এখানেই একবার বলেছিলাম না আমি জল জমাতে ভালোবাসি? জল ছাড়াও আরেকটা জিনিষ জমাই আমি। অভিজ্ঞতা। আসলে তো কোনো কিছুই জমানো যায়না। যা কিছু তুমি ভাববে মুঠো করে ধরে, নিজের নাম লিখে, বাক্সের মধ্যে ভরে তালা দিয়ে রেখে দিয়েছো; আসলে সবই মুঠো গলে কখন যেন পড়ে গেছে। আমরা বুঝতেও পারিনা। অভিজ্ঞতা এমন একটা জিনিষ যেটা না জমিয়েও জমানো যায়। জলছবির মত একটা ছাপ রেখে দিয়ে গেলো মনের মধ্যে। ঐ ছবিটুকুই জমানো গেলো। যেখানে কিছুই হাত দিয়ে ধরা যায়না সেখানে ঐটুকুই মন্দ কী?
তো, ঐ কথাই। অভিজ্ঞতা জমানো। অনেক কিছু করে দেখতে ইচ্ছে হয় আমার। যা কোনোদিন কাজে লাগবেনা সেই সবও। শুধু কেমন লাগে সেটুকু জানার জন্যই। অভিজ্ঞতা জমানোর জন্য মানুষ হেলিকপ্টার থেকে ঝাঁপ দেয়, হাঙরের সাথে সাঁতার কাটে, সাইকাডেলিক ট্রিপ নেয়। তো আমিও এই ধরণের একটা ব্যপার করেছিলাম। খুব সাহসের দরকার হয় এমন কাজ। আমি বুনো ঘোড়ার পিঠে উঠতে গিয়েছিলাম।
সত্যিসত্যি বুনো ঘোড়া নয়। মেটাফরিক্যাল। এর নাম ' রাইড দ্য ওয়াইল্ড হর্স মেডিটেশন'। হ্যাঁ, ধ্যান। অদ্ভুত না? করছে বসে ধ্যান, তার নাম দিয়েছে বুনো ঘোড়া, আবার বলছে এতে সাহসের দরকার? অবিশ্বাস্য লাগছে তো? তাহলে ভেঙে বলি একটু। এখানে 'বুনো ঘোড়া' হলো আমাদের ইমোশনরা।
আচ্ছা, খুলে বলছি। "খুলে বলতে" গেলে অবশ্য বেশ অনেক কথাই বলতে হবে। বিষয়টা খুব সরল নয়। একটু কচকচি আছে। একটু ধৈর্য্য লাগবে। সমুদ্রের ধারে, নদীর ধারে, হ্রদের ধারে, নুড়ি পাথরের মেলায় আমি একদিন 'জীন সিগাল' এর নাম খুঁজে পেয়েছিলাম। উনি সাইকোলজি নিয়ে কাজ করতেন। সোশিওলজি নিয়েও। এই 'রাইড দ্য ওয়াইল্ড হর্স' ধ্যান জীনই তৈরী করেছিলেন। আশির দশকের শুরুর দিকে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া (লস অ্যাঞ্জেলিস) তে থাকাকালীন ক্যান্সার পেশেন্টদের নিয়ে কাজ করার সময়ে। উনি দেখেছিলেন যে এই রোগীদের মধ্যে যেসব মানুষ অনেকটা ওয়াইড রেঞ্জের ইমোশন অনুভব করতে পারেন, তাঁদের পক্ষে ক্যান্সারের কষ্ট নেওয়া অন্যদের তুলনায় কিছুটা সহজ হয়। এই অবজার্ভেশনের ওপর ভিত্তি করে উনি একটা বিশেষ গাইডেড মেডিটেশন তৈরী করলেন। তোমার প্রতিটি অনুভূতি একেকটা উদ্দাম বুনো ঘোড়ার মত। কিন্তু এই ধ্যানের মাধ্যমে তুমি তাদের পিঠে চড়তে শিখবে। তাদের চিনতে শিখবে। হয়তো একদিন ওদের বশ মানাতেও শিখবে।
পুরো ব্যাপারটাই আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগলো। আমি আরেকটু জানতে চাইলাম। এই "ওয়াইড রেঞ্জের ইমোশন অনুভব করা" জিনিষটা আবার কেমন ব্যাপার?
আমাদের সব অনুভূতিই একেকটা মেসেঞ্জারের মত। একেক জন একেক খবর নিয়ে আসে। খবরটা দেবার জন্য ওরা আমাদের ডাকে। বলে "ওগো,তাকিয়ে দেখো। এমন ঘটনা ঘটলে তুমি নিরাপদে থাকবে। এমন ঘটলে তোমার সমূহ বিপদ। এই কাজ ভুলেও করতে যেওনা। এই কাজটা বারবার কোরো।" এইসব। এইবার আমাদের ওরা ডাকবে কী করে? ওরা মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারেনা, গলার স্বর নেই ওদের। আঙুলও নেই যে ইমেল করবে, হোয়াট্স-অ্যাপ করবে। ওদের ভাষা হলো ফিজিক্যাল সেন্সেশন। শারীরিক অনূভূতি। বুকের ভেতর ফাঁকা হয়ে গেলো। কিম্বা গলার মধ্যে শক্ত দলা পাকাচ্ছে। কিম্বা বুক ভরে উঠলো। এইসব। এই দিয়ে ওরা আমাদের ডাকে। অনেক জটিল খবর, ইন্ট্রিকেট খবর দিতে চায়।এগুলোকে আমরা নানা রকম নাম দিয়েছি -- ভয়, আনন্দ, দুঃখ, অপরাধবোধ। এতদূর অব্দি তো ঠিকই আছে। কিন্তু এরপরে মুশকিলটা আমরাই বাধাই। এই যে এই ভিতু, আয়েশী, কুঁড়ে আমরা!
যে অনুভূতিগুলো আমাদের শরীরে ''ভালো'' লাগা জাগায় সেগুলোকে আমরা আঁকড়ে ধরতে চাই। যেগুলো ''খারাপ'' লাগা দেয়, সেগুলো আমরা মোটেই অনুভব করতে চাইনা। ''ভালো'' আর ''খারাপ'' আমি কোটের মধ্যে লিখলাম কারণ এদের এই নামগুলো আমরাই দিয়েছি। আসলে সত্যি করে এরা কেউই ভালো বা খারাপ নয়। এরা জাস্ট অনুভূতি। ডাকার মাধ্যম। কলিংবেলের মত, নোটিফিকেশন সাউন্ডের মত।
তো যা বলছিলাম। খারাপ লাগার অনূভুতি। সেগুলো আমরা নিজেদের শরীরে ফীল করতে খুব অপছন্দ করি। আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক, সব রকম কন্ডিশনিং থেকে আমরা শিখি যে এগুলো "খারাপ"। খারাপ জিনিষকে এড়িয়ে চলতে হবে। ছোট্ট বেলা থেকে আমরা এদের কাছ থেকে পালাতে শিখি। পালানোর রাস্তাও নানা রকম। কেউ জোর করে চাপা দিই, কেউ অন্য কিছুতে মন দিয়ে নিজেকে ডিস্ট্র্যাক্ট করি। একে তাড়ানোর জন্য কোনো একটা মাধ্যম বেছে নিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি -- সোশ্যাল মিডিয়া, মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া, অ্যালকোহল, সিগারেট, পরনিন্দা, শপিং, যেকোনোই নেশা। সবই পালিয়ে থাকার চেষ্টা। আমরা এতদূর এগিয়ে গেছি। সমুদ্রের তলা, মহাকাশ, দুর্গম জঙ্গল কোত্থাও যেতে ভয় পাইনা। কিন্তু নিজেদের সামনে দাঁড়াতে আমাদের অসীম ভয়। আমরা সব সময় নিজেদের ব্যস্ত রাখতে চাই। যদি কোনোভাবে এতটুকু ফাঁকা সময় পেলেই নিজের মনের সামনে দাঁড়াতে হয়? যদি কিছু করে ঐ অসহ্য অনুভূতিগুলো চলে আসে?
কিন্তু গন্ডগোলটা কোথায় জানো? ওরা চলে যায়না। তুমি যতই তাড়াও, যতই চাপা দাও, যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করো, তোমার অনুভূতিরা কক্ষণো 'নেই' হয়ে যাবেনা। ওরা জমা থাকে। শরীরের মধ্যে, মনের মধ্যে। চাপা পড়তে পড়তে, উপেক্ষিত হতে হতে ওরা একসময়ে বেঁকেচুরে যায়। ডিস্টর্টেড হয়ে যায়। হয়তো ছিলো একটা ছোট্ট লাল পিঁপড়ে। কুটুস করে একটু জ্বালা করানো কামড় দিয়ে তোমার মনটা ওর দিকে ফেরাতে চেয়েছিলো। তুমি ওকে চাপা দিলে। আস্তে আস্তে সে’ই হয়ে দাঁড়ালো ভয়ানক একটা ড্র্যাগন। স্মাউগের মত। কিন্তু তোমার ভেতরেই থাকবে ও। আর বারবার ফিরে ফিরে আসবে। এখন হা হা করে জ্বালানো পোড়ানো আগুন বার করবে মুখ দিয়ে। তুমি পুড়বেই। একশো গুণ বেশি জ্বালা ধরানো আজকের এই পোড়া।
আবার আরো একটা দিক আছে। যেকোনো অনুভুতিই 'অনুভূত' হবার কথা। ইমোশনস আর মেন্ট টু বী ফেল্ট। তুমি খারাপ লাগাদের অনুভব করতে চাইছোনা। ওদের চাপা দিতে চাইছো। সেই করতে করতে অভ্যাস এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে যে তোমার অনুভব করার ক্ষমতাটাই ভোঁতা হয়ে যাবে। ভালোলাগা গুলোও তখন আর তত ভালো লাগবেনা। মনে হবে "ধুউউর, এ আর এমন কী? সবকিছু এত বোরিং কেন? কেন আরো ভালো হচ্ছেনা?" যাঁরা সব রকমের অনুভূতি পুরোমাত্রায় ফীল করেন, শরীরে, মনে, তাঁদের জীবনটা অনেকই বেশি জীবনময় হয়। খারাপ লাগাকে বিধ্বংসী মনে হয়না। ভালোলাগায় মনটা ছাপিয়ে যায়। 'ভালো' আর 'খারাপ' এর লেবেল গুলো মুছে গিয়ে জীবনের অপার বিস্ময় স্পষ্ট করে চোখের সামনে ধরা পড়ে।
এত কিছু পড়ার পরে আমি সেইসব চাপা দেওয়া অনুভূতিদের ফীল করতে চাইবোনা তা হয়না। আমার কৌতুহল আজীবন আমাকে টেনেটেনে এখানে ওখানে নিয়ে গেছে। তার ডাক অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি জীন সিগালের তৈরী সেই গাইডেড মেডিটেশন খুঁজে বার করলাম।
এই ধ্যানের সাথে বিপাস্সনা ধ্যানের কিছুটা মিল আছে। প্রথমে প্রোগ্রেসিভ রিল্যাক্সেশন। শরীরের এক একটা অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের ওপর ফোকাস করে সেটা টেনে টাইট করা, আর তারপরেই একদম আল্গা করে দেওয়া। একদম পায়ের আঙুল থেকে মাথা পর্যন্ত। তারপরে গাইড বললেন -- "এবার যে বাজনা শুরু হচ্ছে তার ওপরে নিজের মনটা রেখে দাও। মনের সাথে নরম করে কথা বলো। বলো -- যে আসতে চায় তাকে আসতে দাও। বলো -- যে নিজেকে দেখাতে চায়, তাকে আমি কাছে ডাকছি। যেকোনো অনুভূতি আসুক, তাকে আটকিওনা। চাপা দিওনা। যদি খুব কষ্ট হয় তাহলে ধ্যান বন্ধ করতে হবে। নাহলে সাহস করে তার সাথে থাকো। নিজের শরীরে কোথায় কীরকম ভাবে তার ফীলিং হচ্ছে তার বোঝার চেষ্টা করো।"
বাজনা শুরু হলো। গীটার। শুধু গীটার, আর কিছু নেই। কুড়ি মিনিট। পঁচিশ মিনিট। তারপরে গাইড তোমাকে বলবেন ঝট করে চোখ খুলতে। খুব তাড়াতাড়ি মাটিতে পা রেখে সেই শক্ত মাটি ফীল করতে। খুব তাড়াতাড়ি করে বাইরের দুনিয়ায় কী দেখছো, শুনতে পাচ্ছো, গন্ধ পাচ্ছো, তার ওপরে ফোকাস করতে। নিজেকে মনে করাও আজ কত তারিখ, কী বার, তুমি কোথায় রয়েছো। উনি বলবেন -- “তোমার জীবন শুধু মনের ভেতরের চিন্তার মধ্যেই নয়। বাইরে তাকিয়ে দেখো, জীবন কিভাবে বিছিয়ে রয়েছে।“ ব্যস এইই।
তা,এই সাউন্ডট্র্যাকের সাথে "কশান! হ্যান্ডল উইথ কেয়ার" বা "রয়ে সয়ে সেবন করুন। মাত্রা বেশি হয়ে গেলে আতান্তরে পড়বেন" জাতীয় কোনো হুঁশিয়ারী দেওয়া ছিলোনা। কিন্তু আমারই মনের সাবধানী অংশ একবার পেছন থেকে জামা টেনে ধরে বললো -- "কাজটা ঠিক হচ্ছে তো? সবাই যে জিনিষ এড়িয়ে চলে সেই জলে ঝাঁপ দেওয়া, শেষটায় সামলাতে না পারলে কী হবে?" কী আর হবে? খারাপ লাগার সাথে দেখা সাক্ষাৎ আমার হয়না তা নয়। একটা লোক একে LGBTQ, তার ওপর আবার ভীগান। রূঢ়তা, ঘেন্না, ঠাট্টা, খোঁচা,ডিসক্রিমিনেশন, এইসব দিনরাত্রি এসে পড়ে এমনি লোকদের গায়ের ওপর। দুনিয়ার সেটাই দস্তুর। আরো খারাপ লাগা কোথায় কী লুকিয়ে আছে, সেও দেখা যাক। কীই বা আর এমন হবে?
কীই বা আর এমন হবে! হা হা, লিটল ডিড আই নো!
(ক্রমশ)