ইশকুলে আমার বন্ধু ছিলো অর্চনা হেমব্রম। লোয়ার নার্সারীতে পড়ি, সেই সময়কার কথা বলছি। এই অর্চনার একজনের ওপর বিরাট ক্রাশ ছিলো। জনৈক 'লেদা রাজা'। যে যেখানে কারুর কোনো গুণের কথা বলুক না কেন, অর্চনা হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলতো "লেদা রাজার মত"। আমি তো কিছুতেই ভেবে পেতামনা যে কোনো রাজা 'ল্যাদা' হলে তাঁর এত ভক্ত হবার কী আছে! এদিকে যতই জিজ্ঞেস করা হোক না কেন এই 'লেদা রাজা'টি কে, অর্চনা খালি ফিক করে হেসে বলতো "আমি কী জানি?" শেষে একদিন কৃষ্ণর গল্প শুনে সে সটান বলে বসলো "এটা তো লেদা রাজার গল্প। আন্টি মোটেই জানেনা, লেদা রাজার গল্পে শুধুশুধু ভুলভাল কান্ড ঢুকিয়ে দিয়েছে!" সবাই মিলে তখন নানা প্রশ্ন, নানা মন্তব্য। কারুর রাগ হয়েছে, কেউ আন্টিকে বলে দিতে চাইছে। কিন্তু এই বিস্ফোরক মন্তব্য করে দিয়েই অর্চনা আবার সেই – ফিক, "আমি কী জানি?" মোডে চলে গেছে। কেউ আর তার কাছ থেকে কিছু টেনে বার করতে পারলো না!
তারপর যেমন হয়, আমরা আস্তে আস্তে লোয়ার নার্সারীর ঘর ছড়িয়ে, রিভার্সাইড প্রেপ স্কুলের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে, পড়াশোনার পাট ছাড়িয়ে কে কোথায় চলে গেলাম। শিমূল তুলোর বীজের মত এদিক, ওদিক, কোথায় না কোথায়। অনেক বছর পরে, অন্য রঙের মাটিতে, এক অন্যরকম বইয়ের জঙ্গলে আমার সাথে একজনের দেখা হয়ে গেলো। সিসিল হেনরী বমপাসের লেখা 'ফোকলোর অভ দা সান্তাল পরগণাজ'। তার সূচীপত্রে দেখি 'লেধা অ্যান্ড দা লেপার্ড'। আমার ঘাড়ের কাছে শিরশির করে ওঠে। আমি ফিসফিস করে বলি -- "লেদা রাজা?" গল্প মুচকি হাসে, আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকায়।
নদীর এক পারে এক গভীর জঙ্গল। অন্য পারে ছোট্ট এক গাঁ। গাঁয়ের ছেলেরা নদীর ধারে গরু চরায়, মোষ চরায়। তাদের একজনের নাম লেধা। দিব্যি কালোকোলো তার রং, ভাসাভাসা চোখ, আর মাথা ভর্তি কুচকুচে কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। ছেলেরা মোষের পিঠে চাপে, বাছুরের সাথে দৌড়ঝাঁপ খেলে। লেধা গাছের নীচে বসে বাঁশি বাজায়। দৌড়তে কষ্ট ওর। একটা পায়ে মোটেই জোর নেই, পা টেনেটেনে হাঁটে।আরো একটা খেলা ছিলো ছেলেদের পছন্দের। কোথাও কিছু নেই, ওরা আচমকা চেঁচিয়ে উঠতো "চিতাবাঘ এসেছে, চিতাবাঘ এসেছে"। এই শুনে গাঁয়ের লোক চমকে উঠবে, তাতেই ওদের ফুর্তি! বাঘটাঘ আসলে স্রেফ ফক্কিকারি। অবশ্য ফক্কিকারি বললেও বা ঠিক বলা হলো না। ছিলো চিতাবাঘ। জঙ্গলের ভেতরে। তারও নিজের প্রিয় খেলা ছিলো একটা। মাটির মধ্যে এখানে খোঁদল, ওখানে গর্ত। সেই গর্তে গোসাপের বাসা। এই চিতার খেলা ছিলো ঐ গোসাপ গুলোর সাথে রগড় করা। ও থাবা দিয়ে গর্তের মুখ চেপে ধরতো। গোসাপ তখন অন্য গর্তের মুখ দিয়ে বেরোয় না কী করে সেই হচ্ছে ব্যাপার!
এইবার একদিন একটা গোসাপ তো এতে ভীষণ রেগে গেছে। রোজরোজ এমনি বজ্জাতি কার আর ভালো লাগে? রেগেমেগে অন্য এক গর্তের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসে সে কটাশ করে চিতার ল্যাজের গোড়ায় কামড়ে ধরেছে। ধরলো তো ধরলো, আর ছাড়ার নামটি নেই। চিতা কতই ল্যাজ আছ্ড়ায়, হাঁচোড়-পাচোঁড় করে, ল্যাজের ঠিক গোড়াটায় তো ওর থাবাও পৌঁছোয়না, মুখও না। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চিতাবাঘ একেবারে বেদম হয়ে গেলো। এদিকে ঠিক তখনই ছেলের দল "ওরে চিতাবাঘ রে চিতাবাঘ" বলে চেঁচিয়ে উঠেছে। সেই শুনে সত্যিসত্যি চিতা লাফ মেরে ওদের মাঝে গিয়ে পড়লো।
ছেলের দল তাজ্জব! এরকম তো কখনো ঘটেনি! ভয়ের চোটে চেঁচিয়ে মেচিয়ে সব্বাই দৌড়ে পালাতে পারলে বাঁচে। পারলোনা শুধু একজন। ঐ লেধা। কী করে দৌড়বে? ও তো খোঁড়া পা নিয়ে ভালো করে হাঁটতেই পারেনা! মুখের সামনে ইয়া বড় চিতা দেখে লেধার তো বুক শুকিয়ে গেছে। কিন্তু চিতা বললো "ভয় পেওনা। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না" (সত্যি বলছি কুস্তি করে, ইত্যাদি)
লেধা তো অবাক! চিতা বললে "আমার ল্যাজের গোড়ায় হতভাগা গোসাপ কামড়ে ঝুলে আছে। ওটাকে ছাড়িয়ে দাও। আর কিছু চাইনা।"
লেধা দেখে সত্যিই এইটুকুনি এক গোসাপ এমন গোঁ ভরে ল্যাজ কামড়ে ঝুলে আছে যে অত বড় চিতার কম্ম কাবার! দেখে ভয়ের বদলে লেধা তখন হেসেই কুটিপাটি। কিন্তু দয়ালু ছেলে সে। গোসাপের ঘাড় ধরে ঠিক ওকে ছাড়িয়ে নিলো। তখন চিতার ভারী লজ্জা হয়েছে। একটা ক্ষুদে জানোয়ারের কাছে এমন নাকাল হতে হলো, আবার কিনা একটা মানুষের ছেলের কাছে সাহায্য চাইতে হলো? জঙ্গলের মধ্যে এই খবর রটে গেলে আর কারুর কাছে মুখ দেখানো যাবেনা! চিতা লেধাকে বললো "দেখো ছেলে। তুমি খুব ভালো তা বুঝলাম। কিন্তু এই আজকের ঘটনা যেন কারুর কানে না ওঠে। নাহলে কিন্তু তোমাকে গিলে খাবো।"
লেধাও বুঝেছে চিতা যা বলছে তার অন্যথা করবেনা। ওরও তো প্রাণের ভয় আছে! লেধা কথা দিলো যে কেউ বিন্দু-বিসর্গ জানবেনা। চিতা চলে গেলো জঙ্গলে। লেধা আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরে এলো। সবাই তো তাকে পেয়ে বেজায় খুশি। লোকে ধরেই নিয়েছিলো যে ছেলেটা নিশ্চয়ই চিতার পেটে গেছে! বন্ধুরা সবাই ওকে ঘিরে ধরলো। "চিতা কী কথা বলল রে তোর সাথে? কেন তোকে ছেড়েই বা দিলো?" কৌতুহলে সবার মন চুলবুল করছে। লেধা কিন্তু চুপচাপ। শুধু হাসে আর মাথা নাড়ে। কারুর কাছে মুখটি খুলবেনা সে।
শেষে অনেক রাতে, যখন সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে, লেধার বৌদি এসে জিজ্ঞেস করলে -- "কী হয়েছিলো বলই না লেধা। চিতার কাছ থেকে তো কেউ কোনদিন বেঁচে ফেরেনা। তুই কী জাদু জানিস?"
এই বৌদি লেধার খুব প্রিয় মানুষ। নিজের দিদির মত। তার কাছে আজ অব্দি ও কোনো কথা লুকোয়নি। ও বললো --" কাউকে বলতে মানা করেছে যে। চিতা জানালে আমাকে ছিঁড়ে খাবে।"
বৌদি বলে -- "এই গাঁয়ের মাঝে চিতা কোত্থেকে আসবে? এখানে শুধু তুই আর আমি, দেখছিস না?"
লেধা আর থাকতে না পেরে বৌদিকে সব কথা খুলে বললো। কিন্তু হয়েছে কী, চিতাবাঘ তো লেধাকে মোটেই বিশ্বাস করেনি। সে চুপিচুপি অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আড়ি পেতে ওর জানালার নীচে লুকিয়ে আছে। শুনতে এসেছে ছেলেটা সত্যি কথাটা পাঁচকান করে কিনা। এখন তো সে লেধা আর তার বৌদির কথা শুনে ফেললো। এবার লেধা ঘুমিয়ে পড়তেই ওর বিছানা শুদ্ধু নিজের পিঠে তুলে চিতা জঙ্গলের দিকে রওনা দিলো। গভীর জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বিচ্ছুটার হাড়মাস চিবিয়ে খাবে।
এদিকে জঙ্গলের শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগতেই তো লেধার ঘুম ভেঙে গেছে। ও দেখে এ কী কান্ড! যমদূতের মত চিতা তো ওকে মরণের দোরে নিয়ে চলেছে! ভয়ের চোটে কী করবে ভেবে না পেয়ে লেধা হাত বাড়িয়ে রাস্তার ওপর ঝুঁকে থাকা একটা গাছের ডালকেই জড়িয়ে ধরলো। চিতা বিছানা শুদ্ধু দৌড়ে অনেক দূর চলে গেছে। লেধা রয়ে গেছে গাছে ঝুলে।
কিন্তু খানিক পরেই চিতার হঠাৎ মনে হলো "এ কী রকম ব্যপার হলো? পিঠের বোঝাটা এমন হাল্কা ঠেকে কেন?" বোঝা নামিয়ে দেখে, সব ভোঁ-ভাঁ! কিন্তু মান-সন্মানের ব্যাপার। ও কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে নাকি? নিজেরই পায়ের দাগ দেখে দেখে চিতা ঠিক ঐ গাছের তলায় ফিরে এলো। লেধা তো ওপরে ডালে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে। চিতা তাকে মিষ্টি করে বললো-- "আরে খাবোনা রে তোকে, বলেছি না আগেই? এমনি কটা কথা বলার ছিলো। কিন্তু গাঁয়ের মধ্যে, মানুষের মাঝে আমি বসে কথা বলি কী করে! তাই তোকে নিরিবিলিতে নিয়ে আসছিলাম। নেমে আয় বাপু গাছ থেকে। কথা কটা আলোচনা করে বাড়ি চলে যাই। আমারও কাজকর্ম আছে!"
লেধা কী বিশ্বাস করলো কে জানে! ও আস্তে আস্তে গাছ থেকে নেমে এলো। অমনি চিতা তো স্বমূর্তি ধরেছে। "হালুম"!! লেধা দেখে আর পালাবার উপায় নেই। ও চিতাকে অনুনয় করে বললো "প্রাণটা তো যাচ্ছেই চিতাদাদা। জন্মের শেষ সাধ, একটু দোক্তা খেয়ে নিতে দাও।"
এমন অনুরোধ আর কে ঠেলতে পারে? চিতা রাজী হলো। লেধা ট্যাঁক থেকে দোক্তা পাতা বার করছে, শুকনো পাতাগুলো খড়মড় আওয়াজ করে উঠলো। সেই শুনে চমকে চিতা বলে "ও কিসের আওয়াজ?"
লেধার মাথায় তখন বুদ্ধি খেলে গেছে। "এখনও বুঝতে পারোনি? সেই যে গোসাপ তোমার ল্যাজ কামড়ে ধরেছিলো, সে যে আমার এই ট্যাঁকের মধ্যে রয়েছে। এই বার করলুম বলে!"
এই শুনেই তো চিতার সব সাহস গেছে উড়ে! আবার ঐ গোসাপের পাল্লায়? সাধের ল্যাজ তুলে চিতা এমন দৌড় দিলো যে কোন তল্লাটে গিয়ে থামলো তা আর কেউ জানেনা।
ভোরের আলো ফুটলে পর লেধা দেখে এ তো জঙ্গলের অনেক গভীর! এখান থেকে রাস্তা চিনে ফিরে যাবে সে সাধ্য ওর নেই! ভয়ে, ভাবনায়, দুঃখে ওর অবস্থা যে কী হলো তা বলে বোঝানো যায়না। কিন্তু উপায়ই বা কী? লেধা আস্তে আস্তে পা টেনে টেনে এগিয়ে চললো।
খানিক দূর গিয়ে দেখে এক নদী। তার পাশে বিশাল এক ডুমুর গাছের নীচে বুনো মোষদের থান। জায়গাটা বিশ্রী নোংরা হয়ে আছে। লেধা ছোট থেকে গরু-মোষদের সাথেই বড় হয়েছে। তাদের জন্য মায়ায় ওর মন ভরা। ও গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে ঝাঁটা বানালো একটা। দিব্যি করে ঝাঁটপাট দিয়ে সব পরিষ্কার করে, বুনো ফুল তুলে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলো। তারপর সন্ধ্যে হলে একটা ফাঁপা গাছের খোঁদলে ঢুকে লুকিয়ে থাকলো। বুনো মোষরা ফিরে এসে তো যেমন অবাক, তেমনি খুশি।
দু তিনদিন ধরে এইই চলতে লাগলো। মোষরা রোজ ভোরে চরতে বেরিয়ে যায়। লেধা গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে এসে ওদের থান সাফ সুতরো করে। ফুল,পাতা, পাখির পালক দিয়ে সাজায়। আর গাছ থেকে পাকা ডুমুর পেড়ে খায়। তারপর সন্ধ্যে হলেই আবার লুকিয়ে থাকে। মোষের দল ভাবে "আহা কে এমন দয়ালু যে আমাদের জন্য এত করে!" একদিন মোষরা ঠিক করলো দেখতেই হবে ওদের এই উপকারী বন্ধুটি আসলে কে। সবাই মিলে ভেবেচিন্তে ওরা ফন্দী পাকিয়েছে যে পরের দিন একজন বুড়ি মোষ (তাঁকে মহিষী বললেও চলে!) শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে থানেই থেকে যাবেন। চুপচাপ ঘুমের ভান করে সবটা দেখবেন। হলোও তাই। সকালবেলায় সব মোষ চলে গেছে দেখে যেমনি লেধা বেরিয়ে এসে কাজকর্ম করছে বুড়ি মোষ চোখের ফাঁক দিয়ে সবই দেখে রেখেছেন। সন্ধ্যেবেলায় দলবল ফিরলে তিনি সবকিছু খুলে বললেন। মোষরা তখন ডেকে বললো "উপকারী মানুষ, বেরিয়ে এসো। আমরা তোমার বন্ধু।"
লেধা গাছের ভেতর থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়ালো। মোষরা বললো "তুমি আমাদের সঙ্গেই থাকো না কেন? মোষের দুধ খাবে। আমাদের দেখাশোনা করবে, যেমন করছো।"
লেধা খুশি হয়েই রাজী হয়ে গেলো। এমন গহন জঙ্গলে, হাজারটা বিপদের মধ্যে ও একা একা কতদিনই বা থাকতে পারবে? বুনো মোষদের দলকে সবাই সমঝে চলে। ওদের সাথে থাকলে নিরাপত্তার অভাব হবেনা। তাছাড়া গরুমোষদের ও ভালোবাসে। গাঁয়েও ওরা তার বন্ধু ছিলো।
থেকে গেলো ওদের সাথে লেধা। ওদের থান ঝাঁটপাট দেয়, ওদের গা ঘষে ঘষে চান করায়। ঘন মিষ্টি মোষের দুধ আর রস টুসটুসে ডুমুর খায়। আর বুনোবাঁশের আগা কেটে এক বাঁশি বানিয়েছে; লেধা ডুমুর গাছের নীচে বসে সেই বাঁশি বাজায়।
দিন কাটছে। একদিন মোষদের চান করিয়ে লেধা নিজে নদীতে সাঁতার কাটছে, ওর মাথা থেকে দুটো চুল খসে এলো। কী খেয়ালে চুলদুটোকে ও একটা পাতায় মুড়ে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দিলে। ভাসতে ভাসতে সেই পাতা গিয়ে পৌঁছেছে জঙ্গলের বাইরে, নগরের মধ্যে, খোদ রাজার চানের ঘাটে। সেদেশের রাজকুমারী তখন সখীদের সাথে ঐ ঘাটেই চান করছিলেন। সামনে দিয়ে পাতার মোড়ক ভেসে যাচ্ছে দেখে টপ করে তুলে নিলেন। মোড়ক খুলে দেখেন, ওমা, ভেতরে এ কার চুল? কোঁক্ড়া, কালো, চকচকে, আর কতখানি লম্বা!! রাজকুমারীর মাথায় খেয়াল চাপলো এমন যার চুল তাকে দেখতেই হবে! আর রাজকুমারীদের খেয়াল মানে তো তার আর ছাড়ান কাটান নেই। মুখ থেকে কথা খসলো কি তা মেটাতেই হবে। নাহলে রাজ্য শুদ্ধু সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে! রাজা তো হুকুম দিয়েই খালাস যে "এই চুলের মালিককে খুঁজে বার করো।" কিন্তু বললেই হয় নাকি? কে কোথা থেকে খুঁজে বার করবে! কেমন করে করবে?
শেষে এক বুনো টিয়া এগিয়ে এসে বললো "আমি খবর দিতে পারি। জঙ্গলের গহীনে, বুনো মোষদের সাথে এক মানুষ থাকে। এ তারই মাথার চুল। আহা অমন বাঁশি বাজাতে আর কাউকে শুনিনি।"
রাজার মেয়ের তো সেই শুনে আগ্রহ একেবারে তুঙ্গে গিয়ে পৌঁছালো।আমার তো ধারণা উনি কোনো ফাঁকে "মেরে খোয়াবোঁ মে যো আয়ে" ধরণের কোনো গানও গাইতে লেগেছিলেন। যাই হোক, মোটকথা এ বোঝা গেলো যে ঐ মানুষটিকে তাঁর সামনে এনে হাজির না করা অব্দি কারুর তিষ্ঠানোর উপায় নেই। কিন্তু কাজটা অত সহজ নয়। বুনো মোষদের সবাই ভয় করে। জঙ্গলের নিয়ম আলাদা। রাজা বা তাঁর দেশের কোনো মানুষই সে নিয়ম ভাঙেননা। জঙ্গলকে তাঁরা সন্মান করেন।
তাহলে উপায় কী? এবারও একটা পাখিই সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। একটা দাঁড়কাক। ওদের বুদ্ধি কোনো মানুষের থেকে কম না। কাক তো বনের মধ্যে গিয়ে দেখে নিয়েছে কোথায় লেধা আর মোষরা থাকে। ও নেমে এসে কথা নেই, বার্তা নেই, মোষদের গায়ে মাথায় ঠোকর মারতে লাগলো। মোষরা গাঁ-আ-আ করে ডাকে, শিং বাঁকিয়ে মাথা নাড়ে। কিন্তু কাক নাছোড় বান্দা। সমানে ঠুকরে চলেছে। লেধা হুশহুশ করে ওকে তাড়াবার চেষ্টা করলো। তাতে কাজ না হলে পাথর ছুঁড়লো। কাক কিছুতেই যাবেনা! লেধা গাছের ডাল ছুঁড়ে মারে। তাতেও কাকের পরোয়া নেই। শেষে আর কী করবে ভেবে না পেয়ে লেধা নিজের বাঁশিটাই ছুঁড়ে মারলো। কাক তো তাই চায়। ঠোঁটে বাঁশিটা নিয়ে সে শাঁ করে উড়ে পড়েছে।
"আরে ধর ধর, গেলো গেলো" লেধা কাকের পেছনে ছুটলো*। কাকের বুদ্ধি কম নাকি? ও খানিক দূর যায়। তারপর একটু নেমে বসে। বাঁশিটা নামিয়ে রাখে মাটিতে। যেই লেধা গিয়ে সেটা তুলতে যাবে, অমনি আবার মুখে নিয়ে উড়ে যায়। লেধার এত প্রিয় বাঁশি, তার জন্য যতদূর যেতে হয়! কাকের পেছনে চলতে চলতে ও খেয়ালই করলোনা যে কোনদিকে যাচ্ছে। কাক তো এদিকে ঐ টোপ দিয়ে দিয়ে ওকে জঙ্গল থেকে বার করে এনেছে। শেষটা সোজা রাজবাড়ির বাগানে নিয়ে হাজির। লেধা হঠাৎ দেখে এ কোথায় এসে পড়েছে! কিন্তু এতদূর এসে হাল ছেড়ে দেবে? কাক শোঁ করে বাঁশি মুখে জানালা দিয়ে একেবারে রাজকুমারীর ঘরে গিয়ে সেঁধোলো। আর লেধাও "তবে রে?" বলে জানালা গলে ভেতরে!
রাজকুমারী তৈরীই ছিলেন। লেধা ঘরে ঢুকতেই ঝপাঝপ সব দরজা জানালা বন্ধ হয়ে গেলো। লেধা দেখে সামনে চাঁদের মত রাজার মেয়ে। তাঁর হাতে ওর পেয়ারের বাঁশি! অবাক হবে, না খুশি হবে, না ভয় পাবে তা বুঝে ওঠার আগেই রাজকুমারী বললেন যে বাঁশি ও ফেরত পাবে, কিন্তু শর্ত আছে। তাঁকে বিয়ে করতে হবে। তা বিয়ে করতে অরাজী হবেই বা কেন? এমন শর্ত না মানার তো কিছু নেই! লেধার সাথে রাজার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলো।
তারা প্রাসাদে থাকে। মনের আনন্দে দিন কাটায়। এদিকে বনের মধ্যে মোষদের কিন্তু ভারী দুঃখ হয়েছে। আর তাদের যত্ন হয়না। কেউ পরিষ্কার করেনা, কেউ বাঁশি শোনায়না। মনের কষ্টে কয়েকজন তো রোগেই পড়লো। রাজবাড়িতে খুশি-মজায় কিছুদিন যাবার পরে লেধারও ওর মোষ বন্ধুদের জন্য মনকেমন করতে লাগলো। রাজকুমারী দেখেন এমন হাসিখুশি মানুষটা কেমন মনমরা হয়ে থাকে। শেষটা লেধা তাঁকে সব খুলেই বললো। বন্ধুদের একবার দেখে আসার জন্য ওর মন উচাটন। রাজকুমারী নিজেও যেতে চাইলেন লেধার সঙ্গে। তিনি কখনো গভীর জঙ্গলের ভেতরটা দেখেননি। তাছাড়া লেধার বন্ধুদের সাথে আলাপ করতেও ওঁর ইচ্ছে করছিলো।
দুজনে মিলে বনের মধ্যে, মোষের থানে গিয়ে দেখেন এ কী দুর্গতি! মোষরা অযত্নে, দুঃখে রোগা হয়ে, অসুস্থ হয়ে দিন কাটাচ্ছে। লেধার মন কেঁদে উঠলো। বন্ধুদের ছেড়ে সে নিজের আনন্দ নিয়ে সব ভুলে রয়েছে? রাজকুমারীরও মন খারাপ হয়েছে। তাঁরও মনে দয়ামায়া কম নয়। তিনি ঠিক করলেন লেধার সাথে এই জঙ্গলেই থেকে যাবেন।
রাজার কানে যখন এ কথা পৌঁছালো তখন রাজা কী করলেন? না, যা ভাবছো তা নয়। রাজা রেগে চতুর্ভুজ হয়ে লোক পাঠিয়ে ওদের ধরে আনান নি। আমাদের এই রাজা বুদ্ধিমান, সমঝদার, দয়ালু। মেয়ের কাছে সব শুনে উনি ঐ জঙ্গলের মধ্যেই ওদের একটা বাড়ি বানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন। ওখানে নিরাপদে, ভালোভাবে থাকার জন্য যা যা দরকার সেইসব পাঠিয়ে দিলেন। কেউ জঙ্গলের শান্তিতে বিঘ্ন ঘটালোনা। কেউ বনের পশুপাখিদের বিরক্ত করলোনা। লেধা আর রাজকুমারী ঐ বাড়িতে থাকতে লাগলেন। লেধার দয়া আর ভালোবাসার খবর পেয়ে আস্তে আস্তে সব জন্তু জানোয়াররা এসে ওদের সাথে বন্ধুত্ব করলো। হিংস্র বাঘ, বিষাক্ত সাপও শান্ত হয়ে ওর কথামত চলতে শুরু করলো। ছোট গাঁয়ের খোঁড়া ছেলে লেধা হয়ে গেলো জঙ্গলের রাজা। অনেক অনেক বছর পরে একটা তিন বছরের বাচ্চা মেয়েও যাকে স্বপ্নের মানুষ মনে করতে পারে, সেই "লেদা রাজা"।
* অশক্ত পা নিয়ে কেমন করে লেধা কাকের পেছনে ছুটেছিলো সেই প্রশ্ন আমারও মনে এসেছিলো। কিন্তু বমপাস সাহেব সেই নিয়ে কিছু লিখে যাননি।