এই পৃথিবীটার মধ্যে এতগুলো দেশ, এত রকম ভাষা, এত রঙের মানুষ যে একেক সময়ে আমার মনে হয়, মহাকাশের মধ্যে এই নীল-সবুজ গোলাটার কাছাকাছি এলেই মহা ক্যালোর-ব্যালোর শুনতে পাওয়া যাবে। কত রকম খাবার, কত রকম নাচগান বলো তো! কারুর সাথে কারুর মিল নেই। নাঃ, ঐখানেই ভুল হলো। হাজার বেমিলের মধ্যে এত বেশি মিলও আছে যে একেক সময়ে অবাক হয়ে যেতে হয়। আমরাই খেয়াল করে দেখিনা সবসময়।
তো এমনিইই একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়ে গেলাম একদিন। গল্পের মিল। দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গল্পের মধ্যে কত মিল আছে তা কী জানতে?
বিক্রমাদিত্য আর বেতালের গল্প কত পুরোনো ভাবো। ভারতীয় গল্প-সংস্কৃতি পুরোই হবেনা এই সিরিজটা বাদ দিলে। আমি খুঁজতে খুঁজতে, ধুলো, মাকড়্সার জাল হাতড়ে অনে-এ-এক দূরের এক দেশের উপকথার মধ্যে একটা গল্প খুঁজে পেলাম যার সাথে এই বিক্রম-বেতালের (পুরনো গান মনে আছে? বিক্রম বিক্রম বিক্রম, বেতাল তাল তাল?) বেবাক মিল! দেশটার নাম জর্জিয়া। হ্যাঁ, পূর্ব ইউরোপের সেই ককেশাস পাহাড় আর কালো সমুদ্দুরের দেশ। গল্পটা হলো 'রাজা আর আপেলের গল্প'।
এক দেশের রাজপুত্রের কথা বলছি। রাজপুত্রের বড় মনখারাপ। তাঁর বাবা বুড়ো রাজার খুব অসুখ। সেরে উঠবেন বলে মনে হয়না। রাজপুত্র বাবার বিছানার পাশে মাথা নীচু করে বসে আছেন। বুড়ো রাজা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন --"দুঃখ করার কিছু নেই। সময় এসেছে, আমাকে এবার যেতে হবে। তুমি দেশটার, মানুষগুলোর দেখাশোনা ঠিক মতো কোরো। আর এই জিনিষটা সারাক্ষণ সঙ্গে রেখো। কিন্তু সাবধান। খুউব বিপদে না পড়লে খুলোনা।"
জিনিষটা একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স। অনেক পুরনো কিন্তু নিখুঁত কারুকাজ করা। রাজপুত্রের মুঠোতে বাক্সটা গুঁজে দিয়ে বুড়ো রাজা চোখ বুজলেন। মন্ত্রীমশাই এগিয়ে এসে বললেন "তোমার অভিষেকের দিন স্থির করি তাহলে?"
রাজপুত্র এখন রাজা হয়েছেন। কিন্তু মনখারাপ আর সারেনা। রাজকাজে মনও লাগেনা। কিন্তু এরকম ভাবে চললে তো সব লাটে উঠবে। মন্ত্রীমশাই, সেনাপতিমশাই, কোটাল, পাত্র, মিত্র, বুড়ো রাজার সব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা মিলে তখন নতুন রাজাকে বোঝাতে বসলেন। "আচ্ছা, বরং এক কাজ করো তাহলে রাজাবাবা। তুমি পূবের দেশে বেড়িয়ে এসো। বেড়াতে গেলে মনও ভালো হবে। আর ওদিকের খোঁজখবরও বহুদিন পাওয়া যাচ্ছেনা, তারও একটা হিল্লে হবে।" বাস্তবিক, পূবের দেশে যতই লোক পাঠানো হয়, ফিরে এসে কিছু জানানো দূরের কথা, তাদের আর টিকির দেখা পাওয়া যায়না! দূর্গম জায়গা, চট করে সেখানের খতিয়ান নেওয়াও মেলা অসুবিধা।
নতুন রাজা জনা দশ বারো অনুচর নিয়ে বেরিয়েই পড়লেন। মাঝরাস্তায় বিরাট এক জঙ্গল। গাছপালা, কাঁটাঝোপের ঠাস বুনোট। হিংস্র জন্তু জানোয়ার যে মেলাই রয়েছে তাও বোঝা যায়।কিন্তু রাজার সাহসের কোনো অভাব নেই। বনের মধ্যে দিয়ে, নানা বাধা পার হয়ে তাঁরা দিব্যি চললেন। একেবারে মাঝ জঙ্গলের গহীনে যখন পৌঁছেছেন, দেখেন সামনে একটা বিশাল প্রাসাদ। কতকালের যে পুরনো তার কোনো ঠিক নেই! উঁচুউঁচু খিলান আর থাম। তাতে নানা রকম মুর্তি খোদাই করা। সুন্দর কারুকাজ করা দরজা জানালা গুলো সব বন্ধ। ঘন বনের মধ্যে এমন প্রাসাদ কে বানালো?
রাজা একজন অনুচরকে বললেন "ভেতরে গিয়ে দেখো। কেউ থাকলে অনুমতি নিও যে আমরা প্রাসাদে ঢুকতে পারি কিনা।" সে লোক সিং দরজা দিয়ে ঢুকে গেলো বটে, কিন্তু আর বেরিয়ে এলোনা। একটা পুরো দিন কাটলো। তার দেখা নেই। রাজা আরেকজনকে পাঠালেন।
এইভাবে তিনদিন কাটলো, তিনজন লোক ভেতরে ঢুকলো। কেউই আর ফিরে এলোনা। রাজা তখন খাপ থেকে ঝকঝকে তরোলারটা বার করে নিজেই সিংদরজা ঠেলে ভেতরে পা বাড়ালেন।
সেই দরজা পেরিয়ে আরো এক খানা উঁচু দরজা রয়েছে। সেটার ভারী কাঠের পাল্লা দুটো বন্ধ। ওপরে লেখা আছে "যদি ঢোকো, তোমার মনস্তাপের শেষ থাকবেনা। যদি না ঢোকো তাহলেও অনুতাপে মরবে।" কী ধাঁধালো কথা! রাজা ভাবেন "মনস্তাপ তো হবেই যা দেখা যাচ্ছে। তাহলে আর না ঢোকাই বা কেন? তাছাড়া হারানো লোকগুলোরও তো সন্ধান করা দরকার।" তিনি ভারী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।
দরজার ওপাশে ঢুকে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! সেখানে খোলা তরোয়াল হাতে বারোজন যোদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। ঝকঝকে বর্ম, পাথরের মত ভাবলেশহীণ মুখ। তাদের পেছনে বারোটা বন্ধ দরজা। আমি তো যা বুঝছি বাড়িটায় দরজার শেষ নেই! দরজামহল নাম বেশ মানাতো। সে যাই হোক, ঐ বারোজনের মধ্যে থেকে একজন এসে রাজার হাত ধরলো।
রাজা বেশ আশ্চর্য্য হয়েছিলেন। এরা কারা? বিনা বাক্যব্যয়ে এমনি এসে দেশের রাজার হাত ধরে ফেলছে এইই বা কেমন ব্যবহার! কিন্তু দেখাই যাক ব্যপার কোনদিকে গড়ায়। উনি বাধা দিলেননা। লোকটা ওঁকে হাত ধরে একটা দরজার পেছনে নিয়ে গেলো। সেখানে মস্ত একটা দরবার ঘর। অবশেষে!
সে দরবার ঘরের মধ্যে এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে পাথরের তৈরী মানুষের মূর্তি। এমন সুন্দর কারিগরী যে দেখে মনে হয় যেন এখনই জীবন্ত হয়ে কথা বলে উঠবে। অনেক মূর্তি বহু পুরনো। তার ওপরে ছ্যাৎলা পড়ে গেছে। অনেক গুলো নতুনের মত। তার মধ্যে তিনটে মূর্তি দেখে রাজার বুক জোরে ধকধক করে উঠলো। তাঁরই তিনজন অনুচর, যারা এই বাড়িতে ঢুকে আর ফিরে আসেনি। ব্যাপার বুঝতে তাঁর দেরী হলোনা। এই অসংখ্য মূর্তিরা সবাইই একদিন মানুষ ছিলো। অসাবধান হলে তিনিও এদের দলে সামিল হবেন।
ঘরের ঠিক মধ্যিখানে একটা মস্ত সোনার সিংহাসন। যোদ্ধা রাজাকে তার একেবারে সামনে নিয়ে হাজির করলো। রাজা অবাক হয়ে দেখলেন সেখানে যে বসে আছে তার বয়স আট-নয়ের বেশি হবেনা। শান্ত সমাহিত মুখের এক বাচ্চা ছেলে। চোখ দুটো বোজা। যোদ্ধা রাজাকে বললো "ইনি আমাদের জ্ঞানী ঠাকুর। আপনি এঁকে তিনটে প্রশ্ন করবেন। মনে রাখবেন, প্রশ্ন এমনই হতে হবে যেন কেউ তার উত্তর দিতে না পারে। কিন্তু জ্ঞানী ঠাকুর নিজে যদি উত্তর দিতে না পারেন, তাহলে আপনি পাথর হয়ে যাবেন। আবার যদি এমন প্রশ্ন করেন যে অন্য যেকোনো লোকেই তার জবাব জানে, তাহলেও আপনি পাথর হয়ে যাবেন।" রাজা বেশ বুঝলেন এও সেই দরজায় লেখা ধাঁধার মতই, এদিকে গেলেও বিপদ, ওদিকে গেলেও মুশকিল! জ্ঞানী ঠাকুর না ছাই, পাথর বানাবেই সে তুমি যাই করো! প্রশ্ন টশ্ন সব বাহানা!
হঠাৎ মনে পড়ে গেলো কোমরে গোঁজা সেই কাঠের বাক্সটার কথা। বুড়ো রাজার দেওয়া। এর থেকে বেশি বিপদ আর কীই বা হতে পারে? এই ভেবে রাজা বাক্সটা খুলে ফেললেন। অমনি তার ভেতর থেকে একটা আপেল বেরিয়ে এলো।
রাজার মনটা দমে গেলো। শেষে কিনা একটা আপেল? এই দিয়ে কাউকে না লোভ দেখানো যায়, না ভয়! কিন্তু আপেলটা যে সে আপেল নয়। নাহলে কেনই বা অমন বাক্সে ভরে, রহস্যের মোড়কে মুড়ে টুড়ে রাখা হয়েছে? আপেলটা কথা বলে উঠলো।
আপেল বললো -- "বেশ, প্রথম প্রশ্ন করছি। তার জন্য আগে একটা গল্প বলতে হবে।"
এই শুরু হচ্ছে বেতালের গল্পের মত, দেখতে থাকো! তো, সেই গল্পে একদিন এক কাঠুরে তার ভাই আর বৌকে নিয়ে ভিন গাঁ থেকে বাড়ি ফিরছে। মাঝে পড়লো বড় এক জঙ্গল। জঙ্গলে ঢুকে রাস্তা হারিয়ে গেছে। ঘুরেঘুরে তারা সারা। সারাদিন পথ হেঁটে বৌটির আর পা চলছেনা। তখন ভাই বললো "তোমরা এখানে গাছের তলায় বসে থাকো, আমি এগিয়ে দেখি কোথাও কোনো গ্রাম বা কিছু আছে নাকি।" সে গেছে তো গেছেই। ফেরার নাম নেই। এই আমাদের রাজার অনুচরদের মতই খানিকটা। শেষে অনেক দেরী দেখে কাঠুরে বৌকে বললো "ছেলেটা কোথায় গেলো খুঁজে দেখতেই হয়। তুমি একটু একা থাকো এখানে। আমি এগিয়ে দেখি।" এদিকে হয়েছে কী, ঐ জঙ্গলের মধ্যে ছিলো ডাকাতের আস্তানা। ভাই তো গিয়ে পড়েছে তাদের সামনে। ওরা তার কাছে যা ছিলো সব কেড়েকুড়ে নিয়ে তার মুন্ডু করে দিয়েছে ঘ্যাচাং। গল্পের মধ্যে এরকম ভায়োলেন্স আমার একেবারে পছন্দ নয়। কিন্তু ঘটনাটা নেহাৎ জরুরী!
আমাদের কাঠুরেও যখন খুঁজতে খুঁজতে ওখানে গিয়ে হাজির হয়েছে অমনি তারও অবস্থা ঐ একই হলো। বৌ বেচারী একাএকা অনেকক্ষণ বসে থেকে দেখে কেউই ফিরে আসছেনা। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। ভয়ে, ভাবনায় তার প্রাণ যায় আর কি! শেষে আর বসে থাকতে না পেরে বৌ নিজেই উঠে তাদের খুঁজতে বেরোলো। ততক্ষণে ডাকতের দল কোথায় যেন ডাকাতি করতে বেরিয়ে গেছে। বৌ গিয়ে দেখে তার স্বামী আর দেওর দুজনেই অমন ভয়ানক মুন্ডুহীণ অবস্থায় পড়ে আছে। দেখে সে শোকে দুঃখে কী করবে ভেবে পায়না!
এতদূর অব্দি শুনে রাজা মনেমনে ভাবছেন "এই আপেলটার বুদ্ধির বলিহারি! হচ্ছে একটা গুরুতর প্রশ্নের কথা, তার মধ্যে সাতকাহণ করে গল্প ফেঁদে বসেছে। তাও যদি কোনো মননশীল গল্প হতো।খালি মুন্ডুকাটা আর রক্তারক্তি !" ওদিকে তরোয়াল হাতে যোদ্ধা পাথুরে মুখ করে গল্প শুনছে। 'জ্ঞানী ঠাকুর' চোখের পাতা অব্দি খোলেননি।
তারপর? তারপর কী তা পরের পর্বে বলবো। আজ এই অব্দিই থাক! কাহিনী অনেক লম্বা। একদিনে এত বলাই যাবেনা!