বানানো গল্প আমি খুব ভালোবাসি। মানে, বেশির ভাগ 'গল্প'ই তো বানানো। কিন্তু আমি ঠিক সেরকমটার কথা বলছি না। কিছু গল্প আছে যাদের জলরঙের ছবির মত দেখতে হয়। পুরোপুরি জলরঙও নয়। দেখলে মনে হয় যেন চিনে লন্ঠনের ভেতর থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছি। ছায়াছায়া মোলায়েম, ঠিক স্পষ্ট খোঁচা নেই কোথাও।
আমাদের চারদিকে সারাক্ষণ খড়মড়ে মত বাস্তব ছড়িয়ে আছে। কাগজে, রুপোলি বা সোনালি পর্দাতেও। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলি। অন্য সবার মত। কথা বলি, হাঁটি একসঙ্গে কিছুটা, কখনো কখনো তাদের বাড়ি লৌকিকতা করতে যাই। কিন্তু ওদের আমি ভালোবাসি না। কঠোর বাস্তব, তাকে আমি ভালোবাসি না। সমাজের খাতায় আমার অনেক রকম নাম লেখা আছে। বোকা, ভীতু, ক্যাবলা, অসুস্থ মস্তিষ্ক, এইসব। তবু আমি ঐ তাদের ভালোবাসি। কোমল অবাস্তব গল্পদের। রূপকথা, উপকথা, লোককথা, পুরাণ। তাতেও খড়মড়ে আছে, ধারালো, ছুঁচলো, টগবগে গরম, এসব আছে। তবু কেমন যেন মনে হয় জলের ভেতর দিয়ে শোনা শব্দের মত হয়ে যায় ওরা। নরম, ফিসফিসে। আমার মনে হয়। আমি অবাস্তব গল্পদের ভালোবাসি। রূপকথাদের ।
অনেকদিন আগে ইন্দোনেশিয়ার রূপকথা পড়েছিলাম। আজকে সেই গল্পটা বলবো। হয়তো তোমরাও কেউ কেউ পড়েছো এই গল্পটা। তাহলেও বলবো। সবাই তো জানেনা। একটা সোনালি প্রজাপতির গল্প।
সে ছিলো বিশাল এক নদী। গভীর, স্রোতালো, পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে, পাথরে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে চলা অশান্ত নদী। তার ধারে পাথরের প্রাসাদে থাকতেন রাজকন্যা 'কেম-বাং-মেলাতি'। কেন তা আমি জানিনা, কিন্তু এই প্রাসাদে রাজা নেই, রানি নেই, আর অন্য কোনো রাজপুত্র-রাজকন্যা নেই। মেলাতি থাকেন তাঁর ছোটবেলার ধাই মা 'সারিনা'র সঙ্গে। সবাই জানে দু-চার বছর পরেই কেম-বাং-মেলাতি সিংহাসনে বসবেন। রাজকন্যাকে সবাই তখন 'রানি' বলে ডাকবে।
এখন রাজ্যপাটের চিন্তা ঘাড়ে চাপেনি। মেলাতি পড়াশোনা করেন, ছবি আঁকেন, গান করেন, তেজি ঘোড়ায় চেপে দিগবিদিকে ঘুরে বেড়ান আর নদী দেখেন। জানালায় দাঁড়িয়ে, ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে। নদী তাঁর ভাষা জানে না, কিন্তু রাজকন্যা মনেমনে তার সঙ্গে অনেক কথা বলেন। নদীর সঙ্গে, নদী যেখানে মস্ত খাড়াই থেকে লাফিয়ে দুরন্ত ঝর্না হয়েছে সেই ঝর্নার সঙ্গে। ধন-দৌলত, লোক-লস্কর, মান-সন্মান কিচ্ছুর অভাব নেই। অভাব শুধু আপনজনের, বন্ধুর। কেম-বাং-মেলাতি ভীষণ ভীষণ একা।
অমনিই একা আরেকজনও ছিলেন। তিনি বৃষ্টির রাজা 'বনজির। অসাধারণ রূপবান, অসামান্য গুণী। নদীর অন্যপারে, বৃষ্টির জলের কণা দিয়ে তৈরি প্রাসাদে বনজির থাকেন। সেই প্রাসাদ মানুষের চোখে ধরা পড়েনা। জলের মিহিন গুঁড়ো হাওয়ায় উড়ে উড়ে যায়। আকাশের মেঘের গায়ে বনজিরের প্রাসাদ কেবলই আঁকা হয়, মোছা হয়। কেউ দৈবাত দেখে ফেললে মনে করে রামধনু। সেই প্রাসাদে বনজির একলা একলা থাকেন। তাঁর মা নেই, বাবা, ভাই, বোন কেউ নেই।
বৃষ্টির রাজা বনজির আপনমনে মেঘ আঁকেন। কালো-সাদা-নীল। প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে দুহাত মেলে তিনি ঝড় ওঠান। অনেক রাতে একলা ঘরে একলা রাজা বসে বীণা বাজান। তার সুরে অনেক দিনের দুঃখ গুমরে গুমরে কাঁদে। একাকিত্ব, শূন্যতা, না ভাগ হওয়া কষ্টরা হু হু করে ঝড়ের মাঝখানে, মেঘের মাঝখানে, বৃষ্টির ফোঁটার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে পাক খেয়ে বেড়ায়। বনজির একলা একলা কাঁদেন। তাঁর চোখের জলে নদী ফুলে ওঠে। বান ডাকিয়ে, ঢল নামিয়ে ছুটে ছুটে সারা হয়।
একদিন দুপুর বেলা। আকাশ কালো করে মেঘ ঘনিয়েছে। চারদিক ছায়াছায়া। বনজির তাঁর বারান্দায় দাঁড়িয়ে মস্ত একখানা ক্যানভাসে বৃষ্টিশিশুদের ছবি আঁকছিলেন। কোথাও কোনো আওয়াজ ছিলোনা তখন। বাতাস চুপ করে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকা দেখছিলো। নদী উদাস হয়ে কারুর কথা ভাবছিলো। তার মধ্যে বনজির ভীষণ মিষ্টি একটা গানের সুর শুনতে পেলেন। কে গায়? কে? নদীর ওপারে, পাথরের প্রাসাদে, রাজকন্যা মেলাতি নিজের মনে, নিজের জন্য গান করছেন। বনজির কান পেতে শোনেন।
এমন সুন্দর সুর, এমন কোমল গলা আগে তো কখনো শোনেননি! শেষটা কৌতূহল সামলাতে না পেরে বৃষ্টির রাজা একটা সোনালি প্রজাপতি হয়ে নদী পেরিয়ে উড়ে গেলেন। যে গাইছে তাকে দেখতেই হবে। দেখতেই হবে!
চমৎকার ঝিকমিকে প্রজাপতিটাকে দেখে রাজকন্যা গান থামিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। এত সুন্দর কিছু তিনি কক্ষণও দেখেননি। প্রজাপতি তাঁর গানের বইয়ের পাতার ওপর আস্তে আস্তে এসে বসে। পাতলা সোনালি কারুকার্য করা ডানাদুটো তিরতির করে কাঁপছে। মেলাতির মুখে মুগ্ধ-বিস্ময়ের হাসি বনজিরের দেখতে বড় ভালোলাগে। মেয়েটির মুখটা তাঁর মনের মধ্যে চিরদিনের জন্য আঁকা হয়ে গেলো। সোনালি প্রজাপতি রোজ উড়ে আসে রাজকন্যার জানলায়। রোজ তিনি খুশির হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। রোজ রাতে নিজের প্রাসাদে বনজিরের বীণায় নতুন নতুন সুর বেজে ওঠে।
বৃষ্টির রাজা একদিন মন স্থির করে ফেললেন। প্রজাপতি সেদিন রাজকন্যার চারদিকে কেবলই উড়ছে। রাজকন্যার মনে হলে যেন ফিসফিস করে তাঁর কানে কে বলছে "রাজকুমারী মেলাতি, তুমি কি জানো বৃষ্টির রাজা তোমায় ভালোবাসেন? তুমি তাঁকে বিয়ে করবে?" কেম-বাং-মেলাতি ভাবেন "যাঃ, কী শুনতে কী শুনছি!" কিন্তু তাঁর গালে যেন গোলাপ ফুটে ওঠে। মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রজাপতি বলে "তাহলে কাল তিনি তোমায় তোমার বিয়ের তত্ত্ব পাঠাবেন, তৈরি থেকো।" রাজকন্যা বুঝতে পারেন না এত খুশি বিশ্বাস করে উঠতে পারবেন কি না। তিনি সোনালি প্রজাপতির দিকে তাকিয়ে বললেন "সত্যি আমার বিয়ের তত্ত্ব?"
হবি তো হ, এই সময়েই তাঁর জানলার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়েছিলো ধাই মা সারিনার ছেলে 'নাসিমন'। কথাটা তার কানে গেলো। সে ওসব প্রজাপতি-ফতি জানেনা। নাসিমনের ধূর্ত মনে চট করে একটা ফন্দি খেলে গেলো। নাসিমন ভারি দুষ্টু ছেলে ছিলো ছোটবেলায়। পড়াশোনার ধার দিয়ে যেতোনা। অন্য বাচ্চাদের ধরে মারতো, তাদের জিনিসপত্র কেড়ে নিতো। আর এখন বড় হয়ে হয়েছে দুষ্টু লোক। বাড়িতে থাকে না সে। এদেশ সেদেশ ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, চোর-জোচ্চোর-বদমাশদের দলে মেশে। সবসময় ফিকির খোঁজে কী করে অন্যকে ঠকিয়ে নিজের সুবিধে করে নেওয়া যায়। তার মা সারিনা বারেবারেই তাকে বোঝায় যে কিছু একটা ঠিকঠাক কাজকর্ম তো করতে হবে। এমনি করে লোক ঠকিয়ে কি সারা জীবন চলবে? নাসিমনের এক কথা "তুমি তো রাজবাড়ি থেকে মাইনে পাও। আমাকে আবার কাজ করানোর ধান্দা কেন? তবে ভেবো না, টাকাকড়ি আমি ভালোওবাসি, আর কিছু করে ঠিক টাকাকড়ি করবোও। বুদ্ধি খাটাতে হবে শুধু একটুখানি।" বুদ্ধি অবশ্য কিছু কম নেই তার। দুষ্টুবুদ্ধি।
জানালার পাশ থেকে সরে গিয়ে নাসিমন মাকে ধরলো -- "শোনো মা, আমি স্পষ্ট শুনেছি রাজকন্যা নিজের বিয়ের কথা বলছে। তুমি গিয়ে তাকে বলো আমার মত যোগ্য পাত্র আর কেউ হতে পারেনা। "সারিনার তো মুখে কথা সরে না। হতভাগা ছেলে বলে কী? মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি? নাসিমন মা'কে বোঝায় রাজকন্যা ছোট থেকেই তাকে চেনেন, ছোটবেলায় দুজনে একসঙ্গে খেলাও করেছেন। অজানা অচেনা কোন লোকের বাড়ি গিয়ে উঠতে হবে, তার থেকে এইই ভালো না? সারিনা কপালে চাপড় মেরে বলে "ওরে রাজকন্যাকে বিয়ে করা কি মুখের কথা? সে এত শিক্ষিত, এত গুণের। দু দিন পর সারা দেশের রানি হয়ে বসবে। আর তোর না আছে চালচুলো, না কিছু!" না চালচুলো নেই নাসিমনের। কিন্তু তার মাথার খাঁজেভাঁজে বুদ্ধি আছে প্রচুর। আর হ্যাঁ, তাকে দেখতেও বড় সুন্দর। মাথায় এতখানি লম্বা, ঘন চুল, সুন্দর নাকচোখ। আজ যদি সারিনা গিয়ে মেলাতিকে বলে তার ছেলে বিদেশে এতদিন পড়াশোনা করছিলো। এখন মহা বিদ্বান আর ধনী হয়ে ফিরে এসেছে। রাজকন্যা কি অবিশ্বাস করতে পারবে নাকি?
ভয়ে সারিনার বুক কেঁপে ওঠে। এত বড় ছল-কপটতা করবে কী করে? রাজকন্যাকে সে ছোট থেকে নিজের মেয়ের মত মানুষ করেছে। তিনি ওকে আপনজন ছাড়া কিছু ভাবেননা।
"তবেই ভেবে দেখো, আপনজনের সঙ্গেই বিয়ে দেবে তার। আরে তুমি ঘাবড়াচ্ছো কেন? একটা তো মোটে মিথ্যে কথা। তারপরেই আমি সব সামলে নেবো।"
মন সায় দেয় না, কিন্তু একমাত্র ছেলের কথা ফেলতেও পারেনা বুড়ি ধাইমা। পা কাঁপে, জিভ ভারী হয়ে ওঠে, তবু ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথার পরে সেদিন বিকেলে সে রাজকন্যার কাছে কথাটা পাড়লো। কেম-বাং-মেলাতি হেসে ওঠেন। "ও, নাসিমন এসেছে বুঝি এতদিন পরে? বাব্বাঃ কী দুষ্টুমিই না করতো ছোটবেলায় খেলার সময়! কিন্তু ধাই মা, আমি যে অন্য একজনকে বিয়ে করবো ঠিক করে ফেলেছি। বৃষ্টির রাজা বনজির। কালই তিনি বিয়ের তত্ত্ব পাঠাবেন।" সারিনা চুপ করে সরে আসে সেখান থেকে। কিন্তু নাসিমন ততক্ষণে আটঘাট বেঁধে ফেলেছে।
ওদিকে রামধনুর প্রাসাদে বনজিরের মনে খুশি আজ আর ধরে না। বিয়ের উপহার এর জন্য তিনি চমৎকার স্ফটিকের বাক্স সাজাতে বসেছেন। তার মধ্যে ভরলেন রাজকন্যার বিয়ের পোশাক। মাঝরাত্তিরের মত নীল। তাতে তারার মত লক্ষ হিরে-মানিক বসানো। আর রাখলেন অসামান্য কারুকাজ করা দুষ্প্রাপ্য সব গয়না। পৃথিবীর কোনো কিছু দিয়ে তার দাম হয় না। সবার ওপরে রাখলেন একছড়া ফুল। আসল রামধনুর রঙ দিয়ে তৈরি। তার পাপড়ি কোনদিন বিবর্ণ হয় না। তারপর মেঘ রঙের কাগজে রূপোলি কালিতে নিজের হাতে সুন্দর একটা চিঠি লিখে দিলেন। ভাবী স্ত্রীর উদ্দেশে বৃষ্টির রাজার উপহার। এই উপহার নিয়ে যাবে বনজিরের বিশ্বস্ত দূত। একটা সাদা রঙের কাক। বহুদিন ধরে দূতের কাজ করছে, রাজার বড় প্রিয় পাত্র সে।
পিঠের ওপরে বাক্স বেঁধে, ঠোঁটে চিঠি কামড়ে ধরে সাদা কাক পরের দিন কেম-বাং-মেলাতির প্রাসাদে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু রাজকন্যার কাছ অব্দি যাবার আগেই নাসিমন তাকে আটকালো। বললে "রাজকন্যা তো ঘুমিয়ে আছেন এখন। তুমি বরং আমার বারান্দায় বসে একটু জিরিয়ে নাও না। অত দূর থেকে এই ভারী বোঝা বয়ে উড়ে আসছো। চাট্টি খেয়ে দেয়ে আরাম করো এখন। আমার মা তো রাজকন্যার পাশেপাশেই সারাক্ষণ থাকেন। তা তাঁর ঘুম ভাঙলে পরে মা তোমায় ঠিক ডেকে নিয়ে যাবেন। এই দেখো, কী চমৎকার মাছ ধরেছি। পেট ভরে খাও তো দেখি।"
কাক দেখে সত্যি এক মস্ত মোটা তাজা মাছ। সুন্দর করে রেঁধে বাটি ভরে দিয়েছে। দেখলেই জিভে জল আসে। আর ঠিকই তো, উপহার তো আর পালিয়ে যাচ্ছেনা। রাজকন্যার ঘুম ভাঙানোটাও তো কোনো কাজের কথা নয়! কাক হুশ করে নাসিমনের দাওয়ায় এসে নামলো। নাসিমন মধুঢালা গলায় বলে "আহা, এসো, বসো। ঐ বোঁচকাটা এখানে নামিয়ে রেখে প্রাণ ভরে খাও।" সাদা কাক চিঠি-বাক্স রেখে তুড়ুক তুড়ুক করে মাছের বাটির দিকে এগিয়ে গেলো। মন দিয়ে যখন মাছ খাচ্ছে নাসিমন উপহারের বাক্সটা থেকে সবকিছু বার করে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে। তার বদলে ভেতরে ভরে দিলো ইয়া বড় কটকটে কাঁকড়া কতগুলো, আর পাটকিলে রঙের মাকড়শা! বনজিরের অমন সুন্দর চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে তার বদলে খামের মধ্যে ভরে দিলো অন্য একটা কাগজ। তাতে সে মাকে দিয়ে লিখিয়ে রেখেছে -- "তোমার গায়ের রং যেমন বিশ্রী, তেমনি জঘন্য তোমার চুল। তোমার মত কুৎসিৎ মেয়েকে মানায় এমন সব উপহারই পাঠালাম।" মাকে দিয়েই লিখিয়ে রেখেছে নাসিমন, নিজে তো আর লিখতে পড়তে জানে না।
কাক তো এসবের বিন্দু-বিসর্গ জানে না। সে চেটেপুটে মাছে শেষ কাঁটাটা অব্দি খেয়ে, মুখটুখ মুছে আবার চিঠি আর বাক্স নিয়ে তৈরি হলো। সারিনা এসে ততক্ষণে জানিয়েছে রাজকন্যা ওপরের ঘরে অপেক্ষা করছেন। সাদা কাক সটান সেখানে গিয়ে রাজার উপহার নামিয়ে রাখলো। কেম-বাং-মেলাতি আদৌ ঘুমোননি। তিনি পথ চেয়েই বসে আছেন কখন বনজিরের কাছ থেকে কেউ আসবে। কাক এর কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে খুলে পড়তেই তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। এ কী রকম অপমানকর সব কথা? রাগে হাত কাঁপছে, তবু বাক্সটা খুললেন তিনি। খুলতেই ভেতরে ভয়ংকর কাঁকড়া আর মাকড়শা গুলো কিলবিল করে উঠলো। অসম্ভব রেগে মেলাতি বাক্সটা ছুড়ে দূরে ফেলে দিলেন, চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললেন কুটিকুটি করে। কাককে চিৎকার করে বললেন "এই দণ্ডে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।" কাক তো অবাক হয়ে গেলো। অমন রাজার অমন উপহার, রাজকুমারীর পছন্দ হলো না?
বনজির আশা করেছিলেন সাদা কাককে দিয়েই মেলাতি নিশ্চয়ই চিঠির উত্তর পাঠাবেন। কিন্তু কেউ তো চিঠি দিতে এলো না। সকাল, দুপুর বসে থেকে থেকে শেষটা বিকেলবেলায় আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে বনজির আবার সোনালি প্রজাপতি হয়ে রাজকন্যার প্রাসাদে উড়ে গেলেন। মেলাতি তখন জানলার পাশে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছেন। প্রজাপতি তাঁর চারপাশে উড়ে উড়ে বললো "কই রাজকুমারী? তোমার ভাবী বর যে উপহার পাঠিয়েছেন তা তুমি পরোনি যে?" এই কথা শুনে মেলাতি আর রাগ সামলাতে পারলেননা। জোরে একটা চড় কষিয়ে সোনালি প্রজাপতিটাকে জানালার বাইরে ফেলে দিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন "ঐ অসভ্য লোকের নাম যেন আর কোনদিন আমাকে শুনতে না হয়।" তারপরেই দড়াম করে জানলা বন্ধ করে দিলেন যাতে প্রজাপতি আর ঢুকতে না পারে।
নাসিমন নিজের বারান্দা থেকে সব দেখে হা হা করে হেসে উঠলো। তার ছক কাজ করছে। রাস্তা থেকে বনজিরকে সরিয়ে দেওয়া গেছে। কিছুদিন পরেই ঐসব গয়নাপত্র নিয়ে সে নিজে গিয়ে রাজকন্যার কাছে বিয়ের প্রস্তাব আনবে। তখন কি আর উনি তাকে না করতে পারবেন? কিন্তু বনজির? বনজির দয়ালু, বনজির মৃদুভাষী, বনজির প্রেমিক। কিন্তু সেই সঙ্গে বনজির একজন সন্মানিত রাজা। তিনি নাসিমনের কথা জানেন না। সাদা কাক যে বাক্স রেখে খাওয়া দাওয়া করেছে তাও জানেন না। মেলাতির এই রকম ব্যবহারে তাঁর দুঃখ হয়েছে খুব, তার থেকেও বেশি হয়েছে অপমান। বনজির রাগে অস্থির হয়ে উঠলেন। ঝড়-বৃষ্টির রাজার রাগ! পৃথিবীতে ভয়ানক তুফান উঠলো। একলক্ষ সিংহের মত গর্জন করে বাজ-বিদ্যুৎ ভরা মেঘ ঘনিয়ে এলো। বর্শার ফলার মত বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়লো। নদী-সমুদ্রের জল খ্যাপা রাক্ষসের মত ফুঁসে উঠে সব ভাসিয়ে নিতে নামলো। মানুষজন ভয়েই অস্থির। হঠাৎ এ কী প্রলয় নেমে এলো?
পাহাড়ি নদী তখন প্রবল তোড়ে পাথর ভেঙে, গাছ উপড়ে এগিয়ে আসছে। সারিনার ঘরখানা পাখির বাসার মত ভেসে গেলো। নাসিমন আর সারিনা ভয়ের চোটে দৌড়ে রাজকন্যার কাছে এসে উঠেছে। কিন্তু তাতেও কি আর রক্ষা আছে? বনজিরের অশান্ত রাগ নদীর মত্ত স্রোত হয়ে কেম-বাং-মেলাতির শক্ত-পোক্ত প্রাসাদ পর্যন্ত উপড়ে ফেলে ভাসিয়ে নিয়ে চললো। রাজকন্যা ভয়ে, বিস্ময়ে কথা হারিয়ে ফেলেছেন। নাসিমনের হাসি শুকিয়ে গেছে, এখন সে প্রাণের ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। ধাইমা সারিনা দেখে সব বুঝি রসাতলে গেলো! সে চিৎকার করে বললে "রাজা বনজির, রাজা বনজির, সব দোষ আমার। আমিই ছেলের মন রাখতে ভুল চিঠি লিখে দিয়েছি। আমরাই আসল উপহার বাক্সে লুকিয়ে কদাকার পোকামাকড় ভরে দিয়েছি। আমরাই নিজেদের লোভের দোষে সাদা কাককে ভুলিয়ে ভালিয়ে এই জঘন্য কাজ করেছি। রাজকুমারীর কোনো দোষ নেই। দেশের লোকের কোনো দোষ নেই।তুমি আমাকে শাস্তি দাও রাজা। নির্দোষদের দয়া করো।"
এই কথা ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতের শব্দ ছপিয়ে বনজিরের কানে গিয়ে পৌঁছালো। তিনি আহত হয়েছিলেন, অপমানিত হয়েছিলেন, কিন্তু বনজির কখনো অবিচার করেন না। সারিনার স্বীকারোক্তি শোনার সঙ্গেসঙ্গে তিনি শান্ত হয়ে হাত তুললেন। ঝড়ও শান্ত হয়ে গেলো, বৃষ্টি বন্ধ হলো। নদীর জল বন্যার রূপ ছেড়ে আস্তে আস্তে নামতে লাগলো। ভীত, বিধ্বস্ত মেলাতি থরথর করে কেঁপে উঠে দেখলেন সামনে দাঁড়িয়ে স্বয়ং রাজা বনজির। কী রাজকীয়, কী প্রশান্ত, কী মায়াময় । বনজির তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। রাজকন্যা ফিসফিস করে বললেন "আমার সোনালি প্রজাপতি?"
ততক্ষণে চারদিকে সুন্দর ঝলমলে রোদ্দুর উঠেছে। গাছপালা থেকে টুপটুপ করে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে। রাজা বনজির আর রাজকন্যা মেলাতি হাত ধরাধরি করে রামধনুর প্রাসাদে চলে গেলেন। ধাইমা সারিনা রাজা আর রাজকন্যা দুজনেরই কাছে বারবার ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তার দুষ্টু ছেলে নাসিমনকে নিয়ে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। যদ্দিন না ছেলের মতি শুধরোয়, সৎ পথে থেকে খেটে খেতে শেখে তদ্দিন তারা ফিরবে না। বাকি ছিলো শুধু সাদা কাক। সে ততক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তার অমন লোভ করতে গিয়েই না এমন কাণ্ডটা ঘটলো! সারিনার মত নিজের দোষের ফল সে নিজেই ভোগ করবে ঠিক করেছে। বিবেকের তাড়নায় কাক হয়ে গেলো কুচকুচে কালো। কথা বলার ক্ষমতাও তার হারিয়ে গেছে। সে শুধু নাসিমনের লুকিয়ে রাখা সেই গয়নাগুলো খুঁজে বেড়ায়। আর বলে "কঃ কঃ কাউররর", তার মানে "সোনা কই? সোনা?"
ভাবছিলাম এই বুঝি সব পন্ড হল। হয় নি যাক।
Splendid!
বাহ বেশ
ভালো লাগল
মধুর মিলন! রূপকথার সেই সরলতা