ভারতবর্ষে সাংবাদিকতা বেশ কিছুদিন ধরেই একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। অবশ্য যাঁদেরকে আমরা সাংবাদিক হিসেবে ভাবতে বা দেখতে অভ্যস্ত তাঁদের কথা আলাদা। যাঁরা গ্রামে গঞ্জে, মাঠে ঘাটে খবর সংগ্রহ করে বেড়ান, তাঁদের অবস্থা যে কতটা ভয়ঙ্কর, তার সর্বশেষ উদাহরণ রাঘবেন্দ্র বাজপেয়ী, যাঁকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হতে হলো যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে। ৩৫ বছর বয়সী এই সাংবাদিক এবং আরটিআই কর্মীকে গুলি করে মেরে হত্যা করলো কয়েকজন বাইক আরোহী উত্তরপ্রদেশের সীতাপুর জেলায় রাস্তার ওপরে। খবরে প্রকাশ হিন্দি সংবাদপত্র দৈনিক জাগরণের কর্মী ঐ তরুণ সাংবাদিক, ধান সংগ্রহ নিয়ে সরকারি স্তরের কিছু দুর্নীতি এবং জমি কেনার স্ট্যাম্প ডিউটি ফাঁকি দেওয়া সংক্রান্ত খবর পেয়েছিলেন বলেই তাঁকে কায়েমী স্বার্থে আঘাত পাওয়া কিছু মানুষ খুন করলো।
রাঘবেন্দ্র বাজপেয়ীর পরিবার প্রাথমিকভাবে তাঁর দেহ পাওয়ার পরে শেষকৃত্য করতে চায়নি। তাঁদের দাবী ছিল এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত করতে হবে এবং দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। পরে সরকারি আশ্বাস পাওয়ার পরে, তাঁরা ঐ তরুণ সাংবাদিকের শেষকৃত্য করেন। পুলিশ যদিও বলছে, বিষয়টার সঙ্গে সাংবাদিকতার কোনও যোগাযোগ নেই, কিন্তু যে সরকার হাথরাসে দলিত মেয়েদের ধর্ষণের খবর সংগ্রহ করতে যাওয়ার কারণে কেরালার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে ইউএপিএ দিয়ে গ্রেপ্তার করে তাঁদের পুলিশের কথা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? যে সরকার কুম্ভমেলার ত্রিবেণীর জল নিয়ে খবর করার জন্য রক্তচক্ষু দেখায়, তাঁদের সরকারি দুর্নীতির খবর করার কারণে যে এক সাংবাদিককে তাঁরা মেরে ফেলতেও পারে, সেটাই বরং স্বাভাবিক।
বিশ্বজুড়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ছে সেইসব ব্যক্তিদের দ্বারা যাঁদের কথা ছিল এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করার অর্থাৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (RSF) দ্বারা প্রকাশিত সর্বশেষ বার্ষিক বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক থেকে এটি স্পষ্ট। এই সূচকটি যে তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, তালিকা তৈরি করতে ব্যবহৃত পাঁচটি সূচকের মধ্যে, রাজনৈতিক সূচকটিই সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে, বিশ্বব্যাপী গড় ৭.৬ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে। সহজ করে বললে সরকার নিজেই ব্যর্থ হয়েছে সাংবাদিকতাকে সুরক্ষা দিতে। বিশ্বের বেশীরভাগ সরকার এবং রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকতার জন্য সর্বোত্তম সম্ভাব্য পরিবেশ এবং জনগণের নির্ভরযোগ্য, স্বাধীন এবং বৈচিত্র্যময় সংবাদ ও তথ্যের অধিকারের নিশ্চিন্ততা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা পালন করছে না। আরএসএফের রিপোর্ট অনুযায়ী এই ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সমর্থন বা তাঁদের শ্রদ্ধা করার ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক হ্রাস এবং রাষ্ট্র বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চাপ বৃদ্ধি দেখছে। আরএসএফের সম্পাদকীয় বোর্ডের অন্যতম প্রধান অ্যানে বোকান্ডের মত অনুযায়ী, গণমাধ্যমগুলো বেশীরভাগ দেশে সরকারের প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, এবং সরকারের নির্দেশেই সংবাদ পরিবেশনের নামে তাঁরা মিথ্যে এবং ভুয়ো তথ্য ছড়াচ্ছে। যখন সাংবাদিকতাই হওয়া উচিৎ একটি গণতন্ত্রের অন্যতম মাপকাঠি, তখন তার অবস্থা যদি সরকারি চাপে এইরকম হয়, তখন বুঝতে হবে পরিস্থিতি বেশ খারাপ।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, সাংবাদিকদের সুরক্ষার নীতিমালা, বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশন ২২২২ বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছার স্পষ্ট অভাবের জন্য ২০২৪ সাল উল্লেখযোগ্য। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজা যুদ্ধে সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে রেকর্ড সংখ্যক লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর হাতে ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে কমপক্ষে ২২ জন তাদের কাজের সময় নিহত হয়েছেন। দখলকৃত এবং ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের শিকার, ফিলিস্তিন ২০২৪ সালের বিশ্ব সংবাদপত্র স্বাধীনতা সূচকে জরিপ করা ১৮০টি দেশ এবং অঞ্চলের মধ্যে ১৫৭তম স্থানে রয়েছে, তবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটি শেষ ১০টির মধ্যে স্থান পেয়েছে। চিন এবং উত্তর কোরিয়ার স্থান যথাক্রমে ১৭২ এবং ১৭৮।
অনেকে হয়তো ভাবছেন, ভারতের স্থান কত? ২০২৩ সালে ভারতের স্থান ছিল ১৬২ আর ২০২৪ সালে ভারত ১৫৯তম স্থান পেয়েছে ১৮০টি দেশের মধ্যে। আসলে কোনও দেশের সরকারই গণতান্ত্রিক নয়। ভারতে যদি হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থান হয়ে থাকে, তুরস্কে তেমনি মুসলমান মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতায় আছে, এই সূচকে যাঁদের স্থান ভারতের একটু আগে- ১৫৮। এ যেন কে কত খারাপ হতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে। বিশ্বের বেশীরভাগ সরকার সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেটের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে, সেই ইন্টারনেট কারা ব্যবহার করবেন তার সীমা নির্ধারণ করেছে, অ্যাকাউন্ট ব্লক করেছে এবং সংবাদ ও তথ্য বহনকারী বার্তাগুলিকে দমন করেছে। ভিয়েতনামের সাংবাদিকদের বক্তব্য যা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসে তাকে পদ্ধতিগতভাবে বন্ধ করা হয়েছে৷ চীনে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি সাংবাদিককে আটক করার পাশাপাশি, সরকার বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করা চ্যানেলের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ করেছে। অনলাইন বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের জন্য সেন্সরশিপ এবং নজরদারি নীতি প্রয়োগ করে এবং সংবেদনশীল বা দলীয় লাইনের বিপরীত বলে বিবেচিত তথ্যের বিস্তার সীমিত করেছে। কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী সাংবাদিকদের অপমান, অসম্মান এবং হুমকি দিয়ে তাদের প্রতি ঘৃণা ও অবিশ্বাসকে উস্কে দেওয়ার কাজটাও করে চলেছে। অন্যরা মিডিয়া ইকোসিস্টেম দখলের আয়োজন করছে, তা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিডিয়ার মাধ্যমে হোক, বা বেসরকারি মালিকানাধীন মিডিয়া বন্ধু ব্যবসায়ীদের দ্বারা অধিগ্রহণের মাধ্যমে হোক। জর্জিয়া মেলোনির ইতালি (৪৬ তম) - যেখানে ক্ষমতাসীন সংসদীয় জোটের একজন সদস্য দ্বিতীয় বৃহত্তম সংবাদ সংস্থা (এজিআই) অধিগ্রহণ করার চেষ্টা করছেন – তার ফলে ঐ সূচকে এই বছর পাঁচটি স্থান নেমে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলি প্রায়শই প্রচারের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে চলেছে, এমনকি বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার উসকানিও দিচ্ছে। সূচকে মূল্যায়ন করা দেশগুলির তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি (১৩৮টি দেশ) বেশিরভাগই রিপোর্ট করেছেন যে তাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শই প্রচার বা বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার সাথে জড়িত ছিল। এই সম্পৃক্ততাকে ৩১টি দেশে "পদ্ধতিগত বিষয়" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এবার আসা যাক ভারতের প্রসঙ্গে। ভারতীয় গণতন্ত্রের মতো ভারতীয় সাংবাদিকতাও ২০১৪ সাল থেকে একটা অঘোষিত জরুরি অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছে। যবে থেকে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসেছে তবে থেকে তাঁর দল বিজেপির সঙ্গে বড় বেশ কিছু কর্পোরেট পরিবারের একটা অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। রিলায়েন্স গোষ্ঠীর প্রধান মুকেশ আম্বানি যাঁর নিয়ন্ত্রণেই অন্তত ৭০টি সংবাদমাধ্যম চলে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বন্ধু। এই সংবাদমাধ্যমগুলোর দর্শক এবং পাঠক প্রায় ৮০ কোটি মানুষ। ২০২২ সালের শেষে যখন প্রধানমন্ত্রীর আর এক বিশেষ বন্ধু গৌতম আদানি এনডিটিভি কিনে নিলেন, সেদিনই ভারতীয় গণমাধ্যমের যে বৈচিত্র্য তা এক লহমায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যেদিন থেকেই আমরা মোটামুটি শাসক বিজেপির স্বপক্ষে প্রচার প্রোপাগান্ডাকেই খবর হিসেবে দেখতে শুরু করেছি, সেদিন থেকেই ভারতীয় গণমাধ্যমের একটা নতুন নামকরণ হয়েছে- ‘গোদী মিডিয়া’। চাপ এবং প্রভাবের মাধ্যমে, বহুত্ববাদী সংবাদপত্রের পুরনো ভারতীয় মডেলটি তাই আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। প্রধানমন্ত্রী মুখে বলেন সাংবাদিকদের প্রশ্ন করা উচিৎ ক্ষমতাকে, কিন্তু সেই সব সাংবাদিকদের খুব সমালোচনা করেন, যাঁরা তাঁর সমর্থকদের সাথে তার সরাসরি সম্পর্ককে দূষিত করে। দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যক্তিগত আস্কারার ফলে সরকারের সমালোচক ভারতীয় সাংবাদিকরা বিজেপি-সমর্থিত ট্রোলদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন।
যদিও সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করা হয়নি, তবে এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার দ্বারা সুরক্ষিত। তবে, সরকারগুলি কখনও ঔপনিবেশিক যুগের আইন, যেমন রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ সম্পর্কিত আইন, গণমাধ্যমকে দমন করতে পিছপা হয়নি। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলিও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে এবং প্রতিশোধ হিসেবে আইনি বিধান ব্যবহার করেছে নানান সময়ে। প্রধানমন্ত্রী মোদী বেশ কয়েকটি নতুন আইন চালু করেছেন যা সরকারকে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, সংবাদ সেন্সর এবং সমালোচকদের নীরব করার অসাধারণ ক্ষমতা দিচ্ছে বলে বহু মানুষ মনে করেন, যার মধ্যে রয়েছে ২০২৩ সালের টেলিযোগাযোগ আইন, ২০২৩ সালের খসড়া সম্প্রচার পরিষেবা (নিয়ন্ত্রণ) বিল এবং ২০২৩ সালের ডিজিটাল ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন।
গণমাধ্যমের অর্থনৈতিক ও সামাজিক রাজনৈতিক দিক
ভারতের গণমাধ্যম মূলত বিজ্ঞাপনের রাজস্ব থেকে তাঁদের অর্থ আয় করে, যার প্রধান উৎস হলো সরকার। নরেন্দ্র মোদির অধীনে, কোটি কোটি ডলারের সরকারি তহবিল বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যয় করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য উভয় সরকারই এই তহবিলের মাধ্যমে তাদের বিষয়বস্তু সেন্সর করার জন্য মিডিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করে, যার উপর অনেক ছোট গণমাধ্যম নির্ভর করে। একদিকে, সরকার রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি মালিকানাধীন উভয় মিডিয়ার উপর তার নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করেছে, অন্যদিকে মিডিয়ার মালিকানা বেশ কয়েকটি সংস্থার হাতে ঘনীভূত হয়েছে যারা বেশিরভাগই সরকারের বন্ধু। বন্দর উন্নয়ন, জ্বালানি এবং খনির ক্ষেত্রে মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী গৌতম আদানির নেতৃত্বে এই বহুজাতিক সংগঠনটি সমালোচনামূলক সাংবাদিকতার শেষ ঘাঁটিগুলির মধ্যে একটি, এনডিটিভির যেদিন নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল সেদিনই বোঝা গিয়েছিল ভারতীয় গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ কী? ভারতীয় সমাজের বিশাল বৈচিত্র্য মিডিয়ার দৃশ্যপটে প্রতিফলিত হয় না। সাংবাদিকতা পেশা, বিশেষ করে পরিচালক পদে, এখনও উচ্চ বর্ণের হিন্দু পুরুষদের অধিকারে রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রধান সন্ধ্যার টক শোতে, মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব ১৫% এরও কম। হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ ক্ষমতায় উত্থান করছে। বেশিরভাগ টিভি মিডিয়া, বিশেষ করে হিন্দিতে, তাদের সম্প্রচারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ধর্মীয় সংবাদের জন্য ব্যয় করে, কখনও কখনও প্রকাশ্যে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা প্রচার করে। ভারতীয় গণমাধ্যমে এর বিপরীত উদাহরণও রয়েছে, তবে তা আসলে ওপরের সামাজিক রাজনৈতিক দিকটাই যে সত্যি, সেটাই প্রমাণ করে যেমন খবর লহরিয়া আউটলেট, যা সম্পূর্ণরূপে গ্রামীণ এলাকার মহিলা সাংবাদিক এবং জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বারা গঠিত।
নিরাপত্তা
প্রতি বছর তাদের কাজের সাথে সম্পর্কিত ঘটনায় গড়ে তিন বা চারজন সাংবাদিক নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়, যার সর্বশেষ উদাহরণ রাঘবেন্দ্র বাজপেয়ী। ভারত গণমাধ্যমের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলির মধ্যে একটি। সরকারের সমালোচনাকারী সাংবাদিকরা নিয়মিতভাবে অনলাইনে হয়রানি, ভয় দেখানো, হুমকি এবং শারীরিক আক্রমণের পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তারের শিকার হন। তাঁরা পুলিশ অফিসার এবং রাজনৈতিক কর্মীদের পাশাপাশি অপরাধী গোষ্ঠী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত স্থানীয় কর্মকর্তাদের সহিংসতার শিকার ও হন, ঠিক যেমনটা ঘটলো উত্তরপ্রদেশের সীতাপুরে। হিন্দুত্বের সমর্থকরা, হিন্দু অতি-দক্ষিণপন্থীরা তাঁদের আদর্শ, "বিশ্বাসঘাতক" এবং "জাতীয়তাবিরোধী" হিসাবে চিহ্নিত সমালোচকদের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানান। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণার ভয়ঙ্কর সমন্বিত প্রচার হয় এবং হত্যার আহ্বান দেওয়া হয়। বিশেষ করে যখন তাঁরা মহিলা সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু বানায় এবং তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করেন তখন হিংসাত্মক প্রচারণা বেড়ে যায়। কাশ্মীরে বা মণিপুরে পরিস্থিতিও অত্যন্ত উদ্বেগজনক, যেখানে সাংবাদিকরা প্রায়শই পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনী দ্বারা হয়রানির শিকার হন, কিছু সাংবাদিককে কয়েক বছর ধরে তথাকথিত "অস্থায়ী" আটক রাখা হয়।
আমরা যাঁরা রোজ সন্ধেবেলা আমাদের বসার ঘরে বসে টেলিভিশনের পর্দায় খবর দেখি, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় দেখি আর ভাবি এইটাই হয়তো সাংবাদিকতা, তাঁরা কি জানি ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম একটি স্তম্ভের নাম সংবাদ মাধ্যম? আমরা যাঁরা মনে মনে ভাবি সুমন, অর্ণব বা ময়ূখরা বিভিন্ন চ্যানেলে বসে যে কাজটা করে চলেন রোজ, সেটাই সাংবাদিকতা তাঁদের জন্য বারংবার মনে করিয়ে দিতে হয় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ভারতের অবস্থানের কথা। যে সাংবাদিকেরা কাজ করেন সেই সংবাদমাধ্যমগুলোতে, তার বাইরে অসংখ্য ছোট ছোট সাংবাদিক খবর খুঁজে আনার চেষ্টা করে চলেছেন বহু দিন ধরে। তাঁদের জীবন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা বুঝতে গেলে আজকে উত্তরপ্রদেশের ঐ তরুণ সাংবাদিকের কথা মনে করে অন্তত এক মিনিট ঐ প্রচলিত গণমাধ্যম না দেখে ‘সাংবাদিকতার জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন’ করাটা জরুরি।