যে কোনো প্রতিবাদ, আন্দোলন, সাফল্য, সচেতনতা – অর্থাৎ যা কিছু সমাজকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, মুখে আয়না ধরার, বা নিজ-সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে, তা গৌরবের।
কিন্তু এই চেষ্টায় কোনো লাভের অঙ্ক না থাকলে তাকে ব্যক্তি বা নিরপেক্ষ দলের আয়ত্ত্বে রাখা ভয়ানক কঠিন। কারণ (অপ)ব্যবহার করার, হাইজ্যাক করার, স্পটলাইট ভাগ করে নেওয়ার জন্যে তলে তলে সর্বদা তৈরি হয় একদল ধান্দাবাজ। অনেক আগে থেকেই। এই উদ্দেশ্যেই বিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে বিপাকে ফেলতে দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যান বিরোধী নেতা; সরকারপক্ষের কোনো সাহায্য ছাড়া কোনো নাগরিক আন্তর্জাতিক আঙিনায় সৌভাগ্য/সাফল্যের মুখ দেখলে সর্বাগ্রে তাকে ফোন বা সেই নিয়ে ট্যুইট করেন সর্বাধিনায়ক; মূল্যবৃদ্ধি আটকানোর কোনো চেষ্টাই সরকারে বসে করে না যে দল, তারাই বিরোধীর আসনে বসে অন্যদের ধোলাই করে; যার বাঁ-হাত বিজ্ঞান কংগ্রেস ধ্বংস করে, মহাকাশ-অভিযানের সাফল্যে তারই বেঢপ ডানহাতে দোলে জাতীয় পতাকা, ক্যামেরার ফোকাসে চাঁদ নয়, ধড়িবাজের ফ্যাকাশে চাঁদবদন থাকে।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন ছাত্রদের হাত থেকে জামাতের হাতে চলে যাচ্ছে/গেছে, হিংসার জন্যে আর অজুহাতও দরকার হচ্ছে না — এ তাই আশ্চর্য নয়। স্বৈরাচারী যেমন নিজের আচরণের অজুহাত হিসেবে স্থিতাবস্থাকে দাঁড় করায়—যেমন করেছিল আওয়ামী লিগ – বদলের উত্তেজনার, ধোঁয়ার আড়ালে তেমনই দাঁড়িয়ে থাকে আদিম ধর্মোন্মাদের প্রাচীন ঘেন্না। সোনার বাংলাদেশ গলিয়ে দেবে এই ধর্ম-ছাগলের দল। এরা নাস্তিক ব্লগারদের কুপিয়ে মারতো নিয়মিত; শিশু থেকে বুড়ো অর্ধশিক্ষিতকে ধর্মগুরুর আসনে বসিয়ে সমাজকে টেনে পিছনে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে রোজ।
আরবী চাঁদের মধ্যযুগীয় আলোয় বাঙালিকে পোড়াচ্ছে আরেক বাঙালি। আমরা অবাক হচ্ছি হয়তো, কারণ আমাদের রোজনামচায় পড়শিকে পিটিয়ে মেরে ফেলার, পাড়ায় আগুন লাগানোর কথা লেখা থাকে না। কিন্তু অন্তরের পিশাচ সেই পাঠ দৈনিক মুখস্থ করে। নইলে নির্বাচনে জয়ের অছিলায় এ রাজ্যে মানুষ মরতো? জেতার জন্যে নয়, সে তো পশুরাও করে—জেতার পরে?
ক-দিন আগেই দুই বাল্যবন্ধুর থেকে জানলাম, অলিম্পিয়াড-জয়ীদের উনিজি ফোন করায় তারা খুশি। সেটাই স্বাভাবিক। ভদ্র ব্যবহার, সৌজন্য – এসবের সঙ্গে আমরা 'শুভ'-কে যোগ করতে অভ্যস্ত। এই প্রতিবর্ত শুভানুভূতির থেকে পছন্দের জন্ম হয়, আর তার থেকে অচিরেই আসে আনুগত্যের বোধ। নইলে যে লোক গোটা অতিমারী-পর্ব ছড়িয়ে ছত্রিশ করার পর ভ্যাক্সিন সার্টিফিকেটে অন্য সকলের নাম সরিয়ে নিজের লালায়িত লোলচর্মের সহাস্য নির্লজ্জ ছবি দেয়, গোটা মণিপুর কাণ্ডে অনন্তকাল সম্পূর্ণ নৈঃশব্দ্যপালনের পর পাশের দেশের বিপন্ন হিন্দুর ভালমন্দের কথা ভেবে কুমিরের কান্না জোড়ে, তার ফোনকলের ওপর অত ভরসা তারা রাখতো না।
আওয়ামী-পতন জরুরি ছিল, আর তার জন্যে ছিল ছাত্র থেকে শুরু হওয়া গণ আন্দোলন। জামাতের গলায় বকলশ না পরালে, সেই কৃতিত্বের সঙ্গেই এই আন্দোলনের কপালে বাংলাদেশকে এক যুগ পিছিয়ে দেওয়ার দায়ও জুটবে।
দেখে শেখা সর্বদাই শ্রেয়। এ দেশের/রাজ্যের স্বৈরাচার থামানোর জন্যে উঠে পড়ে লাগার সময়ে আপন ঘরের লুকোনো ধান্দাবাজদের অঙ্কশায়ী হওয়ার সময় এই শিক্ষার কথাও যেন আমরা মনে রাখি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।