ভূগোল পড়ায় নমিতা। দেশ,কাল,রাজ্য,সীমানা। একটু অবাকই লাগে তার। নিজে যখন সে ছাত্রী ছিলো, উচ্চতর ভূগোল পড়তে গিয়ে দেখেছে কীভাবে বিশ্ব সৃষ্টি হলো,পাহার পর্বত তৈরির নানা থিওরি, মানুষ ও তার নানান অভ্যাস এসব কত বেশি জরুরি। এবং স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরে এসবই বেশির ভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে। অথচ ছোট্ট বেলা থেকে বাচ্চাগুলোকে ভূগোলের নামে পড়ানো হয় জেলার নাম। আঁকানো হয় লাল দগদগে আন্তর্জাতিক সীমারেখা। যে মেয়ে নিজের উঠোনের থেকে লাফ মেরে প্রাচীর ডিঙিয়ে পাশের বাড়ির পেয়ারা গাছে দোল খায়, সে কী করে খুঁজে পাবে দাগ, প্লট! অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশর খোপ খোপ অংশগুলো তো তার কাছে কিতকিত কিম্বা এক্কাদোক্কা খেলার কোর্ট। তবুও সে পড়ায় স্বাধীনতা উত্তর ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যের বন্টন, তবুও তাকে চেনাতে হয় মাটির বুক চিরে চিরে খন্ড খন্ড করে তৈরি হওয়া দেশ। কারণ সে তো একজন সামান্য দিদিমণি। সিলেবাস কমিটির মাথা পর্যন্ত পৌঁছনো তার সাধ্য কি। আর তাছাড়া এসব তো প্রায় সমগ্র বিশ্বের ধারণা বদলানোর সামিল। কিন্তু চক ডাস্টার দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে বিভিন্ন দেশের ছবি আঁকতে আঁকতে সে কেবলই আনমনা হয়ে যায়। তার কেমন যেন মনে হয় এসবের মধ্যেই প্রোথিত আছে হিংসার বীজ।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে টিচার্স রুমে এসে সে ফোনটা খুলল,দেখলো সুমিতা আরও একটা ভিডিও পাঠিয়েছে এম টি টিভির। বিশাল বিমানে গাদাগাদি করে বসিয়ে ইউক্রেন থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে পড়ুয়াদের। বাচ্চাগুলোর মুখ আঁতিপাঁতি করে খুঁজছিল নমিতা। এর মধ্যে কি সুমিতার ছেলের মুখ আছে? নাঃ চোখে পড়ছে না। এ কদিনে সে চিনে ফেলেছে ছেলেটাকে। বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে বাইট দিচ্ছিল এদিক ওদিক। কিন্তু এখন আর তাও দেখা যাচ্ছে না। ঘনঘন মিসাইল হানা। ননস্টপ বম্বিং। একঝাঁক কালো শকুনের মতো ফাইটার জেট চক্কর খাচ্ছে মাথার ওপর। ছোট ছোট হাড় হিম করা ভিডিও পাঠাচ্ছিল সুমিতা। একদিন পাঠালো ছেলেটা হাঁটছে আর বলছে আমাদের এখানে কোনো জল নেই,এ টি এম এ টাকা নেই। তোমরা আমাদের সাহায্য কর। কে কাকে কীভাবে সাহায্য করবে? তাছাড়া ভিডিওটা দেখে মনে হলো কেউ ওকে কথাগুলো জোর করে বলাচ্ছে।
ঘুমাতে পারে না নমিতা। রাত দুপুরে হোয়াটস আপ খুলে দেখে সুমিতার ছবির ওপর সবুজ বিন্দু হয়ে আছে। প্রায় তেইশ চব্বিশ বছর নমিতা সুমিতাকে দেখে নি। সেই উচ্চমাধ্যমিকের সময় তারা একসঙ্গে পড়তো। তারপর আবার এই মোবাইল ফোনের দৌলতে যোগাযোগ। তার বর আর ছেলেকেও ওই ছবিতেই দেখা। তবু কান্নায় দম আটকে আসে তার। সে একটা গান পাঠালো সুমিতাকে। নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে। তারপর লিখলো,ঘুমালি? কোনো উত্তর না পেয়ে লিখলো না ঘুমাতে পারলে ওষুধ খেয়ে ঘুমা। লিখেছিস বিপি হাই!
অনেকক্ষণ পরে উত্তর এলো আজ পাঁচ দিন হলো ঘুমাই না। ওষুধ খেলেও ঘুম হয় না। বরং কষ্ট হয়।
আগ্রাসন শব্দটার সঙ্গে মানুষে পরিচিত হয় ছোট্ট থেকেই কিন্তু বুঝতে পারেনা। ক্ষমতা যার বেশি সেই সর্বতোভাবে চাপিয়ে দিতে চায় তার মত দুর্বলের ওপরে।
পাশ ফিরে শোয় নমিতা। এয়ার কন্ডিশন চলছে ঘঁ ঘঁ করে। মেসিন চলছে কিন্তু কাজ করছে বলে বোধ হচ্ছে না। ঠান্ডা কই? সমস্ত শীতল বায়ু আজ উত্তরমুখী বোধহয়। পৃথিবীর শীতলতম স্থান কাজাখস্তান কতটুকু আর দূর ওই বাসটার থেকে? মহাকাশের ঘন অন্ধকারে উড়ছে ওই গাদাগাদি করে ঠাসাঠাসি করে বসে থাকা উড়ান। খুব শীত করছে কি সুমিতার? সে উপুড় হয়ে শুলো। তারপর দেখলো তার এয়ারকন্ডিশন মেসিনের গায়ে লেখা একটা ডট। স্লিপিং মোড। তার মনে হলো একটা লম্বা দড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে তাকে নামিয়ে দিচ্ছে কেউ নিচে। সেখানেও ঘন অন্ধকার। এতোক্ষণে তার ঠান্ডা লাগলো। আরাম লাগলো। তার ঘুম আসছে। সে শুনলো পাশের ঘর থেকে যন্ত্র নয় আসছে নাক ডাকার শব্দ। তার মনে হলো মহা শূন্যের থেকে তবে নির্বিকার ধ্বনি নির্বাচন অধিক সংগত।
তারপর সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলো। দেখলো অন্ধকারে কতগুলো জোকার নাচছে। তারা খুব সুন্দর সেজেছে। তবু তাদের কিম্ভুত লাগছে। কারণ তাদের মাথার ওপর ফোঁৎ ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ফেলছে কতগুলো দেড়ে বুড়ো। তাদের রঙ ঢঙ অসহ্য রকমের। যদিও সেই বুড়োগুলো আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাগুলোকে বোঝানোর, খুব ভালো নাচছ তোমরা। বাহা,বাহা। ক্যামেরা ঝলসাচ্ছে। ওরা নাচ থামিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল। আর ধু ধু সাদা বরফের মরুর ওপর দেখা গেল কতগুলো রক্ত মাখা পায়ের ছাপ। ঘুম ভেঙে গেল নমিতার। ওই অঞ্চলে ইয়েতি থাকে না? সুমিতা কি ঘুমালো? ঘড়ি দেখলো নমিতা। রাত তিনটে। সে আবার ভিডিওগুলো দেখলো। সুমিতার পাঠানো ভিডিওগুলোয় এক একবার এক একটা ছেলেকে সে নিজের ছেলে বলে চিহ্নিত করেছে। অথচ ওই এয়ারবাসটায় সেই ছেলেগুলোর একজনও নেই। সে বুঝতে পারলো না ছবি দেখে সে ঠিকমতো বুঝতে পারছে না নাকি সুমিতার কোথাও ভুল হচ্ছে। সে আবার একটা টেক্সট করলো। কটা বিমান ছেড়েছে কিছু শুনলি?
এবার উত্তর এলো না। তারমানে সুমিতা এতোক্ষণে ঘুমিয়েছে। মানুষের শরীর একটা যন্ত্রের মতো। সে ঠিক নিজের মতো করে রেস্ট নিয়ে নেয়। কিন্তু তার বন্ধুর চিন্তায় তার ঘুম আসে না কেন? সে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে লাগলো দুনিয়ার খবরের চ্যানেলগুলো। ধুর,এরা তো শুধু ঘরের ক্যাচাল শুনাতেই ব্যস্ত। আরে বাবা মানবাধিকার কর্মীগুলো কি এখন নাকে তেল দিয়ে বসে আছে? ভদ্র সভ্যতার নিকুচি করেছে বলে! বাচ্চাগুলো পড়তে গেছে। কিম্বা কেউ কোনো কাজ করতে গেছে। একে তো তোমরা দেশের সম্পত্তি দেশে রাখতে পারো নি। তারপর বিপদের দিনেও চোখ বুঁজে ঘুমুচ্ছ। আরে ওরা তো সেদিনও জানতো না তোমাদের ঠান্ডা ঘরে কাগজের ওপর কি আঁক কাটা হয়েছিল। তবু তোমরা পাছায় লাথি মেরে তাদের ঘরদোর থেকে বিদেয় করে দিয়েছিলে। ঠাকুরদাকে ভিঁটে ছাড়া করেছ আবার নাতিকে। আর মাঝখানে এই আমাদের ঠ্যাং উল্টো করে আকাশের গায়ে হুক লাগিয়ে ঝুলিয়ে রেখে বলেছ দোল খাও আমরা সার্কাস দেখি। রুটির ঝুড়ির দেশে কি হচ্ছে তাতে আমাদের কি, আমরা হলাম জীবিকাসত্তা ভিত্তিক ভেতো বাঙালি। খাবো, ঘুমাবো,আর রঙ চঙ মেখে ড্রইং রুম স্বরগরম করবো।
এখনো বহু মানুষ আটকে আছে। আহ্, এক একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কীভাবে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে শত্রু শিবির। আচ্ছা কোনো ট্যাংকগুলো কাদের? এতো মহা মুশকিল? কে কাকে মারছে? আজ রাতে তো সে ঘুমের ওষুধ খায় নি। সে খুব কমই ওসব ওষুধ ফষুধ খায়। তাও মাথাটা ঝিমঝিম করছে কেন? দলে দলে মানুষ হাঁটছে। বাচ্চা বুড়ো সবাই। যারা ছবি দেখে জানে তারা কি ঠিক জানে কতটা পথ হাঁটলে একটা মানুষ তার গন্তব্য খুঁজে পায়? সামান্য একটা একচালা?
না জানেনা। যেভাবে দিনের পর দিন সিলেবাস কমিটির মাথারা বুঝতেই পারেনি কোন ক্লাসের বাচ্চাদের ঠিক কতখানি পড়া উচিৎ বা কীভাবে পড়া উচিৎ। ভার্চুয়াল দুনিয়ার পক্ষে বিপক্ষে এখন অনেক যুক্তি। কিন্তু এতোকাল তো হেলিকপ্টারে ঘুরেই সবাই বন্যা দেখলো। মানুষের অনন্ত দুর্গতি হয়ে গেল ফান পর্যটন। গুটিকয় কতিপয় এখন অতিকায় হয়েছে। সঞ্চারিত হয়েছে জালিকাতন্তু দিয়ে শরীরের আনাচে কানাচে। ভালো মন্দ যাই বলো তফাৎ শুধু এইটুকুই।
পরদিন স্কুলে যাবার পথে স্টেশনে পৌঁছে নমিতা দেখলো পোঁটলাপুটলি নিয়ে অনেক লোকজন। এক্কেবারে ক্ষুদে, খালি গা,একটা ইজের পরা একটা ছেলে ডিগবাজি পর ডিগবাজি খাচ্ছে,ঢুলু ঢুলু চোখে একটা লোহার রিং হাতে ধরে বসে আছে ধরে নেওয়া যায় তার বাবা। ছেলেটা রিংএর মধ্যে দিয়ে গলে গেল। নিত্যযাত্রীরা ব্যাগপত্তর সামলে রেখেছেন। এরা চোর হয়। কে যেন ফিসফিস করে বলল। হুম। বানজারা। একটা বোঁটকা গন্ধ স্টেশন জুড়ে। সুমিতার ছেলেরা স্নানের জল পাচ্ছে না। ভিডিওয় বলছিল। ট্রেনের এনাউন্সমেন্ট শুনে তাড়াতাড়ি যেতে গিয়ে বেখেয়ালে সে প্রায় হোঁচট খাচ্ছিল। স্টেশনে মাঝখানেই চারটি ইট পেতে আগুল জ্বালিয়েছে ঘাঘরা পরা এক সুন্দরী। রঙিন ফিল্মি স্যুটে যা ঝুমকা গিরারে। হায়! ইউরোপ ও এশিয়া দুই মহাদেশ দিয়ে বিস্তৃত যে দেশ তার নাম ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভাঙন শুরু হলো। ছিল স্বপ্ন গঠনের দিন। সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হলো,ফের বিচ্ছেদ। চলছে তো চলছেই। তাদের সারাটা জীবনই চলে গেল এই দেখতে দেখতে। তবু কি দরকার ছিল সুমিতার ওই দেশে ছেলেকে পাঠানোর?
সুমিতা বলছিল কী অপূর্ব শিক্ষা ব্যবস্থা। দেখলে তোর তাক লেগে যাবে। কিছু ছবিও পাঠিয়েছিল। সত্যিই খুব সুন্দর। ওপরে তো ধরা যায় না ভিতরের ক্ষয়। যখন খসে পড়ে তখন বোঝা যায় পরিস্থিতি আসলে কত ভয়াবহ ছিল। বুঝতে পারেনি ওরা। যেকোনো উপায়ে সন্তানকে আরও কিছুটা কীকরে এগিয়ে দেওয়া যায় এই চিন্তাতেই তো পাগল হয়ে থাকে মা বাবা।
আনমনে ট্রেনে উঠল সে। সুমিতার বর টাঁকশালের মস্ত অফিসার। টাকা তৈরি হয় যেখানে সে জায়গা নাজানি কী বিষ্ময়ের। তাই দুনিয়া কিনে ফেলার অহংকার কি লেগেছিল ওদের সিন্ধান্তে! হবেও হয়তো। সে তো ছোটবেলায় ভাবত কিছুতেই সে ব্যাংকে চাকরি করা লোককে বিয়ে করবে না। তারা কেবল টাকা নিয়ে সারাদিন নাড়াচাড়া করতে করতে টাকা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারে না। হা,হা, আজকাল খুব হাসি পায় কথাটা ভাবলে। কিন্তু খুব বিলাসিতায় যে ছেলেকে বড় করেছে সুমিতা সেকথা কিন্তু নমিতার অজানা ছিল না। সেই ছেলে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে লাফিয়ে পার হচ্ছে বড় বড় পাথরের চাঁই। ওই তো ঢুকে গেল ওরা পড়ে থাকা একটা ফাঁপা নলের মধ্যে। বম্বিং হচ্ছে। ধোঁয়া পাকিয়ে উঠে ঢেকে দিচ্ছে আকাশ। ওদের চোখ জ্বলছে। রাষ্ট্র প্রধানের করমর্দনে যুদ্ধবিরতির আশ্বাস। ট্রেন ছুটছে নমিতার স্কুল অভিমুখে। দুপাশে সাদা বরফ মরু পেরিয়ে। বাঁশির ধ্বনি হাসির ধ্বনি উঠছে ছুটে ফোয়ারায়। ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ ধরে ছুটছে ট্রেন। আর আঁকাবাঁকা সেই পথে হেলতে দুলতে জুড়তে জুড়তে এসে মিশে যাচ্ছে আমাদের ভারতীয় পূর্বরেলপথে। তারপর এক্কেবারে উড়ালপুল দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে উদিত সূর্যের দেশে। অমানিশা ভোর হচ্ছে সুমিতার উচ্ছ্বসিত ফোন কলে। এইই বাবু বাড়ি ফিরে এসেছে রে!!
সত্যি!যাক বাবা। নমিতার চোখের কোল দিয়ে গড়িয়ে নামে গরম জল। তার বলতে ইচ্ছে করে অনেক কথা। কিন্তু বলে না। সব কথা বলে দিতে নেই। শুধু মুঠোর মধ্যে চেপে ধরতে হয় শক্ত করে। মোবাইল ফোনখানা সে চেপে ধরে হাতের মধ্যে।
.