বিজ্ঞাপণ
হয়তো আর কয়েক দশক বাদে,
চারিদিক ছেয়ে যাবে বিজ্ঞাপনে,
এখনের থেকেও বেশি,অনেক অনেক বেশি,
প্রতিটা ঘরের দেওয়াল, রাস্তার পিচ,কংক্রিট বা মাটি কেউ বাদ যাবে না,
বইয়ের পাতায় ফাঁকা অংশ,
টাঁকলার টাঁক, লোমহীন বুক হাত পা,
জামার কাপড় বিজ্ঞাপনে ভর্তি হবে,
সাদা জামার দাম হবে বেশি,
আর বিক্রির জিনিস,সে তো ইজ্জত থেকে শুরু করে আলপিন-চিনির দানা,সওওব বিক্রি হবে,
মানুষের বিবেক,দয়া, মায়া এসবের দাম সবচেয়ে কম হবে,
মরার পরে লাশও বিক্রি করবে আত্মীয়,
দুটো টাকা বেশি পেলে,না কেনা গ্যাজেটটা কিনে নেবে হয়তো,
লাশ তো সেই পচেই যাবে!
বীর জাতির প্রতিনিধি
আমার মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হয়ে যাওয়ার পরেও,
যখন আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম প্রকাশ্য রাজপথে,
ওদের কয়েকজন আমায় চিনতে পেরেছিল,
কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেনি।
কি করে এমন দুর্বল জাতির এত বড়ো বুকের পাটা হতে পারে!
কিন্তু ওরা আমাদের ইতিহাস জানে না।
ওরা তো ক্লাস ফাঁকি দেয়।
আমরাই যে কত সাম্রাজ্যের ভীত নড়িয়ে দিয়েছিলাম আগে,
আমরাই যে সারা পৃথিবী দখল করেছিলাম,
ওরা জানে না তাই।
আর সেজন্যই ওরা আমাদের ফেলনা ভেবেছিল।
আমি আবার ওদের চোখে আঙুল আর বুকে ভয় ধরিয়ে দিয়ে দেখাতে চাই,
সেই বীরের রক্ত ঘুমিয়ে ছিল,
শুকিয়ে যায়নি।
আবার দখল নিতে পারি সব,
এতদিন নিইনি, বিশ্বাস ছিল তোমাদের প্রতি।
এবার আগুনের শিখা জ্বেলে সব শোধন করে নেব,
চিন্তা নেই।
ছোটলোকের অশ্লীল প্রশ্ন
আমি আগে কোনোদিন পাকা রাস্তা দেখিনি,
আজ যখন গ্রাম ছেড়ে এলাম,
বর্ষার কাদায় আমার পা দুখানা হাঁটু পর্যন্ত বুট দিয়ে ঢাকা,
রাস্তার ধারে লয়ানে পা ধুয়ে যখন রাস্তায় উঠলাম-
মনে যে কি বিশাল স্বস্তি পেলাম সে বলে বোঝানোর নয়।
আমি বুঝতে পারলাম আমি কত কষ্টে ছিলাম।
আমার গ্রামে ইস্কুল ছিল না,
প্রতিদিন চোদ্দ কিলোমিটার হেঁটে গেলে বন দিয়ে,
তবে ইস্কুল ছিল একটা,
তাও তাতে একটি মাত্র মাস্টার,
সে সর্বহাটের কাঁঠালি কলা,
জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব করে।
এখানে এসে দেখলাম ঘরের গাঙ দেয়ালে স্কুল,
সকাল বেলা গাড়ি যায় আনতে ছেলেদের,
আবার দিয়ে আসে পড়া হলে,
আমি বুঝতে পেরেছিলাম,
দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মানে কী।
এখানে ঘরের গায়ে ঘর,
সব পাকার।
কত কামরা,
লোকশূণ্য পড়ে আছে,
কেউ থাকে না।
ঘরের নীচে দোকান,তবু নাকি সব্জিও ঘরে দিয়ে যায়।
খাবার রাঁধতেও হয় না।
ঘরে কলের জল,
রান্না হয়,হাঁড়ি কালি হয় না।
এসব আমার কাছে স্বপ্ন।
আমি মাধ্যমিক দেওয়ার আগে বাস দেখিনি,
যখন দেখলাম পনের কিলোমিটার দশ মিনিটে যাওয়া যায়,
বুঝতে পারলাম আমি কত সময় নষ্ট করেছি।
বড় শহরের এসে দেখি,
এখানে মিনিটে মিনিটে বাস,
তবু লোকে ছটফট করে।
যখন গ্রামে ছিলাম,
বুঝতেও পারিনি কাকে সুবিধা বলে।
সবই স্বাভাবিক মনে হত।
ভোটের সময় বাবুরা এসে মদ মাংস দিয়ে বলে যেত,"ভোট আমাকেই দিবি কিন্তু!"
বিশ্বস্ত কুকুরের মতো লেজ নেড়ে হাসিমুখে বলতাম,"হ্যাঁ বাবু।"
তখন জানতাম না ভোটের বদলে-
ঘরের কাছে ইস্কুল,
চওড়া রাস্তা,
ইস্কুলে মাস্টার
সব পাওয়া যায়।
ভাবতাম,"ভোটের সময় যদি বন ভেঙে গাড়ি আমার ঘরের উঠোনে আসতে পারে,
তাহলে হাসপাতালে কেন বলে রাস্তা খারাপ তাই এম্বুলেন্স যাবে না?"
আমি সব স্বাভাবিক ভাবতাম।
ভাগ্যকে দোষ দিতাম রোজ,
ভগবানকে শাপ,শাপান্ত করত আমার ঠাকুমা,
আমার মা চুপচাপ গোরু-গাধার মতো খাটত।
আমি বুঝতে পারতাম না,
বাবুরা এসে বন সাফ করে দিলেও কেউ কিচ্ছু বলে না,
কিন্তু আমি সেবারে কাঠ কুড়াতে গেলে কেন পুলিশ নিয়ে গিয়ে জেলে ভরে রেখেছিল,
পিটিয়ে আমার পা ভেঙে দিয়েছিল?
আমি এখনো ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারি না।
আমি ভেবেছি জিজ্ঞেস করব,
আমারই কি তাহলে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক?
সবার ভোটের যদি সমান মূল্য হয়,
তাহলে সবাই সমান সুবিধা পাবে না কেন?
কিন্তু বাবুরা ধমক দেয় যে!
ভয় লাগে।
নিষিদ্ধ
এই কদিন যখনই হাত চলে যায় পেছনদিকে,প্যান্টের ভেতর,
আমি পরিষ্কার একটা বাড়তি প্রবর্ধকের অস্তিত্ব বুঝতে পারি।
প্রথম যেদিন আবিষ্কার করি,বেশ চমকে উঠেছিলাম।
অনুভূতির যে ধারা বয়ে গিয়েছিল,তাতে ভয়ের অনুপাত ছিল সবচেয়ে বেশি।
তারপর থেকে ধীরে ধীরে মেনে নিতে আরম্ভ করি।
আয়নায় দেখার চেষ্টা করেছি কয়েকবার,
একবারও দেখতে পাইনি।
ভালোই হয়েছে।
নইলে লন মোয়ারদের পিয়ার প্রেসারে পড়ে হাস্যাম্পদ হতে হতো।
তবে আলোর অভাব হলে কিংবা পোষাকের আড়ালে-
ভালোই জানান দেয়,"আমি আছি।"
আমিও এখন উপভোগ করি লাঙ্গুলের সাথে আঙুলের ছোঁয়াছুঁয়ি,লুকোচুরি।
আমার বাঁদরামি বেড়ে গেছে;
বুঝতে পারছি আমি।
খুব যে খারাপ লাগছে তা নয়!
তবু ধরা পড়ে অপদস্থ হতে হয় পাছে,
তাই কাউকে জানাইনি।
আমি জানতাম কেও জানে না এসব!
সেদিন নারদ এসে বলল,"তোমার কী ব্যাপার বলতো!"
গৃহীসন্ন্যাসী
এভাবে বহুদূর চলে যাওয়া যায়,
সীমানাগুলো সব পেরিয়ে,দিগন্তের কাছাকাছি।
কেন যাব জানি না,
এতদূর যে এসেছি,এটাও তো হিসেব না করেই এসেছি,
ভালো লেগেছে বলে,
কিংবা আমার চারিদিক,
(যেটা আছে আর কি!)
ভালো লাগেনি বলে।
এক কথায় পালিয়ে এসেছি আমি।
তবে আমার খোঁজ পড়েনি এজন্য।
পড়ে না।
কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ওরা জানে,
আমি আবার ফিরে যাব।
যদি এখন উধাও হয়ে যাওয়া যায়!
খুব একটা খারাপ হবে না কিন্তু!
কিন্তু আমার কোমরে অদৃশ্য শিকলে বাঁধা আছে -
মায়া, মোহ, ভালোবাসা, দায়িত্ব, কর্তব্য.....
এসব লোহা।
চুম্বক আছে একখানা,
আমার গন্ডির মধ্যে,
বিভিন্ন জায়গায়,
প্রয়োজনমতো চালু করে,
তড়িৎচুম্বক তো!
আমি ফিরতি পথ ধরি,
কেউ সুইচ দিয়েছে চুম্বকে।
আদিমতম প্রবৃত্তি
সব যখন ছেড়ে গেল,
শুধু আমি বসে রইলুম,
আমার অবশিষ্ট শরীর আর মুক্তি উন্মুখ আত্মা নিয়ে,
যে কটা কাক বসে ছিল,
তারাও চলে গেল,
আবার কালকে আসবে বলে গেল -
যদি মরি!
কিন্তু আমি আর একটু বাঁচতে চেষ্টা করছি,
যদি আর একবার শ্বাস নেওয়া যায়,
এই শেষবার বলে কতবার বললাম!
আমি বড্ড আস্তিক হয়ে যাচ্ছি,
বড্ড হাহাকার প্রাণে।
মায়া পড়ে গেছে,
কিন্তু কার উপর,কাদের উপর?
সবাই তো গেছে ছেড়ে,
আমি এখন আমার নিজের মল মেখে পড়ে আছি,
বেশ আশ্চর্য লাগে,
এগুলো (পেচ্ছাব-পায়খানা) বন্ধ হয়নি কিন্তু!
আমি তবু বাঁচতে চাই,
কোনো কারণ ছাড়াই,
কারণ এটা আমার অধিকার,
এটাই একমাত্র প্রতিবর্ত,
যা সেই প্রথম কোয়াসারভেটেরও ছিল।
আমি তো তারই বংশধর।
নৈতিকতা
তোমার গরু-ছাগল মারলে খারাপ লাগে,
কিন্তু গাছ কাটলে কেন লাগে না?
মানুষের জন্য যদি হিউম্যান রাইটস থাকে,
তবে বাকি প্রাণীরা কী করল?
মানুষ আত্মহত্যা করলেও দোষী ঠাউরানো হয় কাউকে,
তবে পিঁপড়ে, মশা, আরশোলা খুন করার জন্য যে বিজ্ঞাপণ দেওয়া হয়,
সেগুলোর কেউ প্রতিবাদ করে না কেন?
তামাকের, মদের বিজ্ঞাপণ যদি বন্ধ হয়,
তবে ইনসেক্টিসাইডের ব্যবহার কেন বন্ধ হয় না?
সবকিছু কি মানুষের উপকারের কথা বলে ন্যায়সঙ্গত করে ফেলা যায়?
পৃথিবীটা কী শুধু মানুষের তবে!
বাকিদের বাঁচার অধিকার কি তখনই থাকবে,
যখন তাদের বেঁচে থাকা মানুষের জন্য লাভজনক হবে?
যদি মানুষকে বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য না করা যায়,
তবে কেন গরু, ছাগল, কুকুরদের যৌনমিলনে বাধ্য করা হবে!
শুধু একথা বলেই কি পার পাওয়া যায়,
"মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব।সবকিছু মানুষের জন্যই।"
আজ যদি পৃথিবীতে হঠাৎ অন্য কোনো প্রজাতি সর্বশ্রেষ্ঠ হয়ে যায়,
তারাও কি আমাদের সাথে এভাবেই ব্যবহার করার অধিকার পাবে?
নাকি তখন আবার অন্য নিয়ম লাগু হবে;
যাতে মানুষের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে?
কালরাত্রি
কি জানি কেন,
আজকের রাতটা ঠিক স্বাভাবিক নয়!
পাখিদের ডাক চড়া,
আকাশে চাঁদ না থাকা সত্ত্বেও যেন ঠিক অন্ধকার নয়,
গাছগুলোও ঠিক করে উঠতে পারছে না,
হাওয়া বওয়ানো উচিত, নাকি ঘামিয়ে মারা?
ওরা সবাই অন্ধকারে প্রশ্নচিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
দূরে পুকুর পেরিয়ে যে ঘরটা দেখা যায়,
সেটা আজকে আবছায়ায় আধো দৃশ্যমান,
কিন্তু চোখে খুব আপত্তিকর ঠেকছে না তো!
মনে হচ্ছে, আজ যেন কেউ পুরোপুরি শোয়নি,
শুধু ভান করছে ঘুমিয়ে পড়েছে যেন,
আমি চারিদিকে দ্রুত কিন্তু সতর্ক হৃদস্পন্দন শুনতে পারছি,
ঘুমালে এমনটা হয়না।
এমনকি পাখিগুলো চঞ্চল,
ঘরের চারিদিকে নিশাচর প্রাণীদের যাওয়া আসা টের পাচ্ছি,
ক্লান্ত গোরু, ছাগল, মুরগি ওরাও ঘুমোতে পারছে না,
কিসের অপেক্ষা করছে ওরা জানি না,
আমিও ঘুমোতে পারছি না,
যদিও জানি না কেন!
ঈশ্বরের ব্যাপারে
হয়তো আমি এখনো ঈশ্বরের কাছে যেতে পারিনি,
চেষ্টাই করিনি তো!
প্রতিদিন ঈশ্বরের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও আমি মোক্ষ নিইনি হাত পেতে,
ঈশ্বরের ইগো বড্ড বেশি,
তাই সে আমাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও মুক্তির অমৃত দেয়নি।
ভালোবাসে সে আমায় সন্দেহ নেই,
কিন্তু অধোশির চায় আমায়,
আমি জানিও না তার এই মনোকামনা,
তাই আমি মাথা ঝুঁকাইনি কোনোদিন।
মুখে বলেনি;কিন্তু কাগজে লিখে,অন্যের মুখ দিয়ে বলিয়েছে বারবার,
আমি আমল দিইনি,
কাগজে কিংবা লোকমুখে কি সেই আবেগ থাকে?
তাই আমি মুক্তি পাইনি।
সবাই আমাকে নাস্তিক বলে।
কিন্তু ওরা আমার মনোজগতে উঁকি মেরে দেখার শ্রমটুকু করে না।
আমিও তো বিশ্বাস করতে চাই,
পিচ্ছিল এই ধরায় আমিও খুঁটি চাই,
চাই এক টুকরো ঘাসে ঢাকা ডাঙ্গা।
কিন্তু চারিদিকে যদি ভাসমান দ্বীপ থাকে,
আমি আশ্রয় নিয়ে প্রতিবার,
যদি নিজেকে প্রতারিত অনুভব করি,
তবে কি করে আমি বিশ্বাস করব আবার?
ভিত বলে কিছু আছে তাই বা কি করে মানব,
যখন আমি দেখিইনি কখনো তা!
ঘর ও গন্ধ
যাদের ঘরের আঙিনা ছোট,
রোদ পড়ে না সেখানে,
ঘর স্যাঁতসেঁতে থাকে,
বাতাস খেলে না ঠিক,
যদি জানালা না খোলা থাকে।
আমার আঙিনাহীন দেহ,
আমি বহুতল ফ্ল্যাটের টবের চারা,
আমার বৃদ্ধি ওই ঘরের আলোর মতোই,
কৃত্রিম, ফ্যাকাশে, পুষ্টিহীন, চকচকে।
আমি মাটি কেমন দেখিনি,
আমার গায়ের চামড়া স্বাভাবিক নয়।
ডাক্তার বলে ভিটামিন ডি আর এ কম।
আমি জানি আমার দেহ আঙিনাহীন,
তাই হাওয়া-বাতাস খেলে না।
আমি কৃত্রিম।
ঘরের গন্ধ
প্রতিটা ঘরের একটা আলাদা গন্ধ আছে,
সেটা সেই ঘরের লোকে হয়তো বুঝতে পারে না,
কিন্তু আমি পারি,
আর পারে,যারা ওই ঘরের বাসিন্দা নয়।
এই গন্ধ ওই ঘরের লোক,
ঝরে পড়া পানির পরিমাণ,
আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা কীট-পতঙ্গ,
এমনকি ঘরের আয়তন,
বাতাস সবাই মিলে নির্ধারণ করে।
প্রতিদিন পাল্টে যায় একটু,
কিন্তু তাতেও মিল থাকে আগের দিনের সাথে।
তখন মনে হয়,
ঘরটা মানুষের মতো।
ওরও নিজস্ব সত্ত্বা আছে,
ওরও প্রাণ আছে হয়তো,
আমরা জানতে পারিনি।
ও কী খায়?
মানুষের প্রাণ?
পুরোনো আর নতুন
এই পথে আমি শত-সহস্রবার গেছি আগে,
আমি এখানের প্রতিটি ইঁট, সিমেন্ট,
এমনকি বালির কণাকেও চিনি,
এই পথের পাশের গাছ আমাকে বেশি ছায়া দেয়,
পথের লোকেরা আমার আত্মীয়।
কখনো আত্মীয়তা দাবি করিনি,
ওটা স্বতঃস্ফূর্ত।
আমি নিশ্চিন্তে যেকোনো ঘরের দরজায় কড়া নাড়তে পারি,
আমার পরিচিত সবাই।
কিন্তু মাঝে এক দশক কেটে গেছে হয়তো,
আমি হিসেবে বড্ড কাঁচা কিনা?
তবে বেশ অনেকদিন, একথা বলতে পারি।
আজকে যখন হেঁটে এলাম,
অনেক নতুন মুখ যোগ হয়েছে রাস্তায়,দরজায়,জানালায়,
দোকানের কাউন্টারে।
ওদের সাথে পুরোনো মুখের আদল মেলে,
কিন্তু তাতে নতুন যুগের পালিশ।
ওদের মুখের অবাক অপরিচিত ভাব বলে দেয়,
আমি বাতিল হয়ে গেছি।
তাই আমি ফিরে যাই কবরস্থানের দিকে,
ওদিকে আমার পরিচিত বেশি।
নতুন যারা, তারাও পুরোনো, চেনা।
ওদের সাথে কথা বলা যাবে না, ঠিক।
কিন্তু ওদের উপস্থিতিও আন্তরিক।
আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারি,
কোনো ক্লান্তি, দ্বিধা বা অপদস্থতা আসে না।
জানি এরা ক্ষমা করে দেবে সব।
এরা আমার নিজের।
প্রেমের মৃত্যুগাথা
যখন আমাদের দুজনের শরীরের প্রীতিটি ভাঁজ চেনা হয়ে যাবে,
যখন বারবার রিভাইজ করে মুখস্থ হয়ে যাব দুজনের কাছে,
তোমার স্তনের বা আমার অন্ডকোষের অসাম্যতা,
তখন আর অজানা থাকবে না,
কথা তখন বড্ড কেজো হয়ে যাবে,
হয়তো রাতের পর রাত আর ঘনিষ্ঠ হব না আমরা,
হাজার দায়িত্বের মাঝে প্রেম চাপা পড়ে যাবে মনের স্টোররুমে,
দরজা খুলতে চেয়েও খোলা হবে না কয়েক বছর,
যদি খুলেও ফেলি,
ময়লা মুছে আবার চর্চা করতে মন যাবে না,
কত কাজ বাকি!
আমরা তখন নিছকই বাবা-মা,কাকা-কাকী, মামা-মামী।
স্বামী-স্ত্রী যে ছিলাম তাও ভুলে যাব।
তারপর একদিন যখন সব দায়িত্ব সারা হবে,
সব ছেড়ে যাবে অখন্ড অবসর দিয়ে,
নিজেদের আবার নিভৃতে পাব আমরা,
কিন্তু তখন বুড়ো হাড়,গলে যাওয়া মাংসপেশী,
অকেজো অঙ্গ আর জাগবে না,
শুধু বেঁচে থাকা সবচেয়ে বড় কাজ হবে,
থিতিয়ে পড়ব আমরা সংসার পুকুরের নীচে,
পাঁক সরিয়ে আর কেউ দেখবে না,
ছেনে দিয়ে পায়ে চলে যাবে,
নতুন পাঁক এসে পড়বে,
আমরা প্রাগৈতিহাসিক হয়ে যাব।
মিষ্টিকথা
রেখে রেখে মিষ্টিখানি,
শেষপাতে খাব বলে,
শেষে আর খাওয়াই হলো না।
জুতোর কাদা পড়ে গেল এসে।
শুরু থেকেই কয়েকবার মনে হয়েছে,
একটা কামড় দিয়েই দিই,
কিন্তু শেষে পুরোটা তারিয়ে তারিয়ে খাব বলে,
রেখে দিয়েছিলাম নিজেকে বঞ্চিত করে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার,
এই পুরো সময়টা ওটা আমাতেই অর্পিত ছিল,
কিন্তু আমি তার যথার্থ ব্যবহার করিনি,
যখন কাদার ছিটে পড়ল,
তখন একটু বাঁকা হাসি কি দেখিনি,
কান্নাও ছিল জানি।
এখন আমি আফসোস করছি,
কিন্তু আমার কিচ্ছু করার নেই,
ফেলে দেওয়া ছাড়া।
আত্মমুগ্ধ জাতির প্রতি
তুমি যে আমকে আম বলো,
সেটা কি সে জানে?
যদি তুমি তাকে আমড়া বলো,
তাতে কি ও রাগ করবে?
নিদেনপক্ষে যদি মিষ্টি না থাকে আর?
তুমি কী করে জানলে,
ওটাকেই কালো বলে?
কী করে বলা যায় আকাশটা নীল?
কেন কমলাটা স্কারলেট রেড নয়?
আমি কী করে বুঝব যেটাকে তুমি হলুদ বলো আমিও সেটাকে হলুদই বুঝি?
তুমি কী নিশ্চিত করে জানো,
আমাদের জানার বাইরে আর কোনো অনুভূতি নেই?
যদি অদৃশ্য অতিবেগুনী, অবলোহিত,
অশ্রাব্য শব্দেতর,শব্দত্তোর তরঙ্গ থাকে,
তবে কেন আর অনুভূতি থাকতে পারে না?
আমি আরো জানতে চাই,
আমার ক্ষুধা দিনদিন বাড়ছে।
যদি তোমাদের কথামতো স্রষ্টা থেকে থাকে,
তবে কিন্তু বেশ সুবিধা হয়।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করে নিতাম সব।
আমার পিপাসা নিবারণ হতো।
জিজ্ঞেস করতাম,
সে কী কী অনুভব করে।
তাহলে নিশ্চয় তার মতো হতে হবে।
তারপর যদি আমি আর তার রূপ না ছাড়ি,
কিংবা হারিয়ে দিই তাকেই?
এটাও তো জানার জিনিস?
আরো অনেক জানার থাকবে তখনও।
তখন কি তোমরা আমাকে স্রষ্টা বা ঈশ্বর মানবে?
যাকে তোমরা ঈশ্বর বলো
প্রতিবারে কেন ঈশ্বর জিতে যায়?
প্রিয়জনের প্রাণ কেড়ে নিলেও ভালো করে,
প্রাণ দিলেও ভালো।
কি করে হতে পারে?
দেশের পর দেশ উজাড় করেও কি করে ভালো হতে পারে?
কি করে গরিবকে দিনের পর দিন অভুক্ত রেখেও ভালো হতে পারে?
তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নাকি পাতাও নড়তে পারে না,
তোমার সমস্ত পুণ্যের দায় তার,
কিন্তু যেই পাপ করলে,
তখন সে ঘাড় সরিয়ে নেবে সুড়ুৎ করে,
সেটা নাকি তোমার দোষ!
কেউ দেখেনি তাকে,
কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই,
তবু সবাই গভীর বিশ্বাস করে,
কেউ ভয়ে, কেউ লোভে, কেউ স্বার্থে।
তার জন্য খুন করতে পারে লোকে,
খুন হতে পারে।
এত ভুলে ভরা চরিত্র, এত চরিত্রহীন, দুশ্চরিত্র;
মানুষ হলে কয়েক লক্ষ বার ফাঁসি হত।
কিন্তু তার হয় না।
প্রচন্ড স্বেচছাচারী, আত্মমগ্ন, স্তুতিপ্রেমী,
কিন্তু তবু নাকি মহান!
সব ধর্মগ্রন্থ পড়ে একটিই নির্যাস পাওয়া যায়,
মানুষকে সে সৃষ্টি করেছে বন্দনার তরে।
কী আত্মপ্রেমী, কল্পনা করা যায়!
এমন জিনিস মহান হতে পারে না,
না হয় থাকতে পারে না।
দ্বিতীয়টাই সম্ভব।
মানুষ নিজের দরকারে বানিয়েছে তারে,
অমন কেউ না।
সভ্যতার আগে, মানুষের ভয়ের সময়ে,
অসহায় মানুষ বানিয়েছিল তাকে,
নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য,
তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে গেছে অহর্নিশ,
পুতুলখেলা করে গেছে,
নিজেদের বানানো নিয়ম অনুসারে।
অমরত্বের পরীক্ষা
আমি ভেবেছি একটা কফিন বানাব।
খুব যে সুদৃশ্য হতে হবে তা নয়,
কিন্তু খুব মজবুত হওয়া দরকার।
ঠিক প্রাণায়ামের মতো খুব ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ে যেমন,
আমি তেমনই ধীরে ধীরে উপভোগ করব জীবনটা,
যেন কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা না আসে কোনোভাবে,
তীব্র দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রনা, সুখ, আনন্দ, প্রাপ্তি কিচ্ছু দরকার নেই।
তাতে জীবন দ্রুতলয়ে চলে,
কম সময়ে অনেকখানি আয়ু ক্ষয়ে যায়।
মনে হয় পাওয়া হয়ে গেল,
বাঁচার জন্য একটা কারণ কমে গেল।
আমি সব আশা-আকাঙ্খা জিইয়ে রাখতে চাই।
যাতে কখনো প্রাপ্তি না এসে বাঁচার ইচ্ছা নিভিয়ে দেয় এক ফুঁয়ে।
আমি এখন থেকেই প্রতিদিন মেপে খাই,
নিয়ম করে ব্যায়াম করি প্রতিদিন,
প্রতিদিন আটঘন্টা ঘুমাই,
একদিনও ভুল হয়নি।
হবেও না কোনদিন।
আমি যে ব্রহ্মার সাথে পাল্লা দিতে চাই।
প্রক্তনের জন্য
তুমি এবার না আসলেও চলবে,
আমি তোমার ছবিখানা দেওয়াল জুড়ে এঁকে ফেলেছি।
যেগুলো তোমার খুঁত ছিল,
সব ঠিক করে নিয়েছি তাতে।
এখন আমার কোনো অভিযোগ নেই।
তুমিও আর অভিযোগ করবে না,
তুমি এখন দেওয়ালবন্দী,
কথা কইতে পারো না।
আমি দেবত্ব দিয়েছি তোমাতে,
তুমি দেবী,উপাস্য আমার এখন।
কিন্তু তোমাকে,রক্তমাংসের মানুষটাকে আমি আর ভালোবাসি না।
তুমি সবসময় চাও,
কিছু না কিছু!
সবসময় তটস্থ থাকতে হয়,
সীমা বাঁধতে হয়।
সমান চিহ্ন বসিয়ে মাঝে,
হিসেব করে খুব,
দুদিক সমান রাখার প্রবল চেষ্টা করতে হয় প্রতিনিয়ত।
আমি হাঁফিয়ে গেছি,
আমি হোঁচট খেয়ে বারবার,
আমার পায়ের সব নখ উঠে গেছে,
সারা গা ক্ষতবিক্ষত।
তাই এখন আর তোমার সান্নিধ্য চাই না,
তুমি না আসলেও চলবে।
নন-ডারউইনিয়ান সমাজ
আমার ঘরের ভাঙা দেওয়াল বেয়ে দুঃখের বুজকুড়ি ওঠে,
চেনা মানুষের কণ্ঠে বলে ওঠে ভাঙা তেপায়া তক্তপোষ,
"তুই শালা অপদার্থ বোকাচোদা!"
যে দেশে হারামজাদা রাজা, রাজার পরিষদে শুয়োরের বাচ্চাদের দাপাদাপি,
বড়লোকের হাতে টাকা দেখলেই সাধারণ মানুষ খানকি হয়ে যায়,
ডেকে ডেকে বলে,"আমার, আমায় চুদে দাও।"
সে দেশে আমি নিজেকে চালাতে পারিনি,
কানা অচল পয়সা!
আমার মা-বাপ,বউও বিনা চিকিৎসায় মরে গেছে,
মরার সময় আমার মা বলেছিল, "বাবা! তুই কিছু করে উঠতে পারলি না!
তোর জন্য আমি সারা জীবন চিন্তায় জর্জরিত,
মরেও শান্তি পাব না।"
শান্তি সে পেয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু আমি একই রয়ে গেছি।
বাপ মরার সময় আমাকে বলেছিল বহু কষ্টে,
"একটু কাছে আয়, একটা কথা বলব।"
কান কাছে নিয়ে যেতেই কামড়ে ধরেছিল কান,
কোনোমতে ছাড়িয়ে নিয়ে যখন এলাম,
এক টুকরো রয়ে গেছে তার মুখে।
দাঁতে দাঁত পিষে বলেছিল, "কুলাঙ্গার!"
আমার বউ যখন মরে তখন সে কোনোরকম নাটক করেনি,
সে জানত আমার স্বরূপ,
তাই কোনো আশা ছিল না আর।
কেউ দেখলে বলতেই পারত না, দৃশ্যটাতে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে।
আমি নিখুঁত স্বামী হওয়ার অভিনয় করে গিয়েছিলাম,
আর ও স্ত্রীর।
শুধু ভাই বেঁচে গেছে,
কারণ সে আমার ভরসায় থাকেনি।
তারপর বহুবছর কেটে গেছে,
আমি বেঁচে গেছি আশ্চর্যজনকভাবে,
যখন নেতা, তার চটিজুতো আর বড়লোকেরা মন্দিরে আর মসজিদে দান করে,
তার উচ্ছিষ্টগুলো খেয়ে আমি টিকে গেছি।
আমি ডারউইনকে বলতে চাই,
"অপদর্থরাও বেঁচে যায় এই সমাজে। এর এইটিই যা ভালো।"
মৃত্যু ও ক্ষয়
সবাই মরে যায় ক্রমে,
শুধু রয়ে যায় নামগুলো,
তাদের ব্যবহার হয়, খ্যাত হলে,
জামাগুলো পরে গরিব-আতুরে,
খোরাকি লাগে না আর,
চোখের কোনের জলও শুকিয়ে যায়,
শুধু নুন পড়ে থাকে শেষে।
ঘরখানি অন্য কেউ ভোগ করে,
সাধের জিনিস পড়ে থাকে আস্তাকুড়ে,
কেউ খোঁজও রাখে না তার,
হঠাৎ অনাথ হয় পোষ্যগুলো,
বাগানের গাছগুলো শুকিয়ে মরে,
প্রেয়সীর জীবনে অন্য কেউ আসে,
মাটিও ভুলে যায় কার অবশেষ,
সূর্য উঠে-ডুবে, বাতাস বয় আগের মতোই,
আবার নতুন প্রাণের কান্না শোনা যায়,
পুরাতন ভোলে লোকে।
২৯শে আষাঢ়,১৪৩১
দুর্গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।
প্রথমে সেটা আমার প্রতিবেশীর ঘর পর্যন্তই বিস্তৃত ছিল,
এখন আমার দোরগোড়ায়,
আমি খুব চেষ্টা করছি যাতে আমার ঘরে না ঢুকতে পারে,
আমি পারফিউম, আগরবাতি, আতর সব ছড়িয়ে দিয়েছি ঘরে,
কিন্তু যেন নরকের আগুনে পুষ্ট দানব এগিয়ে আসছে আমার দিকে,
ও শুধু আমাকে হত্যাই করতে চায় না,
আমার রূহের প্রতিও ও চরম লোভী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
আমি সেই মর্মভেদী দৃষ্টি আমার সারা শরীরে অনুভব করছি।
ও যেকোনো মুহূর্তে ঢুকে পড়তে পারে আমার ঘরে,
পারফিউম, আগরবাতি, আতর-এরা সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করছে,
কিন্তু তারাও বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারবে না,
এবার ও আতরের বুক ফেড়ে দিল,
তার মৃতদেহের উপর পা দিয়ে এগিয়ে এল,
আমি ওর বুকের হাড় ভাঙার মড়মড় শব্দ শুনতে পেলাম,
এবার ওর দুহাতে পারফিউম আর আগরবাতির গলা,
ওরা মৃত্যযন্ত্রনায় ছটফট করছে,
কিন্তু ওর মুখে পৈশাচিক হাসি।
এবার পারফিউম আর আগরবাতি দুজনেই রণে ভঙ্গ দিল।
ওদের দেহ ছুঁড়ে ফেলল দানবটা।
আমি ঘরের এককোণে সিঁটিয়ে বসে আছি,
ও আমার দিকে বেপরোয়া হেসে এগিয়ে এল।
আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম।
সারা শরীরে ওর নোংরা হাতের স্পর্শ পেলাম আমি।
আমার আত্মা টেনে বের করছে ও এখন।
সেই পূতপবিত্র আত্মা।
আমি হারিয়ে গেলাম গহীন,অতল অন্ধকারে।
যেতে যেতে অট্টহাস্য শুনলাম,
আমার দেহহীনতা সত্ত্বেও বুক কেঁপে গেল।
আকাশ দেখা
আমি যতবার আকাশ দেখতে চেয়েছি,
আমার চোখ বেঁধে দিয়েছে ওরা,
বলেছে, "দেখতে নেই। মন বিষিয়ে যায়, মুক্তির নেশা পেয়ে বসে। আর নেশা মানেই খারাপ।"
আমি প্রতিবারেই বিশ্বাস করেছিলাম,
বাধ্য ছিলাম খুব, একান্ত অনুগত।
তারপর একদিন কেউ ছিল না পাশে,
মানা করেনি কেউ.....
আমি ভয়ে ভয়ে মুখ তুলেছিলাম,
চোখ বন্ধ রেখেছিলাম ভয়ে,
তারপর শেষে খুলেই ফেললাম।
দেখলাম বেশ নীল, সুন্দর।
আমার মালিক, সুপ্রিম লেডির মতো উগ্র সুন্দর নয় যদিও,
বুকে কামনার আগুন জ্বালায় না,
তবে মনে শান্তি দেয়।
তারপর আমি ফাঁক পেলেই,প্রতি অবসরে আকাশ দেখতাম।
আমি বিদ্রোহ করলাম শেষে,
ওরা আমার শাস্তি দিল মৃত্যুদণ্ড,
একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হওয়া দরকার অন্যদের কাছে,
যাতে কেউ আর বিদ্রোহ না করে।
কিন্তু ওরা জানে না,
আমি দুচারজনকে সংক্রামিত করে দিয়েছি,
তারা প্রতিদিন আকাশ দেখে।
খ্যাপা
আজ চারিদিকে যেখানে চোখ যায় সবাই বিকারগ্রস্ত,
পাগল, মাতাল, খ্যাপা।
তার মাঝে একজন ডেকে গেল, "ওই খ্যাপা।"
আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, কেউ কোথাও নেই; আমি আর লোকটা ছাড়া,
আমারও কদিন সন্দেহ হচ্ছিল নিজের অবস্থা নিয়ে,
এই যে স্রোতে গা ভাসাতে পারছি না আগের মতো, যুক্তি খুঁজছি,
এসব তো আগে হতো না!
মাস গেল, একটা গোটা বছরও,
রোগ বেড়ে গেল,
ডাক্তার বলল, "এ ব্যাধি দুরারোগ্য।"
আমি আর ভাবিনি চিকিৎসা নিয়ে,
নিজেকে সুস্থ প্রমাণ করতে লাগলাম প্রানপণে,
দল গড়লাম, নাম দিলাম 'অমুক',
দলে দলে লোক যোগ দিল তাতে,
সবাই আমার মতো,
নিজেদের ঘোষণা করলাম সুস্থ বলে,
বললাম, "আমরা সুস্থ মানুষের প্রতিনিধি।"
আগে দল ছিল দুচারটা,
ভক্তপাগল, নেতাপাগল, টাকাপাগল নামে।
এখন আর কেউ খ্যাপা বলে না আমাদের,
এখন সবাই সুস্থ, একটাই দলের সদস্য সবাই।
ডাক্তারের পেশা উঠে গেছে।
দৃশ্যশ্রাব্যরহিতকারীঅতিনিকৃষ্ট কবিতা
মাছরাঙা ভুলে ডাঙ্গা, দাঙ্গা লাগায় জলে,
মাছগুলো মুখ তুলে দিয়ে গালি যায় তলে।
মাছরাঙা শাঁসায়, বলে,
"দেখা হবে ডাঙ্গা পেলে।"
এরপর যদি চাঁদ উঠে বলে,
ভুলে গেছি কাকে বলে জোৎস্না?
হয়রান হোস নাকো,
পেরিয়ে সামনের সাঁকো,
চুপচাপ চলে তুই আয় না!
রাত বেশি হয়নিকো, দেখো দেখো, শেয়ালের দলটা,
ডাকবে বলেই তারা তার বাঁধে সাত তাড়া,
এই দেখ হাত বাড়া, বাড়াবাড়ি রকমের দেরি
হয়ে গেছে আজ, জ্বালতে ও ঘরের ওই আলোটা।
ওরে সুমি ডাক ডাক, ওই যায় আসফাক,
ওর সাথে দরকার, বহু কথা বলা বাকি,
ঝাঁকি ভরে আনবে সে পুঁই শাক।
ডাক আগে, চলে যায়, ডাক ওরে, ও কি?
আজকের কথাগুলো এখানেই শেষ হোক,
যার যা কাজ সেরে সব্বাই ঘরে যাক,
কাল যদি ছন্দ, হয় পছন্দ,
যদি ধরা দেয় সে, জমবে বেবাক।
চাকা
যুগে যুগে, হাজার হাজার বছর ধরে,
সবাই একই কাজ, একই ভাবে বারবার করে যায়।
বসন্ত আসে, তারপরে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত।
শুধু গরম বেশি কম হয়, শীতও,
কোনো বছর বর্ষায় বেশি জল ঝরে।
কিন্তু মানুষ পাল্টায় না।
তার জন্মায়, মরে যায়।
মাঝখানে প্রেমে পড়ে,
প্রতি প্রজন্ম!
বিয়ে করে, মিলিত হয়,
বিয়ে না করেও কখনো।
নিজের অপত্যগুলোকে বুকের রক্ত আর উষ্ণতা দেয়,
সেই কোন কাল থেকে!
আমি যখন সদ্য কিশোর,
রক্তে নিয়মভাঙার নেশা মাথাচাড়া দিয়েছিল,
আমি সব পাল্টে দিতে চেয়েছিলাম।
জানতাম না কী পাল্টাব,
কিন্তু পাল্টাতে চাইতাম সব।
সব নিয়ম, সব প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু নতুন নিয়ম কী লাগু করব?
তাই ভাবতে ভাবতে যৌবন পেরিয়ে গেল,
মধ্যাহ্নে এসে দেখলাম,
আমিও সেই কলুর বলদ,
শেষে চুলে পাক ধরলে,
আমিও হার মানলাম মনে।
কিন্তু মুখে, পুরোনো প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করলাম।
তখন নব কিশোরদের সাথে আমার নিত্য লড়াই,
আমিও হারি না, ওরাও না।
আমার পিছনে অনেক লোক, অনেক অভিজ্ঞতা,
ওদের রক্ত গরম, কিন্তু অনভিজ্ঞ।
শেষে আমি মরার পরে,
ওরাও আমার দলে চলে এল।
জীবন এত ছোট কেন!
স্ব-মূল্যায়ন
আমরা কতটুকু পাল্টাই,
অর্জন কতটুকু করি?
আমি তো প্রতিদিন আমার ফেলে আসা সত্ত্বাকে অনুভব করি,
আমার প্রতিটি রোমকূপে।
আমি নিজেকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছি,
আমি আর কালকের আমি নেই,
আমি পাল্টে গেছি।
কিন্তু তখনই,
যেন আমাকে মুখ ভেংচিয়ে,
আমার পুরোনো আমি বেরিয়ে আসে,
মনে করিয়ে দেয়,
যতই ছুটে যাই,যতদূরই,
ছায়া ফেলে কী করে যাব!
যতক্ষণ আলো ছিল না মনে,
মনে হতো আমি এগিয়ে এসেছি অনেকদূর,
কিন্তু আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার পর, সয়ে গেলে,
দেখতে পাই আমি পাল্টাইনি,
একটুও যে নয়,বলা যাবে না,
তবে তাতে চেনা যায়,
'ওটা আমিই।'
যে দিবাস্বপ্ন দেখত
ওদের বাড়িগুলো বেশ বড়,
মানে আমাদের চোখে তো বড়ই লাগত!
কিন্তু ওদের স্ত্রীরা তাতেও খুশি ছিল না,
প্রায়ই অভিযোগ করে বলত,
"ধুর, অমুকদের বাড়িটা এত স্কোয়ার ফিট,
আর আমাদেরটা, তাদের অর্ধেকও নয়।"
আমি একদিন আমার বোনকে ডাকতে গিয়েছিলাম ভেতরে,
ও তখন ঘর মুছছিল,
আমি কামরাটায় ঢুকে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম,
হঠাৎ বোনের গলার আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলেছিলাম,
"এত বড় ঘর!"
ও বিরক্ত হয়ে বলেছিল, "কি দরকার বল।"
আমি তাকে বলে চলে এসেছিলাম।
কিন্তু তারপর থেকেই আমি প্রায়ই স্বপ্ন দেখি,
আমি ওরকম দিগন্তপ্রসারী ঘরে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছি,
কারণ অত বড় ঘরের ছাদ মানুষের তৈরি হলে মানায় না।
আমি ভেবেছিলাম,
অমন বিশাল ঘরের গোসলখানায় নিশ্চয় নিজস্ব সমুদ্র আছে!
তাহলে কি মজা হবে, না?
একজনকে বলতে শুনেছিলাম,
ওদের বাড়ির ছাদ থেকে নাকি আমেরিকা দেখা যায়,
যাবেও বা, যা উঁচু!
আমি এখন আমার বাড়িতে যাওয়া বন্ধই করে দিয়েছি,
কে যাবে ওইটুকু, ওরকম ঘিঞ্জি, নোংরা ঘরে,
সারাদিন কূটকাচালি, চেঁচামেচি, গালাগালি।
ওগুলো মানুষ!
সারাদিন জানোয়ারের মতো খেয়োখেয়ি করে,
কুকুরগুলো সব!
আমি পার্কের বেঞ্চে শুয়ে শুয়ে ভাবি,
আমি ওরকম ঘরে শুয়ে আছি,
যার দেওয়ালগুলো দিগন্ত, আর ছাদটা আকাশ।
লোকে পাগল বলে আমায়,
কিন্তু আমি খুব সুখে আছি।
আমার প্রেয়সী
আমি কখনো আমার প্রেমিকার মুখদর্শন করিনি,
ইচ্ছা যে ছিল না তা নয়,
আলো ছিল না তখন।
সে যতদিন ছিল,
আকাশজুড়ে মেঘ ছিল,আর গভীর রাত ছিল।
আমি ভাবতাম প্রতিদিন,
"আজ নিশ্চয় সকাল হবে!"
কিন্তু না॥
আমি ভাবতাম পৃথিবী হয়তো ঘোরা বন্ধ করে দিয়েছে,
কিংবা কোরআনবর্ণিত তওবার দরজা বন্ধ করার রাত এসে গেছে।
কিন্তু তা না।
আমি পরে জানতে পেরেছি,
ওর মুখ কারো আক্রোশের শিকার ছিল,
তাই ও মুখ দেখাতে চায়নি আমায়,
পাছে আমার ভালোবাসা উবে যায়!
ও প্রতিদিন অন্ধকার অর্ধে নিয়ে ঘুরে বেড়াত,
ওর খোলের মধ্যে শুইয়ে আমাকে,
পায়ে পায়ে দৌড়ে বেড়াত সারাক্ষণ।
আমি ভাবতাম,
'আমাদের চুম্বন গাঢ় হয় না কেন?'
ও আমায় ভালোবাসত প্রচন্ড,
কিন্তু একদিন-
ও নিজের মতো একজনকে পেয়ে গেল।
দুজনেরই ক্ষতবিক্ষত মুখ।
তাই কারোর কাউকে লুকানোর কিছু নেই।
ওরা তখন দিনের আলোয় দেখা করতে এসেছিল আমার সাথে।
আমি শিউরে উঠেছিলাম,
এমন মুখ মানুষের হয়!
মিথ্যা স্বপ্নদেখিয়েরা
এখনো শহরে হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি নামে,
কচি কচি হাতে নৌকা বেরিয়ে এসে,
ভেসে যায় নিরুদ্দেশের ঠিকানায়।
বড়-বুড়োরা সারাদিন গম্ভীরমুখে মোবাইলের স্ক্রিনে চেয়ে থাকে,
যেটুকু বেঁচে থাকা, সজীবতা,
ওই কচি মুখগুলোতে ফুটে উঠে।
বুঝতে পারি, মানুষ এখনো বিলুপ্ত হয়নি।
এখনো কিছু কিছু মানুষ স্বপ্ন দেখে,
তারা ভাবে পৃথিবীর সব খারাপ মুছে যাবে আগামী বর্ষাতে,
নাহয় পরেরটাতে!
সব ভালো ছেয়ে যাবে চারিদিকে,
নিঃশ্বাসে বা বুকে কোথাও বিষ থাকবে না মোটে।
তখন হয়তো বসন্ত আসবে প্রকৃতিতে,
পলাশ, কৃষ্ণচূড়া আর শিমূলের যুগলবন্দী দাঁড়িয়ে থাকবে পথের ধারে,
সূর্যের তেজ আর কখনো গা পুড়িয়ে দেবে না।
আমি ওদের চোখে হতাশা দেখতে চাই না,
তাই আমি প্রতিদিন সবার অলক্ষ্যে সবকটা ছিন্ন হাত, পা, মাথা কুড়িয়ে নিই।
আমি ঘরে শুতে পারছি না,
স্থানাভাব আর অসহ্য দুর্গন্ধ!
আমি প্রতিদিন তিনশ তেত্রিশ বার শহরটাকে মুছি,
ওদের মনটাকেও দু-একবার,
পারলে হাতগুলোও।
নইলে ওরা গ্লানিতে ভোগে,
আমি দেখতে পারি না ওদের কষ্ট।
ওরা ভাবে,
সব পাপ ধুয়ে যাবে,
আবার বসন্ত আসবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।