আমার বাড়ির পেছনে একটা জঙ্গল আছে। জানলা দিয়ে দেখা যায় ঘাসজমি ঢালু হয়ে জঙ্গলে মিশে গেছে। সেই মিশরেখার সীমানায় মাঝেমাঝে হরিণ এসে দাঁড়ায়। আর খরগোশ। খরগোশ খুব আসে। মেটেমেটে রং, লম্বা কান। অনেক সময় এসে আমার সিঁড়ির তলায় চুপটি করে বসে থাকে। কুচকুচ করে ঘাস খায়। ওদের দেখতে দেখতে কত গল্প মনে পড়ে আমার। খরগোশেরই গল্প। আর চাঁদের। বলেছিলাম না আগের বার?
পূর্ণিমার দিন যদি চাঁদের দিকে তাকাও, চাঁদের গায়ে যে দাগ দাগ আছে তার দিকে তাকাও, মনে হবে ঐ লম্বা-কান খরগোশ খল-নুড়ি নিয়ে কী যেন ঘুঁটছে। প্যারিডোলিয়া বলে একে, বিজ্ঞানের ভাষায়। মানে দাগের মধ্যে ছবি দেখতে পাওয়া। মাইথোলজি অবশ্য অন্য কথা বলে। বলে চাঁদের মধ্যে ঐ খরগোশ অমৃত তৈরি করছে। এ গল্প চীনদেশের। হ্যাঁ,পুরোটা বলছি।
আকাশের রাজাকে ওদেশে বলতো 'জেড সম্রাট'। অন্য সব রূপকথার গল্পের রাজাদের মতই ইনিও মাঝেমাঝে ছদ্মবেশে রাজ্যময় ঘুরে বেড়াতেন। প্রজাদের আসল অবস্থা দেখার জন্য, তাদের স্বভাব চরিত্র পরীক্ষা করার জন্য। ভালো রাজাদের এই করারই নিয়ম। তো সেবারে জেড সম্রাট এক থুত্থুড়ে বুড়ো সেজে পৃথিবীতে নেমেছেন। লাঠি ঠুকঠুক করে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে যাচ্ছেন। ভাবখানা যেন ক্লান্তিতে বুড়ো মানুষটার পা আর চলেনা। ঐ জঙ্গলে থাকতো শেয়াল, বানর আর খরগোশ। তিন বন্ধু। বুড়ো জেড সম্রাট তাদের সামনে গিয়ে পড়লেন। এই ঘোর সন্ধেবেলা অতিথি এসে হাজির হয়েছে, ওরা তিনজনে তো ব্যস্ত হয়ে উঠলো। তাতাপোড়া মানুষটাকে কী দিয়ে আপ্যায়ন করবে? বানর গাছে গাছে উঠে অনেক রকম ফল পেড়ে আনল। শেয়াল নদী থেকে মাছ ধরে এনেছে। কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বালিয়েছে, মাছ পুড়িয়ে অতিথির পাতে দেবে। আর খরগোশ? খরগোশ আর কী করবে? সে গাছে উঠতেও পারেনা, নদীতেও নামতে পারেনা। খায় তো কেবল ঘাসপাতা। তা তো আর অতিথিকে বেড়ে দেওয়া চলেনা? কিন্তু ক্লান্ত ক্ষুধার্ত বুড়োমানুষ তার ঘরে এসেছেন, সে তাঁর জন্য কোনোকিছু করতে পারবেনা তাই বা কী করে হয়? খরগোশ অম্লান বদনে আগুনের সামনে এসে দাঁড়ালো -- "আমি তো কোনো খাবার জোগাড় করে আনতে পারিনি। কিন্তু তাই বলে অতিথির অমর্যাদা হতে দেবো না। এখুনি এই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি। বুড়োবাবা, আপনি আমার মাংস খেয়ে পেট ভরান।"
খরগোশের এই সাহস আর আত্মত্যাগ দেখে জেড সম্রাট মুগ্ধ হলেন। বুড়োমানুষের ছদ্মবেশ ছেড়ে নিজের রূপ ধরে খরগোশকে বললেন --"তোমার মহানতা দেখে বেজায় খুশি হয়েছি। দাঁড়াও, তোমাকে একটা ভালো রকম পুরষ্কার না দিয়েই ছাড়ছি না।" এই বলে উনি খরগোশকে চাঁদে নিয়ে চলে গেলেন। সেখানে মস্ত শ্বেতপাথরের প্রাসাদ হলো তার বাড়ি। চাঁদের দেবী 'চাং-য়' হলেন তার বন্ধু। খরগোশ আগুনে নিজের প্রাণ দিয়ে অন্যের সেবা করতে চেয়েছিলো, তার পুরস্কারে জেড সম্রাট ওকে অমর করে রেখে দিলেন। দেবতার আশীর্বাদে ওর নাম হলো 'জেড খরগোশ'। কেউকেউ 'সোনার খরগোশ' বলে। শুধু নিজে অমর নয়, অন্য দেবতাদের অমর করে রাখার ভারও এই লক্ষ্মী খরগোশকেই দেওয়া হলো। চাঁদের প্রাসাদে, মস্ত খল-নুড়ি নিয়ে অমৃত তৈরি করা। তাই করছে সে সেইদিন থেকে। একটু মন দিয়ে দেখলেই দেখতে পাবে।
এই গল্পটা কোরিয়াতেও আছে। জাপানে। ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়াতেও। সব একটু অন্য অন্য ভার্শন নিয়ে। কোরিয়াতে যেমন স্বর্গের দারচিনি গাছের তলায় ও অমৃত বানায়। জাপানে বানায় 'মোচী' বলে একরকম চালের পিঠে। অতদূর যেতে না চাও তো ভারতেও আছে এই একই গল্পের একটা ভার্শন। জাতকের গল্পে -- 'শশজাতক'। কোনো কোনো ভার্শনে বানর, শেয়াল আর খরগোশ ছাড়াও একজন ভোঁদড় ছিলো বলে। মাছ এই ভোঁদড়ই ধরে এনেছিলো। শেয়াল এনেছিলো একটা গোসাপ আর এক বাটি দই। এখন বনের মধ্যে দই কোত্থেকে পেলো সেটা ভাবার বিষয়! হয়তো কোনো খামার থেকে চুরিটুরি করে এনেছিলো।
চাঁদ আর খরগোশের সম্পর্ক কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছেনা! পশ্চিম গোলার্ধেও গল্প নেই ভেবেছো? অবশ্যই আছে। মেক্সিকোতে আছে। অ্যাজটেকদের গল্প। উত্তর অ্যামেরিকা আর ক্যানাডার উপজাতিদের মধ্যেও আছে। অ্যাজটেকদের গল্পটা এই এশিয়ার গল্পেরই রকমফের অবশ্য। ওখানে 'কোয়েতজালকোটল' বলে একজন দেবতা অমনি মানুষ সেজে পৃথিবী দেখতে বেরিয়েছিলেন। খিদেয় ক্লান্তিতে যখন আর পা চলেনা তখন ঐ বুনো খরগোশ এসে নিজের মাংস দিয়ে ওঁর পেট ভরানোর প্রস্তাব দিয়েছিলো। শেয়াল টেয়াল অবশ্য ছিলোনা।
এদিকে 'ক্রী' উপজাতির লোকেরা একটা অন্য গল্প বলে। তাতে খরগোশ অনেক জাদু জানতো। তার এদিকে চাঁদের ভেতরটা দেখার ভারী শখ। কিন্তু তেমন কোনো জাদু ওর জানা নেই যা দিয়ে আকাশে ওঠা যায়। খরগোশ গিয়ে পড়লো সারস পাখির কাছে। 'স্যান্ডহিল ক্রেন' বলে যেগুলোকে ইংরেজিতে। সারস পাখিদের কিন্তু তখন অমনি লম্বা পা ছিলোনা। অন্য পাখিদের মতই ছোটছোট ঠ্যাং। তা, সারসের মনে দয়া হলো। খরগোশকে বললো -- "আমার পা ধরে ঝুলে পড়ো। উড়ে উড়ে তোমাকে চাঁদে নিয়ে যাবো।" তাই হলো শেষ অবধি। খরগোশ তো সারসের পা ধরে লটকে আছে। এদিকে চাঁদ তো আর কাছে নয়! উড়তে উড়তে ওর টানের চোটে পা গুলো একটু একটু করে লম্বা হতে হতে ঐ আজকের সারসের মত হয়ে দাঁড়ালো। তবে গিয়ে তারা চাঁদে পৌঁছেছে। অতক্ষণ ধরে ঝুলে থেকে থেকে খরগোশের হাতও কেটেকুটে এক শা। সেই রক্তমাখা হাত সারসের মাথায় রেখে সে আশীর্বাদ করলো। সেই থেকে স্যন্ডহিল ক্রেনের মাথায় অমনি সুন্দর লাল ছাপ।
ক্যানাডার উপকথাতেও খরগোশ আর চাঁদের গল্প পড়েছি। সে পুরোপুরি অন্য গল্প। খরগোশ সেখানে থাকতো বনের মধ্যে কাঠের কুটিরে। সঙ্গে ওর বুড়ি ঠাকুমা। শীতকালের বরফের মত ধপধপে সাদা রং ওদের।এই সময়ে খরগোশরা কিন্তু ঘাসপাতা খেতো না। আমাদের খরগোশ গভীর জঙ্গলে ফাঁদ পেতে রাখতো রোজ রাতে। সকালে গিয়ে দেখতো রোজই তাতে কোনো না কোনো ছোট জানোয়ার, পাখি ধরা পড়েছে। সেইগুলো বাড়ি নিয়ে আসতো। আর বুড়ি ঠাকুমা তাই দিয়ে চমৎকার সুরুয়া রাঁধতেন। এমনি করে দিন যায়। একদিন হঠাৎ সব অন্যরকম হলো। সকাল বেলা জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে খরগোশ দেখে কি ফাঁদের জাল সব ছেঁড়া, কাঠের খুঁটিগুলো ভেঙে চুরে পড়ে আছে। ফাঁদের ভেতর থেকে সব শিকার কে চুরি করে নিয়ে গেছে। খরগোশ ভারী অবাক হয়ে গেলো। এমনটা তো কখনো হয়নি! হয়নি তো হয়নি। কিন্তু সেদিন তো হলই, পরের দিনও একই কাণ্ড। তার পরের দিনও। খরগোশ যত শক্ত ফাঁদই বানায়, যত মোটা জালই লাগায়, ঠিক কে যেন এসে সব ভেঙে ছিঁড়ে ওর শিকারগুলো নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে! খরগোশ তো পড়েছে মহা মুশকিলে। এমন হলে ওদের চলে কী করে?
বুড়ি ঠাকুমা বললেন "এভাবে হবে না। চোর ধরতে হবে।" খরগোশ ফাঁদের আশেপাশে অনেক খুঁজে দেখলে কার যেন পায়ের দাগ পড়েছে। লম্বা, সরু, ঠিক যেন একটা চাঁদের রশ্মির মত দাগ। কী অদ্ভুত চোর! কে এ?
ঠাকুমার পরামর্শে খরগোশ করলো কী, খুব লম্বা আর শক্ত দড়ির ফাঁস বানালো একটা। আজ রাত জেগে ও ফাঁদের পাশে ঝোপের মধ্যে বসে পাহারা দেবে। চোর এলেই টপ করে দড়ির ফাঁস ছুঁড়ে দেবে। তাহলে বাছাধনকে আর পালাতে হবেনা! তখন দড়ির অন্যদিকটা গাছের সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেললেই হলো।
রাত তো বেশ ঘোর হয়েছে, জঙ্গলের মধ্যে পাতার সরসর আওয়াজ হচ্ছে। খরগোশ তার ফাঁস নিয়ে চুপ করে লুকিয়ে রইলো। হঠাৎ শুনতে পেলো চুপিসারে কে যেন আসছে। চোর! ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে কিছু ভালো দেখা যায় না। কিন্তু পায়ের শব্দ লক্ষ্য করে খরগোশ দড়ির ফাঁসটা ছুঁড়ে দিলো। খুব ওস্তাদ ফাঁদ-পাতিয়ে সে। ফাঁসটা ঠিক গিয়ে চোরের গলায় জড়িয়ে গেছে! খরগোশ শুনতে পায় চোরটা ঝটপট করছে। ফাঁস খোলার জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু অতই সোজা নাকি? মোক্ষম ফাঁস একেবারে পাকাপাকি ভাবে শক্ত হয়ে বসেছে।
খরগোশ লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এলো। চোরটাকে ধরতে হবে তো। দড়ির অন্য প্রান্তটা সে ততক্ষণে একটা গাছের সাথে শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু চোর ধরবে কী! সামনে আসতেই দেখে এমন জোর সাদা আলো যে ভালো করে তাকাতেই পারে না। চোখ যেন একেবারে ঝলসে যাচ্ছে! খুব কষ্ট করে, দু চোখের পাতা টেনে খুলে ও চোরটার দিকে তাকালো। আলোর তেজে চোখ এমন জ্বালা করছে, লাল হয়ে গেছে যে বলার না! চোরটা এদিকে মহা ঝটাপটি লাগিয়েছে। কিন্তু যতই করুক। বাঁধন আর খুলতে পারেনা। খরগোশ দেখলো এভাবে তো হবেনা। তাকাতেই পারছেনা, ও চোরের কাছে যাবে কী করে? তখন ও করলো কী, নদীর জলে হাত ডুবিয়ে তলা থেকে কালো আঠালো কাদা তুলে আনলো। তারপর সেগুলো গোল্লা পাকিয়ে ঐ জোরালো আলোর দিকে ছুঁড়ে দিলো। কাদার তালগুলো গিয়ে থ্যাপ করে চোরের গায়ে মুখে গিয়ে লেগেছে। অমনি আলোর কিছুটা কাদার তলায় চাপা পড়ে গেলো। কিছুটা আলোর জোর কমতেই খরগোশ দেখে ওমা! এ তো আকাশের চাঁদ স্বয়ং!
কী কাণ্ড দেখো! চাঁদ হয়ে কিনা বুনো খরগোশের খাবারে ভাগ বসানো! আবার তার তম্বি কত! চাঁদ মুঠো পাকিয়ে খরগোশকে বললো -- "তোর সাহস তো কম নয়। খোদ চাঁদকে ফাঁসে আটকেছিস? ভালো চাস তো খুলে দে বলছি। নাহলে তোকে, তোর ঠাকুমাকে, তোর পুরো জ্ঞাতি গুষ্টিকে শেষ করে ছাড়বো।" চোরের নিজেরই বড় গলা আর কাকে বলে! খরগোশেরও এদিকে ভয়ে প্রাণ উড়ে গেছে। কী অনর্থটাই না বাধে এখন! ঘর থেকে এদিকে ঠাকুমা টের পেয়ে বলছেন -- "ওরে ছেড়ে দে রে, ছেড়ে দে! এইসব ঠাকুর-দেবতাদের দিয়ে কোনো বিশ্বাস নেই। সব নাশ করে ছাড়বে।"
খরগোশ সমস্ত সাহস এক করে এগিয়ে এলো। বললো -- "দেবো ফাঁস খুলে, যদি কথা দাও আর কোনদিন আমার ফাঁদ ভাঙতে আসবেনা।" অন্য সময় হলে চাঁদ কী করতো বলা যায়না। কিন্তু তখন রাত প্রায় ভোর হয়ে আসছে। দিনের আলো ফুটবার আগেই চাঁদকে আকাশে ফিরে যেতে হবে। সকাল হয়ে গেলেই তার আর থাকার যো নেই! বেগতিক দেখে চাঁদ বললে -"ওরে আসবো না রে আসবো না। এই আমার সাদা আলোর নামে প্রতিজ্ঞা করলাম। আর কোনদিন পৃথিবীতে নেমে আসবো না। এখন তাড়াতাড়ি করে দড়িটা খুলে দে রে বাপ!"
খরগোশ গিয়ে আস্তে আস্তে দড়ির ফাঁস খুলে দিলে। চাঁদ শোঁ করে এক্কেবারে ভাগলো! কিন্তু ঐ আলোর ঝলকানিতে খরগোশের চোখ সেই যে লাল হয়ে গেলো, আজও দেখবে সব সাদা খরগোশদেরই কেমন লাল লাল চোখ। তবে চাঁদেরও শাস্তি হয়েছিলো বৈকি! ঐ যে কাদার ছোপ। আকাশে ফিরে গিয়ে কতবার ধুলো, কতবার রগড়াল। কিন্তু চুরির শাস্তি ঐ কাদার দাগ চাঁদের গা থেকে আর উঠলো না। সব্বাই দেখতে পায় দুনিয়ার। ঝকঝকে সাদা মুখের মধ্যে ঐ চোর-চন্দ্রের কলঙ্ক।