প্রথম দুটো দিন খুব ভাল কাটল। আমি কিছুটা উত্তেজনা নিয়ে ধ্যান শুরু করি। যেন নতুন কোনো পাহাড়ি জায়গায় বেড়াতে গেছি। আজ এই রাস্তা ধরে যাব, কাল ঐ রাস্তা ধরে। কী রকম জঙ্গল-পাহাড় দেখব কে জানে? হয়তো লাফিয়ে চলা ঝোরা দেখব একটা। হয়তো নতুন কোনো পাখি। সেইরকম। গিটারের বাজনার মাঝামাঝি উত্তেজনা কমে মন শান্ত হয়ে আসে। মনে হয় চারদিকে পাইন বন, মাঝখানে সেই লুকোনো পাথুরে নদীর ধারে আমি শুয়ে আছি ঘাসের ওপরে। অনেক উঁচুতে ভীষণ নীল আকাশ। ধ্যান শেষ হলে মনটা খুব ভাল হয়ে যায়। বুনো ঘোড়াদের দেখা পাই না আমি। বুলবুলি পাখির ডাক শুনতে পাই আর মজার মুখো কাঠবেড়ালি। ব্রাইট আইড, বুশি টেইলড। বুনো ঘোড়া জঙ্গলের অনেক গভীরে থাকে। সেই গভীরতার তুমি কী জান?
তিন দিনের দিন থেকে বদল শুরু হল। সেদিন ঐ অত চেনা বন-পাহাড়ি আর ততটা চেনা লাগে না আমার। খালি মনে হয় বুকের অনেক ভেতরে, মনেরও অনেক ভেতরে, কোথাও যেন কোনো কিছু গলে যাচ্ছে। পাথরের মত জমাট হয়ে থাকা কোনো অনুভূতি। কিংবা ভাবনা। কিংবা স্মৃতি। বিশাল একটা হিম-শৈল। অনেক পুরোনো। বাজনাটা খুব মন-কেমন করানো মনে হয় আজ। মনে হয় সবকিছু নদীর জলে ফেলে দিয়ে বসে থাকি। মনে হয় আমার হাত-পা কোনো শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। আজ সেই দড়িগুলো আলগা হয়ে খুলে পড়ছে। গলে যাওয়া অনুভূতি চোখ ছাপিয়ে বার হয়ে আসে। আমি বুঝতে পারি, কিছু একটা ঘটছে। কী, কোথায়, কিভাবে – তা বুঝতে পারি না। যাকে পাঁচটা ইন্দ্রিয় দিয়ে ধরা যায় না – সেই সে, কী ছবি যে আঁকে, তা কী করে ধরব? এই কি তাহলে সেই মহাসিন্ধুর ওপারের সঙ্গীত? বিষণ্ণতা অদ্ভুত একটা সুরে বাঁশি বাজাতে থাকে। তার আওয়াজ বাঁশির মত নয়। ব্লো-গান দেখেছ? যা দিয়ে অ্যামাজনের গভীর জঙ্গলের আদিবাসীরা বিষের তীর ছুঁড়ে মারে? সেই ফাঁপা নলের মধ্যে দিয়ে একেবারে একলা হাওয়া যখন এ’ধার থেকে ও’ধারে ছুটে যায়, তখন ঐ রকম আওয়াজ বেরোয়। বিষণ্ণতা আমার দিকে তাক করে ব্লো-গান ছোঁড়ে। বিষের তীর।
সেদিন খুব ঠান্ডা আর ভারী একটা কিছু মনের মধ্যে নিয়ে আমি ঘরে ফিরলাম। আমার ভেতর থেকে কেউ হাত টেনে ধরে বলে, “সাবধান, সাবধান। এখনো সময় আছে, পিছিয়ে এসো।” ভয় পাওয়া গলা, মিনতি করে। আমি তখনই নির্দ্বিধায় বুঝতে পেরে যাই, আমার ঝাঁপ দেবার সময় এসেছে। অতলে।
চতুর্থ দিন আসে। তুমি কখনো সেই স্বপ্নটা দেখেছ? যার মধ্যে একটা উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে তুমি খুব গভীর কোনো খাদে পড়ে যাচ্ছ? পড়ার কোনো শেষ নেই। কারণ ঐ খাদের কোনো তলা নেই। তুমি পড়তেই থাকছ, পড়তেই থাকছ। অনন্ত অসহ্য কাল ধরে। দেখেছ? আমার সেই স্বপ্ন সত্যি হবার কাছাকাছি এগিয়ে আসে। চতুর্থ দিন, গিটারের বাজনা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয় আমার পায়ের তলায় আর মাটি নেই। আমার চেনা দুনিয়ার সবকিছু পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে গেল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, যে আমি হারিয়ে যাচ্ছি। কোথায়, কোনদিকে – তা বোঝার কোনো উপায় নেই। সত্যিকারের হারিয়ে যাওয়াতে কোনো বোঝা থাকে না। আমার ফুসফুস থেকে সব হাওয়া বেরিয়ে যায়। চাপ খাওয়া বেলুনের মত। ডুবন্ত মানুষের বুকের ভেতর যেমন আস্তে আস্তে জল ঢুকে হাওয়ার জায়গা নিয়ে নেয়, ঠিক সেইভাবে আমার মধ্যে ঢুকে আসে নিখাদ ভয়। আলকাতরার মত ঘন, কালো। নিঃশেষে মুছে যাবার মত ভয়। অমোঘ। যা কিছুকে, যে কাউকে আমি চিনতাম, নিজের বলে, কাছের বলে ভেবেছিলাম, সব এক নিমেষে ‘নেই’ হয়ে যায়। আমি চারপাশে কোনো কিছুকে চিনতে পারি না। নিজেকেও না। এখানে কোনো আলো নেই। এখানে কোনো শব্দ নেই। তবু আমি সন্দেহাতীত ভাবে বুঝতে পারি, ওরা এসে গেছে। বুনো ঘোড়ার দল। অসম্ভব ঠান্ডা, ধারালো, শক্ত ক্ষুর নিয়ে ওরা আমার গায়ের ওপর দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। আমি বুঝতে পারি, আমার পুরো সত্তাটাই ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। ভয়ের পরে ভয়ের পরে ভয়, অসম্ভব আদিম, নিষ্ঠুর। ওদের ক্ষুরের শব্দহীন কোলাহলে আমার চিৎকার ডুবে যায়।
ধ্যানের প্রয়োগ-বিধিতে লেখা ছিল – খুব কষ্ট হলে, তখনই ধ্যান বন্ধ করে খানিকটা ঠান্ডা জল খেতে হবে। খোলা হাওয়ায় একটু হাঁটাচলা করতে পারলে ভাল। ছোটছোট চুমুক দিয়ে গরম চা খাওয়া যেতে পারে, ইত্যাদি। আমি লিখতে পারতাম, যে সেই মুহূর্তে আমার এসব কিছুই মনে পড়েনি। সেটা কিন্তু সত্যি বলা হবে না। আমার মনে ছিল। কিন্তু আমি তা করতে চাইনি। আমি জানতাম, যতই বীভৎস হোক, ভয়ানক হোক, এই অনুভূতিরা আমার নিজের। এরা আমার চরম সত্য। এবং এরাই এক প্রকারে আমি। এদের কাছ থেকে আমি কতদিন পালিয়ে বেড়াব? নিজের কাছ থেকে? না, আমি পালাতে চাইনি। আমি জানতাম আমাকে ওদের সামনে দাঁড়াতেই হবে। ভেঙে হাজার টুকরো হয়ে গেলেও।
নিকষ অন্ধকারের মধ্যেও আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম এবার। কিছু জিনিস দেখার জন্য চোখ দরকার হয় না। আমি ওদের দেখলাম। পাঁচটা বিরাট ঘোড়া। ঝাঁকড়া কেশর আকাশ-পাতাল ছেয়ে উড়ছে। ফেনাতোলা মুখ, ওদের পেশিতে গতিময়তা ঢেউয়ের মত ওঠে পড়ে। পাঁচটা ঘোড়া – ফিয়ার, ড্রেড, টেরর, প্যানিক, ফোবিয়া। ওরা একটা বিশাল রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই রথে যিনি দাঁড়িয়ে, তাঁর দীর্ঘদেহে গাঢ় নীল পোশাক। রুপোলী লম্বা চুল হাওয়ায় ওড়ে। ইস্পাতের তৈরি। আর একজোড়া সবুজ চোখ। সে চোখের কোনো শুরু নেই, শেষ নেই, তল নেই। সেই মহারথীর নাম জানা হল না। রথটা আমাকে দলে-পিষে-মুচড়ে দিয়ে চলে গেল। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে শুধু এক ঝলক হাসলেন। সেই দুর্বোধ্য হাসি একটা তীক্ষ্ণ বর্শার মত অসম্ভব ঠান্ডা ঝাঁকুনি তুলে আমার শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। এতক্ষণের নৈঃশব্দ ভেঙে আমার গলা দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে। মানুষের গলায় তেমন আওয়াজ হয় না। আদিম, জান্তব চিৎকার। ধ্যান শেষ। আমি থরথর করে কাঁপতে থাকি। আক্ষরিক। আনকন্ট্রোলেবল শেকিং। বাইরে তখনও রোদ্দুরময় বিকেল, পাখি ডাকছে।
পরের দিন যখন ধ্যানে বসলাম, আমার মধ্যে থেকে গতকালের ভয়াবহতা যায়নি। আমার ভেতরের মূল পর্যন্ত নাড়া খেয়ে গেছে। আমার হাত, পা, মন সব কেমন শিথিল লাগে আজ। তবু আমি জানি, আমাকে যেতেই হবে। এখান থেকে ফেরার রাস্তা নেই। আমি বসি। প্রোগ্রেসিভ রিল্যাক্সেশন। তারপর গিটার শুরু হয়। আজ কোথাও অন্ধকার নেই, ভয় নেই। আমার মনে হয় বাজনার সুর আজ বাস্তব, পরাবাস্তব সব ছাপিয়ে আমাকে ঘিরে নিচ্ছে। পরিচিতির গণ্ডি আজও ঝাপসা হতে হতে মুছে গেল। খুব নরম রঙের একটা আলো আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি বুঝতে পারি – আজ যে এসেছে, তার নাম ‘দুঃখ’। কোনোকিছুতে ওর কোনো ব্যস্ততা নেই। ও এখানে তাড়াহুড়ো করার জন্য আসেনি। তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্যও নয়। স্লো-মোশন ছবির মত ধীরে দুঃখ আমার অস্তিত্বের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দেয়। আমার মনের ভেতরের সবচেয়ে অরক্ষিত, সবচেয়ে ভঙ্গুর জায়গায় হাত রাখে। আমি দেখতে পাই, শুনতে পাই, বুঝতে পাই – দুঃখরা আমার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার ভেতর থেকে উঠে আসছে। সেইসব দুঃখ, যাদের দিকে কেউ কোনোদিন তাকিয়ে দেখেনি, যাদের কথা কেউ কোনোদিন শোনেনি। যাদের আমিও দূরদূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি। আমি দেখতে পাই – ঐ যে অগুণতি ‘আমি’। যাদের আমি বরাবরের জন্য ভুলে যেতে চেয়েছি। বাজনার মত কোমল একটা জিনিসের চাকায় আমার বুক, আমার মন পিষে যেতে থাকে। আমার সমস্ত সত্তা নিংড়ে আরো আরো দুঃখ বেরিয়ে আসে। মাড়াইয়ের কলের আখের গোছার মত।
শরীরে মধ্যে আবারও কাঁপুনি শুরু হচ্ছে। এই কম্পনের রকম আলাদা। কম্পাঙ্ক আলাদা। আমি কান্নার শব্দ শুনতে পাই। ফিসফিসে, লুকনো কান্না। নিরুপায় অপার কান্না। মর্মান্তিক বিলাপ, ডুকরে ওঠা অতল রোদন। আমি শরীরের সব অঙ্গ দিয়ে শুনতে পাই। আমার বুকের মধ্যে মহাসমুদ্রের ঢেউয়ের মত কষ্ট ওঠে, পড়ে। নোনতা জল আমাকে পুরোপুরি ডুবিয়ে নেয়। সেই জলের ভেতরে চোখ মেলা যায় না, শ্বাস নেওয়া যায় না। তবু সেই অতীন্দ্রিয় অনুভূতির জগতে আমি এবার আরো একজন দুঃখের অস্তিত্ব টের পাই। তার সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্নায়ুতন্ত্র অচল হয়ে যায়। তার সবথেকে বড় শক্তি – তার প্রাচীনত্ব।
এই অনুভূতিকে লিখে বোঝানোর জন্য যে ভাষা দরকার, তা আমার একেবারে জানা নেই। এমনকি, এ-ও জানি না, যে সেরকম কোনো ভাষা আদৌ আছে কিনা। শব্দ জিনিসটা যে কত অক্ষম, তা আমি সেই মূহুর্তে পুরোপুরি বুঝে ফেলি। কী যে গভীর, কী যে বিপুল, কী যে অসম্ভব পুরোনো এই দুঃখ – তা কোনোকিছু দিয়েই বোঝানো যায় না! মনে হয় হাজার হাজার বছরের জমাট কষ্ট, সব মন্থন করে উঠে আসছে। মহাপ্লাবনের মত সব নিঃশেষে ভাসিয়ে নেওয়ার জন্য ছুটে আসছে। দুঃখ যে এত পুরোনো হতে পারে, তা আমার দূরতম কল্পনাতেও কোনোদিন ধারণা করতে পারিনি। মনে হয় এই আমি, সেই আমি, চিরন্তন কোনো আমির সযত্নে তিলেতিলে জমানো দুঃখ আজ সব লেপেপুঁছে দিয়ে তুষারের মত ঝরে পড়ছে। সেই যে কোনকালে কে যেন “কেঁদে চলে গেছে, কাঁদিয়ে চলে গেছে...” – সেই যে কে যেন আমার সমস্ত ভালবাসাকে কাঁটাওয়ালা জুতো দিয়ে থেঁতলে মাড়িয়ে গেছে... সেই কারা আমার সভয় কান্না শুনে মজা পেয়ে হো হো করে হেসেছে... সেই সব কথা পুরোনো অ্যালবামের ছবির মত একের পর এক আমার কাছে এসে হাজির হয়। হাজার বছরের একাকীত্ব, উপেক্ষা, অবহেলা, উপহাস – আজ আমার সামনে অলজ্জ, নগ্ন হয়ে এসে দাঁড়ায়। আর তার মধ্যে এই তুচ্ছ আমি, ক্ষীণ আমি, নিজের দুঃখকে তাকিয়ে দেখতে অস্বীকৃত আমি, নিরুচ্চারে, নিঃশেষে তলিয়ে যেতে থাকি।
গিটারের সুর বদলে যাচ্ছিল। রোজই যায় হয়তো। আগে কোনোদিন এভাবে আমার চেতনায় ধরা পড়েনি। যে বাজাচ্ছে, তার কথা আস্তে আস্তে পাপড়ি মেলতে থাকে। শুধু সুর নয়। বার্তা। অন্তরঙ্গ। আমার চোখের সামনে টুকরো টুকরো ছবি ভেসে ওঠে। পুরোনো রাশিয়ান বইয়ে যেমন ছবি আঁকা থাকত – সেই রকম। লাল ইঁটের ফায়ারপ্লেস, নরম পুরোনো কম্বল, রান্নাঘরের টেবিলের পাশে সোনালি রঙের কুকুরবাচ্চা। এত চেনা, এত আপন, যে বাস্তবের পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব থাকতেই পারে না। সেখানে চুল্লির পাশে বসে বাজনা বাজাচ্ছে কেউ। বাজনা আমাকে কাছে টেনে নেয়। তার কথাহীন ভাষা বুঝতে আমার এতটুকু অসুবিধা হয় না। আমি বুঝি, ও বলছে, “আমি সবসময় তোমার সঙ্গে থাকব। সারাক্ষণ। আমি তোমাকে বলব না – কোনো ভয় নেই। বলব না – সব দুঃখ কেটে যাবে। ভয় বারবার আসবে, দুঃখ আসবে, কান্না। খুব খারাপ ঘটনাও আসবে। খুব ভয়ানক। কিন্তু তবু তুমি সেসব নিতে পারবে। ইট’স ওকে টু বি স্কেয়ার্ড। ইট’স ওকে টু বি স্যাড। ইট’স ওকে টু বি ভালনারেবল। আমি সবকিছুর মধ্যে তোমাকে দু’হাতে জড়িয়ে থাকব। আমি তোমাকে কোনোদিন ফেলে দেব না।” আমি এই কথার সত্যতা সন্দেহাতীতভাবে বুঝতে পারি। গিটারের সুর আমার প্রতিটি অণু-পরমাণুতে চারিয়ে যায়। যে বলছে, তার কথা মিথ্যে হতেই পারে না। সে আমার সব আত্মীয়, সব বন্ধুর থেকে আপন। সে ‘আমি’। আমার মনের ভেতরের ‘আমি’। আজকে আরো এক বুনো ঘোড়া তার মায়াময় অতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ওর ঘাড়ে, ঝালরের মত কেশরের ওপর মাথা রাখি। ‘সাটোরি’ কাকে বলে – কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। নিঃসন্দেহে।
‘রাইডিং দ্য ওয়াইল্ড হর্স মেডিটেশন’ আমি আর কখনো করিনি। ঐ পাঁচদিন আমার শরীরের, মনের ওপর যে ছাপ ফেলেছিল – তার জের সামলে উঠতে পারছিলাম না। আমি বুঝতে পেরে গেছিলাম, যে জীবনকে আমি এতদিন যা বলে জেনে এসেছি, তা ঐ পাঁচদিনে একেবারে শেষ হয়ে গেছে। সেই ‘আমি’ শেষ হয়ে গেছে তার সঙ্গেই। আমি বুনো ঘোড়ার পিঠে উঠতে গেছিলাম। বুনো ঘোড়ারা আমাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ঐ ধুলোর মধ্যে এখন রয়েছি পড়ে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ক্রিচারের মত এই ‘আমি’। নিজের অচেনা। নতুন। হ্যাঁ, ঐ বুনো ঘোড়া আমার জন্মদাতা।
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। অনেক মাস, এমনকি বছর। সময়ের সমুদ্রে অনেক ঢেউ উঠেছে, পড়েছে। আমার জীবনেও। ইমারত ধ্বসে পড়েছে, ভিতে ধরেছে ফাটল। প্রোফেশনাল এক্সপার্টরা আমাকে কন্ট্রোলড পদ্ধতিতে ধীরে ধীরে ট্রমা রিলিজ করতে শিখিয়েছেন। প্রসেস করতে। আরো অনেক কিছু শিখিয়েছেন। মাইন্ডফুলনেস, অ্যাক্সেপ্টেন্স অ্যান্ড কমিটমেন্ট থেরাপি। আর্ট থেরাপি, কগনিটিভ জার্নালিং। নিজেকে তুলে দাঁড় করানোর এই ‘প্রসেস’ এখনও চলছে। চলবেও। ভয়, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, যেমন কথা দিয়েছিল, বারবার ফিরে ফিরে আসে আমার কাছে। নতুন নতুন চেহারা নিয়ে। প্যান্ডোরার বাক্সের ঢাকা বন্ধ করার উপায় কেউ কোনোদিন বার করতে পারেনি। কিন্তু বহুদিনের লুকোনো ক্ষতদের খুঁজে বার করতে পারলে, ওদের মধ্যে থেকে বিষতীরের ফলা টেনে উপড়ে ফেলতে পারলে আরো এক নতুন বাক্সের ঢাকনা খুলে যায়। তার নাম ‘হিলিং’।
এখন আমি নিজের ইমোশনদের অনুভব করতে শিখেছি। পুরো মাত্রায়। হৃদয়ের একূল-ওকূল-দুকূল ভেসে যাওয়া যে কী, তা আমি সত্যি করে বুঝতে শিখেছি। এক গভীর প্রাপ্তিতে আমার ভেতর-বাইরে ভরপুর হয়ে গেছে। দুঃখ কী, সুখ কী, ভালবাসা কী, ভয় কী – আমি আজ অসামান্য ক্ল্যারিটিতে দেখতে শিখেছি। প্রত্যেকটা দিনে আমি একটা নতুন জন্ম কাটাতে শিখেছি। আমি অর্ফিউস হয়ে জন্মেছি। প্রমিথিউস হয়ে। ট্যান্টালাস হয়ে, সিসিফাস হয়ে। যাঁরা বাইরের দুনিয়ার ঘটনাবলি দিয়ে জীবনের বিচার করেন, তাঁরা আমাকে কেউ বলেন ‘পাগল’, কেউ বলেন ‘ন্যাকা’, কেউ বিরক্ত হয়ে বলেন ‘উজবুক’, বা ‘দুঃখবিলাসী’। তাতে অবশ্য অসুবিধা নেই কোনো। সবার দেখার চোখ তো এক রকমের হয় না। জীবনের অনেকখানি, বরং বেশিরভাগটাই যে ভেতরের দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে, তা কাউকেই বোঝাতে যাওয়ার প্রয়োজন আমার ফুরিয়ে গেছে। অনেক প্রয়োজনই ফুরিয়ে গেছে আমার – সত্যি বলতে। আমি নির্দ্বিধায় নিজের দিকে তাকাতে পারি। আমি অকাতরে ভয় পাবার মত সাহসী হতে পেরেছি। এক জীবনের পক্ষে এই অ্যাচিভমেন্টই কি কিছু কম কথা?
(ক্রমশ)