এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জরিমানা

    পাগলা গণেশ লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৭৮ বার পঠিত
  • লোকটার নাম অতীন্দ্র বর্মন।গরীব লোক,ফড়িং খায়।ওর বাড়ি রাস্তার ধারে,এখান থেকে দূরের প্রাইমারি স্কুলটা আবছা দেখা যায়।কোনো কোনো গ্রীষ্মের দুপুরে,বাতাসে জলীয় বাষ্প কম থাকলে বেশ স্পষ্ট দেখা যায়।ওখানে ওর মেয়েটা পড়ে।পড়াশোনায় ভালো নয় তেমন,কিন্তু খেলতে খুব ভালবাসে। অতীন্দ্রও বাসত,কিন্তু এখন আর পেরে উঠে না।পঁচিশ বছর একটা সিমেন্ট কারখানায় কাজ করার পর ফুসফুস সিমেন্টিভূত হয়ে গেছে।ডাক্তার বলেছে স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে ফেলেছে।তিনি একটা রাবারের গার্টার নিয়ে দেখিয়েছিলেন স্থিতিস্থাপকতা কী জিনিস।

    অতীন্দ্র আগেও দেখেছে,পাত্তা দেয়নি।কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারটা যে ওর জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তা আগে ভাবেনি কখনও।ওর গার্টারটাকে হিংসে হয়,মনে হয় কী অন্যায়!
    ওর দরকার,কিন্তু ওর ফুসফুসের স্থিতিস্থাপকতা নেই,আর এদিকে ওই গার্টারটর না হলেও চলে,কিন্তু.....
    একটা দীর্ঘশ্বাস ওর বেরিয়ে এল।

    "বাবা,ও বাবা!"
    অতীন্দ্রর ঘুম ভেঙে গেল।ধড়ফড় করে উঠতে গেল,কিন্তু তাতে ওর শ্বাস দ্রুত হয়ে দমবন্ধ হওয়ার জোগাড় হল।খাবি খেতে খেতে ও আমিনাকে ইশারা করল,আমিনা ইনহেলারটা এনে দিল।ইনহেলার বহুকষ্টে টেনে নিল ভেতরে,কিন্তু তাতেও উপশম হতে একটু সময় লাগল।মিনিট পাঁচেক পরে একটু কমতে বলল,"মা,তোকে বলেছি না,এরকম হঠাৎ করে ডাকবি না!"
    আমিনা এতটুকু মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।তার সত্যিই খেয়াল ছিল না।

    আসলে ও আসার সময় দেখল একটা কী অদ্ভুত জিনিস,ওদের বাড়ির সামনে একটা বড় পোঁটলা পড়ে আছে।চকচকে,ঝকঝকে,উজ্জ্বল, রঙচঙে।প্যাকেট বলা যায়,কিন্তু ওদের বাড়ির যা অবস্থা,ওরা তো সাদা কালো বাস্তবতায় বাস করে,তাই প্যাকেট বললে ঠিক মানায় না।পোঁটলা বলাই ভালো।মনে হল কেউ খুব বড়োলোক যতটা বিনয়ী এবং সাধারণ হওয়া যায়,হয়ে রেখে গেছে।কিন্তু তাতেও তার অর্থবাহুল্য চাপা পড়েনি।

    অতীন্দ্র বহুকষ্টে উঠে দাঁড়াল।তারপর আমিনার দিকে ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল।আমিনা এসে তার হাতটা কাঁধে নিল।আর এক হাতে লাঠিটা ধরিয়ে দিল।অতীন্দ্র এক একটা পা ফেলল,আর প্রতি পায়ের অগ্রগতির সাথে তারা হাঁপ বেড়ে চলল।যখন সে গিয়ে পৌঁছল,সে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অবস্থায়।প্যাকেটটার সামনে দাঁড়িয়ে সে একটু দম নিল।মিনিট দশেক পর সে একটু ধাতস্থ হতে দেখল বেশ বড়ো প্যাকেট,দুটো মানুষ অনায়াসে ঢুকে যায় তার মধ্যে। ও এবং ওর চারপাশে পৃথিবী সাদাকালো,ওরা গরীব,রং কিনতে টাকা লাগে।তাই ওদের পৃথিবী এরকম।যারা যত বড়লোক,তাদের পৃথিবী তত রঙচঙে।কিন্তু এই প্যাকেটটা রং বিচ্ছুরণ করছিল,তাতে প্যাকেটটার চারপাশ রঙিন হয়ে উঠেছিল।

    অতীন্দ্র মনোযোগ দিয়ে দেখল বাক্সটা,ভয় করল ওর।যদি বোম হয়?
    কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল,ওর আছেটা কী,যে ওকে কেউ বোম দিয়ে উড়িয়ে দেবে?তাতে তারই ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা।
    একটু ঝুঁকে তুলতে গেল।খুব ভারী সেটা।
    উপরে ওর নাম আটকানো আছে,তার সাথে বাবার নাম,বাড়ির নম্বর সব হুবহু ওরই,তাই অন্য কারো হবে এমন সম্ভাবনাও নেই।
    কাউকে ডাকতে হবে জিনিসটা ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।কিন্তু তার আগে দেখা দরকার কী আছে এটাতে।
    ও আমিনাকে বলল,"মা,ঘর থেকে একটা ছুরি নিয়ে আয় তো?"
    আমিনা দৌড়ে চলে গেল।পরক্ষণেই ফিরে এল একটা ছুরি নিয়ে।

    অতীন্দ্র ছুরি দিয়ে প্যাকেটটার উপরের রঙিন আবরণটা কেটে ফেলল।ভেতরে কার্ডবোর্ডের বাক্স দেখা গেল।ধীরে ধীরে পুরো অবরণটা খুলে ফেলতে দেখা গেল,সেখানে একটা স্টিকার আটকানো।তাতে ও যে কোম্পানিতে কাজ করত,তার নাম লেখা।জি. সি. ইন্টারন্যাশনাল।ওর মনে একটা স্বস্তির ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল,ও মাটিতে বসে পড়ল।ও যে কতটা দুশ্চিন্তা আর চাপের মধ্যে ছিল,সেটা ও বুঝতে পারল।

    কিন্তু জি. সি. ইন্টারন্যাশনাল ওকে কী পাঠিয়েছে,কেন পাঠিয়েছে?ওর সবকিছু শেষ করেও কী শান্তি হয়নি?
    একবার ভাবল যাই পাঠাক,পড়ে থাক বাইরে,তারপর আবার ভাবল,নিয়ে যাই, কী আর হবে মরে তো যাব না!

    কিন্তু জিনিসটা অসম্ভব ভারী।এই জগদ্দল পাথরকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাবে কী করে?কাউকে ডাকতে হবে।আমিনাকে বলল,"যা তো মা,পরিমল কাকুকে ডেকে নিয়ে আয়।"আমিনা স্বভাবজাত ভঙ্গিতে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল, কী মনে হতে অতীন্দ্র ডাকল,"শোন, দাঁড়া ।"আমিনা ফিরে এল।"সমসুদ্দি কাকুকেও ডেকে আনিস তো।"
    আমিনা আবার ছুটতে ছুটতে চলে গেল।

    মিনিট পাঁচেক পরে আমিনা ফিরে এল,তারও কিছুক্ষণ পরে এল সমসুদ্দি,তারপর পরিমল।পরিমল আসতে অতীন্দ্র বলল,"সবার আগে তোকে ডাকতে বলেছিলাম,আর তুই এলি সবার শেষে।"
    পরিমল হেসে বলল,"না রে, গোরুর জন্য ছানি কাটছিলাম,আর আঁটি দশেক বাকি ছিল,তাই ওগুলো কেটেই এলাম।"
    -"তা বেশ।এক কাজ কর না ভাই। কী জানি কোম্পানির এতদিন পর আমাকে মনে পড়ল কেন কে জানে! কী একটা পাঠিয়েছে।কিন্তু যমের মতো ভারী।একটু তুলে ঘরে করে দে না ভাই!"
    পরিমল বলল,"কোম্পানি!কোম্পানি কী পাঠিয়েছে?"
    অতীন্দ্র -"কে জানে কী!ঘরে নিয়ে চ,তারপর খুলে দেখা যাবে।"
    ওরা সেটাকে তুলে ঘরে নিয়ে গেল।দুজনেই বেশ জোয়ান,কিন্তু ওরাও গলদঘর্ম হয়ে গেল।ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে সমসুদ্দি বলল,"ভাই পাথর পাঠিয়েছে মনে হয়।"বলে হাসল।ওর কথায় বাকিরাও হাসল।তারপর পরিমল বলল,"ভাই আমাকে গোরুকে কুড়চি দিতে হবে,আমি যাই,দেরি হয়ে যাবে।গাবিন গোরু,দুধ দিচ্ছে, খাবার দিতে দেরি হলে চেঁচিয়ে ঘর মাথায় তুলবে।"
    অতীন্দ্র -"আচ্ছা যা।"
    তারপর ছুরিটা সমসুদ্দির দিকে বাড়িয়ে বলল,"খোল দেখি, কী আছে ভেতরে!"
    সমসুদ্দি হাত বাড়িয়ে ছুরিটা নিল।

    বাক্সটার উপর যে টেপটা দেওয়া ছিল,সেটা কাটল।তারপর ঢাকনাটা খুলতে তার ভেতরে একটা ট্রে।সেটা টানতে গেল,কিন্তু এত ভারী ছুরিটা রেখে পরিমলকে বলল,"একটু হাত লাগা তো?"
    পরিমল বেরিয়েই যাচ্ছিল,একটু বিরক্ত হয়েই বলল,"কত ভারী বলত?"
    বলে হাত লাগাল।
    দুজন মিলে টেনে বের করতেই,দুজনের চোখ মাথায় উঠে গেল।ট্রের ভেতরে থাক থাক পাঁচশ টাকার নোট।ওদের চোখে পড়ল,ওই টাকার থাকের উপর একটা সাদা কাগজ।পরিমল হাত বাড়িয়ে সেটা তুলে নিল।একটা চিঠি।তার উপর অতীন্দ্রর নাম লেখা।
    পরিমল চিঠিটা অতীন্দ্র কে দিল।

    অতীন্দ্র পড়তে আরম্ভ করল।

    প্রিয় অতীন্দ্র বাবু,
       কেমন আছে বলে ভণিতা করব না।জানি আপনি ভালো নেই।আপনার রোগের কথা শুনেছি।আমাদের অনেক কর্মচারীদের মতো আপনিও এই দুরারোগ্য রোগে ভুগছেন। তা আমাদেরই দোষ।আমরা চাইলে আপনার এই রোগ হতো না।কিন্তু আমারা আমাদের লাভ বাড়ানোর জন্য আপনাকে এবং আপনার মতো আরো হাজার হাজার লোককে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি।আমরা জানি এই অন্যায়ের ক্ষমা হয় না।তবু আমরা কায়মনোবাক্যে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।শুধু আমরা চাই আমরা সামান্য কিছু আর্থিক মূল্য আপনাকে দিচ্ছি,যাতে আপনার পরিবার অন্তত আর্থিক অকুলানের মধ্য দিয়ে না যান।তার সাথে কোম্পানির কিছু শেয়ার আপনার নামে ট্রান্সফার করে দিয়েছি।

    আমরা আবার আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।আপনার যদি আরও কিছু দাবি থাকে করতে পারেন,আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।মনে রাখবেন আপনি আমাদের পরিবারের অংশ।
                                    ইতি -
                                 ম্যানেজার
                                জি. সি. ইন্টারন্যাশনাল

    অতীন্দ্র চিঠিটা পড়ার পর কিছুক্ষণ বসে রইল হতভম্ব হয়ে।এটা কী,আদৌ বাস্তব তো?
    কিন্তু অচিরেই সে বুঝতে পারল;না,সবই সত্যি।পরিমল জিজ্ঞেস করল,"কী রে, কী লেখা আছে?"
    অতীন্দ্র যন্ত্রচালিতের মতো চিঠিটা তার দিকে এগিয়ে দিল।পড়ে সেও যারপরনাই অবাক হল।এমন আবার হয় নাকি?
    তার হাত থেকে চিঠিটা নিল সমসুদ্দি।সেও পড়ে অবাক। এত অভাবনীয় ব্যাপার ঘটছে আজ সকাল থেকে।কেউ মজা করছে না তো তাদের সাথে?

    আজ সকালে সে ঘুম থেকে উঠেই দেখল,তাদের বাড়ির সামনে অনেক লোক।সে সকাল বেলায় এমন ব্যাপার দেখে হকচকিয়ে গেল।প্রথমে ভাবল বুঝি কোনো অঘটন ঘটেছে,কিন্তু কাছে গিয়ে দেখল, এ তো তাদের বিধায়ক!
    সে আর একটু কাছে যেতেই বিধায়ক হাত জোড় করে বললেন,"মাফ করবেন,আমার নাম অনিরুদ্ধ বাগচী,আপনার সেবক।"
    এমন বিনয়ী কথা,তাও আবার রাজনৈতিক নেতার মুখে!সে আবার যে সে নেতা নয়,খোদ বিধায়ক।
    প্রথম ধাক্কাটা হজম করার আগেই সে বলল,"আমি আপনার তথা আপনাদের সাথে অনেক অন্যায় করেছি।কথা দিয়ে কথা রাখিনি।আমাকে ক্ষমা করবেন।এরপর থেকে কথা দিচ্ছি,আমি আমার কাজ প্রাণপণে করব,কখনও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হব না।যদি চান আমি পদত্যাগ করতেও রাজি।"
    সমসুদ্দি ঢোঁক গিলে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।এমন আশ্চর্য কথা কেউ তাকে কোনোদিন বলেনি,এই এত শুদ্ধ বাংলা,তার অর্ধেক শব্দের অর্থ সে বুঝতেই পারেনি।

    সে ভাবল বিধায়ক বুঝি তার সাথে মজা করছে।তাতে তার গলা শুকিয়ে গেল।তার মুখ দিয়ে কথা সরল না।বিধায়ক সেটা বুঝতে পারল,সে বলল,"আমি বুঝতে পারছি।এমন অদ্ভুত ঘটনা আপনি হৃদয়ঙ্গম করতে পারছেন না।অসুবিধা নেই,কিছুদিন যাক,গা সওয়া হয়ে যাবে।"
    বলে সে চলে গেল।
    সমসুদ্দি হাঁ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

    ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল,ও কি এখনও ঘুমাচ্ছে?ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই এমন অবাস্তব স্বপ্ন দেখছে?
    কিন্তু না,তার হাতে একটা তীক্ষ্ম যন্ত্রণা জানান দিল।সে সেদিকে চকিতে ঘুরে দেখল,একটা মশা হুল ফুটিয়ে পরমানন্দে রক্ত খেয়ে চলেছে।সে চটাস করে এক চাপড় মারল,মশাটার নরম শরীর ছড়িয়ে পড়ল বৃত্তাকারে,ওর রক্ত আর মশার মাংসের সুষম মিশ্রণ ওর হাতে একটা লাল - কালো আলপনার জন্ম দিল।অনেক রক্ত খেয়েছিল মালটা,কতগুলো প্রাণ আসতে গিয়েও ব্যর্থ হল।
    ও হাত দিয়ে জায়গাটা মুছে দিল।দৃশ্যমান কোনো চিহ্ন রইল না।

    এই ঘটনার পর কয়েকদিন কেটে গেছে।নিরুপদ্রব কেটে যাওয়াতে তিনজনেই নিশ্চিন্ত হচ্ছিল ধীরে ধীরে।তবুও মনের ভেতর একটা খটকা চোখের মধ্যে পড়ে থাকা বালিকণার মতো করকর করছিল।মনে হচ্ছিল,এই বুঝি খারাপ খবর আসবে;যেটা ওদের জীবন খুবই স্বাভাবিক।টানা সুখ,বা ঠিক বললে সুখ ওদের জীবনে নেই।তবে এর একটা সুবিধা আছে বলে মনে করে অতীন্দ্র,খুব ছোট ছোট দুঃখের নিম্নগমনগুলোকে সুখ বলে ভ্রম হয়।এই একদিন তিনবেলায় ভরপেট ভাত খাওয়া হল,কি একদিন শ্বাসকষ্ট একটু কম থাকল।

    কিন্তু ঠিক সাতদিনের মাথায় একদল কোট-প্যান্ট পরিহিত লোকের আবির্ভাব ঘটল গ্রামের সীমানায়। ওরা যখন হেঁটে আসছিল,ওদের মাথার উপর কালো বজ্রগর্ভ মেঘ গরগর করতে করতে আসছিল,যেন ওদের পোষা কুকুর,শুধু আদেশের অপেক্ষা করছে।সেই মেঘগুলোর নীচে অনেক কাক নিরবিচ্ছিন্ন,গলাফাটানো চিৎকার করছিল।মাঝে মাঝে ওই লোকগুলোর পচা-গলা শরীরের যেটুকু অংশ সুন্দর সুদৃশ্য কোটের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছিল কাকগুলো।ওদের হাতে ব্রিফকেস,পাগুলো মাটিতে লেগে ছিল না,যেন ওরা ঠিক তিন সেন্টিমিটার ভেসে আছে মাটি থেকে।আর ঠিক হেঁটে নয়,বরং হোভার করে আসছিল।

    এমন অবিশ্বাস্য গতিতে ওরা আসছিল,মনে হচ্ছিল না ওরা মানুষ।আমিনা প্রথম দেখল লোকগুলোকে।ও খেলা করছিল বাইরে।ছুটে ঘরের ভিতরে গিয়ে বলল,বাবা দেখবে এসো কতগুলো অদ্ভুত লোক আসছে।অতীন্দ্রের সারা শরীর জমে গেল ভয়ে।তবে ওর আশঙ্কাই ঠিক হল। ও ওঠার চেষ্টা করল,ব্যর্থ চেষ্টা।

    ততক্ষণে লোকগুলো এসে গেছে।দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের একজন কেমন অস্পষ্ট গলায় কী একটা বলল।পরক্ষণেই উপরের মেঘ সেই শব্দকে পরিষ্কার করে গুরুগম্ভীর স্বরে বলল,"শুনেছি আপনাদের কাছে নাকি অনেক টাকা নগদ আছে?তার ট্যাক্স দিয়েছেন?আয়ের উৎস কী?"
    অতীন্দ্র কী একটা বলতে গেল,কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোলো না।
    সেই লোকটি আবার কী একটা বলল,মেঘ থেকে আবার আকাশবাণী হল,"শুনতে পাচ্ছ না?"
    অতীন্দ্র এবার বহুকষ্টে বলল,"না স্যার।ওটা আমার কোম্পানি ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছে।ওতে যে ট্যাক্স দিতে হয়, তা জানতাম না।"
    লোকটা আবার কী বলল,আকাশবাণী হল,"জানতে না?ভালো কথা,ট্যাক্স প্লাস ফাইন দাও।"
    তোমার প্রাপ্ত মোট অর্থের মূল্য সাড়ে সাত কোটি টাকা।তার থেকে সত্তর শতাংশ ট্যাক্স হয় পাঁচ কোটি পঁচিশ লাখ টাকা,সাথে জরিমানা আরও পাঁচ কোটি টাকা।আর না জানার জন্য আরো সাত কোটি টাকা,তোমার খারাপ ফুসফুস দিয়ে বেশি বাতাস টেনে নিচ্ছ,তাই এগারো কোটি টাকা,তুমি হিন্দু নাম রেখেছ নিজের, তা সত্ত্বেও তুমি মুসলমানের সাথে বন্ধুত্ব রেখেছ,তাই তোমার একত্রিশ কোটি টাকা জরিমানা।সব মিলিয়ে একশ একুশ কোটি টাকা।আগামী সাতদিনের মধ্যে মেটাতে হবে,অন্যথা প্রতিদিন দশ শতাংশ হারে সুদ ধরা হবে।"বলেই লোকগুলো একটা রশিদ ওর ঘরের চৌকাঠে রেখে দিয়ে আবার চলে গেল।যাওয়ার সময় ওদের পোষা মেঘটা হাঁচতে গিয়ে ওর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল।ওরা গ্রামের সীমানা পার হওয়ার আগেই অতীন্দ্রের বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

    খবর শুনে সমসুদ্দি আর পরিমল এল।
    পরিমল - "কী রে, কী হল?"
    অতীন্দ্র মাথায় হাত দিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে বসেছিল।সে একটা কথাও বলল না।
    সমসুদ্দি আবার জিজ্ঞেস করল,"কী রে, কী হয়েছে?"
    অতীন্দ্র খুব দূর্বল কন্ঠে বলল,"আমার পাপের সাজা হয়েছে ভাই।"মনে হল তার কন্ঠস্বর যেন বহু দূরদেশ থেকে ভেসে আসছে।
    আমিনা পাশেই দাঁড়িয়ে কাঁদছিল।তার ছোট্ট শরীরটা কান্নার দমকে ফুলে ফলে উঠছিল।সমসুদ্দি তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,"আয় মা,তুই আমার সাথে আয়।"
    যেতে যেতে সে পরিমলকে ইশারা করল।পরিমল অতীন্দ্রকে ধরে তুলল।তারপর আস্তে আস্তে ওরা নিজেদের ঘরের দিকে চলে গেল।

    কয়েকদিন কাটল এভাবে।

    অতীন্দ্র মানিয়ে নিতে চাইল।কিন্তু যদি ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হয়ে যেত,তাহলেও ভাবতে পারত,যে জিনিস গেল সে তো আমার নয়।কিন্তু যা দিয়েছিল তা তো গেলই,সাথে এমন বোঝা চাপিয়ে দিয়ে গেল, তা বওয়ার জন্য যত বড় কাঁধ দরকার, তা ওর নেই।
    বেনোজল ঢুকে জমাজল নিয়ে গেল।

    একদিন ওরা তিনজন পরিমলের ঘরের সামনের দাওয়ায় বসেছিল।
    সমসুদ্দি -"আচ্ছা ওদের কাছে আর্জি করলে হয় না,যদি একটু কমত।বলতাম সাড়ে সাত কোটি টাকাটা পুরোটা নিয়ে নিক,দিয়ে তোকে ছেড়ে দিক।"
    পরিমল -"তা হবে বলে তো মনে হয় না।"
    সমসুদ্দি -"আচ্ছা দেখাই যাক না!"
    অতীন্দ্র -"ভাই,এক কাজ কর।আমাকে মেরে ফেল। যা কিছু দায় সব তো আমার।আমি মরে গেলে তো আর কিছু নেই।তোরা আমিনাকে দেখিস।ওর মায়ের ইচ্ছা ছিল ওকে অনেক পড়াবে,খুব বড় চাকরি করবে।তারপর বিরাট ধুমধাম করে বিয়ে দিবে।কিন্তু তা তো আর হল না,তোরা দুজন আছিস,আমি মরে গেলে মেয়েটাকে দেখে রাখতে পারবি না।"
    ওরা দুজন রে রে করে উঠল।সমস্বরে বলল,"ধুর, কী বলছিস!"
    অতীন্দ্র -"ঠিকই বলছি ভাই।চিন্তা তো হয়!আর কদিনই বা বাঁচব?মাঝে মাঝে যখন হাঁপ উঠে,মনে হয় আর এক ঘন্টাও কাটবে না।
    সমসুদ্দি বলল,"সে যা হবে দেখা যাবে,তুই এমন অলক্ষুণে কথা বলিস না।"
    অতীন্দ্র -"আমি না বললেই কি আর হয় না?"
    সমসুদ্দি -"তোর এই তর্ক করা অভ্যাসটা গেল না।সবকিছুতে তর্ক!কেন আমি বললে কথাটা শুনতে তোর অসুবিধা কোথায়?আমি বলতে মানা করলাম,তুই বলবি না। ব্যস,কথা শেষ।"
    অতীন্দ্র হেসে বলল,"আচ্ছা ঠিক আছে,বলব না।"

    চারদিন কেটে গেছে।কোম্পানি থেকে যে টাকাটা দিয়েছিল,সেটা সমসুদ্দি আর পরিমল গিয়ে আয়কর বিভাগের অফিসে জমা করে এসেছে।অনেক কাকুতি-মিনতি করেও একটা টাকা কমাতে পারেনি।তবে আরও একসপ্তাহ সময় চেয়ে এনেছে।

    পরিমলকে ওরা গ্রেফতার করে নিয়েছে।কারণ,পরিমল ওদের একজনকে বলতে গিয়েছিল,কিছু টাকা নিয়ে যদি কেসটাকে চাপা দেওয়া যায়।কিন্তু লোকটা আবার খুব সৎ,শালা যুধিষ্ঠিরের বাচ্চা।সে গিয়ে তার ঊর্ধ্বতন আধিকারিককে বলে দিল।ফলে,পরিমল গেল লকআপে।এখন ওকে জামিন করার জন্য নাকি আবার একত্রিশ লাখ টাকা লাগবে।

    অতীন্দ্র খুব রাগারাগি করল সমসুদ্দিকে।সমসুদ্দি ওকে থামাতে গেল,কিন্তু তাতে ও তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল।সমসুদ্দি তা দেখে চুপ করে গেল।
    তবে অতীন্দ্র বেশিক্ষণ চালাতে পারল না।থেমে গিয়ে হাঁপাতে লাগল।তার বুক হাপরের মতো উঠতে পড়তে লাগল। কাতলা মাছের মতো খাবি খেতে লাগল।তাই দেখে সমসুদ্দি আমিনাকে ডাকল।সে তখন ছিল সমসুদ্দির বাড়ি।সেখান থেকে দৌড়ে এসে দেখল, অতীন্দ্রের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে।সমসুদ্দিকে বলল,"দৌড়ে গিয়ে বাবার নেবুলাইজারটা আনো।"
    সমসুদ্দি ইতঃস্তত করতে লাগল।
    এমন সময় একটা বিশাল কাক সামনে দিয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে কুঁয়োটার উপর বসল।এরকম বড় কাক সে আগে কখনো দেখেনি।সে হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কাকটা একদৃষ্টিতে অতীন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বসেছিল।সে যেন সমসুদ্দির দৃষ্টি টের পেল।একবার তার দিকে ঘুরে তাকাল।সমসুদ্দির বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল।এমন চোখ সে কখনও দেখেনি।রক্তলাল চোখ,তার মধ্যিখানে,সরীসৃপদের যেমন লম্বালম্বি মণি থাকে,ঠিক সেরকম মণি।তবে তাকে মণি বলা যায় কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।কারণ সেখান থেকে চোখের ভেতরটা দেখা যায়,সেখানে আগুন জ্বলছে,কয়েক যুগের পুরোনো আগুন।সৃষ্টির আগের থেকে এই আগুন জ্বলছে,যা কিছু ভালো,সব পুড়িয়ে ছারখার করে তার থেকে বাঁচার রসদ সংগ্রহ করে এই আগুন।

    আমিনা অতীন্দ্রকে ইনহেলার দিচ্ছিল।পেছন ফিরে দেখল সমসুদ্দি তখনও দাঁড়িয়ে।সে খুব বিরক্ত হল।জিজ্ঞেস করল,"কী হল? যাও!"
    সমসুদ্দি ঢোঁক গিলে বলল,"আমি জানি না কোথায় আছে।"
    তখন আমিনা ছুটে গেল। যখন নেবুলাইজার নিয়ে ফিরে এল,অতীন্দ্রের প্রায় শেষ অবস্থা। কোনোমতে কাঁপা কাঁপা হাতে সে নেবুলাইজারটার প্লাগ সকেটে গুঁজল।তারপর ওষুধটা দিয়ে মুখোশটা অতীন্দ্রের মুখে দিল। অতীন্দ্র নিস্তেজ হয়ে এসেছে।নিজের থেকে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।আমিনা দেওয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।পরিমলের স্ত্রী এসে তাকে ধরল।

    ঠিক এমন সময় অতীন্দ্র জোরে একটা হাঁফ ছাড়ল,আবার একবার নিঃশ্বাস নিল।তারপর বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের পাতা খুলে তাকাল। কী একটা বলল,আমিনা তাড়াতাড়ি তার কাছে এল।অস্থির হয়ে বলল,"বাবা,কিছু বোলো না।একটু সুস্থ হও,তারপর সব শুনব।"
    মিনিট দশেকের মধ্যে সে ঠিক হয়ে গেল।

    সমসুদ্দি তখনও ঠিক সেই জায়গাতেই স্থানুর মতো দাঁড়িয়েছিল।নিজেকে তার খুব বড় অপরাধী মনে হচ্ছে।সে আর একটু হলেই মেরে ফেলেছিল লোকটাকে।কিন্তু ও তো ভালোই করতে চেয়েছিল।কিন্তু কিচ্ছু ভালো হয় না।প্রতিবারে যা করতে যায়,ঠিক খারাপটাই হয়।ওর মনে হল,মরে যাই।কিন্তু তা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে।এখন শুধু ওর পরিবার নয়,অতীন্দ্র আর পরিমলের পরিবারও ওর উপর নির্ভরশীল।ওর আবার নিজের উপর,নিজের পরিণতির উপর খুব রাগ হল,ঘৃণা হল নিজের উপর।ও এত গরীব,যে নিজের ইচ্ছায় আত্মহত্যাও করতে পারছে না, পারবেও না কোনোদিন। কী বিড়ম্বনা!

    পরিমলের স্ত্রীর এবার ওর দিকে চোখ পড়ল।এতক্ষণ সে আমিনাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য এদিকে খেয়াল করেনি।লোকটা এই অত ঝক্কি পুহিয়েছে,রোদে রোদে এতটা রাস্তা হেঁটে এসেছে,তারপর একফোঁটা জল মুখে দেওয়া তো দূরের কথা, বসেনি পর্যন্ত।এখন দোষী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।ওর খুব মায়া হল সমসুদ্দির উপর।"আহা রে,বেচারা!"
    সে বলল,"সমসুদ্দি দা,উঠে এসে বসুন।আমি আপনার জন্য একটু শরবৎ করে নিয়ে আসি।"
    সমসুদ্দি সারাদিনে এই প্রথমবার একটু সহানুভূতির ছোঁয়া পেল।আমিনাও ওর দিকে তাকিয়ে খুব লজ্জিত হল।না মানুষটা ওদের জন্য কত করছে। কী দরকার ছিল!বাকি সবার মতো উনিও তো পারতেন নিজের পিঠ বাঁচাতে!
    সে ভেতর থেকে একটা পিঁড়ে এনে দিল।সমসুদ্দি দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসল।

    সমসুদ্দি তখনও সেই কাকের কথা ভাবছিল।সে জানে অতীন্দ্রর কাছে সত্যিই আর বেশিদিন সময় নেই।কিন্তু ও কী করবে?ভাবল কাকটাকে তাড়িয়ে দেয়,কিন্তু কাকটা নিজে তো মৃত্যু আনেনি,বরং মৃত্যুর গন্ধ পেয়ে এসেছে।ও চলে গেলেও অতীন্দ্র মরবে।তার থেকে থাক,একটা মহাজাগতিক অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে।

    এমন সময় কাকটা বিকট স্বরে ডেকে উঠল,পরিমলের স্ত্রী আয়েশা শরবৎ নিয়ে আসছিল,কাকের আওয়াজ শুনে চমকে সব ফেলে দিয়ে কানে হাত দিয়ে দাঁড়াল।শরবতের গ্লাস গিয়ে লাগল অতীন্দ্রের কপালে,সে ঘুমিয়ে পড়েছিল ক্লান্ত হয়ে।গ্লাসের আঘাতে চকিতে জেগে উঠল।উঠেই হাঁপাতে লাগল।
    এমন সময় কাকটা অদ্ভুত একরকমভাবে হাসতে লাগল,শুনে মনে হল,যেন সে অট্টহাস্য করছে।খুব রগড় হল একটা,সবাইকে চমকে দিয়েছে সে।সে এমন অপার্থিব আওয়াজ,সবার বুকের জল হিম হয়ে গেল।মনে হল,ও যেন কেয়ামতের অগ্রদূত,জানান দিতে এসেছে,পৃথিবীর কাছে আর বেশি সময় নেই।

    সেদিন ওরা আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল,দুপুরে খাওয়াদাওয়া হল না, সমসুদ্দিকে ওর বাড়ি থেকে ডাকতে এল,কিন্তু সে গেল না।ওর মনে হল আজকেই বোধহয় সব শেষ হয়ে যাবে।যদি নাও হয়,ওই কাক নিশ্চয় অধৈর্য্য হয়ে ঠোকর বসাবে। ঠাই রাত পর্যন্ত বসে থাকল সবাই।মাঝে একবার অতীন্দ্রকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল,কিন্তু সেখানে যেতেই তার শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হল,এবং তা উত্তরোত্তর বাড়তে রইল।তখন ওকে আবার বাইরে নিয়ে আসা হল।এসে দেখল,কাকটা তখনও ঠিক সেই জায়গাতেই বসে রয়েছে।ওদিকে আবার বাইরে আসতে দেখে ওর মিশকালো ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠল।সমসুদ্দিকে হঠাৎ একটা অন্ধ রাগ ভর করল,দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কাকটাকে মারতে ছুটে গেল সে।কিন্তু কাকটাও যেন এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিল,অপেক্ষা করছিল কখন ও ছুটে আসবে।সে নিজের সব পালোকগুলোকে ফুলিয়ে নিজের আয়তন দ্বিগুণ করে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল, ডানাদুটোকে প্রসারিত করে এমনভাবে তেড়ে এল,সমসুদ্দি আর এগোতে পারল না।

    রাতেও ওরা বাইরেই রইল,আর রইল সে,সাক্ষাৎ বিভীষিকার মতো।

    পরদিন সকালে উঠে ওরা দেখল, কাকটি এখনো সেই একই জায়গায় বসে আছে। অতীন্দ্রের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে।যে যার কাজে চলে গেল।

    একটু বেলার দিকে দেখা গেল,দুর থেকে একটা অবয়ব হেঁটে আসছে।গ্রামকে কে মনে রাখে?
    যত আলো,উন্নয়ন,খবর - সব শহরে।
    তাই ওদের গ্রামের ছেলেমেয়েরা সব শহরে।বেশিরভাগ সেখানে কাজ করে,থাকে।মাসে একবার,কেউ শুধু লম্বা ছুটিগুলোতে আসে।বাকি তেমন কেউ যায় না,অবশ্য যারা একটু বড়লোক তাদের কথা আলাদা।

    কাছে আসছে ক্রমশ অবয়বটা।খর গ্রীষ্মের দুপুরে মনে হচ্ছে শরীরটা যেন জলের উপর দিয়ে হাঁটছে।তার ছায়াটা জলে সরীসৃপের মতো হিলহিল করে নড়ছে,তার নশ্বর শরীরটাও নড়ছে তার সাথে তাল দিয়ে।না চাইতেও অবাধ্য চোখগুলো বারবার সেদিকে চলে যায়।আরও কাছে এসেছে লোকটা,তার শরীরের ক্লান্তি দেহভঙ্গিমায় স্পষ্ট।কিন্তু মুখ এখনও চেনা যাচ্ছে না।

    মিনিট দশেক পরে যখন চেনা গেল,ওরা চমকে উঠল। আরে,এ তো পরিমল!
    কিন্তু তার এ কী অবস্থা!
    হাত ঝুলে পড়েছে হাঁটুর নিচে,কাঁধ যেন বিপুল বোঝার ভারে মাটি ছুঁতে চাইছে,খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে বেচারা।
    সমসুদ্দি দৌড়ে গেল,পেছন পেছন আয়েশা।আমিনা ইতঃস্তত করছিল,বাবাকে ছেড়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?
    শেষ পর্যন্ত সে থেকে যাওয়াই ঠিক করল।

    ওরা গিয়ে পরিমলকে ধরল।এতক্ষণ মানুষটা শুধু মনের জোর হেঁটে আসছিল,ওরা ধরতেই ওদের উপর ঢলে পড়ল।
    কোনমতে ওরা টেনে নিয়ে গিয়ে দাওয়ায় অতীন্দ্রের পাশে বসল।

    কালকে যখন পরিমলকে গ্রেফতার করে নিল,তারপর ও দেখল সমসুদ্দিকে কেমন তাড়িয়ে দিল।আর ওকে নিয়ে গেল গারদের একটা কামরায়।সেখানে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে,দরজা বন্ধ করে চলে গেল।সেই তল্লাটে টানা করিডোরের দুপাশে সারি সারি খুপরি,তার প্রায় প্রতিটাতেই একজন,দুজন করে লোক।ওকে যে খুপরিটাতে ঢুকিয়েছিল,সেটাতে আর কেউ ছিল না।ও বসে বসে ভাবছিল, কী থেকে কী হয়ে গেল?এরপর ওর কী করণীয়?ভাবছিল এবার ওদের  কেউ এলেই কেঁদে পায়ে পড়ে যাবে।কিন্তু এও মনে হচ্ছিল,তাতে বিশেষ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।কিন্তু আর কিছু করারও তো নেই!

    এভাবে কখন সময় কেটে গেছে ওর খেয়াল নেই।আর করিডোরটা এমন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার,যে বাইরের পরিবর্তন কিছু বোঝা যায় না,যেন সবসময় মাঝরাত।

    তবু আন্দাজ ঘণ্টা পাঁচেক পরে একদল পুলিশ কর্মচারী এল।দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল, হাতে একধরনের স্বচ্ছ প্লাস্টিকের লাঠি,দড়ি ইত্যাদি।ওদের মধ্যে দুজন ওকে জামা-কাপড় খুলে একেবারে উলঙ্গ করল।ও বাধা দেওয়ার কথা ভেবেছিল,কিন্তু যদি হিতে-বিপরীত হয়,তাই একটা কথাও বলতে পারল না।তারপর উপুড় করে শুইয়ে হাত-পা টেবিলের পায়ার সাথে বাঁধল।তারপর শুরু হল মার।একজন ক্লান্ত হলে আর একজন,সে ক্লান্ত হলে আবার একজন।পায়ের পাতা থেকে আরম্ভ করে ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত ক্রমাগত পিটিয়ে যেতে থাকল।এভাবে ঘণ্টা খানেক চলল।ও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেল,কত কাকুতি মিনতি করল,কিন্তু কিছুতেই কিচ্ছু হল না।যখন ওরা শেষ করল,ও তখন অজ্ঞান।

    যখন জ্ঞান ফিরল,দেখল ওরা চলে গেছে।ও মেঝেতে শুয়ে আছে।ধড়ফড় করে উঠতে গিয়ে টের পেল,ওর সারা শরীরে অকথ্য ব্যথা।সেই যন্ত্রণার তাড়সে ওর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।আর নড়াচড়ার চেষ্টা না করে চুপচাপ শুয়ে রইল।বুকের উপর জামা-কাপড়গুলো ছিল,সেগুলো নিয়ে পরার চেষ্টা করল।প্যান্টটা পরল,কিন্তু জামাটা পরা যাবে না।একটু সুস্থ মনে হতে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।হাতদুটো অক্ষত আছে এখনও।হাত বাড়িয়ে দেখতে দেখতে একটা থালা হাতে ঠেকল।সেটা টেনে কাছে এনে দেখল তাতে কয়েকটা রুটি,তিনটে বাটিতে ডাল,সব্জি আর মুরগির মাংস রয়েছে।

    এতক্ষণ মনে ছিল না,কিন্তু খাবার দেখতেই হঠাৎ প্রচণ্ড খিদে লাগল। মনে হল পেট জ্বলে যাচ্ছে খিদেয়,প্রচণ্ড দাবানল যেন জ্বলছে সেখানে।প্রচণ্ড যন্ত্রণা সত্ত্বেও ও উঠে বসল।তারপর রুটিগুলো খেল।আটটা রুটি,ডাল,সব্জি আর মাংস যথেষ্ট।খেয়ে মনে হল,এত ভালো খাবার ও এর আগে কোনোদিন খায়নি।আয়েশা ভালো রান্না করে বটে,কিন্তু এত ভালো সেও কোনোদিন রাঁধেনি।রাঁধতে পারবেও না।পাবে কোথায় এত উপাদান!

    ওর মনে হল,পুলিশগুলো তত খারাপ নয়।মেরেছে,কিন্তু খাইয়েছে তো ভালো করে!ওর মনে পড়ে না,শেষ কবে মাংস খেয়েছে।বাড়ি গিয়ে কী হবে? মারে মারুক,এরকম নিশ্চিন্ত খাবার তো দিচ্ছে?সবকিছুরই তো দাম থাকে।

    তারপর ও কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না।সকালে ওয়ার্ডেনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল। খাবার নিয়ে এসেছে। খাবারের সুগন্ধে ওর জিভ সরেস হয়ে উঠল।ব্যথাটা আজকে আরও বেড়েছে,হাত নাড়াতে গেলেও মনকে তৈরি করতে হচ্ছে।তাও খাবারের লোভে ও মনটাকে শক্ত করল,লোকটার অসীম দয়া,খুব ধৈর্য্যশীল।একটা কথাও বলল না,একটুও বিরক্ত হল না।ওরা দরজা পর্যন্ত এসে খাবার নেওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইল।নইলে এখানে চাকরি পেত কি?তার মত নাকি?

    প্রাতঃরাশে চা, চারটে বিস্কুট,একটা চিকেন প্যাটিস এবং ডিমের ওমলেট।সে কী উপাদেয় খাবার,ও কোনোদিন কল্পনা করেছিল কি!

    তারপর খাওয়া হলে একজন এসে জায়গা নিয়ে গেল।তার কিছুক্ষণ পর একজন কনস্টেবল এসে ওকে অফিসারের কাছে নিয়ে গেল।ওকে অফিসার একটা কাগজে সই করিয়ে বলল,"তোকে ছেড়ে দিলাম এবারের মতো।কিন্তু এবারে এরকম কিছু করলে আর ছাড়ব না।"
    ওর খুব মন খারাপ হয়ে গেল।ছেড়ে দিল,এর মধ্যেই?দু-চারদিন রাখতে পারত,নাহয় দুবেলা ওরকম উদুম ক্যালাতো!

    তারপর সেখান থেকে বাস ধরে এখানে বাসস্ট্যান্ডে,সেখান থেকে হেঁটে বাড়ি।ব্যস।

    এসব বলা শেষ হওয়া মাত্র কাকটা আবার ডেকে উঠল বিকট স্বরে।পরিমল চমকে উঠল। "কী রে?"
    কিন্তু বাকিরা স্বাভাবিক থেকেই উত্তর দিল,"ওই কাকটা কাল থেকে ওখানে বসে আছে;কেন কে জানে!"
    সবাই জানে ওটা কী,কেন ওখানে বসে আছে।কিন্তু কেউ বলল না।
    কাকটা আবার একটা শব্দ করল।শুনে মনে হল,সে যেন উপহাস করছে।এবারে কাকটা যেন বলল,"শালা!"
    সবাই শুনল,কিন্তু কাক কি কথা বলতে পারে?ওদের মনের ভ্রম হয়তো!

    সমসুদ্দি পরিমলের কথা শুনে আফসোস করে বলল,"তাহলে তো আমাকেও ধরলে পারত।আমি খামোখা চলে এলাম।একটু বসে থাকলে আমাকেও ধরত নিশ্চয়।"বলে ফ্যাকাশে হাসল।
    অতীন্দ্র বলল,"তাহলে আমিও গেলে পারতাম তোদের সাথে। মারত,মারত,খেতে তো পেতাম।"
    আমিনা তাই শুনে বলল,"আমিও।"
    আয়েশা কিছু যেন বলতে চাইছিল।কিন্তু সে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল।
    আজকে ভাতের সাথে তরকারি কিচ্ছু নেই।শুকনো ভাত,তার সাথে শুকনো লঙ্কা ছেনে ভাত ভর্তা করা হবে।

    কাকটা তখনও একইভাবে বসে আছে।ওর মধ্যে সামান্যতম শৈথিল্য নেই,একটুও অন্যমনস্ক হচ্ছে না।ও যেন অনন্তকাল পর্যন্ত ঐভাবেই বসে থাকতে পারে।ওর দিকে তাকালেই কেমন গা ছমছম করে।মনে হয়,ও যেন অতীন্দ্রের আত্মাটা ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে।অতীন্দ্র ক্রমে নিস্তেজ হয়ে আসছে।

    এর চারদিন পর দিগন্তে আবার একদল লোকের উপস্থিতি দেখা গেল।সেই পূর্বোল্লিখিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল।ওরা হোভার করে আসছে,মাথার উপর কাক আর বজ্রগর্ভ মেঘের প্রহরা।ওদের বাহিনী যত এগিয়ে আসতে লাগল অতীন্দ্রের শ্বাসকষ্ট তত বাড়তে লাগল।

    ওরা এসেই বলল,"অতীন্দ্র বর্মন কোথায়?"
    ওরা তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যন্ত্রচালিতের মতো অতীন্দ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল। অতীন্দ্রের তখন নাভিশ্বাস উঠেছে।ওর দিকে তাকিয়েই অফিসারটা বিরক্ত হল।
    "ধুর,এরকম ন্যাকামি ভালো লাগে না।এই মালটাকে ঠিক করুন,নইলে সামনে থেকে নিয়ে যান।"
    ওরা খুব বিব্রত হল।বিশেষ করে আমিনা।সে তাড়াতাড়ি গিয়ে অতীন্দ্রকে ধরে তুলতে গেল। অতীন্দ্র ওকে ইশারা করতে লাগল,কিন্তু আমিনার দৃষ্টি অফিসারদের দিকে,সে খেয়াল করল না।টেনে হিঁচড়ে অতীন্দ্রকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল।ওর গায়ে যেন অমানুষিক বল।

    বাইরে এসে শুনল সমসুদ্দি অফিসারদের সাথে কথা বলছে।কথা বলছে,বলা বোধহয় ঠিক হল না। দয়া ভিক্ষা করছে, যাতে ওরা একটু ভেবে দেখে।প্রথমে মাফ করার কথা বলছিল,কিন্তু তার কোনরূপ সম্ভাবনা না দেখে কমানোর কথা বলছে।কিন্তু কমা তো দূরের কথা,বরং ডেট মিস করার জন্য আরো দু কোটি টাকা জরিমানা আরোপ করল।

    সমসুদ্দি এবার পায়ে পড়ে গেল।কিন্তু ওর শরীরের গন্ধে ওরা এতক্ষণ নাকে রুমাল চাপা দিয়ে কথা বলছিল,এবার তারা এরকম কীর্তি দেখে যারপরনাই বিরক্ত হল।একজন ভারী জুতো নিয়ে প্রচণ্ড একটা লাথি কষাল সমসুদ্দির মুখে।সমসুদ্দি নিথর হয়ে গেল।পরিমল,আমিনা আর আয়েশা ভাবল মরেই গেছে বুঝি।কিন্তু অপার্থিব ভয়ে ওরা নিঃশব্দ হয়ে রইল,একটা টুঁ শব্দটিও বেরোলো না কারো মুখ দিয়ে।
    ওরা বলে গেল,আগামী তিনদিনের মধ্যে যদি পেমেন্ট না পায়,ওরা এসে যা কিছু অবশিষ্ট আছে সব তুলে নিয়ে যাবে।

    ওরা চলে গেলে পরিমল ছুটে এল।এদিকে খবর পেয়ে সমসুদ্দির স্ত্রী জোবায়দা ছুটে এসেছে।সে সমসুদ্দির বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারস্বরে কাঁদতে লাগল।ঠিক তখন ওর নজর পাগলের মতো কাউকে খুঁজতে লাগল,তাকে না পেয়ে সব রোষ গিয়ে পড়ল আমিনা উপর।"হারামজাদী!খানকি মাগী! তোদের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমরা,যে আমাদের জীবনটা এমন ছারখার করে দিলি।"বলেই প্রচণ্ড আক্রোশে ওর দিকে ছুটে গেল।
    কেউ ধরল না তাকে,আয়েশা চুপ করে দাওয়ার একটা খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে ছিল,সেরকমই দাঁড়িয়ে রইল।তার মুখে একটা দ্বিধা কেটে যাওয়ার নিশ্চিন্ত ভাব।

    জোবায়দা আমিনাকে চুল ধরে মাটিতে ফেলে কিল,ঘুষি,চড়,থাপ্পড়,লাথি মেরেই গেল ক্রমাগত।পাগলের মতো সে আমিনার পরণের সব পোশাক ছিঁড়ে ফেলল।এতক্ষণ আমিনা কিছু বলেনি,কিন্তু জোবায়দা তার পোশাক ছিঁড়তে সে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল।তাতে জোবায়দা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল,গালাগালি আরও তীব্র,আঘাতের গতি এবং তীব্রতা দশগুণ হয় বর্ষিত হতে লাগল।

    সেই কাক এবার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বিকট স্বরে হেসে উঠল।সবাই পরিষ্কার শুনতে পেল কাকটা বলছে,"ওকে ওরকম মারলে হবে না,সমসুদ্দিকে বলো,ওকে এমন কিছু করুক,যেন ও কাউকে মুখ দেখাতে না পারে।"
    জোবায়দার মনের কথা যেন বলল কাকটা;জোবায়দা আবেগাপ্লুত হয়ে কাকটার দিকে ছুটে গেল,তার পায়ে ষষ্ঠাঙ্গ প্রণামের ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে শুয়ে বলল,"জয়!কাক বাবার জয়!"
    কাকটা উপভোগ করল ব্যাপারটা।সে তার যৌনাঙ্গ থেকে একচিলতে প্রস্রাবের ধারা বর্ষণ করল জোবায়দার মাথায়।সে ধন্য হয়ে গেল।মাথা থেকে সেই প্রস্রাব মুছে ভক্তিভরে চেটে নিল,তারপর জোড়হাত বুকে আর মাথায় ঠেঁকিয়ে চুমু খেল সেই হাতটা।

    আশ্চর্যের বিষয়,আয়েশা পায়ে পায়ে হেঁটে নেমে এল।সেও জোড়হাত করে দাঁড়াল কাকটার সামনে।কাকটা তার যৌনাঙ্গের দিকে ইশারা করল।আয়েশা তার সামনে অঞ্জলি পাতল,কাকটা আবার প্রস্রাব করল,আগের থেকে পরিমাণে একটু বেশিই।আয়েশা একইভাবে সেই প্রস্রাব খেয়ে বুকে-মাথায় ঠেকিয়ে চুমু খেল।তারপর জয়ধ্বনি দিল,"জয়! কাক বাবার জয়!"
    কাকটার যৌনাঙ্গ সে পরিষ্কার দেখেছিল,সেটা ছেলে নয়।
    আবার জয়ধ্বনি দিল,"জয়!কাকবাবার জয়!"

    এরপর একে একে পরিমল এল,জ্ঞান ফিরে পেতে সমসুদ্দি এল।তার পিছনে পিছনে গ্রামের আরো লোক এল।ক্রমে সেই জায়গাতে চাঁদা তুলে আস্তানা হল,পাশে একটা মন্দির।কাকটা দুটো শিফট দিতে লাগল,অর্ধেক দিন মন্দিরে,অর্ধেক দিন আস্তানায়।এদিকে অতীন্দ্রের হাঁফ বেড়ে চলল,কেউ তার খোঁজ রাখে না আর।শুধু আমিনা গায়ে একটা চটের বস্তা জড়িয়ে বসে থাকে তার পাশে,শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অতীন্দ্রের কোনো ডাকে সে সাড়া দেয় না।

    এর মধ্যে দুদিন কেটে গেছে।কাকটা বলল,"যদি এর কিছু বিহিত না করা যায়,ওই অফিসাররা গোটা গ্রামের পেছনে পড়বে।সব শেষ করে দেবে।"
    গ্রামের লোকেরা দিশেহারা হয়ে গেল।কাকটা ওদের ভয়টা মজ্জাগত হতে দিল।চুপচাপ বসে মুচকি মুচকি হাসতে থাকল।তারপর যখন সবাই প্রায় পাগলপারা হয়ে গেছে,সে বলল,"উপায় আছে।কিন্তু তোমার তা পারবে না।"
    লোকগুলো মরিয়া হয়ে উঠল,সবাই সমস্বরে বলল,"পারব বাবা ,পারব।আপনি শুধু আদেশ করুন।"
    কাকটা একটা চতুর হাসি হেসে বলল,"আমিনাকে জানিস তোরা?"
    সবাই চিৎকার করে বলল,"চিনি,চিনি। কী করতে হবে বলুন।হাত পা কাটতে হবে,খুন করতে হবে! কী করতে হবে বলুন শুধু।"
    কাকটা আবার রহস্যময় হাসি হাসল,তারপর সেই হাসি করুণার হাসিতে রূপান্তরিত হল।সে বলল,"না রক্তপাত করতে হবে না।ওকে শুদ্ধ করতে হবে।আমার সামনে নিয়ে এসোওকে।ওকে তোমাদের প্রসাদ দিতে হবে।"

    কয়েকজন সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেল।পরক্ষণেই ধরে নিয়ে এল তাকে।আমিনা ভাবলেশহীন মুখে ওদের সাথে এল।কোনরকম বাধা সে দিল না।কাকটা বলল,"ওকে ভালো করে স্নান করিয়ে নিয়ে এস।কিন্তু মেয়েরা যেন ওর অঙ্গস্পর্শ না করে।"
    সেই ছেলেগুলোর সাথে আরো কয়েকজন যোগ দিল।দলটি গ্রামের প্রতিনিধি,সব বয়সের পুরুষ সেই দলে আছে।
    তারা সোৎসাহে নিয়ে চলল তাকে স্নান করাতে।

    সাবান মাখিয়ে স্নান করে তাকে নিয়ে আসা হল।কাক বাবা এবার বললেন,"এবার মেয়েদের হাতে তুলে দাও ওকে।ভালো করে সাজিয়ে নিয়ে আসুক।ও ছেলেদের কম্ম নয়।"বলেই গগনবিদারি অট্টহাসি দিলেন কাক বাবা।সবাই বিরাট আমোদে হেসে গড়িয়ে পড়ল।

    আধঘন্টা লাগল সাজাতে।তারপর কাকবাবা বললেন,ওকে শোয়াও।আমিনা নিজেই শুয়ে পড়ল।তারপর কাক বাবা আদেশ দিলেন,"সবাই এস।ওকে প্রসাদ দাও।"
    সবাই একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল।ঘণ্টা ছয়েক সেদিন চলল প্রসাদ দেওয়ার ব্যাপারটা।যারা অংশগ্রহণ করল না,তারা দাঁড়িয়ে এই পবিত্র আয়োজন দেখে নিজের চোখ সার্থক করল।এমন পূণ্যের কাজ কজন করে,কবার করে,সুযোগ পায় কি?

    যখন সব শেষ হল, রাত প্রায় এগারোটা।আমিনা নিশ্চল হয়ে পড়েছিল।তার খোলা চোখ দিয়ে জলের ধরা গড়িয়ে পড়ে শুকিয়ে একটা সাদা রেখা তৈরি হয়েছিল,তার দুধারে বাদামী সীমানা।কাক বাবা বললেন,"ওকে এবার তুলে আগে ডাক্তার দেখাও।

    ডাক্তার এল,কোনো সমস্যা নেই।তবে গর্ভসঞ্চার হতে পারে,তাই একটা গর্ভনিরোধক ওষুধ খাইয়ে দিলেন।এবার কাকবাবার আদেশে স্নান করিয়ে খাওয়ানো হল আমিনাকে।কাক বললেন,"ওকে শুতে দাও।কালকে অফিসাররা আসবেন।ওকে নিয়ে যাবেন পেমেন্ট হিসেবে।"

    পরদিন সত্যিই অফিসাররা এল।অতীন্দ্রকে ডাকতে গিয়ে সমসুদ্দি দেখল,তার জ্ঞান নেই।নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে দেখল নিঃশ্বাস পড়ছে।সে গিয়ে বলল অফিসারদের।তারা প্রচণ্ড রেগে অতীন্দ্রের অবশিষ্ট কী আছে জিজ্ঞেস করলেন।কিচ্ছু নেই।

    পরিমল এগিয়ে এল।"স্যার,ওর তো কিছুই নেই।তবে ওর মেয়েটা আছে।ওকে যদি চান নিয়ে যেতে পারেন।"
    অফিসারদের চোখ চকচক করে উঠল।
    "সে নাহয় নিয়ে যাব।কিন্তু তাতে কি পুরোটা উঠবে?এক কাজ করো, অতীন্দ্রের শরীরটাও আমরা নেব।ও মরে গেলে ওর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিক্রি করে দেখব কতটা পূরণ করা যায়!তবুও কিছু বাকি থাকবে,কিন্তু কী আর করা যাবে?"
    "আচ্ছা, অতীন্দ্র বর্মনের মেয়েটাকে নিয়ে এস।

    আমিনাকে আয়েশা নিয়ে এল।আজকে অনেকদিন পর  তার পরনে ভালো পোশাক।গ্রামের লোকেরা চাঁদা তুলে কিনে দিয়েছে।একটা লাল বেনারসি শাড়ি,গয়নাও আছে কিছু।ওরা আমিনাকে কাঁধে তুলে নিল,তারপর মনে পড়ল,কথাটা পাকাপাকি হয়নি তো!
    আবার ওকে কাঁধ থেকে নামিয়ে পরিমলকে বলল,"এই কাগজটা নিন,এতে অতীন্দ্র মরে গেলে যে তার শরীর আমাদের,তার আইনি কাগজ।এটা তার সই করিয়ে আনুন।পরিমল টিপসই করিয়ে এনে দিল।ওরা নিয়ে চলে গেল।

    গ্রামে কেউ নেই। মানে,নেই ঠিক নয়,কেউ 
    অতীন্দ্রের উপস্থিতি খেয়াল করে না আর।করতে চায় না।আমিনাকে ওরা নিয়ে চলে যাওয়ার পর,সে আরো কারো সাথে কথা বলারও চেষ্টা করে না।ধীরে ধীরে একটা দেওয়াল খুব স্পষ্ট হয়ে গড়ে উঠতে লাগল ওর চারপাশে।
    সেদিন ও শুনতে পেল,আয়েশা বলছে,"এই লোকটাকে ঘর থেকে বের করে দাও না কেন?খামোখা ঘরজোড়া করে বসে আছে,এক পয়সা রোজগার করে না, অন্ন ধ্বংস করছে বসে বসে।"
    পরিমলের কোনো আওয়াজ অতীন্দ্র পেল না।
    আয়েশা আবার বলল,"তুমি কিছু করবে,না আমিই বলে দেব?ঝেঁটিয়ে বিদেয় করো এই অপদটাকে।"
    পরিমলের গলা শোনা গেল। অতীন্দ্র কান পেতেছিল বলে তাই,"লোকটাকে তো নিজে ডেকে এনেছি,এখন কী করে বলি বলোতো?"
    -"কী করে বলি? নুন আনতে তো পান্তা ফুরায়,আবার এই জমিদারি করলে চলবে তো?এদিকে কর্ভাস বাবাকে প্রতি শুক্রবারে খাওয়াতে হয়,সে খেয়াল আছে?সবাই কত ভালোমন্দ দিচ্ছে,আমাদেরকেও তো সেরকম দিতে হবে? কর্ভাস বাবা নেহাত ভালো লোক,যা দিই খেয়ে নেন,কিন্তু নিজের তো বিবেক বলে একটা জিনিস আছে?"
    পরিমলের মিনমিনে গলা শোনা গেল আবার,"আচ্ছা,তোমার যা ভালো মনে হয় করো।"
    আয়েশা এবারে আর সভ্যতার বালাই রাখল না।সে চেঁচিয়ে,খুব সম্ভবত উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল,"আমি করব,আর তুমি কী করবে,ভালো মানুষ সাজবে?ও চলবে না।বলবে,তুমিই বলবে,আর এক্ষুণি বলবে।যদি লজ্জা লাগে আমি সাথে যাচ্ছি চলো।"
    বলেই সে পরিমলের হাত আকর্ষণ করল হয়তো।পরিমল স্বর ততোধিক খাদে নামিয়ে বলল,"কী করছ কী?পাগল হয়ে গেলে নাকি?লোকটার সব গেছে,একটা মেয়ে ছিল শেষ সম্বল,তাও নেই।এক্ষুণি বলা যায়?একটু দাঁড়াও,আমি দেখেশুনে বলব।এত অধৈর্য্য হলে চলে?তুমি বসো।"
    কথাটা আয়েশার মনে ধরল।সে আর উচ্চবাচ্য করল না।

    এর কিছুদিন পর সন্ধ্যাবেলায় অতীন্দ্র ঘরে বসে বসে কী ভাবছিল,পরিমল গলা খাঁকারি দিল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে।অতীন্দ্রর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল।সে চমকে উঠে বলল,"কে;ও পরিমল? আয় আয় ভেতরে আয়।"সে একটু উঠে বসার চেষ্টা করল,কিন্তু তাতে তার হাঁফ ধরে গেল।পরিমল ইতঃস্তত করে দাঁড়িয়ে রইল। অতীন্দ্র মিনিট দুয়েকের মধ্যে ঠিক হয়ে গেল।
    -"বোস না?"
    পরিমল অপ্রস্তুত,বলল,"ঠিক আছে।"
    তারপর একটু থেমে বলল,"একটা কথা বলছি....তুই তো জানিস আমার অবস্থা।ছেলেমেয়ে বড়ো হচ্ছে,ওদের থাকার জায়গা দরকার,আমরা চারজন দুটো কামরায় থাকি,আর একটা হলে ভালো হতো।"
    অতীন্দ্র জানত একথা উঠবে।সে মাটির দিকে চেয়েছিল।সেদিকে তাকিয়েই নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল,"তা তুই কি আমাকে আজকেই ছেড়ে যেতে বলছিস?"
    পরিমল দ্রুত বলল,"না,না,আজকের রাতটা থাক,কাল সকালে যাবি।আমি তোর বাড়ির ওখানে ত্রিপল খাটিয়ে দিয়েছি। একটা চাটাই আর একটা বালিশও রেখে এসেছি।আমরা তো আছিই,তোর অসুবিধা হবে না।"
    অতীন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।পরিমল ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।

    বাইরে ওদের চাপা উল্লাসের শব্দ শুনতে পেল অতীন্দ্র।এটাই কি হওয়ার ছিল না?
    সে বিড়বিড় করে বলল,"পরের সোনা দিও না কানে, কেড়ে নেবে ভোর গাজনে।"

    পরদিন সকালে পরিমল অতীন্দ্রকে ডাকতে এসে দেখল,বিছানা ফাঁকা,ঘর খালি।তার বুক হঠাৎ খুব হালকা হয়ে গেল।এত সহজে ব্যাপারটা মিটে যাবে,সে আশা করেনি।সে ভেবেছিল কতগুলো আবেগপূর্ণ দুঃখের কথা শুনতে হবে,হয়তো গলাবাজি করতেও হতে পারে,কিন্তু কিছুই না।সব নির্ঝঞ্ঝাটে মিটে গেল।সে,"আয়েশা,আয়েশা" বলে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

    কদিন পর,কয়েকজন দেখল,গ্রামের সীমান্তে যেখানে রাস্তাটা গ্রামে ঢুকেছে,প্রচণ্ড কুকুরের চিৎকার। লোকে প্রথমে ভেবেছিল গ্রামের কুকুরগুলো হয়তো নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে।কিন্তু দেখল চিৎকারটা ক্রমে গ্রামের কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে আসছে।কাছে আসতে দেখা গেল,একদল পুলিশ।ওরা গ্রামের মধ্যে ঢুকে ঘেউ ঘেউ করে প্রচণ্ড চিৎকার করতে আরম্ভ করল।লোকে বুঝতে পারল ওরা কিছু বলার চেষ্টা করছে।কিন্তু কী বলছে বুঝতে পারল না।পুলিশগুলো এবারে ধৈর্য্য হারাচ্ছিল।সামনে যে লোকটা ছিল সে জিজ্ঞেস করল,"স্যার কী বলছেন বুঝতে পারছি না।"
    এবারে পুলিশের সহ্যের সব সীমা ছড়িয়ে গেল।সে লোকটাকে ধরে তার ঘাড়ে কামড়ে দিল।লোকটা এমনিতেই ছিল রোগা পটকা, কামড়াতেই নেতিয়ে পড়ল।পুলিশটা তবুও তাকে ছাড়ল না।তার ঘাড় থেকে পিঠ,বুক বিয়ে রক্ত পড়তে লাগল।এই দৃশ্য দেখে আশেপাশের লোক ভয়ে দৌড় দিল।সবাই গিয়ে পড়ল কর্ভাস বাবার সামনে।

    কাক সব শুনে বললেন,"চিন্তা নেই।ওদের আমার কাছে ডাকো।আমি বলে দিচ্ছি।"সবাই এ ওকে ঠেলতে লাগল।তাই দেখে কাক বললেন,"সবাই মিলে যাও।"
    সবাই মিলে ভয়ে ভয়ে গেল।তারা কোনমতে দূর থেকে দাঁড়িয়ে বলল,"আমাদের কর্ভাস বাবা আপনাদের ডাকছেন।আপনারা যা জানতে চাইছেন তিনি বলতে পারবেন।"
    বলেই তারা দৌড় দিল।

    পুলিশগুলো কাকের কাছে গেল।কাক তাদের কথা শুনে বুঝতে পারল,ওরা এসেছে অতীন্দ্রের খোঁজে।ট্যাক্স না দেওয়ার জন্য,এবং তারপর তাড়াতাড়ি না মরার জন্য আয়কর দপ্তর তার উপর মামলা করেছে।পুলিশ এসেছে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আদালতে পেশ করার জন্য।তিনি ওদের অতীন্দ্রের বাড়ির পথ দেখিয়ে দিলেন।ওরা চলে গেল।

    এরপর একমাস আর অতীন্দ্রের দেখা নেই।তার বিচার চলছে।ইতিমধ্যে কয়েকজন মাঝে মাঝে সে বিচারের শুনানিতে যায়।সেখানে শেষদিন ওরা যখন ফিরে এল,সন্ধ্যায় সবাই তাদের ঘিরে বসল।বিচারের রায় দিয়েছে আজ।অতীন্দ্রকে বিচারক বলেছেন আর বেশিদিন বাঁচা যাবে না।তাহলে ট্যাক্সের পরিমাণ সুদে বেড়ে অনেক হয়ে যাবে। তা এমন মহাজাগতিক পরিমাণে গিয়ে দাঁড়াবে,যে ওর আগামী একশ প্রজন্মকে বিক্রি করলেও মেটানো যাবে না। তাই অতীন্দ্রকে দ্রুত মরতে হবে। অতীন্দ্র আপিল করেছিল ফাঁসি দেওয়ার।কিন্তু তাতে নাকি অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহের ক্ষতি হয়ে যাবে।সেগুলো বিক্রি করে আর ক্ষতিপূরণ করা যাবে না।তাই তাকে নিজেকেই মরতে হবে,তবে হঠাৎ আত্মহত্যা নয় (যেমন - গলায় দড়ি,বিষপান,শিরাকাটা ইত্যাদি।),নিজের ফুসফুসের অবনতি দ্রুত করতে হবে,যাতে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হয়।

    অতীন্দ্র বাড়ি ফিরেছে।সবাই দেখল অতীন্দ্র খুব অধ্যাবসায়ের সাথে নিজের ফুসফুসকে নষ্ট করছে।সে প্রতিদিন নিয়মিত ধুলো শোঁকে,বুকভরে ধোঁয়া টেনে নেয়।এখন সে আর উঠে বসতেও পারে না,সারাদিন প্রাণান্তকর কাশতে থাকে।কিন্তু ধুলো শোঁকা,ধোঁয়া টানা বন্ধ করে না।সবাই নির্নিমেষ চক্ষে দেখে,কিভাবে স্বাভাবিক মরার মতো আত্মহত্যা করতে হয়।শিক্ষার কি শেষ আছে?

    এর পরে আর বেশি কিছু নেই।সপ্তাহখানেক বেঁচে ছিল অতীন্দ্র।তার মৃত্যুর পর মৃতদেহ পড়ে রইল ঘরের মধ্যে।মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক আগেই ওরা এসে পৌঁছে গিয়েছিল।বরফ,বাক্স সব নিয়ে তৈরি ছিল ওরা।মরে যেতেই একজন দক্ষ হাতে সুনিপুণভাবে অতীন্দ্রের শরীরটাকে চিরে ফেলল।সবার প্রথমে ভেতরের অঙ্গগুলো বের করে নিল।বেশি দেরি করলে সেগুলো আর কোনো কাজেই লাগবে না।একে একে হৃদপিন্ড,যকৃৎ,পাকস্থলী,ক্ষুদ্রান্ত্র,বৃহদন্ত্র,অগ্ন্যাশয়,বৃক্ক,মূত্রথলি তারপর অন্ডকোষ এবং পুরুষাঙ্গ বের করে বরফ দেওয়া শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাক্সগুলোতে রাখল একে একে।তারপরেই চালান করে দিল গাড়ির ভেতরে।সেখানে পরিবেশটা আরো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

    এবারে ওর শরীরের উপরের চামড়াটা ছাড়াতে লাগল।সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করা লোকেদের চামড়ার কদর খুব।বেশ টেকসই চামড়া হয়, পালিশও হয় খুব ভালো।এক ঘণ্টার মধ্যে সব কাজ শেষ।তারপর খুব সন্তর্পণে ওরা রক্তবাহ গুলো বের করে নিল মাংসের ভেতর থেকে।শেষে শুধু পড়ে রইল,মাংস আর হাড়।তাও হাড়ের মজ্জাগুলো বের করে নিয়েছে আগেই।

    একজন খুব কৌতূহলী লোক সাগ্রহে ব্যাপারগুলো দেখছিল।সে জিজ্ঞেস করল,"স্নায়ুগুলো নেবেন না,স্যার?"
    একজন সার্জন তার দিকে না তাকিয়েই তাচ্ছিল্যভরে বলল,"না,বের করতে করতেই ওটা মরে যাবে।"

    কাকগুলো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।আর ছিল ওদের কুকুরগুলো;পাড়ার কুকুরগুলো করুন চোখে তাকিয়ে দেখছিল পুরোটা।ওরা জানত,ওদের ওই মাংসতে দাবি সবচেয়ে বেশি,কিন্তু ওরা হয়তো কিচ্ছু পাবে না। সার্জেনরা নিজেদের কাজ সেরে গাড়ির কাছে গেল।একজন একটা ট্রে এগিয়ে দিল,ওরা হাতমোজাগুলো খুলে তাতে রাখল।তারপর সাবান দিয়ে হাত ধুলো।খুব ভালো করে রগড়ে রগড়ে। কাক আর কুকুরগুলো হামলে পড়েছে অতীন্দ্রের অবশিষ্ট দেহের উপরে।একজন একটা কাটারি নিয়ে বসেছে একটা পিঁড়ের উপর।মাংস আর হাড়গুলো কেটে কেটে একটা করে ফালি শূন্যে ছুঁড়ে ফেলছে,আর কুকুরগুলো লাফিয়ে উঠছে, কাকগুলোও কম যায় না।তারা কুকুরগুলো লাফিয়ে ওঠার আগেই লুফে নিচ্ছে।কিন্তু ভারী টুকরোগুলো নিয়ে ভেসে থাকতে পারছে না।ফলে পড়ে যাচ্ছে।আর কুকুরগুলো অতীন্দ্রের মাংসের সাথে ওদেরকেও পেটের মধ্যে চালান করে দিচ্ছে।

    সার্জনদের প্রত্যেকের হাতে এখন এক কাপ করে চা।একজন সিগারেট ধরিয়েছে।গল্প করতে করতে ওরা এই দৃশ্যটা উপভোগ করছে।

    "শালা,গরীব!"
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন