২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী তখনও ক্ষমতায় আসেননি, সারা দেশে তখন একটাই শ্লোগান ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, নিজেও চুরি করবো না, অন্যকেও চুরি করতে দেবো না। সারা দেশের সমস্ত মানুষ তখন একযোগে একটাই কথা বলছেন, একমাত্র নরেন্দ্র মোদীই পারবেন, দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে। মানুষের মনে তখন অনেক আশা, গত সত্তর বছর ধরে, কংগ্রেস এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলো যেভাবে চুরি করে, দেশটাকে ফোঁপড়া করে দিয়েছে, তাতে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদীই এখন একমাত্র পারেন দেশকে রক্ষা করতে। তাই শ্লোগান উঠেছিল, ‘আব কি বার, মোদী সরকার’, অর্থাৎ এবার চাই মোদী সরকার। কিন্তু আজকে যখন আমরা ২০২৪ সালের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি, তখন কি মনে হচ্ছে, দুর্নীতি কমেছে? অনেকে হয়তো যুক্তি দেবেন এই যে বিভিন্ন সময়ে দেখা যাচ্ছে, ইডি, সিবিআই এবং ইনকাম ট্যাক্সের মতো সংস্থা বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা মন্ত্রীদের জেলে পুরছেন, তাহলে কি সেগুলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই নয়? অবশ্যই সেই সমস্ত অসৎ রাজনৈতিক নেতা এবং মন্ত্রী, যাঁরা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত, কিন্তু তার মানে কি এটা হতে পারে, যে যাঁরা আজকে কেন্দ্রের এবং অন্য বেশ কিছু রাজ্যে ক্ষমতায় আসীন, তাঁরা একেবারেই দুর্নীতিমুক্ত, নাকি তাঁদের দুর্নীতি আমাদের দেখানো হচ্ছে না? যে গণমাধ্যমে সারাক্ষণ আঞ্চলিক বেশ কিছু দলের এবং প্রধান বিরোধী কংগ্রেসের নেতা নেত্রীর দুর্নীতি নিয়ে প্রচার হচ্ছে, সেই গণমাধ্যম কি তাহলে শাসক দলের দুর্নীতি দেখেও, চুপ করে থাকছে? নিন্দুকেরা বলে থাকেন, যদি বিরোধী দলের কোনও নেতা দুর্নীতি করার জন্য, ইডি কিংবা ঐ জাতীয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ‘নজরে’ পড়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে এবং তাঁর দলকে যেভাবে সমালোচিত হতে হয়, তাঁদের দুর্নীতি নিয়ে যেভাবে মিডিয়া ট্রায়াল হয়, তার এক শতাংশও কি সেই মন্ত্রী কিংবা নেতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, তিনি যদি বিজেপিতে যোগ দেন? অনেকের হয়তো আন্না হাজারের নামটা মনে আছে। যে সময়ে আন্না হাজারে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লোকপাল বিল গঠনের জন্য অনশন করছেন, সেই সময়ে এই বিজেপি এবং তাঁদের দলের প্রধানমন্ত্রীর মুখের দাবিদার, নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে লোকপাল বিল আনবেন, কিন্তু দশ বছর আগের সেই প্রতিশ্রুতির কি হলো, সেই প্রশ্ন আজকে করা হলে, তাঁরা কি উত্তর দিতে পারবেন? তাহলে কি তাঁদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, শুধুমাত্র ভাঁওতা? ২০২০ সালে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে, লোকপালের তরফ থেকে একটি রিপোর্ট জমা পড়ে, যাতে বলা হয়, সেইদিন অবধি কোনও একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায় নি।
আচ্ছা, লোকপালের কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল, কিন্তু আজকের মোদী সরকার যেভাবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স এবং কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করেছেন, তা আগের কোনও কেন্দ্রীয় সরকার করেছে কি না সন্দেহ আছে। যে সমস্ত রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তি মোদী এবং তাঁর নীতির বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই দেখা গেছে, এই সব কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থারা অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চাপ দিয়ে তাঁদের দলবদল করানো হয়েছে, এই উদাহরণও অজস্র আছে। যেভাবে সুপ্রীম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে, মোদী সরকার ইডির ডিরেক্টরকে, তাঁদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পরের পর মেয়াদ বাড়িয়েছে, তা দেখে যে কোনও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ প্রশ্ন করবেন। কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন অ্যাক্ট এবং দিল্লি স্পেশাল পুলিশ এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাক্টকে পরিবর্তন করে, এই ইডি এবং সিবিআইয়ের ডিরেক্টরের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে গেছে, যাতে পছন্দের লোক দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যায়।
এখন কথা হচ্ছে, তাঁরা কি সত্যিই দুর্নীতি বন্ধ করতে চায়? যদি তাই চায়, তাহলে, তাঁরা দুর্নীতি বিরোধী আইনে কেন বদল করলেন? ২০১৮ সালে, এই মোদী সরকার, প্রিভেনশন অফ কোরাপশান অ্যাক্টে একটি বদল আনে, যাতে বলা হয়, যদি কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনও তদন্ত করতে হয়, তাহলে যে সময়ের ঘটনার জন্য ঐ অভিযোগ আনা হচ্ছে, সেই সময়ে ঐ ব্যক্তি যদি সরকারি কর্মী হন, তাহলে সরকারের থেকে ঐ তদন্তের অনুমতি নিতে হবে। অর্থাৎ কোনও সরকারি নেতা মন্ত্রী বা বড় আমলা বা সরকারি চাকুরের বিরুদ্ধে যদি কোনও তদন্ত করতে হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে সরকারের আগাম অনুমতি নিতে হবে। যদি মোদী সরকার দুর্নীতি প্রশ্নে এতোটাই কঠিন হবে, তাহলে তো যে কোনও দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ যাতে শাস্তি পায়, তা দেখাই দায়িত্ব ছিল মোদী সরকারের। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালে যে ‘হুইশল ব্লোয়ার প্রোটেকশন অ্যাক্ট’ আনা হয়েছিল, যার মধ্যে দিয়ে, যে কোনও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগকারী যাতে সুরক্ষা পায়, সেই আইনেও বদল আনা হলো? এমনভাবে পরিবর্তন আনা হলো, এবং বলা হলো, জাতীয় সুরক্ষা বা জাতীয় স্বার্থ জড়িত থাকলে, সেই সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ করা যাবে না। যদি তা করা হয়, এবং পরে তা ভুয়ো অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে অভিযোগকারীর ১৪ বছর জেলও হতে পারে, সেই প্রস্তাবও করা হলো। সরকারের যুক্তি হল, তথ্যের অধিকার আইনেও যেমন সমস্ত কিছু জানানো যায় না, তেমনই WBPA (হুইশল ব্লোয়ার প্রোটেকশন অ্যাক্ট’) এও সমস্ত অভিযোগ করা যায় না, অথচ এই অভিযোগ তো আর সাধারণ মানুষের কাছে করা হচ্ছিল না, করা হচ্ছিল, সঠিক পদ্ধতিতে, সঠিক জায়গায়, তাহলে এই আইন পরিবর্তন করলে কার লাভ হওয়ার কথা?
আসুন দেখে নেওয়া যাক, মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির কিছু অভিযোগের দিকে, যেগুলো নিয়ে যাতে চর্চা না হয়, এবং মানুষ যাতে ঐ দুর্নীতিগুলোর থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকে, তার ব্যবস্থা বিজেপি সরকার করছে এবং কীভাবে মানুষকে বোকা বানাচ্ছে।
প্রথমেই আসা যাক নোটবন্দীর কথায়। হঠাৎ একদিন সরকারের তরফ থেকে ঘোষিত হলো, ২০১৬ সালের ৮ই নভেম্বর, যে মোদী সরকার ৮৬ শতাংশ চালু নোট বাতিল করছে এবং এইভাবেই তাঁরা কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়। সারা দেশের বেশীরভাগ মানুষ পড়লেন চরম বিপাকে, অর্থনীতি সেই যে নীচের দিকে চলে গেল, তা আজও ভালো করে উঠে দাঁড়াতে পারেনি। শেষে দেখা গেল, যে সমস্ত টাকা বাজারে ছিল, তার সম্পূর্ণটাই ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সরকারের ঘরে ফিরে গেল। সেই সময়ে চালু হওয়া ২০০০ টাকার নোট যখন আবার বাজার থেকে তুলে নেওয়া হলো, তখন এই বৃত্তটা সম্পুর্ণ হলো। কিন্তু যে ‘কালো টাকা’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ঐ নোটবন্দীর প্রক্রিয়া নেওয়া হলো, সেই কালো টাকা কি ফিরলো? সরকারের কাছে কোনও উত্তর নেই। যখন নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, বিদেশের ব্যাঙ্কে লুকোনো টাকা ফেরত নিয়ে আসবেন, তখন অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন, যে এইভাবেই তো একজন শক্তিশালী মানুষ, দেশের অর্থনীতির উন্নতি ঘটাতে পারবেন, কিন্তু নোটবন্দী করে তিনি কী করলেন? দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ এবং মধ্যবিত্তদেরই বিপদে ফেললেন। শোনা যায়, দেশের জাতীয় সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা, অজিত দোভালের ছেলেই বিদেশের মাটিতে ঐ রকম ট্যাক্স ফাঁকির বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। সুতরাং এই ঘটনা থেকে একটাই পরিণতিতে পৌঁছনো যায়, যে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করার কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিল, সেই সরকার বিগত সরকারের থেকেও বেশী দুর্নীতিগ্রস্ত।
এরপর তাঁরা নিয়ে এলেন, নির্বাচনী বন্ড। মুখে বললেন ভারতীয় নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলুষ মুক্ত করার এর চেয়ে ভালো উপায় আর ছিল না, কিন্তু বাস্তবে কী দেখা গেল? ঘুরিয়ে তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোকে, বিশেষ করে যাঁরা ক্ষমতায় আছে, তাঁদের টাকার যোগানের ব্যবস্থা করলেন। ২০১৭ সালে যখন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি এই ব্যবস্থা নিয়ে আসার প্রস্তাব দেন, তখন তিনি বলেছিলেন, এতদিন রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন মানুষের কালো এবং নগদ টাকায় চলতো, ফলত, দুর্নীতি হওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী। এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে টাকার বদলে বন্ড আসলে, দুর্নীতি মুক্ত হবে, ভারতীয় নির্বাচনী ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা গেল? গত ৬ বছরে, এই নির্বাচনী বন্ডে সবচেয়ে বেশী টাকা পেয়েছে তাঁরাই। তার অর্থ কী দাঁড়ায়? যে বড় বড় শিল্পপতিরা চাইছেন, তাঁদের স্বার্থসিদ্ধি ঘটুক, তাঁরাই বিজেপিকে টাকা দিয়েছে, বিনিময়ে, তাঁরা কি কোনও সুবিধা নেয় নি? এই যে দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পপতি গৌতম আদানি গত ৯ বছরে, দেশের রেল, বন্দর এবং এয়ারপোর্টের মালিক হলেন, তা তিনি কীভাবে হলেন? সরকারের থেকে কিনেই হয়েছেন, তাহলে আজকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, দেশের এই অন্যতম বড় শিল্পপতি কোন জাদুবলে এগুলো কিনলেন, তিনি কি ভুল প্রশ্ন করছেন? অথচ সরকারকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এই যে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে, বিজেপি নির্বাচনী বন্ডে এত কোটি কোটি টাকা পেয়েছেন, কারা এই টাকা দিয়েছেন, সেই তথ্য কেন সরকার জানাচ্ছে না, তখন তাঁরা বলছে, সরকার এই তথ্য জানাতে বাধ্য নয়। তাহলে কেউ যদি বলেন, আদানিকে এই সব বন্দর বা রেল কিংবা এয়ারপোর্ট সরকার সচেতন ভাবেই কম দামে বিক্রি করেছে, এবং তার বিনিময়ে বিজেপিকে আদানি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে টাকা দিয়েছেন, তাহলে কি তিনি সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠবেন? আসলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার, কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারিনি, উনি বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’, আসলে তিনি বলেছিলেন, আমি একা খাবো, কিন্তু তোমাদের খেতে দেবো না, আমরা শুনতে ভুল করেছিলাম।
রাফাল দুর্নীতি।
মোদী সরকারের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি যদি কিছু হয়ে থাকে, তা হলো এই রাফাল বিমান কেনা নিয়ে দুর্নীতি। ১২৬টি রাফাল বিমান কেনার যে চুক্তি ছিল, সেই চুক্তি বাতিল করে, ৩৬টি রাফাল বিমান কেনা হয়। দুঁসো অ্যাভিয়েশনের সঙ্গে চুক্তি ছিল, ১২৬টি রাফাল কেনার, তার বদলে ভারতীয় সেনাবাহিনী পায় মাত্র ৩৬টি আর একেকটি এই বিমানের জন্য ২৭ কোটি ইউরো অর্থাৎ প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা বেশী দিতে হয় ভারত সরকারকে। বলা হয়, ভারতের জন্য কিছু বিশেষ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন করতে হয়েছে বলে এই বেশী টাকা নাকি দিতে হয়েছে, কিন্তু আগের চুক্তিতে এই বিশেষ বদলের কথা উল্লিখিত ছিল। যেহেতু তার আগেই, দেশের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে, সমস্ত দুর্নীতি সংক্রান্ত কথা বলা যাবে না, এই আইন আনা হয়ে গিয়েছে, তাই বিরোধীরা শত চিৎকার করলেও, কোনও গণমাধ্যম একবারও বলেনি, এটা দেশের প্রতিরক্ষার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়েছে। এখন মানুষ বলতে পারবেন, এই বিষয়টিকে যদি দুর্নীতি না বলা হয়, তাহলে কোনটা দুর্নীতি? শুধু তাই নয়, আগের চুক্তিতে ছিল, হ্যাল অর্থাৎ হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকাল কোম্পানি সমস্ত প্রযুক্তিগত সহায়তা করবে, নতুন চুক্তিতে দেখা গেল, হ্যালের বদলে, অনিল আম্বানির কোম্পানি, যার এই বিষয়ে কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতাই ছিল না, তাঁকে ২১০০০ কোটি টাকার এই কাজটা দেওয়া হল।
অভিযোগের বিভিন্ন কাগজ এবং ডায়েরি।
ইনকাম ট্যাক্স বিভাগ আগের ইউপিএ সরকারের আমলে বিড়লা গোষ্ঠীর বেশ কিছু দপ্তরে হানা দেয়। সেখান থেকে তাঁরা বেশ কিছু কাগজ, ডায়েরি, ইমেইলের কপি, মোবাইল মেসেজ উদ্ধার করে, যাতে দেখা যায়, ইউপিএ সরকারের বড় বড় মন্ত্রী এবং বহু আমলার নাম আছে, যাঁদের কাছে বিড়লারা নিয়মিত টাকা দিতেন, বেশ কিছু রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীদের নামও ছিল সেই তালিকায়। আদবানি থেকে শুরু করে, সেই সময়ের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, আজকে যিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সেই নরেন্দ্র মোদীর নামও ছিল সেই ডায়েরির পাতায়। সাহারা গ্রুপের দপ্তর থেকেও ঐ রকম বেশ কিছু নথিপত্র উদ্ধার করে, ইনকাম ট্যাক্স বিভাগ। সেখানেও গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর নাম ছিল। এইরকম ঘটনা সরকার জানলে, কী করা উচিত? ইডি এবং সিবিআইকে সমস্ত নথি দিয়ে বলা উচিত, তদন্ত করতে, তার বদলে সরকার কী বললো? সরকার বললো, এই ধরনের টুকরো কাগজের কোনও মূল্য নেই, তাই তদন্তের প্রয়োজনও নেই। তাহলে এখন কি বোঝা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী কীভাবে নিজেকে ঐ অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন? একইরকমভাবে অরুণাচল প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী খালিকো পুল, ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করার আগে একটি লেখা লিখে যান, যার প্রতি পাতায়, তাঁর সই ছিল। সেই কাগজে তিনি লেখেন, তিনি কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে যখন বাইরে থেকে বিজেপির সমর্থন নিয়ে, সরকার গঠন করেন, তখন সেই সরকারকে মান্যতা দেওয়ার জন্য, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কিছু বিচারপতিকে কত টাকা দেওয়া হয়েছিল, ঘুষ হিসেবে, তার উল্লেখ করেন। তাঁর স্ত্রীও বলেন, ঐ চিঠি খালিকো পুলেরই লেখা, কিন্তু যথারীতি কোনও তদন্ত হয়নি। ঐ বিচারপতিদের একজন পরবর্তীতে দেশের প্রধান বিচারপতিও হয়েছিলেন। খালিকো পুল, লিখেছিলেন, ঐ বিচারপতির ছেলের মাধ্যমেই তাঁর কাছে প্রস্তাব গিয়েছিল, কিন্তু তাতেও কোনও তদন্ত হয়নি। কর্ণাটকের বিজেপি সভাপতি এবং মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পা তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতাদের তিনি কত টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকাটা নেহাত কম নয়, প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা, কিন্তু তাও সেই সব নিয়ে কোনও তদন্তই হয়নি।
অমিত শাহের ছেলের কোম্পানি এবং অন্যান্য এই রকম ঘটনা।
অমিত শাহের ছেলের সংস্থার নাম টেম্পল এন্টারপ্রাইজ প্রাইভেট লিমিটেড। যে সংস্থার ২০১৪-১৫ সালে মাত্র ৫০০০০ টাকার ব্যবসা ছিল, তা দেখা গেল ২০১৫ -১৬ সালে বেড়ে গিয়ে দেখা গেল ৮০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এই ১৬ হাজার গুণ বৃদ্ধি কিসের ইঙ্গিত দেয়? যে সময়ে নোটবন্দী করা হয়, সেই সময়ে, মাত্র ৫ দিনে আহমেদাবাদ জেলা সমবায় ব্যাঙ্কে, যার আবার ডিরেক্টর, অমিত শাহ নিজে, সেখানে ৭৬০ কোটি বাতিল হওয়া টাকা জমা পড়ে। সারা দেশের কোনও ব্যাঙ্ক বা কোনও সমবায় ব্যাঙ্কে এত কম সময়ে এত টাকা জমা পড়েনি। শুধু অমিত শাহ নন, পীযুষ গোয়েল, যিনি খুব অল্প দিনের জন্য অর্থ মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং এখনও একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে কাজ করছেন, তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর নামে যে সংস্থা আছে, তার শেয়ার হাজার গুণ বেশী দামে অজয় পিরামল নামে এক সংস্থার কাছে বিক্রি করেন। কিন্তু মন্ত্রী থাকাকালীন, তিনি কি স্বীকার করেছিলেন, এই লেনদেনের আগে এবং পরে, তাঁদের কত টাকার সম্পত্তি ছিল?
ক্রোনিইজ়ম- অর্থাৎ অন্তরঙ্গ সঙ্গী বা বন্ধু।
উপরে উল্লিখিত যে সমস্ত দুর্নীতির উদাহরণ দেওয়া হলো, তার বাইরে, সব চেয়ে বড় দুর্নীতি যদি কিছু হয়ে থাকে, তা হয়েছে, ওই ক্রোনিইজ়ম - অর্থাৎ অন্তরঙ্গ সঙ্গী বা বন্ধুত্বের খাতিরে, যা এই ১০ বছরের বিজেপি সরকারের অন্যতম মূল মন্ত্র। টেলিকম মন্ত্রকের সমস্ত আইন বদল এমনভাবে বদল করা হয়েছে, যাতে নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স গোষ্ঠী সুবিধা পায়। টেলিকম রেগুলেটারি অথোরিটির এক প্রাক্তন চেয়ারম্যান এই অভিযোগ করেছিলেন, যে এই বদলগুলোকে আটকানো তাঁদের পক্ষে মুশকিলের ছিল। এমনকি রিলায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়, অবধি খুলে দেওয়া হয়েছিল এমন একটা সময়ে, যখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও অস্তিত্বই ছিল না। আরো একটি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যারা এই সরকারের খুব কাছের এবং অন্তরঙ্গ থেকেছে, তা হলো, আদানি গোষ্ঠী। বিভিন্ন সময়ে, এই আদানি গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানি এবং নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তার সখ্যতা নিয়ে, নানান কথা উঠেছে। এমনকি হিন্ডেনবার্গ সংস্থার অভিযোগ করেছে, যে এই আদানি, নিজেদের করের টাকা, বিদেশে বিভিন্ন ছোট সংস্থার মাধ্যমে সরিয়ে ফেলেছে, এবং চালাকি করে নিজেদের শেয়ারের দর বাড়িয়ে দেখিয়ে, সরকারী ব্যাঙ্ক থেকে লোন অবধি করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই আদানি এবং তাঁর সম্পত্তি বৃদ্ধি নিয়ে কোনও তদন্তই করেনি। যেদিন থেকে মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তবে থেকেই এই আদানি, এসার এবং অনিল আম্বানির গোষ্ঠীর রমরমা। আগেও বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, কী করে তাঁরা ৫০ হাজার কোটি টাকা কামিয়েছিলেন, কয়লার দাম বেশী দেখিয়েছিলেন, নিজেদের পাওয়ার প্রজেক্টের জন্য, তারপরে বিদ্যুতের দাম বেশী করে দেখিয়েছেন। যথারীতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এই বিষয়ে আবেদন করেও কোনও লাভ হয়নি। পাশাপাশি, রাজস্থান থেকে শুরু করে, বিভিন্ন রাজ্যে আদানিকে খোলা মুখ খনির বরাত দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে পরিবেশ ধ্বংসের সম্ভাবনা আছে, জেনেও দেওয়া হয়েছে। কোলগেট স্ক্যামে সর্বোচ্চ আদালত এই বিষয়ে রায় দেওয়া সত্ত্বেও, আদানিকে সুবিধা দেওয়ার জন্যই এই কাজের বরাত দেওয়া হয়েছে।
ব্যাঙ্ক জালিয়াতি এবং বিজয় মালিয়া, নীরব মোদী এবং অন্যান্যদের পলায়ন।
যে পদ্ধতিতে, বিজয় মালিয়া, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সী এবং অন্যান্যরা সরকারী ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা লোন নিয়ে এবং তারপরে তা শোধ না করে পালিয়েছে, তা কি সরকারের প্রত্যক্ষ মদত ছাড়া সম্ভব হতো? যে কোনও বাচ্চাই এই বিষয়টা বোঝে আর আমাদের সরকার তা বোঝে না? এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংস্থা থেকে ধার নিলে, একজন সাধারণ মানুষকে কতরকম কাগজ দেখাতে হয়, তারপরে, তা ফেরত না দিলে, আরো কতরকমের হয়রানি হতে হয়, আমরা সকলেই জানি, কিন্তু এই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কি সেইরকম হয়েছে? নাকি তাঁরা বহাল তবিয়তেই আছে, সরকারী বদান্যতায় বিদেশ পালিয়ে, সেই প্রশ্নও উঠেছে, কিন্তু যথারীতি সরকার কোনও অভিযোগকেই পাত্তা দেয়নি।
আরো অজস্র দুর্নীতির উদাহরণ আছে, মধ্যপ্রদেশের ভ্যাপম কেলেঙ্কারী, ছত্তিশগড়ের রেশন কেলেঙ্কারি, যার অন্যতম। যারা বলে থাকেন, বিজেপির মতো সৎ দল আর হয় না, কিংবা মোদীই একমাত্র দুর্নীতির বিরুদ্ধে, কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়ছেন, তাঁদের অবগতির জন্য এটা জানানো প্রয়োজন, যে মহারাষ্ট্রের সরকার ফেলার জন্য, একেক জন বিধায়ককে ৫০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল, সেই টাকা কি সাদা টাকা? আসলে বিজেপি হচ্ছে, এমন একটা ওয়াশিং মেশিন, যেখানে ইডি, সিবিআইয়ের হাত পৌঁছয় না।