যে সংসদের সিঁড়িতে প্রণাম করে, ২০১৪ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রবেশ করেছিলেন, সেই সংসদকেই কি বিরোধী-মুক্ত করতে চাইছে দেশের শাসক দল? এই প্রশ্নটিই আপাতত ঘুরছে, সংসদে, যেখানে লোকসভা এবং রাজ্যসভা মিলিয়ে গত তিনদিনে বিরোধী দলের ১৬১ জন সাংসদকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দেশজুড়ে যা নিয়ে চর্চাও শুরু হয়েছে। এখন বোঝা দরকার, সরকার কি সংসদে বিতর্ক চাইছে না? তাঁরা কি বিনা বিতর্কে, বেশ কিছু বিল পাশ করিয়ে নিতে চাইছে, যা দেশের নাগরিকদের জন্য আরো বিপজ্জনক? না হলে, এই ধরনের আচরণ কেন করছে শাসক দল? অনেকে বলছেন, নতুন যে টেলিকম রেগুলেটারি বিল বা পোস্টাল সংশোধনী বিল পাশ করানো হচ্ছে, তার মধ্যে দিয়ে ভারতকে আরো নজরদারি রাষ্ট্র বানানোর দিকে নিয়ে যেতে চাইছে এই সরকার, তাতে যাতে বিরোধীরা কোনও বাধা না সৃষ্টি করতে পারে, সেই জন্যেই সচেতন ভাবে, এই কাজটি করছে শাসক দল।
অনেকে বলতে পারেন, বিরোধী সাংসদদের আচরণের কারণেই তাঁদের বহিষ্কৃত হতে হচ্ছে। কিন্তু সত্যিটা কী, তা জানা কি জরুরি নয়? গত ১৩ই ডিসেম্বর, এই সংসদে কিছু যুবকের ঢুকে পড়া থেকে এই বিতর্কের সূত্রপাত। যখন নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন হলো, সেদিন শোনা গিয়েছিল, নতুন সংসদ ভবনে নাকি কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে, মুখাবয়বের ছবি মিলিয়ে প্রবেশ করানো হবে। লোকসভায় রং বোমা নিয়ে দুই যুবকের ঢুকে পড়ে, শ্লোগান দেওয়ার ঘটনার জেরে প্রশ্ন উঠেছে সংসদ ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে। কীভাবে, মার্শালদের নজরদারি এড়িয়ে দুই ব্যক্তি বিনা বাধায় লোকসভার দর্শক আসন থেকে ফ্লোরে ঝাঁপ দিলেন, কীভাবে গ্যাস ভরা রং বোমা নিয়ে নিরাপত্তা বলয় টপকে অধিবেশন কক্ষে ঢুকতে পারলেন, সে প্রশ্নও উঠে এসেছে। বিরোধীরা শুধুমাত্র দাবি করেছেন, এই বিষয়ে যেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দেন। খুব কি অনায্য দাবি? যদি তা না হয়, তাহলে সেই প্রসঙ্গে একটিও কথা বলতে কেন শাসক দল ভয় পাচ্ছে? আসলে তারা বুঝতে পারছে, এই নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা শুরু হলে, জল আরো অনেক দূর গড়াতে পারে। কেন ঐ যুবকেরা সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে, ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’ শ্লোগান তুলেছিলেন সেই প্রশ্নও সামনে চলে আসতে পারে। একদিকে বিজেপির ছোট বড় নেতারা, বিষয়টিকে বলছেন, শুধুমাত্র নিরাপত্তাজনিত খামতির ফলে এই ঘটনা ঘটেছে, অন্যদিকে যে যুবকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদি ধৃত যুবক-যুবতীদের মধ্যে কোনও একটি নামও সংখ্যালঘু মুসলমান হতো, তাহলে কি শাসকদল এবং তাঁদের পোষা গণমাধ্যম এই রকম চুপচাপ থাকতো? তখন কি এই আক্রমণকে সামনে রেখে, তাঁরা হিন্দু মুসলমানের মেরুকরণের রাজনীতি করতেন না?
যা জানা গেছে, মণিপুরে দীর্ঘদিন গণতন্ত্র না থাকা নিয়ে যেমন তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, শাসকদলের বিরোধী কণ্ঠ বন্ধ করার বিরুদ্ধে যেমন তাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁরা আরো একটি মূল জায়গাতে আঘাত করতে চেয়েছেন, তা হলো বেকারত্বের প্রশ্ন। যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের বেশিরভাগই যথেষ্ট শিক্ষিত, এবং তাঁদের চাকরির এবং তার নিরাপত্তার দাবি যে অন্যায্য নয়, তা সবাই বুঝতে পারলেও সরকার আমল দিতে চাইছে না, কারণ তাহলেই সরকারের জিডিপির অঙ্কের ফাঁপানো বেলুন যে চুপসে যাবে, তা সরকার জানে। সেই জন্যেই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা হোক চাইছে না। অথচ সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য যৌবনের কাজ না পাওয়ার ক্ষোভকে সঠিক বলে মনে করছে। সার্ক ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ১৫-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ভারতে কাজ না পাওয়ার সংখ্যা (২৩.২২%) সবচেয়ে বেশি।এর পরে আছে পাকিস্তান (১১.৩%), বাংলাদেশ (১২.৯%) এবং ভুটান (৯.৩%)।
আমাদের দেশের সরকারের মাথারা যে বিষয়টি জানেন না তেমনটা নয়, জানেন বলেই তাঁরা নানান পন্থা রোজ নিয়ে চলেছেন, যাতে যুবকযুবতীরা আরো বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। সেই জন্যেই লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠের মতো কর্মসূচী তাঁদের সংগঠিত করতে হয় এবং সেখানে ছাত্রদের প্রবেশমূল্য নামমাত্র ধার্য করা হয়, সেইজন্যেই রামমন্দিরের উন্মাদনা তুলে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়, যে আসল সমস্যা বেকারত্ব। শাসকদল জানে, বেকার যুবকযুবতীদের যদি ২৪ ঘণ্টা, ৩৬৫ দিন, হিন্দু-মুসলমান বিতর্কে আটকে রাখা যায়, তাহলে তাঁরা আসল সমস্যা থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকবেন। তাই অষ্টপ্রহর রাম- নাম সংকীর্তন চলতে থাকে, সামাজিক মাধ্যমে।
যদি মনে করা যায়, গত ২০২২ সালে, এই বেকারত্বের প্রশ্নটিকে মোকাবিলা করতে চেয়ে, বিজেপি সরকার অগ্নিপথ প্রকল্প নিয়ে আসেন, যার ফলে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। এই ঘোষণার পরেপরেই সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর ঊর্দ্ধতন কতৃপক্ষ হয়তো ভেবেছিলেন, যে বছরে ছেচল্লিশহাজার চাকরির খবর শুনে দেশের কর্মক্ষম যুবকবৃন্দ দুহাত তুলে মোদীর প্রশংসা করবেন। কিন্তু দেখা গেল ফল হয়েছে উল্টো। তাঁরাই রাস্তায় নেমে পড়লেন এই প্রকল্পের বিরোধিতায়, পুড়িয়ে দিলেন ট্রেন, বাস সহ নানান সরকারী সম্পত্তি। বিক্ষোভকারীদের একজন মারাও গেলেন। সরকার এবং প্রশাসন হতচকিৎ, তাঁরা ভাবতেই পারেননি, এমনটা হতে পারে। যাঁরা এই ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প প্রস্তাব করেছেন, এই ভেবে যে তাঁরা সেনাবাহিনীর গড় বয়স কমিয়ে আনবেন, তাঁরা হয়তো ভারত এবং ইন্ডিয়ার তফাৎ বোঝেন না। তাঁদের কাছে ২১ বছর বয়সী একজন তরুণ মানেই একজন ঝকঝকে তরুণ, যিনি স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, যিনি শাইনিং ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি, অথচ তিনি জানেনই না, যে ভারতের অধিকাংশ তরুণ কর্মহীন, এবং তাঁরা এই রকম শর্তে সেনাবাহিনীতে যুক্ত হতে চান না। তাঁরা তাঁদের ভারতকে ভালবেসে শহীদ হতেও রাজি কিন্তু এই চুক্তির ভিত্তিতে এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াতে রাজি নন। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের মধ্যে ১৫ – ১৯ বছর বয়সী তরুণদের প্রায় ৫০ শতাংশই কর্মহীন। সরকারের একটি সিদ্ধান্তের ফলে, তাঁর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বা তার নিশ্চয়তা আরও কমতে পারে, তবে কি তাঁর ক্ষোভ খুব অনায্য?
চাকরির দাবীকে সামনে রেখে যদি আজকে কিছু যুবকযুবতী সংসদে ঢুকে পড়ে, আওয়াজ তোলেন, তবে কি তাঁদের সন্ত্রাসবাদী, হানাদার ইত্যাদি বলা উচিৎ? তাঁরা হয়তো অপরিণত আচরণ করেছেন, কিন্তু কখনো কখনো কিছু ঘটনা ঘটে, যা অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। ১৯২৯ সালের ৮ই এপ্রিল, বটুকেশ্বর দত্তকে সঙ্গী করে, ভগৎ সিং, সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি হলে, দর্শকাসন থেকে দুটো বোমা ছোঁড়েন। সেই সময়ে সেখানে একটি অধিবেশন চলছিল, এবং ঐ বোমা ছোড়াকে কেন্দ্র করে এমন হট্টগোল শুরু হয় যে তাঁরা ঐ ঘটনার পরে ঐ হল থেকে পালাতে চাইলেই পালাতে পারতেন, কিন্তু তাঁরা না পালিয়ে, ওখানেই দাঁড়িয়ে শ্লোগান দেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পরে, তাঁদের যখন প্রশ্ন করা হয়, তাঁরা কেন ঐ কাজ করেছিলেন, তখন ভগৎ সিং বলেছিলেন, ‘অনেক সময়ে বধিরদের শোনানোর জন্য, বড় বিস্ফোরণের প্রয়োজন হয়’। আজকের সংসদে রঙ বোমা নিয়ে ঢুকে পড়া যুবক যুবতীরা কি একই কাজ করলেন না? সাংসদদের বহিষ্কার করেও কি এই মূল প্রশ্নগুলো থেকে পালাতে পারবে আজকের কেন্দ্রীয় শাসকদল ?