চিকিৎসকেরা বলে থাকেন, দিনে একটি আপেল খাওয়া গেলে মানুষ তাঁর জীবন থেকে চিকিৎসকদের দূরে রাখার মত কাজটি খুব সহজেই করতে পারে। এখন সামাজিক মাধ্যমের সময়ে এই কথাটাকেই একটু অন্যভাবে বলা যেতে পারে। দৈনিক একটি কৃত্রিম সমস্যা তৈরি করা গেলে, আসল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সহজে ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব। সামাজিক মাধ্যমের কিছু প্রভাবশালী মানুষ, নিত্যনতুন একএকটি বিষয় নিয়ে রোজ সকালে একটি পোস্ট করেন, তাতে কিছু গণমাধ্যমকে জড়িয়ে, প্রশ্ন তোলেন কেন তাঁরা সেই বিষয়ে নিশ্চুপ? তারপর সেই লেখা বা পোস্ট নিয়ে দিনভর আলোচনা চলতে থাকে, প্রচুর মানুষ সেই লেখা শেয়ার করেন, মন্তব্য করেন। পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা চলে, তারপর তা নিয়ে সন্ধ্যেবেলা টেলিভিশনে তর্ক-বিতর্ক সভা বসে, বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা আসেন, বক্তব্য রাখেন, চিৎকার চেঁচামেচি হয়, আমরাও ভাবি, একজনের সঙ্গে অন্যজনের বৈরিতামূলক সম্পর্ক, তারপর অনুষ্ঠান শেষ হয়, সবাই হয়তো সৌজন্যমূলক করমর্দন করে বিদায় নেন। আবার পরদিন অন্য সমস্যা দিয়ে দিন শুরু হয়, আবার একই কথা, অন্য মুখ, অন্য আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক আবার নতুন করে চলতে থাকে। যদি বিষয়বস্তু একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে মুখ পাল্টে একই আলোচনা একদিনের বদলে হয়তো দু-দিন বা তিনদিন ধরে চলে। এরই মাঝে বিজ্ঞাপন আসে, এরই মাঝে অন্য খবর আসে, কিন্তু কোনও সময়েই মানুষের আসল সমস্যা আর সামনে আসে না, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে এই নিয়ে আর আলোচনা হয় না। এই পুরো প্রক্রিয়াতে যে কার লাভ হয় তা জানা না থাকলেও, মানুষের নিত্যদিনের সমস্যার যে কোনও সুরাহা হয় না, তা আজকে পরিষ্কার না হলেও আগামীদিনে যে হবেই সেই বিষয়ে নিশ্চিত করেই বলা যায়।
ভারতবর্ষের মত একটি বৃহৎ দেশ বা বাংলার মত একটি রাজ্যের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার শেষ নেই। কোথাও যদি কিছু নাও পাওয়া যায়, তাহলে ফটোশপ করা ছবি বা কম্পিউটারে তৈরি করা ভিডিও তো হাতের কাছে পাওয়াই যায়। আশ্চর্যের বিষয় হল, এটা যদি প্রমাণিতও হয়, যে ঐ ছবি বা ভিডিওটা মিথ্যে, তাও সেগুলো সরানো হয় না, কারণ কেউ না কেউ জেনে অথবা না জেনে আবার সেই ছবি যদি সামাজিক মাধ্যমে ছাড়ে, কোনও না কোনও মানুষ এসে বলবেন, ঐ ছবিটি বা ভিডিওটি মিথ্যে। সেই কথাও আবার সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার হবে, তাতে কেউ হয়তো বলবেন, হতে পারে এই নির্দিষ্ট ছবিটি মিথ্যে, কিন্তু তার মানে তো এটা হতে পারে না, আগে এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি? শুরু হয়ে যাবে, তা নিয়ে চাপানউতোর। সেই ছাগল আর নেকড়ের গল্প।
যদি একটু নজর দেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে সাধারণত দু ধরনের মানুষ এই ঘৃণা ও বিদ্বেষ ফেরি করে থাকেন। যাঁরা এই মুহূর্তে অবসরপ্রাপ্ত জীবন যাপন করছেন, যাঁদের গাড়ি, বাড়ি, ব্যাঙ্কের সঞ্চয় অপরিমিত, যাঁদের পরিবারের সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিত, হয় বিদেশে থিতু হয়ে আছেন, না হয় এদেশেই যথেষ্ট সুপ্রতিষ্ঠিত। যাঁরা আগের সরকারের আমলে পড়াশুনা করেছেন, প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, তাঁরাই এখন আগের শিক্ষাব্যবস্থা বদলের পক্ষে সওয়াল করেন, তাঁরাই বলে থাকেন এই ধর্মনিরপেক্ষতা যা আমাদের শেখানো হয়েছিল, তা মূল্যহীন। আর একদল, যাঁদের নিশ্চিত চাকরি নেই, যাঁদের সেই অর্থে রোজগার অনেকটাই কম, তাঁরাও এই কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু কমবয়সি ছাত্রছাত্রী, যাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তাঁরাও এই ঘৃণার কারবারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছেন। যে কোনও কারণেই হোক না কেন, এই মুহূর্তে ঘৃণা একটি বড় ব্যবসা, এবং বেশ কিছু মানুষ সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে এখান থেকে অর্থ রোজগারও করছেন। আরও একদল মানুষ আছেন, যাঁদের পূর্বপুরুষেরা হয়তো বাংলাদেশ থেকে বিতারিত হয়ে এসেছিলেন, তাঁরা নিজেরা ধর্মীয় উৎপীড়নের শিকার না হয়েও মনে করেন তাঁদের উপর অত্যাচার হয়েছে, তাই এখানে যাঁরা এখন সংখ্যালঘু, তাঁদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেন। নিশ্চিত, কোনও কোনও মানুষ ধর্মীয় কারণে অত্যাচারের শিকার হয়েছেন প্রতিবেশী দেশের সংখ্যাগুরুর কাছে, কিন্তু তা কতটা হয়েছেন, আর কতটা শোনা কথা, তা কিন্তু এই সময়ে যাঁরা মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন, তা কিন্তু জানা নেই। যাঁরা ঐ সময়ে এদেশে এসেছিলেন, তাঁরা কিন্তু এদেশে এসে সেই সময়কার কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, তাঁদের মধ্যে যতটা না সাম্প্রদায়িকতা ছিল, তাঁদের তিন প্রজন্ম পরের মানুষজন কিন্তু তার ঢের বেশি সাম্প্রদায়িক, তাঁদের পূর্বপুরুষদের ওপর হওয়া অত্যাচারের কথা বলে তাঁরাই এখন ঘৃণা ছড়াচ্ছেন। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, যে একজন মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মাচারণ, যা চিরদিনই, শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের কথা শেখায়, তা কি করে এই ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি করে তোলে? ধর্ম তো তাঁরাও মানতেন, কিন্তু সেই ধর্মের অনুষঙ্গ তো তাঁদের সাম্প্রদায়িক করে তোলেনি? ধর্ম যখন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের দখল নিতে উদ্যোগী হয় এবং যে কোনও ধর্মের প্রবক্তাদের যখন রাজনৈতিক নেতারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হন, তখনই সমস্যা বাড়ে। রাষ্ট্র যখন পক্ষ নিতে অপারগ হয়, সরকার যখন সার্বিক বিষয় থেকে ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাতে শুরু করে, কে কি পরবে, কে কী খাবে, কীভাবে খাবে এই সব তুচ্ছ বিষয়ে ঢুকে পড়ে, তখন সমস্যা গভীরতর হয়। কীভাবে একজন ব্যক্তি মানুষ ধর্মাচারণ করবেন, তা নিয়ে যখন রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীরা মাথা ঘামাতে শুরু করেন, তখন বারংবার করে এই ঘৃণার ব্যবসায়ীদের সুবিধা হয়ে যায়।
যাঁদের সংবিধান রক্ষা করার দায়িত্ব, তাঁরা যদি তাঁদের নীতি-নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বা বলেন মেয়েরা হিজাব পরে আসতে পারবে না, তখন যাঁরা ঘৃণার রাজনীতির ফেরি করে চলেছেন তাঁদের সুবিধাই হয়। কোনও মানুষ কী খাচ্ছেন, বা কী পরছেন, তা দেখার বদলে রাজনৈতিক নেতারা যদি একটু হলেও কত মানুষ খেতে পাচ্ছেন না, বা কত মানুষের পরিধানের জন্য একটির বেশি দুটি জামা নেই, তা নিয়ে চিন্তিত হতেন, তা হলে কি ভালো হতো না? সাংবিধানিক গণতন্ত্রের নীতি হল একজন মানুষ যদি নিরামিষ খাবার খেতে চান, তাহলে তিনি যেমন তা খাওয়ার স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য, তেমনি একজন মানুষ যদি আমিষ খাওয়ার খেতে চান, তিনিও তা খাওয়ার স্বাধীনতা যেন পেতে পারেন। কোনও একদল মানুষ যেন রাষ্ট্র ক্ষমতাকে হাতিয়ার করে, অন্যদলের ওপরে তাঁদের অভ্যাস বা বিশ্বাস চাপিয়ে না দেন। মহাত্মা গান্ধী, নিজে নিরামিষ খাওয়ার খেলেও কোনো দিনও বলেননি, সবাইকে নিরামিষ খেতে হবে- এটাই ভারতবর্ষের ঐতিহ্য। আমাদের দেশের শাসকদলের ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু মানুষ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আজকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘ধর্ম সংসদ’ আয়োজন করছেন, সেখান থেকে সংখ্যালঘু মানুষদের গণহত্যার ডাক দিচ্ছেন। রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তীতে অস্ত্র নিয়ে আস্ফালন করতে করতে মসজিদের মধ্যে গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করছেন। দাঙ্গা লাগানোর পরিস্থিতি তৈরি করছেন, এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার বদলে, সরকার উল্টে সংখ্যালঘু মানুষকেই লক্ষ্য বানাচ্ছেন। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশকে উলঙ্ঘন করে, সংখ্যালঘু মানুষের ঘরবাড়ি মসজিদ ভেঙে দিচ্ছেন বুলডোজার দিয়ে। তৈরি হচ্ছে এক নতুন দৃশ্যকল্প, রাষ্ট্রীয় শক্তির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সংখ্যালঘু মানুষদের প্রতি ঘৃণা। রাজনীতি এবং ধর্মের কারবারিদের মিলিত উল্লাসে ফেটে পড়ছে সমাজ। আমরা রোজ নিত্য নতুন ঘটনার মধ্যে ঢুকে পড়ছি, আর অবহেলিত থেকে যাচ্ছে দৈনন্দিন রুটি রুজির সমস্যা। তিনশো বছর আগে মৃত মোঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট আওরাঙজেব হয়ে উঠছেন আজকের দিনের আলোচ্য ব্যক্তিত্ব, অথচ প্রতিবেশী দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে যে আমাদের দেশের খুব বেশি ফারাক নেই, তা আমরা ভুলে যাচ্ছি। অপেক্ষা করছি আবার পরেরদিনের নতুন কৃত্রিম সমস্যার জন্য, যা আমাদের দৈনিক চিন্তাকে সেদিনের জন্য প্রভাবিত করবে। ঘুরতেই থাকছি চক্রাকারে, রোজ নেকড়ে আর ছাগলের গল্পের মধ্যে। ডলারের তুলনায় টাকার দাম রোজ পড়ছে, মুদ্রাস্ফীতি চরমে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের দাম, পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের জন্য খরচ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী, অথচ, সমস্ত কিছু বুঝেও আমরা প্রশ্ন করছি না। আমরা রোজ কি চক্রাকারে ঘুরতেই থাকবো এই দৈনিক কৃত্রিম সমস্যার মধ্যে, আর ভারত ক্রমশ দেউলিয়া হওয়ার দিকে এগিয়ে যাবে? শেষমেশ কি আমাদের পরিণতি শ্রীলঙ্কা, তা ভাবার কি এখনো সময় হয়নি?