আপেল তার গল্প বলে চললো--
ভয়ানক সেই কান্ড দেখে কাঠুরে বৌ তো থ'। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তার মধ্যে আবার কোথা থেকে এক জংলী ইঁদুরের ছানা বেরিয়ে এসে কুটুর কুটুর করে ওর পায়ে কামড়াতে লাগলো। পা'টাকে কোনো খাবার মনে করেছিলো কিনা কে জানে! একে তো এই দশা, তার ওপর ইঁদুরের এই উপদ্রব! বৌ সব হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে একটা গাছের ডাল তুলে নিয়ে ইঁদুরছানাকে মারলো এক বাড়ি । ছানাটা অত জোরে ঘা খেয়ে খানিক ছটফট করেই নিথর হয়ে গেলো। [এই গল্পটার মধ্যে বড্ড বেশি ভায়োলেন্স! কোনো মানে হয়?] এদিকে মা ইঁদুর ততক্ষণে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। সে বৌ এর দিকে একবার আর ছানার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললো "মরণ আর কী! এইটুকুতেই অমন রেগেমেগে যা তা করলেই হলো, না? কেন, জিয়ন-পাতার গাছ দেখতে পাওনি ঐ পোড়া চোখে?"
জিয়ন পাতার গাছ! বৌ তো অবাক। মা ইঁদুর তখন একটা ঝোপ থেকে কটা পাতা তুলে, দাঁত দিয়ে চিবিয়ে তার রসটা ছানার শরীরের ওপরে টপটপ করে ফেলছে। ওমা, দু মিনিটের মধ্যেই ইঁদুর ছানা দিব্যি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আবার কুটুর কাটুর শুরু করে দিলো। মা ইঁদুর বৌকে বললো "তা বাছা, তুমি কী কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়েই থাকবে? না লোকদুটোকে বাঁচিয়ে তুলবে?"
বৌ তো সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি করে এক মুঠো পাতা তুলে আনলে। মরা মানুষ দুটোর মাথা শরীরে কাছে রেখে, পাতার রস করে তার ওপরে ঢেলে দিলো। অমনি তারাও ধড়মড় করে উঠে বসলো যেন ঘুম ভেঙে উঠেছে।
কিন্তু কী মুশকিল! তাড়াহুড়োর চোটে বৌ একটা মস্ত ভুল করে ফেলেছে। সে কাঠুরের শরীরে দিয়েছে তার ভাইয়ের মাথা, আর ভাইয়ের শরীরে কাঠুরের! কী কান্ড বলো দেখি!
আপেল বলে -- " এবার তবে জ্ঞানী খোকা, বলো দেখি কে মেয়েটির আসল স্বামী?"
সিংহাসনে বসা 'জ্ঞানী ঠাকুর' চোখ মেলে বললো -- "যার মাথা কাঠুরের, সেই ওর স্বামী"।
আমাদের বিক্রম রাজা কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলে তার যুক্তিটাও বলে দিতেন। কিন্তু জর্জিয়াবাসী এই বাচ্চা সেসবের ধার দিয়ে গেলোনা। শুধু উত্তর। তা তাই সই। রাজা সবার অলক্ষ্যে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
আচ্ছা, এবার দ্বিতীয় গল্প। আপেল নড়েচড়ে আবার শুরু করলো। এক পুরোহিত ,এক কাঠমিস্ত্রী, আর এক দর্জি যাচ্ছে ভিনদেশে কাজের খোঁজে। পথের মাঝে যথারীতি পড়লো এক জঙ্গল। ততক্ষণে সন্ধ্যে নেমে এসেছে। অন্ধকারে আর পথ চলা যায়না। ওরা ঠিক করলো একটা বড় গাছের তলায় বসে রাত কাটিয়ে দিতে হবে। কাঠকুটো দিয়ে বড় করে আগুন জ্বালানো হলো। বন্ধুরা বুঝতে পারছে সবাই একসাথে ঘুমিয়ে পড়া উচিৎ হবেনা। কত কী বিপদ আপদ আসতে পারে। তাই পালা করে একজন পাহারা দেবে, এই স্থির হলো। প্রথম রাতে কাঠমিস্ত্রীর পালা। চুপ করে বসে থাকলে তো ঘুম পেয়ে যাবে। তাই সময় কাটানোর জন্য কাঠমিস্ত্রী একটা উপায় বার করলো। সামনেই একটা গাছের গুঁড়ি পড়ে ছিলো। যন্ত্রপাতি তো সঙ্গেই আছে। সেই গুঁড়ি চেঁছে-ছুলে কাঠমিস্ত্রী চমৎকার এক মানুষের মূর্তি তৈরী করে ফেললে। যেই মূর্তি তৈরী পুরো হলো, অমনিই তার পাহারার সময়ও শেষ হয়ে গেলো। বন্ধু দর্জিকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে মিস্ত্রী শুয়ে পড়লো।
দর্জি বন্ধু তো দু চোখ কচলে ঘুম ছাড়িয়ে দেখে সামনে একটা সুন্দর কাঠের মানুষ! সে ভাবলো --"বাঃ, এই তো তোফা হয়েছে! একটা সময় কাটানোর মত কাজ পাওয়া গেলো"। তার ঝুলি থেকে বেরিয়ে এলো ছুঁচ-সুতো, কাঁচি, নানা কাপড়ের টুকরো। আগুনের ধারে বসেবসে দরজি একটা দিব্যি সুন্দর পোশাক তৈরী করে ফেললো। কাঠের মানুষের গায়ে তা এক্কেবারে মাপসই হয়েছে ! এই অব্দি হবার পরেই দর্জির পালা শেষ হয়ে গেলো। পুরোহিতকে ডেকে দিয়ে সে গেলো আরেক দফা ঘুমিয়ে নিতে।
টানা এতক্ষণ ঘুমিয়ে পুরোহিতের শরীর তখন বেশ ঝরঝরে। আগুনের ধারে বসেবসে তিনি পুঁথি পড়ছেন আর নানান দার্শনিক চিন্তা করছেন। ঘুম টুম আসার বালাই নেই। যখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে, ওঁর চোখে পড়লো সুন্দর পোশাক পরানো চমৎকার এক কাঠের মানুষ এইখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। পুরোহিত তো বুঝতে পেরেছেন যে তাঁর দুই বন্ধুর হাতের কাজেই এমন চমৎকার মূর্তি তৈরী হয়েছে। উনি ভাবলেন "আমার তো কোনো কারিগরী বিদ্যা জানা নেই। আমি যা জানি তাই দিয়েই এই মূর্তির জন্য দেখি কিছু করতে পারি কিনা"।
পুরোহিত একমনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন যে কাঠের এই মূর্তির শরীরে ভগবান যেন এক আত্মা দিয়ে দেন। ভগবান কী ভাবছিলেন তা আমি জানিনা, কিন্তু ভোরের আলো ফোটার সঙ্গেসঙ্গেই কাঠের মানুষ সত্যি করে মেলে তাকালো! ভগবানের দেওয়া আত্মা এসে জড় মূর্তিটাকে জীবন্ত মানুষ করে তুলেছে। অন্য বন্ধুরা ঘুম ভেঙে তা দেখে তো অবাক!
আপেল একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো -- "জ্ঞানের খোকা, তাহলে বলো, কে এই মানুষের আসল স্রষ্টা?"
বারবার তাকে খোকা বলা সত্বেও এতটুকু রেগে না গিয়ে 'জ্ঞানের খোকা' বললো -- "যিনি ওর শরীরে আত্মা দিয়েছেন তিনিই ওর স্রষ্টা।"
আপেল খুশি হয়ে গিয়ে তিন নম্বর গল্প শুরু করলো।
এবারের গল্পে আর কাঠুরিয়া বা কাঠমিস্ত্রী নেই। তবে এও তিন বন্ধুর গল্প। তিনজনের তিন রকম গুণ। একজন তিনকালের কোথায়, কখন, কী, ঘটে সব দেখতে পান। একজন হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়োতে পারেন। আর একজন হলেন ডাক্তার। তিনি পৃথিবীর সবরকম অসুখ সারাতে পারেন। সুখে দুঃখে তাঁদের দিন কাটছে বেশ। একদিন ত্রিকালজ্ঞ বন্ধু হঠাৎ বলে উঠলেন -- "আরেঃ, এখান থেকে এতশো ক্রোশ দূরে, অমুক রাজ্যের রাজার ছেলের দেখি কঠিন অসুখ। ডাক্তার-বদ্যি কেউ কিছুই করতে পারছেনা ছেলেটা বাঁচলে হয়!"
তাই শুনে ডাক্তার বললেন --" ও কী অলুক্ষুণে কথা! বাঁচবেনা আবার কেন? যা যা লক্ষণ দেখছো স্পষ্ট করে বলো তো। আমি ওষুধ বানিয়ে ফেলি।"
বন্ধুর কাছ থেকে অসুখের লক্ষণ শুনে শুনেই ডাক্তার অব্যর্থ ওষুধ বানিয়ে ফেললেন। কিন্তু ওষুধ অতদূরে পৌঁছবে কে? কে আবার? দৌড়বীর বন্ধু তাহলে আছেন কী করতে? তিনি হাওয়ার আগে দৌড়ে গিয়ে রাজার ছেলের মুখে দুটো বড়ি আর চার ফোঁটা তরল ওষুধ ঢেলে দিলেন। সেও অমনি সুস্থ্য হয়ে উঠে দুষ্টুমি আর বায়নাক্কা শুরু করে দিলো! তাহলে এবার প্রশ্ন হলো, কার জন্য রাজপুত্রর প্রাণ বাঁচলো?
এবার আর আপেলকে 'জ্ঞানী খোকা' বলার সুযোগ না দিয়েই সে ছেলে চটপট বলে উঠলো -- "ডাক্তারই ওর প্রাণ বাঁচিয়েছেন।"
উত্তর শুনে আপেল একবার মুচকি হেসে আবার কাঠের বাক্সটার মধ্যে ঢুকে পড়লো। রাজা তা কোমরে গুঁজে, গোঁফের আড়ালে স্বস্তির হাসি লুকিয়ে বললেন -- "এবার?"
জ্ঞানী ছেলের মুখেও হাসি খেলে গেলো। সে বললো "বহু বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি। কোনদিন এমন প্রশ্ন নিয়ে কেউ আসেনি। আজ আমি খুব খুশি হয়েছি। বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি।"
রাজা চাইলেন যত লোক পাথর হয়ে আছে তারা সবাই যেন প্রাণ ফিরে পায়। তাই ফিরিয়ে দিলো জ্ঞানী ঠাকুর। আর অনেক সুন্দর সুন্দর উপহার দিয়ে সব্বাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।
তা এই হলো গল্প। শেষটা বেশ ভালোই। আমি ভাবছিলাম আমাদের বিক্রমাদিত্য আর বেতালের সাথে শুধু গল্পের মিল আছে তাইই নয়। একটু চেষ্টা করলেই ঐ পুরনো গানটাও এই খাপে বেশ মিলিয়ে দেওয়া যায়।
জ্ঞানী-জ্ঞানী-জ্ঞানী। আপেল-পেল-পেল। হচ্ছে না?