এ পাড়ায় মশা আছে তবে সংখ্যাটা মারাত্মক নয়। তবু সাবধানের মার নেই - কাজেই হলাহুল প্রয়োগে মশার বংশ ধ্বংস করাই হচ্ছে সুবিবেচনার কাজ। কিন্তু অনেকেই করেন না, ঈশ্বর না করুন, তার ফল হতে পারে মারাত্মক। মনে রাখবেন মশারা প্রায় সর্বদাই আপনার আশেপাশে আছে। বিশেষ করে রাত্রের দিকে। অতএব রাত্রে শোওয়ার আগে আপনার ঘরে হলাহুল স্প্রে করতে কখনও ভুলবেন না।
রাত্রে শোবার আগে চুল বাঁধা মণিমালার অনেকদিনের অভ্যেস। খাওয়া দাওয়ার পর রান্নাঘরে সব গোছগাছ করে এসে সে রোজ ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আঁচড়ায়। চুলের গোড়ায় ঘষে ঘষে বালকেশরী মাখে। সে তেলের দারুণ খোশবু। আঁচড়ানো শেষ করে খুব টান টান করে চুল বেঁধে বিনুনি বানায় রোজ। বিনুনি বাঁধার সময় ঘাড়টা বাঁ দিকে একটু হেলিয়ে দেখতে থাকে বিনুনির পাক, আর চাপা ঠোঁটে ধরে রাখে কালো ফিতের একটা ধার। অবাধ্য দু একটা চুল - তার কপালে উড়ে এসে জুড়ে বসে। কখনও শাড়ির আঁচল একটু সরে যায়, জানালার পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়ানোর মতো বেরিয়ে পড়ে ব্লাউজে ঢাকা বুকের আধখানা দুষ্টু। অথবা সামান্য মেদ সমৃদ্ধ পেটের দুষ্টু নাভি।
সিগারেট টানতে টানতে বিছানায় শুয়ে লোলুপ নজরে এই সব দেখছিল সুকান্ত। ঊর্ধাঙ্গে তার জন্মদিনের পোষাক আর নিম্নাঙ্গে লুঙ্গি। কে ওই ভদ্রলোক, যিনি এত রাত্রে মণিমালার শোবার ঘরের বিছানায় আধশোয়া হয়ে সিগারেট টানছে? কী করেই বা সে এখন বিছানা থেকে নেমে মণিমালাকে জড়িয়ে ধরতে পারল পিছন থেকে? মণিমালার ঘাড়ে ঠোঁট রাখতে পারল? কেনই বা শিউরে উঠল মণিমালা আর প্রশ্রয়ের হাসি মুখে নিয়ে গলা দিয়ে আদুরে মেকুরের মতো আওয়াজ করতে পারল? পারছে, কারণ সুকান্তই তো মণিমালার স্বামী।
চুল বাঁধা হয়ে গেল, চিরুনিতে লেগে থাকা চুলগুলি ছাড়িয়ে নিয়ে মণিমালা ছোট্ট একটা নুটি বানিয়ে তুলল, তারপর অস্ফুটস্বরে সুকান্তকে বলল, অ্যাই ছাড়ো না, আজকে ঘুমোবে না, নাকি? সুকান্ত ছেড়ে দিতে, মণিমালা মুচকি হেসে বলল, লক্ষ্মী ছেলে, সোনা ছেলে। বলতে বলতে বেরিয়ে গেল ঘরের লাগোয়া বারান্দায়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুলের নুটিতে সশব্দে একটু থুথু দিয়ে, নুটিটা ভাসিয়ে দিল শূণ্যে। বেচারা চুলের নুটি! একটু আগেও সুন্দরী রমণীর কেশদামের অংশ হয়ে বেশ ছিল, শ্যাম্পু আর বালকেশরীতে নিত্য নিষিক্ত হয়ে। এখন এই প্রায় মধ্যনিশিতে অবহেলিত, পরিত্যক্ত হয়ে, মুক্ত বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল - কার জানালা দিয়ে কোথায় ঢুকে পড়বে কে জানে!
বারান্দার দরজা বন্ধ করে, মণিমালা পাশের ডাইনিং হলে গেল, ফ্রিজ খুলে একটা বোতল আর টেবিল থেকে দুটো গ্লাস নিয়ে এল। একটা গ্লাসে জল ঢেলে বলল জল খাবে? সুকান্ত গোমড়া মুখে ঘাড় নেড়ে না বলল। মণিমালা হাতে ধরা গ্লাসের জলটা এক নিশ্বাসে খেয়ে নিয়ে আওয়াজ করল, আআআআঃ, বলল, সেই থেকে যা তেষ্টা পেয়েছিল। গ্লাস দুটো আর বাকি জলের বোতলটা মাথার কাছে ছোট টেবিলে রেখে, মণিমালা সুখশয্যায় বসতে এসেও আবার উঠে গেল। ডাইনিং টেবিলের ওপরে রাখা ভাজা মৌরির কৌটো নিয়ে এসে খাটের পাশে দাঁড়াল। কৌটো থেকে একটু ভাজা মৌরি ডানহাতের তালুতে ঢেলে বলল, ভাজা মশলা খাবে? সুকান্ত হাত বাড়াল না, হাঁ করল। মণিমালা নীচু হয়ে সুখশয্যায় শোয়া সুকান্তের মুখের সামনে হাত নিয়ে ঢেলে দিল ভাজা মৌরি। সুকান্ত মুখ বন্ধ করে জড়িয়ে ধরল মণিমালাকে, টেনে নিল নিজের বুকের ওপর। সুকান্তর বুকে মণিমালার বুক থেপসে গেল। একটুও আগুন জ্বলল না ঠিকই, কিন্তু সুকান্ত পুড়ে ছাই হতে লাগল। ছাড়ো, ছাড়ো আমার এখনো রাজ্যের কাজ বাকি। আমার পাশে শোয়াটাও তোমার একটা কাজ। ছাই কাজ। ঠিক তাই, সেই থেকে পুড়ে পুড়ে আমি ছাই হচ্ছি। ইস, আমি এখন তাহলে এসে ছাইয়ের গাদায় শুলাম? ছাইয়ের গাদা, উঁ, ছাইয়ের গাদা, দেখাচ্ছি কেমন ছাইয়ের গাদা। নরম ও আরামের সুখশয্যার ওপর সুকান্ত চেপে ধরল আগুনতপ্ত মণিমালাকে। তারপর মণিমালার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বলল মশলা খাবে? মণিমালার দু চোখে সর্বনাশের ডাক, তার আঁখিপাখি পাখা ঝাপটিয়ে বলল, খাবো। সুকান্ত ডুব ডুব ডুব দিল মণিমালার অধরে, তার জিভ মৌরির কয়েকটা দানা সমেত ঢুকে পড়ল মণিমালার মুখে।
খোলা জানালা দিয়ে উড়ে এসেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। জবর ভোজের এমন সুন্দর সুযোগ আর পাব কিনা জানি না। অন্যদিন খাটের ওপর মশারি ঝোলে, সারারাত কেটে যায় মশারির ফাঁক খুঁজতে অথবা মশারির দেওয়ালে ছোট্ট ফুটো খুঁজতে। যদি কোনরকমে ঢুকতে পাই। মশারির চালের দিকে যাওয়া যায় না, এতো হাওয়া! দু একদিন মশারি তুলে বাথরুমে গেলে, সেই ফাঁকেও ঢুকে পড়েছি মশারির ভেতর। যদিও ব্যাপারটা খুব বিপজ্জনক, অনেক সময় এক পেট রক্ত গিলে মশারি থেকে বের হতে না পেরে, সকালবেলায় হাতের চাপড়ে মৃত্যু ঘটে গেছে আমার দু একজন সঙ্গীর। আজ মশারি নেই। তার ওপর দুজন মানুষ একসঙ্গে। যে অবস্থায় আছে, হি হি, আমরা হলে বলতাম মেয়েটা কদিন পরেই ডিম দেবে। মেয়েমানুষগুলো খুব চালাক, ডিম পাড়ে না। বাচ্চাকে পেটের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। খাটের চালে ভাঁজ করা মশারির একধারে বসে দেখতে লাগলাম। আর অপেক্ষায় রইলাম সুযোগের।
ছেলেমানুষটা খালি গা হয়ে গেছে, এবার মেয়ে মানুষটা খালি গা হচ্ছে। খাটের মাথা থেকে গড়িয়ে মেঝেয় পড়ে গেল শরাবিখানা, খাটের মাথার বাজুতে হাসিনাটা লটকাতে লাগল। আর নটখটটা বিছানাতেই পড়ে রইল ওদের পায়ের কাছে। আমি ওদের দুজনকে দেখে মুখ চাপা দিলাম, লজ্জায়। ছি,ছি, এতোটুকু লজ্জা নেই গা, বেহায়া একনম্বরের। হি হি, হি হি হাসির শব্দে আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, আরো কয়েকটা ছুকরিমশা আমার মতোই মশারির চালে বসে বসে সব দেখছে। কি তাদের হাসাহাসি, আর কি তাদের ঢলাঢলি!
কি যে বাপু করছে এই মানুষ জোড়া কে জানে, সেই থেকে জোড় লেগে রয়েছে, তবু ঝুটোপুটির অন্ত নেই। আমাদের বাবা এত কল্লা নেই, উড়তে উড়তেই ছেলেগুলো আমাদের পিঠ খামচে বসে পড়ে, একটু সময় হতে না হতেই মিটে যায় ব্যাপারটা। খিদে পেয়েছে খুব, তবে এই সময় গায়ে বসাও যাবে না, হুটোপুটিতে কোথায় চাপা পড়ে শেষ অব্দি প্রাণটাই খোওয়াব নাকি? তার চেয়ে আরেকটু অপেক্ষা করাই ভালো।
তাছাড়া আমাদের শাস্ত্রেও বলা আছে এই সময়ে কাউকে কোন চোট আঘাত করতে নেই। মানুষদেরই কেউ একজন হোমড়াচোমড়া রাজা বহুদিন আগে এমনই একটা কেলেংকারি করে সারাটা জীবন পস্তেছিল খুব। হয়েছিল কি, বনের মধ্যে একটা হরিণ তার বউকে খুব আদর করছিল। দুজনেরই তখন যাকে বলে বিহ্বল অবস্থা। এদিকে সেই হোমড়াচোমড়া রাজামানুষটা ওই বনেই শিকার করতে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেই জায়গাতেই চলে এসেছে, যে জায়গায় হরিণদুটো ফস্টিনস্টি করছিল। সে মানুষটার আর তর সয় নি, ছুঁড়ে দিল দু দুটো তীর, ব্যস পটল তুলল ছেলে হরিণটাও, মেয়ে হরিণটাও। বেচারারা লক্ষ্যই করে নি কিনা, করলে তো পালিয়ে বাঁচত। সে যাই হোক মরার আগে তারা খুব শাপ দিলে সেই হোমড়াচোমড়াকে। যতোই তুমি হোমড়া হও, হে, সারাজীবন তুমি আর ভালোবাসতে পারবে না। ও মা, সত্যি সত্যি সেই হোমড়াচোমড়া রাজামানুষটা সারা জীবনে কিচ্ছু করতে পারে নি, দু দুটো বউ থাকা সত্ত্বেও। করবে কি তার তো হি হিই হয় না। অন্য লোকে এসে তার দু বউকে ছেলে দিয়ে যেত। সেই থেকে আমাদের মানা, ওই সময় কোন চোট দেওয়া যাবে না, এমনকি হুল ফোটানোও মানা।
মেয়েটা এখন যেরকম ডাকাডাকি করছে, মনে হচ্ছে হয়ে এসেছে। আমি আমার ডানাদু্টো আর হুলটাকে একবার চেক করে নিলাম। বলা যায় না, বয়েস হয়েছে তো, লাস্ট মোমেন্টে হয়তো ডানা দুটো খুলল না, বা দেখলাম হুলটা একটু ভোঁতা হয়ে গেছে। ওদিকে নিচে, যা ভেবেছিলাম তাই, হয়ে গেছে, ছেলেটা মেয়েটার থেকে নেমে পাশে শুল, আর মেয়েটা ছেলেটার বুকে মাথা রাখল। দুজনে খুব আরাম করে সুখশয্যায় শুয়ে চোখ বুজল। আমি এবং আমার দেখাদেখি অন্যরাও একসঙ্গে নেমে এলাম, ভাগাভাগি করে বসে পড়লাম ওদের গায়ে।
মণিমালার কদিন ধরেই খুব জ্বর। প্রথমে মনে হয়েছিল সাধারণ সর্দিজ্বর। তারপর শোনা গেল ভাইরাল ফিভার। ডাক্তারবাবু উল্টে পাল্টে নানান অ্যান্টিবায়োটিক আর প্যারাসিটেমল ট্রাই করেও জ্বরতো ছাড়লই না, দিন দিন দুর্বল হয়ে অবস্থা ক্রিটিক্যাল হয়ে উঠতে লাগল। ডাক্তার প্রেসক্রাইব করলেন, ব্লাড টেস্ট করানোর জন্যে। ব্লাড রিপোর্টে পাওয়া গেল প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের প্যারাসাইট। অর্থাৎ ম্যালেরিয়া, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। অ্যাডমিট করে দেওয়া হল স্বাস্থ্যরক্ষা ডায়াগ্নস্টিক এণ্ড রিসার্চ সেন্টারে।
দিন কতক খুব যমে মানুষে টানা পোড়েনের পর, মণিমালা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করল। সবাই বলল মণিমালা নিখাদ সতী, জলজ্যান্ত স্বামী রেখে, হাতের শাঁখানোয়া, সিঁথিতে ডগডগে টুকটুকি সিঁদুর নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে স্বর্গে চলে গেছে। টুকটুকি অলক্তক রাগে রাঙানো তার দুই রাতুল চরণের ছাপ সাদা কাগজে তুলে নিল সকলে। শ্রাদ্ধের দিন ফ্রেমে বাঁধাই হয়ে বাসরে রাখা হল সেই চরণ চিহ্ণ। তার ওপরে লেখা, তোমা বিনা সংসার নিদারুণ শূণ্য আর নিচেয় লেখা সংসার ভরে দিলে সাধ্বীর পুণ্য। সুকান্তর ক্লাস নাইনে পড়া ডেঁপো ভাগ্নের এমন কাব্য প্রতিভা সকলকে অবাক করে দিল।
মণিমালা খুবই ভাগ্যবতী তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে না মরে যদি আজ সুকান্ত মারা যেত, তার কপালে অশেষ দুঃখ ছিল। পাড়া প্রতিবেশীরা চোখ গোলগোল করে, গালে আঙুল ঠেকিয়ে বলত, যেদিনই ও বউ হয়ে এ বাড়িতে ঢু্কেছে সেদিনই আমি বুয়েছিলাম গো দিদি, এ রাক্কুসী আমাদের সুকুকে গিলে খেতে এয়েচে। তুমি সরল মনের মানুষ দিদি, মনে কোন ঘোরপ্যাঁচ নেই। ওর বুকের গড়ন দেখেচ? আর পাছা? সব ডাইনীর লক্ষণ, থা নইলে আমাদের সুকু, অমন ডাকাবুকো স্বাস্থ্য, বেঘোরে প্রাণ দেয়? মায়ের কোল এমন করে খালি করে দিতে আছে, রে পোড়ারমুকি। অশ্রুহীন চোখের জল মুছতে আঁচলে মুখ ঢাকত সেই প্রতিবেশী। সেই বিদ্যাসাগরও নেই এবং তাঁর বিধবা-বিবাহ অ্যালাউন্সও নেই, মণিমালার চট করে বিয়ে হওয়াও মুশকিল হত। মাঝের থেকে বেশ কিছু ছুঁচকো লোকের আনাগোনা বাড়ত, তাকে ফুঁসলে নির্দায় ফস্টিনস্টি সারার ধান্দায়।
মণিমালার মৃত্যুটা সুকান্তর বুকে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে দিল। বহুদিন আগে শরৎ চাটুজ্জের এক মুকুজ্জে হিরোর ধারা অনুসরণ করে, সুকান্ত রোজ সন্ধ্যেবেলা সস্তা বারের এক কোণায় এসে জুটতে লাগল। তার সঙ্গী হল গ্রীণ লিওর হাল্কা সবুজ ৭৫০ মিলির বোতল। আগে যাদের সে সযত্নে এড়িয়ে চলত, সেই সেব মদ্যপ বন্ধুরা এখন তার নিত্যসঙ্গী ও প্রাণের দোসর। সারাদিন বাবা-মা, বন্ধুবান্ধবের, আবার বিয়ে করে নতুন সংসার পাতার সদুপদেশে তার কানপাতা দায় হয়ে উঠেছে। তার এই সব ফিরে পাওয়া বন্ধুরা ঠিক তার উল্টো। তারা বলেছিল, তার এই প্রেম যে অমর এবং মণিমালা মারা গেলেও, তার আত্তাঁ নাকি আত্মা, তার এই অমর প্রেমের নিত্যসঙ্গী হয়ে তার পাশটিতেই থাকবে। তবে এই আত্তাঁকে আগলে রাখতে, একটু যত্নআত্তি করতে হবে। সেটা কী রকম? তার এই প্রেম যেন একটি ছোট্ট চারাগাছ। একে নিত্য গ্রীন লিও সিঞ্চনে, বাড়িয়ে মহীরূহে পরিণত করাই এখন সুকান্তর নিত্যব্রত হওয়া উচিৎ। আর এই ব্রতপালনে তার বন্ধুরা সানন্দে নিত্যসঙ্গী হতে রাজি।
মাস ছয়েক পর এক রোববার তার জেঠতুতো বোন আর মা, সুকান্তর ঘুম ভাঙালো একটা মেয়ের ছবি দেখিয়ে। অনেকটা মণিমালার মতো দেখতে। ঘুমভাঙা চোখে তার মন্দ লাগল না। কিন্তু মণিমালাকে সে কী করে ভুলে যাবে? সে মাকে বলল, পাষাণী। বোনকে বলল, নারদ-বুড়ি, আমাদের দাম্পত্যে ভাঙন ধরাতে এসেছিস? মা আর বোন রাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, বিছানায় ফেলে গেল প্রায়-মণিমালার ছবি। ওরা বেরিয়ে যেতে ছবিটা হাতে নিয়ে মন দিয়ে দেখল সুকান্ত। নাঃ, বিয়ে যদি করতেই হয় এই মেয়েকে নয়। এক মণিমালা থাকবে তার বুকের ভেতর, আর বাইরে ঘুরবে আরেক প্রায়-মণিমালা, এ অসম্ভব। ছবি রেখে সুকান্ত উঠে পড়ল।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে নারদ-বুড়ি বোন ল্যাপটপে সাতপাক.কম খুলে মেয়ে দেখছিল। সুকান্তকে দেখে রাগে দুমদুম পায়ের শব্দে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। ল্যাপটপের পর্দায় একের পর এক সুন্দরীর ছবি আসতে লাগল লাগাতার। আড়চোখে সুকান্ত দেখতে লাগল আর খেতে লাগল। বাটার টোস্ট, কলা, অমলেট আর চা। আনমনে অমলেটের আধখানা খেয়ে ফেলার পর সুকান্ত মাকে খুব ধমকাল। মণিমালা মারা যাওয়া্র পর থেকে সে নিরিমিষ খাচ্ছিল। তার কথা হল, বাবা নেই - তাই তুমি তো নিরিমিষ খাও। মণি না মরে আমি মরে গেলে, মণিকেও তুমি নিরিমিষ খাওয়া বিধবা বানাতে। তাহলে আমিই বা ডিম-মাছ-মাংস খাই কোন মুখে? এটা যে তার নারদ-বুড়ি বোনের কারসাজি, বুঝতে তার বাকি রইল না। তবে বহুদিন পর অমলেটটা তার বেশ লাগল, কিন্তু পুরোটা খেল না, একটুখানি ফেলে রাখল প্লেটে। অমলেট নিয়ে মাকে ধমকানোর সময়, অনেকগুলি মেয়ের ছবি মিস হয়ে গিয়েছিল। আশে পাশে কেউ নেই দেখে, সুকান্ত ফটো ফাইলটা রিওয়াইন্ড করে দেখতে দেখতে চায়ে চুমুক দিল। নারদবুড়ি বোনের খিক খিক হাসির আওয়াজটা তার কানে এলেও, ওটাকে গুরুত্ত্ব দেওয়াটা কোন কাজের কথা নয়, বলেই তার মনে হল।
মিলেনিয়াম পার্কে মুক্তামালার হাত ধরে সুকান্ত সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে যখন একটা জুতসই গানের কলি মনে করার চেষ্টা করছিল, মুক্তামালা জিগ্যেস করল, মণিমালাদিকে, তুমি মিস করো না? করতাম, ভীষণ করতাম। তুমি যেদিন থেকে আমার জীবনে ল্যাণ্ড করেছ, তাকে মুক্তি দিয়ে দিলাম। পার্থিব মায়ার বাঁধনে বিদেহী আত্মাকে বেঁধে রাখার কোন মানে হয় না, জানো? শুনেছি, মণিমালাদি হেব্বি সুন্দরী ছিল। কে বলেছে তোমায় জানিনা, তার চোখের দোষ আছে নিশ্চয়ই। তুমি ভাববে তোমায় গ্যাস খাওয়াচ্ছি, কিন্তু বাস্তব হল, তোমার কাছে, সে একদম তুচ্ছ। কাকের পিঠে যেন ময়ুরের পুচ্ছ! আমি যদি বিয়ের পর মরে যাই, রতনমালাকেও এইরকমই বলবে? রতনমালা কে? তোমার পরের বউ। তুমি নাকি সাতপাক.কম থেকে পনের পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট পেয়েছ? তোমার আর মণিমালাদির মধ্যে নাকি কোন সম্পর্কই তৈরি হয়নি, নামমাত্র বিবাহ - মণিমালাদি খুব অসুস্থ ছিল, না? ভীষণ, বিয়ের আগে তো বোঝা যায় নি। বিয়ের পর খালি বলত জ্বর, মাথা ব্যথা, কোমরে ব্যথা। বেচারা খুব রুগ্ন ছিল। ওসব দুঃখের কথা এখন ছাড়ো তো। আমাদের নতুন জীবন নিয়ে, এসো ভাবি। ডিসেম্বরের আঠাশ তারিখ আমাদের বিয়ের দিন ঠিক করছি, ওসময় ছুটি পেতে অসুবিধে হবে না। ওইসময় স্কুল কলেজেও ছুটিই থাকে, তোমার কি মত? ওসব আমি জানিনা, আমি বাপিকে গিয়ে বলব, বাপি তোমার সঙ্গে কথা বলে নেবে।
মুক্তামালার বাবা ফোনে কথা বললেন সুকান্তর মায়ের সঙ্গে, দিন স্থির হয়ে গেল ওই আঠাশে ডিসেম্বরেই। সুকান্তর মা সেদিনই বুক করে দিলেন সদানন্দ ভবন। সুকান্তকে এখন গুণে গুনে ১৮৫টা দিন পার করতে হবে। নারদ-বুড়ি বোনের সঙ্গে সুকান্তর এখন আবার খুব ভাব। সুকান্তর মা তার হাতেই তুলে দিয়েছেন বিয়ের যাবতীয় কেনাকাটার দায়িত্ব। প্রায় প্রত্যেক শনিবারেই নারদ-বুড়ি বোন, মুক্তামালা আর সুকান্ত, রমণীয় বস্ত্র বিপণিতে শাড়ি, জামা কাপড় পছন্দ করতে যাচ্ছে। কনে্র জন্যে আর তত্ত্বের জন্যে কেনা হচ্ছে অনেক শরাবী, হাসিনা আর নটখট। তত্ত্বে দেওয়ার জন্যে টুকটুকির সিন্দুর আর তরল আলতাও অনেক কেনা হল। কিছুদিন আগে মোবাইলের সিমকার্ড বদলে সে নতুন নাম্বার নিয়েছে, তার সেই মদ্যপ দোসরদের এড়াতে। একটু খালি হওয়া গ্রীন লিওর ৭৫০ মিলির বোতলটা দিয়ে দিয়েছিল জমাদার ঝড়ু সিংকে। বলেছিল টয়লেট সাফ করার অ্যাসিড। রাত্রে ঝড়ু সিং তার বস্তিতে বিবির সঙ্গে ঝগড়া করে সুইসাইড করতে গিয়েছিল, অনেকটা গ্রীন লিও খেয়ে। কিন্তু গ্রিন লিওতে সেতো মরেই নি। বরং পরের দিন এসে সুকান্তকে বলেছিল ওইসান বোতল আওর চাহিয়ে, বাবু, টয়লেট একদম চকাচক হো যাতা হ্যায়।
মুক্তামালার সঙ্গে অনেক তর্ক-মান-অভিমানের পর মধুচন্দ্রিমা যাওয়ার লোকেশনও ঠিক হয়ে গেল। পটায়া। বাসি বিয়ে সেরেই টাটকা হানিমুনে যাওয়ার ডেট ঠিক হল ৪ঠা জানুয়ারি। ওইসময় পটায়ায় ঠাণ্ডা কেমন পরে। কতটা পরে। কলকাতার শীতের মতো, নাকি বেশি। নাকি কম। নাকি একদম না। সেইমতো তৈরি করতে হবে ড্রেস কোড। গুগ্ল্ খুঁজে পাওয়া গেল অনেক তথ্য। ডিসেম্বর জানুয়ারিতে ম্যাক্সিমাম ২৯ থেকে ৩১ আর মিনিমাম ২২-২৩ ডিগ্রী। মুক্তামালা বলল সেন্টিগ্রেড না ফারেনহাইট? সেন্টিগ্রেড। খুব একটা ঠাণ্ডা নয়, যদি একটু আধটু লাগেও, তুমি তো রয়েছ, মুক্তা। আমি কি করবো? বারে, তুমিই তো করবে। একে তো দেশটা থাইল্যাণ্ড, ওদেশে ল্যান্ড করে কাছে যদি পাই, তোমার থাই। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মুক্তামালা বলল, পিজে, এনজে। মানে? পচা জোক, নোংরা জোক, আনলাইক।
মুক্তামালার সঙ্গে কনসাল্ট করে, সুকান্ত আর তার নারদ-বুড়ি বোন মেনু ঠিক করে ফেলল। কাশ্মীরি আলুর কোপ্তা, আনারসের মেক্সিক্যান স্যালাড, চিকেন পনীর রোল, নান, জিরা রাইস, রুই মাছের ওরেটা আল ফার্নো, পাঁঠার নুইয়া পিং, আলুবোখরার চাটনি, সাবুরপাঁপড়, রসগোল্লা, লেবুর ফালি ভাসানো হাত ধোবার গরম জল, ভ্যানিলা আইসক্রিম, চিনিমোড়া রঙিন মৌরির পাউচ, টুথপিক। বউভাতের নিমন্ত্রিতের দল আধপেটা খেয়ে, গিফটের আবর্জনা ঢেলে দিয়ে সবাই চলে গেল ভূরিভোজের ভূয়সী প্রশংসা করতে করতে। বাড়ির লোকজনরা সবাই মিলে খেতে বসল। সুকান্তর নারদ-বুড়ি বোন আর তার বর ক্যাটারারকে আগেই বলে রেখেছিল, ভাত রুই মাছের কালিয়া আর পাঁঠার কালিয়া ছাড়া কিছুই খেল না। বোন বলল, যাই বলিস তুই দাদা, তোর ওই মালয়েশিয়ান, ইটালিয়ান ডিশের চেয়ে এই বেশ ভালো খেলাম। কেউ কিছু বলল না, লোলুপ দৃষ্টিতে তাদের খাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল অন্য সবাই।
বউভাতের সব অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার পর মুক্তামালা ফুলসজ্জিত শোবার ঘরে ঢুকেই চালু করে দিল মশ-কিল, মসকুইটো রিপেল্যান্ট। বিছানা থেকে ফুলের পাপড়ি ঝেড়ে ফেলে মশারি টাঙিয়ে নিল চটপট। বিছানার তিনদিকে মশারি গুঁজে নিয়ে, সুকান্তকে ডাকল, খাটে উঠে পড়ো, সাবধানে, একটাও মশা যেন না ঢোকে। বাধ্য ছেলের মতো সুকান্ত মশারির মধ্যে ঢোকার পর বলল, মশ-কিলতো চলছে, মশারি টাঙানোর দরকার ছিল? মুক্তামালা কোন উত্তর দিল না, ঢোকার দিকের মশারি গুঁজে, ভেতরে মুখ উঁচু করে দেখতে লাগল, মশারির মধ্যে কোন মশা ঢুকেছে কিনা। নিশ্চিত হয়ে বলল, প্রথমদিন দেখিয়ে দিলাম, কাল থেকে মশারি গুঁজে মশা চেক করবে তুমি।
একদল মশা মশ-কিলের গন্ধ সত্ত্বেও আড়চোখে ওটার দিকে তাকাতে তাকাতে, নাক চিপে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। মশারির বাইরে পাঁচ দিক ঘুরেও তারা না পেল কোন ফুটো, না পেল কোন ফাঁক, যেখান দিয়ে ঢুকে পড়া সম্ভব। হয়রান হয়ে আবার জানালা দিয়ে বেরিয়ে জানালার পাল্লায় বসে সকলে দম নিতে লাগল। সবচেয়ে বুড়ি মশাটা তার আবার হাঁপানির টান, বেশ খানিকক্ষণ দম নিয়ে বলল, এই বয়সে এত হয়রানি আর পোষায় না, বাপু। এর জন্যে দায়ী তো আমরাই। সে কি রকম? আজ থেকে প্রায় সতের পুরুষ আগে, আমার এক ঠাকুমার হুলের খোঁচায় এ বাড়ির পেতম বউ ম্যালোরি হয়ে মরে গেছিল, সেই থেকে মানুষগুলো খুব সেয়ানা হয়ে গেছে! লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুড়ি মশা আবার বলল, মানুষরা বাঁচে বছরে, আর আমরা ঘণ্টায়। চল চল, খিদে পেয়েছে খুব, অন্য কোথাও দেখি। মিহিন পাখনা মেলে উড়ে গেল মশাদের দলটা।