ভারতের নাগরিকেরা কি তবে আর ভারতীয় গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ উৎসব, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইছেন না? অন্তত নির্বাচন কমিশনের তথ্য তো তাই বলছে। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং তারপরে যে কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ভোটদানের হার ক্রমশ কমছে। গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনের আগে, নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে মৌ চুক্তি অবধি করেছিল, যাতে সেই সব সংস্থাতে কর্মরত মানুষেরা ভোট দিতে অনীহা প্রকাশ না করেন। যে সমস্ত কর্মীরা নির্বাচনে অংশ নেবেন না, তাঁদের নামের একটি তালিকা অবধি প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। বিরোধীদের তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়, এই বন্দোবস্ত তো ‘বাধ্যতামূলক’ ভোটদানের প্রক্রিয়া, কোনও গণতন্ত্রে একজন মানুষ, নানান কারণে ভোট নাও দিতে চাইতে পারেন, তা’বলে কি একজন মানুষকে ভোটদানে অংশ নিতে বাধ্য করা যায়?
তখনকার মত পিছিয়ে গেলেও, নির্বাচন কমিশন কিন্তু তাঁদের বক্তব্য থেকে এতটুকুও সরে আসে নি, যে ভোট দেওয়ার হার ক্রমশ কমছে, ভারতীয় নির্বাচকদের মধ্যে যে একটা অনীহা দেখা যাচ্ছে, তার কী কী কারণ, তা খোঁজার চেষ্টা করেই চলেছে, এবং ভোট দেওয়ার হার বাড়ানোর কী প্রক্রিয়া নেওয়া যায়, তার উপায় বের করারও চেষ্টা করা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। দেখা গেছে, গড়ে ভারতীয় নির্বাচনে ৬৫ শতাংশ ভোট পড়ে। কমবেশি, একটু এদিক ওদিক হলেও, মোটামুটি দেখা গেছে ভোটদানের শতাংশ প্রায় এইরকমই থাকে। তার অন্যতম একটি কারণ অনুসন্ধান করে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা, যাঁরা কাজের প্রয়োজনে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পাড়ি দেন, তাঁরাই যখন নিজের রাজ্যে ভোট হয়, মূলত অনুপস্থিত থাকেন। ২০১৭ সালের একটি অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, এই পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা গত দু- দশকে বেড়েই চলেছে। ঐ সমীক্ষা অনুযায়ী, মোটামুটি দেখা গেছে এই সংখ্যাটা ১৪ কোটি থেকে ৪০ কোটির মধ্যে। কোভিডের সময়ে আমরা যে বিপুল, সংখ্যক মানুষকে, ট্রেন-বাস বন্ধ থাকার কারণে, হেঁটে ফিরতে দেখেছি, তা এই সমীক্ষাকেই মান্যতা দেয়। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, মূলত এই পরিযায়ী শ্রমিকেরাই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে, নির্বাচন হয়, যে সংস্থাতে তাঁরা কাজ করেন, তাঁরাও ছুটি দিতে চান না, ছুটি মিললেও, যাতায়াতের খরচও অনেকটাই বেশি, তাই তাঁরা এতো টাকা খরচ করে, আর ভোট দিতে যাওয়ার উৎসাহ বোধ করেন না। মূলত, এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা, যাতে সামনের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, তাই নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এইবার ‘রিমোট ভোটিং’ ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছেন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এই প্রযুক্তি দিয়ে কিভাবে বাড়ি থেকে দূরে থেকেও ভোট দেওয়া যাবে, সেই বিষয় ব্যাখ্যা করার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে, ইতিমধ্যেই মতপার্থক্য দেখা গিয়েছে। বাম এবং আরজেডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাঁরা এই প্রযুক্তি দেখে, তবেই সিদ্ধান্ত নেবেন। কংগ্রেস, ডিএমকে এবং তৃণমূল কংগ্রেস এবং আরও বেশ কিছু দল, সরাসরি এই প্রযুক্তি নির্ভর নির্বাচন ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছে, আবার তেলেগু দেশমের মত কোনও কোনও দল এই ‘রিমোট’ ভোটিং বিষয়টিকে সমর্থন জানিয়েছেন। আগামী ২৫শে জানুয়ারি, জাতীয় নির্বাচক দিবসে, এই বিষয়টি যদি গৃহীত হয়, তাহলে সরকারীভাবে ঘোষিত হবে।
বেশ কিছু প্রশ্ন কিন্তু ইতিমধ্যেই এসে গেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বা সংসদে যখন কোভিডের সময়ে কতজন পরিযায়ী শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন, সেই নিয়ে কোনও কোনও বিরোধী সাংসদ প্রশ্ন তুলেছিলেন, তখন সরকারের তরফে বলা হয়, তাঁদের কাছে এই সংক্রান্ত কোনও তথ্য নেই, কিন্তু তাও সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে এতো চিন্তিত হয়ে পড়েছে কেন? কি করে নির্বাচন কমিশন এতো জোর দিয়ে বলছে, যে পরিযায়ী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বাড়লেই, গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে? কমিশনের তরফে বলা হয়েছে, একটি নির্বাচনী বুথে, একটি রিমোট ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বসিয়ে, ৭২ টি বিধানসভার ভোট করানো যাবে, সেইরকম প্রযুক্তি তাঁদের কাছে আছে। সুতরাং, আগামী সাধারণ নির্বাচনে মাত্র ৭টি এই ধরনের বুথ তৈরি করা গেলে, পুরো দেশের নির্বাচনে পরিযায়ী শ্রমিকদের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করা যাবে।
কিছু কিছু দেশ এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করিয়েছে, যার মধ্যে রাশিয়াতে কোভিড পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালে, মস্কো শহরের ডুমাতে যে নির্বাচন হয়, তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। যদিও সেখানকার আদালত, সমস্ত অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে, কিন্তু তাও সেই প্রশ্নগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত বলা হয়েছে, এই পদ্ধতিতে, আসল নির্বাচকই যে ভোট দিচ্ছেন, তাঁকে কি করে চেনা যাবে? তার মানে যাঁরা নির্বাচক নন, তাঁদের নামও ভোটার তালিকায় উঠতে পারে। দ্বিতীয়ত, একজন নির্বাচক যে কোনও ভয়ভীতি ছাড়া, নিজের ভোট নিজে দিতে পারছেন, তার নিশ্চয়তা কোথায়? তৃতীয়ত, প্রতিটি মানুষ, ইন্টারনেট ব্যবহারে একইরকম সড়গড় নাও হতে পারেন, সেক্ষেত্রে কী হবে? রাশিয়ার ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন উঠলে, ভারতের ক্ষেত্রে তার কি প্রভাব পড়তে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। শেষে, সবচেয়ে জরুরী বিষয়টি উঠে আসে, তা হল, এই ধরনের প্রযুক্তি নির্ভর যন্ত্র দিয়ে নির্বাচন হলে, তাতে নির্বাচন কমিশনের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না, থাকে কিছু প্রযুক্তিবিদদের, যাঁরা দূর থেকেও এই যন্ত্রগুলোকে চালাতে পারবেন।
আজ অবধি কোনোদিনই কোনও প্রযুক্তিবিদকে দিয়ে কোনও ইভিএম বা ভিভিপ্যাট মেশিন পরীক্ষা করানো হয়নি, সুতরাং আগামী দিনে যে এই রিমোট ইভিএম মেশিন পরীক্ষা করতে দেওয়া হবে, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? সাধারণ মানুষ এমনিতেই প্রযুক্তির বিষয়টা কম বোঝেন, তাই আরও কিছু বিষয় আছে, যা আলোচনার প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন বেশ কিছু বিষয়ে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে। কি প্রক্রিয়ায়, অন্য রাজ্যে নির্বাচনের আদর্শ আচরণবিধি লাগু রাখা হবে, কিভাবে আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী মানুষদের চিহ্নিত করতে হবে এবং কীভাবে তাঁদের জন্য একটা নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, যাতে তাঁরা নির্ভয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর উচিৎ আরও বেশ কিছু প্রশ্ন তোলা। কারা নির্বাচনে এজেন্ট হতে পারবেন, তাঁদের ভূমিকা কি হবে, কীভাবে প্রচার হবে? উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। ধরা যাক, তৃণমূল কংগ্রেস দলের ব্যাঙ্গালোরে তেমন প্রভাব নেই, তাহলে বাংলায় যখন নির্বাচন হবে, কোনও একটি বিধানসভার কেন্দ্রের প্রার্থী কিভাবে তাঁর প্রচার করবেন? অনেকে বলতে পারেন, আজকের হোয়াটসঅ্যাপের সময়ে, সামাজিক মাধ্যমের যুগে এই প্রচার কোনও বাধাই হতে পারে না, কিন্তু বিষয়টা কি এতোটাই সরল? একটি জাতীয় পার্টি যতটা সুবিধা এবং সংবাদমাধ্যমে যতটা জায়গা পায়, ততটা কি একটি রাজ্যস্তরের দল পায় বা পেতে পারে? নির্বাচন কমিশন মুখে যতই বলুক, নিয়ম সবার জন্য সমান, কিন্তু বাস্তবে কি তাই হয়? আবার ধরা যাক, বামেদের রাজনৈতিক প্রভাব হয়তো বেশ কিছু পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে আছে, কিন্তু তাঁদের সাংগঠনিক তেমন উপস্থিতি নেই, তাহলে তাঁরা কিভাবে তাঁদের প্রভাবিত নির্বাচকদের ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যাবেন অন্য একটি রাজ্যে? এই প্রশ্নগুলো তো রাজনৈতিক দলগুলোকেই তুলতে হবে। হয়তো এই রিমোট ভোটিং চালু করলে, ভোটদানের হার বাড়তে পারে, কিন্তু বেশ কিছু বিধানসভা কেন্দ্র, এই পদ্ধতির ফলে নিশ্চিত প্রভাবিত হবে। আরও একটি জরুরী বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর মাথায় রাখা উচিৎ, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের সময়ে, তা হল, মূলত কোন সামাজিক বিন্যাসের মানুষজন পরিযায়ী শ্রমিক হচ্ছেন, তাঁদের কতজন হিন্দু এবং কতজন অন্য ধর্মের? একজন ব্যাঙ্গালোরে, আইটি সেক্টরে কাজ করা মানুষ ও পরিযায়ী আবার একজন গুজরাটে গয়না শিল্প বা দিল্লির নয়ডায় কাজ করতে যাওয়া রাজমিস্ত্রিও পরিযায়ী। মূলত দেখা যায় গরীব মুসলমান মানুষজন শ্রমিক এবং গয়না শিল্পতে নিযুক্ত হন, আর সফটওয়ার সংস্থায় কাজ করা মানুষজন হিন্দু। এই রিমোট ভোটিং পদ্ধতি চালু হলে, কোন কোন বিধানসভা প্রভাবিত হবে, তা ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে হিসেব না থাকলেও বিজেপির কাছে আছে, তাই তাঁরা চাইছেন, খুব তাড়াতাড়ি নির্বাচন কমিশন যেন এই পদ্ধতি চালু করে। এখন দেখার কিভাবে এই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে আঞ্চলিক দলগুলো।
এমনিতেই গত কয়েক বছরে, নির্বাচন কমিশনের স্বশাসন এবং স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে, এবং তার যথেষ্ট কারণ ও আছে। গত কয়েকবছরে বারংবার দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশন শাসক বিজেপিকেই সহায়তা করেছে, তার উদাহরণও আছে আমাদের সামনে। সদ্য শেষ হওয়া গুজরাট নির্বাচনেই, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেছিলেন যে ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যায়, দাঙ্গাবাজদের উচিৎ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তখনও কিন্তু নির্বাচন কমিশন একটি প্রতিবাদও করেনি, উল্টে বলেছে, এই কথার মধ্যে দিয়ে কোনোভাবেই নির্বাচনের ‘আদর্শ আচরণবিধি’ লঙ্ঘিত হয়নি। এছাড়া ইভিএম এখনও প্রশ্নাতীত নয়। ভিভিপ্যাট গণনা করা নিয়ে বিরোধীরা বারংবার আবেদন করা সত্ত্বেও, নির্বাচন কমিশন এখনও তাতে কর্ণপাত করেনি, এবং আগামীতেও করবে, এমন ইঙ্গিত নেই।এরপরে নতুন প্রযুক্তি, নতুন ধরনের ভোটদানের ব্যবস্থা করা ‘রিমোট’ ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন, বিরোধী দলগুলোকে কতটা সন্তুষ্ট করতে পারে, তাই দেখার। কিন্তু, শুধু বিরোধী দলগুলো সন্তুষ্ট হলেই তো হবে না, গণতন্ত্রে প্রতিটি নির্বাচক গুরুত্বপূর্ণ, নির্বাচন কমিশনের কি দায়িত্ব নয়, যিনি ‘নোটা’ তে ভোট দেন, তাঁকেও সন্তুষ্ট করার?