নিশিগন্ধা খুব যত্ন করে পিঠ পেতে দেয়। সুদীপ যখন চাবুক মারে তখন দাগটা যাতে কোণাকুণি সুষ্ঠু ভাবে পড়ে সেই জন্যে। কোনো কিছুতেই শৈল্পিক সুষমা নষ্ট হওয়া সে চায় না। বেশি তো মারে না সুদীপ। এই চারটে কি পাঁচটা। চুপচাপ সয়ে নিলে ওর রাগ পড়ে যায়। কিন্তু এই সয়ে টুকু নিলে নিশি একটা দারুণ জিনিস পেয়ে যায়। সুদীপ ঘর ছেড়ে চলে গেলে সে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর আস্তে করে হাউজকোটের দড়িটা খুলে পিছন ফিরে দাঁড়ায়। আর প্রতিদিনই প্রায় আবিষ্কার করে ফেলে নতুন নতুন নক্সা। তার চোখ দিয়ে যখন গরম জলের ধারা নামে তখন মাথার মধ্যে শুরু হয় নৃত্য। আলোর বিন্দু গুলো ছুটোছুটি করে এ রাস্তা থেকে ও রাস্তা। সে ঘাড় ঘুরিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার নগ্ন পিঠের দিকে। তারপর সরু নিবের একটা রোটারিং পেন নিয়ে বসে। আর হিজিবিজি কাটতে থাকে। তার বেশি জ্বালা টালা করে না। সুদীপ নিশ্চয়ই পুলিশ নয়, সে নিশ্চয়ই জেল বন্দিকে পেটায় না যে মারাত্মক কিছু একটা লাগবে। একটা হাইনেক ব্লাউজ পরে নিলে দিব্যি পরের দিন স্কুল করা যায়।
তবে এই সহজ ব্যাপারটাও কিন্তু সহজে রপ্ত হয়নি নিশিগন্ধার। সে এরমধ্যেই অনেক রঙ ঢঙ দেখিয়ে ফেলেছে। সেটা কিরকম? সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণে যেমন লেখা থাকে স্মোকিং ইঞ্জুরিয়াস টু হেলথ তা সত্ত্বেও লোকে ফকফক করে সিগারেট খায় তেমনি রগচটা সুদীপের সঙ্গে সে একটু বেশি মাখামাখি করতে গেছে। তর্ক ঝগড়াও করতে গেছে। ভেবেছে এরপর ভাব হলে খুব মজা হবে। তা তো হয়ই নি। উলটে শঙ্কর মাছের লেজ উঠে এসেছে দীঘার সমুদ্র থেকে। আর একদিন ফোঁচ ফোঁচ করতে করতে সে দেখে ফেলেছে সেই রেখার মধ্যে এক অদ্ভুত ছন্দ। এতটুকু আঘাত বানিয়ে তুলেছে এই ইয়া বড় হাতির কান কিম্বা বাঘের পেট। তারার সঙ্গে লাইন জুড়ে যেভাবে মানুষ ভাগ্য গণনা করে, সিংঘ, মেষ, বৃষ। ছবি আঁকে জিজ্ঞাসা চিহ্নের। সেইভাবে সেও।
আর এই করতে গিয়ে সে দেখল একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে। আসলে গায়ে হাত হয়তো অনেক কমই দিয়েছে সুদীপ। কিন্তু নিরন্তর হাওয়ায় ছুঁড়ে দেওয়া তার ওই পাথরগুলোর দিকে নিশি যেই পিছন ফিরে দাঁড়ায় ফুটে ওঠে কালো কালো ছোপধরা নানা রকম ছবি। কিন্তু ভোতা অস্ত্রের আঘাতের থেকে সপাং শব্দের সঙ্গে যে রেখা তৈরি হয় সেই ছবির প্যাটার্ন তাকে বেশি টানে। জ্যামিতিক বিন্যাসের মধ্যে থাকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ। আয় কত মারবি মার, এরকম একটা একরোখা মনোভাব। তখন আর তার সামনে শুধু সুদীপ থাকে না। সে যেন সমাজের থেকে মুখ ফিরিয়ে পিঠ পেতে দেয়। ছবিগুলো হয়ে ওঠে তীক্ষ্ণ। আবেদনময়। আর ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা তীরগুলো পৃষ্ঠতলে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যেতে যেতে ঘটায় আলোর প্রতিফলন।
পুনশ্চ...আসুন ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। ধরুন এটা একটা অংক। যেহেতু প্যাটার্নের প্রশ্ন তাই গাণিতিক ব্যাপারটা একটু এসেই যাচ্ছে। তা এই কোণাকুণি ফুটে ওঠা রেখাগুলির কোণের মান বা ডিগ্রি সম্পর্কে কিন্তু আপনি জানেন না। তা সূক্ষ্ম হতে পারে স্থূলও হতে পারে। প্রজেকশনে অতিরঞ্জন নিরাময়ের আলাদা নিয়ম আছে। আর প্রিজমেটিক কম্পাস হলে তো ব্যাপারটা সাংঘাতিক। এরর ক্যালকুলেশন জন্যে পরীক্ষা হলে আলাদা নম্বর ধার্য করা থাকে। আপনি যদি ভুল না করেন তাহলে গেলো, ওই নম্বরটা আপনার ফক্কা। অতএব ভুল আপনাকে করতেই হবে। এবং অবধারিতভাবে তা সংশোধন করতে হবে। আর সেই সংশোধন করবার অংক কোনো কোনো সময় মূল অংকের থেকে বেশি গড়ায়। সে যে করছে কেবল সেই জানে। গল্প লেখাটা বেশিরভাগ লোকে খুব সহজ মনে করলেও আসলে গল্পও অনেকটা এইরূপ জটিল ধাঁধা মতই। তাই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ এই যে, অংক না বুঝে বুঝবার চেষ্টা করার মত গল্পও না বুঝে বুঝবার চেষ্টা করা মস্তিষ্কের পক্ষে ক্ষতিকারক।
(পুনশ্চ অংশটুকু কেবল মাত্র আগ্রহী পাঠকদের জন্যে।)