হাতের মধ্যে মানুষের হাতের গরম আর কাঁচ ও পানীয়ের ঠান্ডার ছোঁয়া পেলাম। এতক্ষণে মন কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। "ওকে দেন, মিজ টোটাল সেনসরি এক্সপেরিয়েন্স! অ্যাম রেডি। লেট'স রোল।" আমি হাতে ধরা গ্লাসের কিনারায় ঠোঁট ছোঁয়াই।
প্রথম কোর্স এগিয়ে আসে। তার সামান্য পরিচয় -- "তোমার সামনে একটা বাটি নামিয়ে রাখা হচ্ছে। ডানদিক থেকে চামচ উঠিয়ে নাও। সাবধান, গরম আছে।" আমাদের বুদ্ধিমান মস্তিষ্ক এই থেকেই ডিডিউস করে নেয় নিশ্চয়ই কোনো স্যুপের কথা বলা হচ্ছে। যাক তাহলে তো অর্ধেক জেনেই গেছি। আর চিন্তা কিসের? হা হা, মস্তিষ্ক বরাবরই নিজের আন্দাজ সম্পর্কে বেশি রকম অহংকারী। শুধু 'স্যুপ' জেনে গেলেই হয়না। তার পূর্ণতা পাওয়া অন্য এক মাত্রার বাজনা। প্রথম এক চামচ মুখে দিয়ে মনে হয় -- একি! এ তো শুধু স্যুপ নয়। সঙ্গে থতমতও খাচ্ছি। এ কেমন এক দুর্বোধ্য স্বাদ? নাঃ, এভাবে নয়, এভাবে হবেনা। স্লো ডাউন। এবার ধীর পায়ে এগোতে হবে। প্রথমে গন্ধ নিই বুক ভরে, তারপর খুব আস্তে আস্তে জিভের ওপর অনুভব করতে থাকি। হুঁ, একটু ঘন, সিল্কি, কিছুটা টক, একটু ধোঁয়াটে গন্ধ। টমেটো স্যুপ? রোস্টেড টমেটো? সঙ্গে কোনো আর্ব আছে। কী পাতা? পার্সলে? নাঃ। তাহলে? জিভের স্মৃতি মনের মধ্যে অনেকগুলো খোপ খুঁজে দেখে। কে তুমি? কে? না, বুঝতে পারছি না। এই কোর্সে এই অব্দিই আমার দৌড়। অপূর্ণতা, এসো ভাই, পিঁড়ি পেতে বসো। এ তো তোমারই ঘরদোর।
দু নম্বর কোর্সের আসার সময় হয়ে গেলো। ছোট্ট করে সে নিজের পরিচয়ে বলে তাকে খাবার জন্য কোনো কাটলারি লাগবেনা। হাত দিয়ে খাবার কথা। তোমার প্লেটের ওপরে কিছু একটা জিনিষ পাতা আছে, তার ওপরে দুই, না না আড়াই পরতে কিছু সাজানো আছে। মুড়ে নিয়ে খাবার কথা। এই অব্দি শুনে আমরা আবার মুচকি হেসে ভাবি "ওঃ, র্যাপ (wrap) তাহলে। আচ্ছা, তবে তো বুঝেই গেলাম।" আঃ, আবার সেই এক কথা? বোঝা জিনিষটা যে অত সোজা নয় তা আর কদ্দিনে শিখবে?
হাতের ছোঁয়া মেলে আমি দেখতে থাকি আবার। একটা তাজা স্পর্শ, শীতল। ওঃ, এটা পাতা কোনো, যতখানি পাতলা তাই দিয়ে মনে করছি বাটার বা বীব লেটুশ। তার ওপরে ছোটছোট সামান্য গরম টুকরো। তারও ওপরে ছোটছোট সামান্য ঠান্ডা টুকরো। বটে? মুড়ে নিয়ে কামড় দিয়ে দেখি তো। জিভের ওপরে এক নিমেষে একটা সবুজ স্বাদ ছড়িয়ে যায়। হ্যাঁ, বীব লেটুশই। মাঝখানে প্রথম পরতে ভরপুর নোনতা টুকরোগুলো। অত্যন্ত সুস্বাদু। স্বাদ আমার জিভের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকায়। তোমাকে চিনি আমি, চিনি ... কিন্তু নাম মনে পড়ছেনা। এর সাথে আছে এক ঝলক ক্রীমিনেস। আলতো করে হাত ছোঁওয়ালো। খুব ফিকে রঙের একটু ঝাল গলার পেছন দিকে নরম করে হাসতে থাকে। যেমন ছোট বাচ্চারা হাসে অবোধ্য খুশির সময়ে। তার ওপরে সামান্য ঠান্ডা টুকরো গুলো ফ্রেশ। ওরা রান্না করা নয়। কাঁচা। খুব মিহি টমেটো, ঝাঁঝ-মিষ্টি লাল পেঁয়াজ, গাঢ় সবুজ ঝালের হ্যালাপিনিও। সালসা নিশ্চয়ই। টেবিলে তখন ঘোরতর স্পেকুলেশন চলছে ;" আরে এতো নিশ্চয়ি এই। হুঁ, আমি যেন একটা এই জিনিষেরও স্বাদ পেলাম। এই মাংসের মত স্বাদের সেভারী জিনিষটা নিশ্চয়ই বিয়ন্ড মীট?" ইত্যাদি। আমি যোগ দিইনা। একটা ছাই রঙের হীণম্মন্যতা আমাকে নীরবে জড়িয়ে ধরছে।অন্যদের কথা আমার নিজের অপারগতা সম্পর্কে আমাকে আরো বেশি সচেতন করে তোলে। শতকরা অমুক ভাগ ঘ্রাণশক্তি, তমুক ভাগ স্বাদশক্তি আমি বহু বছর আগেই হারিয়েছি। জীবনের দাম।
এবার তিন নম্বরের প্রবেশ। ইনিও হাতে ধরে খাবার। তার ওপর এঁর আরেক পরিচয় হলো ইনি অ্যাম্যুজ বুশ। অর্থাৎ কিনা এক বা দুই গ্রাসেই খতমোপযোগী। তার মানে মুখের ভেতর পরিচিতির সময় সংক্ষিপ্ত। ভাই সেন্স কনশাসনেস, পে অ্যাটেনশন। ইউ নীড টু প্লে শার্প দিস টাইম। দু আঙুলে জিনিষটাকে ধরে মুখে ফেলে দিতে হয়। দাঁতের চাপে তার 'বেস'টা কুড়মুড় করে ভেঙে যায়। কোনো চিপ্স রে এটা। আলু না, আলু না। নিমকির মত স্বাদ। ওয়ন্টন নিশ্চয়ই। আর তার ওপরের চৌকো টুকরো মত জিনিষটার স্বাদ আমি কখনো ভুল করবোনা। ইনি হলেন সুশি। চেরী ফুল, পাখা আর ছাতার ছবি মনে করানো আমার প্রিয় জাপানী বান্ধবী। কিন্তু, একটা বিরাট কিন্তুও আছে এই সাথে। সুশির মধ্যে কী রয়েছে? দু রকম কচকচে জিনিষ। তাদের কচকচেত্বর মাত্রা এক নয়। স্বাদ এখানে এসে আমাকে সোজা সাপ্টা তিন তালাক দিয়ে চলে যায়। আমি সমস্ত জিভ জুড়ে শুধু টেক্সচার বুঝি। কোনো স্বাদ নেই। শূণ্য। হীণম্মন্যতা একটা ডুকরে ওঠা আর্তনাদ করে একটানা। আমি ডুবে যাচ্ছি। অতি কষ্টে যে এক ফালি সেনসরি পার্সেপশনের কার্নিশে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখান থেকে পা ফস্কে আমি অন্ধকারের দিকে পড়ে যাচ্ছি। এই স্বাদশূন্য টেক্সচার আমার মুখে সপাটে একটা থাপ্পড় মারে। আমি নিঃসন্দেহে বুঝতে পারি ‘আমি’ মানুষটা কতখানি চোখ দিয়ে খায়। একটা হাহাকার ছুরির মত ধারালো নিঃশব্দ দিয়ে বলতে থাকে -- "ব্যর্থ, তুমি ব্যর্থ। অন্ধ সব দিকেই। ভারী গুমোর করতে না? এই হলে আসল তুমি।" বুঝলাম, অন্ধকারেই তাহলে নিজেকে সবথেকে স্পষ্ট দেখা যায়?
.