মেদিনীপুর-জামনা বাসটা ধকড় ধকড় করে এগুচ্ছে। বাসের পেট আর পিঠ লোড হয়ে আছে প্যাসেঞ্জার। ডেঁপো ছেলেদের সাথে বেশ কিছু বয়স্ক মানুষের দলও ঝুলছে বাসের সিঁড়িতে। হয়ত কুড়ি বাইশ কিলোমিটার ধরেই ঝুলে আসছে তারা। এ রাস্তায় বাস চলে সাকুল্যে দুটো। সুতরাং এ ছাড়া গতি নেই। বাস গড়াচ্ছে শামুকের মত ধীর গতিতে। যদিও পুরো বাসটাই অসম্ভব রকমের নীরব। অন্য সময় হলে ড্রাইভার,কন্ডাক্টার আর বাসের দু’গেটে থাকা হেল্পারদের মা মাসি উদ্ধার হয়ে যেত। কিন্তু এখন কেউ টুঁ শব্দটিও করছে না বরং সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করছে মানুষটাকে।
বাসের ঠিক সামনেই মাথায় ছাতা ধরে হাঁটছে একটা মানুষ। পরনে ধবধবে ধুতি আর ততোধিক ধবধবে হাফ শার্ট। দুনিয়ার কোনো দিকে তাঁর নজর নেই। হাঁটছেন নিজের ছন্দে। পেছন পেছন যে একটা বাস আসছে সেই খেয়ালটাই নেই। ড্রাইভার হর্ণ দিচ্ছেনা, হেল্পার বাসের বডিতে চাপড় মারছেনা। যাত্রীরা অধৈর্য হচ্ছেনা। আরও একশ মিটার দূরে ষোড়শীরঞ্জন স্মৃতি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। মানুষটি রাস্তা থেকে নেমে বিদ্যালয়ের গেটের দিকে মোড় নিলে তবেই বাস গতি পাবে। এই হচ্ছে মদ্দা কথা। সব সময় এমনটা ঘটে তা নয় কিন্তু কখনও কখনও বাসটা নিজের সময়ের চেয়ে দেরি করে ফেলে। তখনই এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। ফলে বাসের আরও দেরি হয়ে যায়। হরিপদ মিত্র অর্থাৎ ষোড়শীরঞ্জন স্মৃতি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের প্রতি এমনই সম্ভ্রম মানুষের।
ছবিটা অবশ্য বছর তিরিশ আগের। সেই যখন ষোড়শীরঞ্জন স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক কথাটার আগে উচ্চ কথাটা যুক্ত হয়নি। তখন আড়াই হাত চওড়া মাটির দেওয়ালের দশ হাতের মাথায় তালগাছের কড়ি বর্গার ওপর টালির চাল। পরপর ছ’টা রুম, ফাইভ থেকে টেন। মাঝখানে ফুটবল খেলার মাঠ পেরিয়ে অনুরূপ আরেকটা টানা বারান্দা যুক্ত ছ’ঘরের একটা অফিস রুম, একটা লাইব্রেরী কাম সাট্ফ রুম আর বাকি চারটা ঘরে আট জন স্যারের থাকার ব্যবস্থা। হেড স্যারের বাড়ি স্কুল থেকে দুশো মিটার দূরে। বাস যদিও বা কখনো কখনো দেরি করত, হেড স্যার দেরি করতেন না কখনও। টুকরো ট্রাম পাতের মাঝখানে এক ফালি ফাঁকা অংশে লোহার রড ঢুকিয়ে মৃত্যঞ্জয় দা প্রার্থনা শুরুর ঘন্টা বাজাত। রিনরিন করে তার প্রতিধ্বনী মিলিয়ে যাওয়ার আগেই হেড স্যার অফিস রুমে ঢুকে পড়তেন।
আজ অবশ্য ছবিটার বদল হয়েছে। আজ স্যারের পরনের ধূতি ও হাফশার্টের দুটোই মলিন। ঈষৎ নূব্জ্য দেহটির পেছন পেছন বাস আর বাসের পেছনে বাইকে আমি। ড্রাইভার সনাতন বাস থামায়। হেল্পার দুজন নেমে সযত্নে স্যারকে ধরে রাস্তার একপাশে নামিয়ে দেয়। আমি বাইকটা রাস্তার একপাশে সাইড স্ট্যান্ড করে দৌড়ে যাই। আমাকে পৌঁছাতে দেখে হেল্পাররা সরে যায়। সনাতন ও আমার চোখাচোখি হয়। আমি তাকে নিশ্চিন্ত করি। সে হেল্পারদের বাসে তুলে বাস ছেড়ে দেয়। সামনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন ভট্টাচার্য বাবু। খোলা বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে দেন। আমি স্যারকে বসাই। স্যার ভাবলেশহীন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় বলেন, “রতনকে দেখেছো? আমার রতন?” আমি হাসি মুখে বলি, “স্যার, আমিই রতন।” স্যার মাথা নাড়েন, “না না তুমি নও, রতন গো, আমাদের সেই ব্যাকবেঞ্চার রতন!”
আমি জানি সে রতন আর কোনদিন ফিরবেনা। কিন্তু আমিও তো রতন। ব্যাকবেঞ্চার না হলেও ফ্রন্ট কিংবা সেকেন্ড রো তে বসিনি কোনও দিন। বরং ব্যাকবেঞ্চারদের সাথেই বেশি হৃদ্যতা ছিল আমার। স্যারের কথায় রতনের কথা মনে পড়ে যায় খুব।
আ্যসিস্টেন্ট হেড স্যার হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছেন আর জিজ্ঞেস করছেন, “নলিনীবাবুকে দেখেছেন? আধঘন্টা ধরে মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। থার্ড পিরিয়ডের পর থেকে হাওয়া! ক্লাশ নাইনের ক্লাস ছিল অথচ ক্লাসে যাননি!” স্কুলময় রটে গেল এনার্জি হাওয়া। ক্লাসরুম, অফিস রুম, লাইব্রেরী রুম কোথাও নেই এনার্জি! আমরা তাঁকে এনার্জি বলতাম তিনি আসলে এন আর জি, নলিনী রঞ্জন ঘোষ স্যারের নাম। পদার্থবিদ্যার সংগে তাল মিল করে নামটা দিয়েছে রতন মানে লম্বু রতন। আমাদের ক্লাসে দুটো রতন। ও আমার চেয়ে লম্বা তাই ওর নাম লম্বু রতন। আমরা হেড স্যারকে এইচএম বলতাম। এইচএম মানে যেমন হেড মাস্টার হয় তেমন হরিপদ মিত্রও হয়। আমাদের রোগা লিকলিকে আ্যসিসটেন্ট হেড স্যারের নাম মদন মাইতি। রতন ওঁদের দুজনের নাম দিয়েছিল হারা মিত্র আর মরা মাইতি। রতন বলেছিল, একদিন বোর্ডিংয়ে মাইতি স্যারকে ডাকতে গিয়ে দেখি, স্যার চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মাইরি বলছি, আমার পুরো মনে হল যেন শ্মশানে চালার মধ্যে শুয়ে আছে একটা মড়া। আর হেড স্যারকে দেখলে মনে হয় কিছু যেন হারিয়ে গেছে। সব সময় খুঁজে চলেছেন কিছু। এনার্জির সাথে মরা মাইতি আর হারা মিত্র নামটাও গোপনে চালু হয়ে গেল।
পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে এনার্জি স্যারকে উদ্ধার করা হল পুকুরের পাড়ে থাকা বাথরুম থেকে। পুকুর পাড়ে বাথরুমের দুটো রুম। একটা স্যারেদের অন্যটা ছাত্রীদের। আমরা পুকুরের খাড়া পাড়টার আড়ালে বাথরুম সারি। গরম পড়েছে মারাত্মক। গায়ের ঘাম গায়েই শুকায়। ফলে সচরাচর এখন খুব একটা বাথরুমে যাওয়ার দরকার হয়না। আন্টি স্যার মানে নগেন ত্রিপাঠী, এনটি থেকে রতনের বানানো আন্টি! বাথরুমে গিয়ে দেখেন স্যারেদের বাথরুম বাইরে থেকে তালা দেওয়া। ভেতরে চিঁচি করছেন এনার্জি স্যার। চিৎকার করে করে গলা বসে গেছে। তখন তো আর মোবাইল ছিলনা। মৃত্যুঞ্জয় দা কে দিয়ে তালা ভাঙিয়ে উদ্ধার করা হল এনার্জি স্যারকে। জামা কাপড় ভিজে সপ সপ করছে। কাল থেকে গরমের ছুটি পড়বে। এনার্জি স্যার নাকি বারবার ওটাই ভাবছিলেন। স্কুল ছুটির আগে তাঁকে কেউ না খুঁজে পেলে কী হত? তিরিশ চল্লিশ দিন কী তাঁকে বাথরুমেই থাকতে হবে? ভাবতে ভাবতে স্যার টেনশনে অর্ধ অচেতনের মত হয়ে গেলেন। তাঁকে লাইব্রেরী রুমে শোয়ানো হল।
ক্লাস ছুটির পর রতন পকেট থেকে একটা চাবি বের করে পুকুরে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “কী করব বল? স্যার আজকে সব্বাইকে মৌলিক আর যৌগিক পদার্থের সংকেত ধরবে বলেছিল। আমার তো শালা কিছুতেই সংকেত টংকেত মনে থাকেনা। তাই এনার্জি স্যারের এনার্জিটা একটু লস করে দিলাম আর কি! গোয়াল ঘরের তালাটা নষ্ট হয়ে গেল, এটাই শুধু দুঃখের।”
সেদিন লম্বু রতন ছাড়া ঘটনার সাক্ষী ছিলাম আমি, সনাতন, মদন আর অনন্ত। ওরা চারজন ব্যাকবেঞ্চার। আমি ব্যাকবেঞ্চার নই তবুও মনটা খারাপ হয়ে যায়। পাক্কা পঁয়তাল্লিশ দিন ছুটি। কতদিন দেখা হবেনা নিয়ম করে! রতন এক পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট আর খালি দেশলাই কাঠি বের করে। অন্য প্যাকেট থেকে বেরিয়ে আসে খালি দেশলাই খোল। খোল আর কাঠি একসাথে রাখলে খড়খড় শব্দ হয়। তাই এমন বন্দোবস্ত। আমরা স্কুল থেকে একটু দূরে একটা মাঠে বসে বিড়ি ধরাই। আজ দেরি করে বাড়ি ফিরব সবাই। রতন ঠোঁট দুটো আলতো ফাঁক করে রিং ছাড়ে। পাক খেতে খেতে ধোঁয়ার টায়ার আকাশের দিকে উড়ে যায়। আমরাও চেষ্টা করি কিন্তু রিং হয়না।
সনাতন এখন বাস ড্রাইভার। মদন তেমন কিছু জমাতে না পেরে কীর্ত্তনের দল গড়েছে। ওরা দাস, জাত বৈষ্ণব। অনন্ত একটা মুদি দোকানে কাজ করে। ওরা নাইনেই পড়ায় ক্ষান্ত দিয়েছিল। আমি মাধ্যমিক উৎরে গেলাম ভাল ভাবেই। আমার পেছন পেছন উৎরে গেল রতনও। অনাথবন্ধু শিক্ষা নিকেতনে সেন্টার পড়েছিল আমাদের। আমার পেছনেই রতন। খাতার পাতা খুলে দিয়েছিলাম। রতন দিব্যি দেখে দেখে মেরে দিল। উচ্চ মাধ্যমিকে অন্য স্কুলে ভর্তি হলাম সায়েন্স নিয়ে। রতন অবশ্য আর স্কুলে ভর্তি হলনা। সে ভজনদার আখড়ায় ভর্তি হয়ে কুস্তি শেখে, ডাম্বেল ভেঁজে হাতের গুলি বাড়ায়। শুনেছি কাঁচা ছোলা ভেজানো পাশাপাশি গাঁজাও খায়। আমাকে একদিন বলল, “শুধু গাঁজা খেলেই হবেনা বুঝলি। সংগে দু’পোয়া করে দুধও খেতে হবে।” রতন ঘোষ জাতিতে গোয়ালা। বাড়িতে পেল্লাই সাইজের সব গরু ও মোষ। মস্ত গোয়াল। খড়গপুর, মেদিনীপুর, টাটা অবধি ছানা যায় ওদের বাড়ি থেকে। ও দুধ খেতেই পারে। আর দুধ যখন খেতে পারে তখন গাঁজা খেতে অসুবিধা কোথায়? আমাদের দুধ নেই তাই গাঁজা খেতে পারিনা তবে বিড়ির বদলে লুকিয়ে চুরিয়ে সিগারেট খাই মাঝে মধ্যে।
এ হেন রতনকে দেখলাম গাজনের ভক্তা হয়ে বসে আছে। আমাদের গ্রামের চৈতি গাজন আশেপাশের দশ গাঁয়ের মধ্যএ সেরা। নীলেশ্বর মন্দিরের মাঠে চড়কের মেলা দেখতে হাজার হাজার মানুষের ভীড় হয়। তিনদিন ধরে মেলা চলে। কলকাতা থেকে যাত্রাদলের পাশাপাশি গ্রামের আ্যমেচার পার্টি নীলেশ্বর অপেরাও যাত্রা করে। আরেকদিন রাতভর কবির লড়াই। গাজনের পাঁচদিন আগে ব্রাহ্মন ন’জন ভক্তাকে মন্ত্র পড়িয়ে শিব গোত্র দান করল। গাজন শেষ না হওয়া অবধি ওই ন’জন একসাথে মন্দির বাস করবে। হলুদ রঙের থান, উপবীত আর হাতে একটা বেতের ছড়ি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করে সন্ধ্যার আগে হবিষ্যির অন্ন খাবে। একবেলাই আহার। আর দিনভড় শিবের প্রসাদ স্বরূপ গাঁজা, ভাঙ। কিন্তু সবার কপালে সব সয় না। রতনের সইল না। ভক্তার পোশাকের সঙ্গে গলায় মোটা আকন্দের মালা ঝুলিয়ে ভিক্ষেয় বেরিয়েছিল রতনের দল। পড়বি তো পড় একেবারে হেডস্যারের সামনে। “রতন না?” রতন কবে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু হেডস্যারের বাজখাঁই গলা শুনে তার গাঁজার নেশা ছুটে গেছিল। অন্যরা পায়ে পায়ে পেছুতে শুরু করলেও রতনের পা রাস্তায় সেঁটে গেছে কোন এক অদ্ভুত সম্মোহনে। তার হাতে থাকা ছড়িটা নিজের হাত থেকে হেডস্যারের হাতে গিয়ে সপাং সপাং করে পড়তে থাকলো তারই পিঠে।
“ভক্তা হয়েছিস, চড়কের পাটে উঠে দুনিয়া দেখবি? পিঠে শুলের ফোঁড় নিয়ে কেতা দেখাবি? হারামজাদা, কেতা দেখাতে হলে নিজের কেতা দেখা, নিজের জোরে কি করতে পারিস দেখা। গাঁজা ভাঙ খেয়ে কেরদানি দেখাতে সবাই পারে।” ছড়িটা ভেঙে দু টুকরো হয়ে গেল। রতন চুপচাপ দাঁড়িয়ে মার খেল। তারপর দুজনে দুজনের বাড়ির দিকে চলে গেল। পরে শুনেছিলাম বাড়ির অমতে ভক্তা হওয়ায় হেডস্যারের দ্বারস্থ হয়েছিল রতনের বাবা। যদিও ততদিনে রতন প্রাক্তন কিন্তু হেডস্যারের তাতে কী? রাতে ব্রাহ্মন ডেকে রতনকে সগোত্রে ফিরিয়েছিল রতনের বাবা। আর সেই থেকে নাকি গাঁজাও ছেড়ে দিয়েছিল রতন।
আর অন্যান্য বইয়ের চাইতে জীবন বিজ্ঞানের বই এত মোটা হয় কেন কি জানি ? তবে রতন কে হেডস্যারের হাতে মার খেতে আর একবার দেখেছিলাম স্কুলে। সেদিন হঠাৎ গোটা স্কুল থমথমে হয়ে গেছে কোন অজানা কারণে। ক্লাস নাইনের থার্ড পিরিয়ড। ভুজঙ্গ স্যার, এই নামটাও রতনের আবিষ্কার। আসল নাম ভজন দাস। তো স্যার ক্লাশের ফার্স্ট বয় অপূর্ব-র কাছ থেকে জীবন বিজ্ঞান বইটা চেয়ে নিলেন। অপূর্বর বই, খাতা অদ্ভুত চকচকে। আমাদের বইগুলোর পাতার মত উপরের কোন মুড়ে নীচের দিকে ঝুঁকে থাকেনা। ঝকঝকে মলাটের ওপর গোটা গোটা ইংরেজিতে লেখা অপূর্ব রায়, ক্লাস নাইন, রোল নম্বর ওয়ান। অপূর্বর দেওয়া বইটার দু’চারটা পাতা উল্টে কেমন গুম হয়ে গেলেন স্যার। হনহন করে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই সমস্ত ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন সব স্যারেরা। আধঘন্টা পর ডাক পড়ল অপূর্বর। ততক্ষণে জরুরি তলব পেয়ে তড়িঘড়ি ছুটে এসেছেন অপূর্বর বাবা। তাঁর মুখ থমথমে।
পরবর্তী ঘটনা পরে জেনেছি রতনের কাছে কিন্তু তখন যেটা দেখলাম আগে সেটাই বলি। একটু পরে মৃত্যুঞ্জয়দা এসে ডেকে নিয়ে গেল রতন, সনাতন, অনন্ত আর মদনকে। একটু দূরত্ব রেখে আমিও গেলাম পেছন পেছন। লাইব্রেরী রুমে সব স্যাররা জটলা করছেন। হেডস্যারের রুমে হেডস্যার ছাড়া আ্যসিস্টেন্ট হেডস্যার আর অপূর্বর বাবা। রতনের জামা খুলে একটা চেয়ারের পিঠে ঝোলানো। ও কোনদিন গেঞ্জি পরতনা। আদুর গা, হাফপ্যান্ট। রতনের খোলা পিঠে হেডস্যারের বেত আছড়ে পড়ছে সপাং সপাং সপাং। এক সময় হাঁফাতে হাঁফাতে থামলেন হেডস্যার। বললেন, “তোর হাত পা আজ ভেঙে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। খালি বেঁচে গেলি সত্যি কথাটা স্বীকার করে নেওয়ার জন্য।”
পরে রতন জানিয়েছিল, আগেরদিন পেন আনতে ভুলে গেছিল সে। আমাদের ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র অপূর্বর কাছে স্পেয়ার থাকে বরাবর। অপূর্বকে পেন চাইতে সে বলেছিল চাইনিজ পেন আর চেলপার্কের কালি সবাই ব্যবহার করতে পারেনা। ভুজঙ্গ স্যার অপূর্বর বইয়ের মধ্যে যৌবনের পিপাসা নামে একটি সচিত্র চটি বই আবিষ্কার করেছিলেন। সেদিনও স্কুল ছুটির পর মাঠে গিয়ে বসেছিলাম আমরা। ধোঁয়ার টায়ার আকাশ ওড়াতে ওড়াতে রতন হাসতে হাসতে বলেছিল, “আমি তো শালা জীবন বিজ্ঞানের বইয়ের ভেতরে আরেকটা জীবন বিজ্ঞানের বই ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম! তাতেও দোষ!”
সবারই বোধহয় কোনও না কোনও দুর্বলতার জায়গা থাকে। যেমন আমাদের হেডস্যারের ছিল টিটো। বাঘের মত লাল দেশী কুকুরটা। মাঝে মধ্যে চেন ছিঁড়ে কিংবা বাড়ির লোকদের অসতর্কতায় বাড়ি থেকে ছুটতে ছুটতে চলে আসত স্কুলে। নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ত হেডস্যারের রুমে। তাকে সরিয়ে নিয়ে যায় কারও সাধ্য নেই। সরাতে গেলে রীতিমতো দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে। তখন মৃত্যুঞ্জয় দা কে দিয়ে খবর পাঠাতে হত হেডস্যারের বাড়িতে। হিমুদা এসে টিটো কে নিয়ে যেত। হিমুদা মানে হিমবন্ত মিত্র, হেডস্যারের একমাত্র সন্তান। খুবই ব্রিলিয়ান্ট, ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ার। সমস্যা হত হিমুদা বাড়িতে না থাকলে। তখন টিফিন অবধি অপেক্ষা করতে হতে হেডস্যারকে। তারপর নিজে পৌঁছে দিয়ে আসতেন। তারই মধ্যে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।
সেবার শীতকালে জমে যাওয়ার মত অবস্থা। শৈত্যপ্রবাহ কথাটা তখন চালু হয়নি ঠিকই কিন্তু মাঘের শীতে বাঘের পালানোর কথাটা যেখানে সেখানে শোনা যাচ্ছে। উত্তরের হু হু বাতাসে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের খাড়া পুকুরটার পাড়ে ভেঙে পড়েছে ফাইভ থেকে টেন। টিটোকে টিফিনে বাড়ি ফেরাতে যাচ্ছিলেন হেড স্যার। হঠাৎ টিটো উল্টো দিকে দৌড় দিল। মাঠ ছাড়িয়ে উঠে পড়ল পুকুরটার পাড়ে কিন্তু ভারসাম্য রাখতে না পেরে গড়িয়ে পড়ল পুকুরে। আগেই বলেছি পুকুরটা খাড়া। খাড়া শুধু পাড়ই নয়, পুকুরের ভেতর দিকটাও খাড়া করে কাটা। টিটো সাঁতরে নিজেকে ভাসিয়ে রেখেছে ঠিকই কিন্তু কোনো ভাবেই উঠে আসতে পারছেনা। বারবার দু’পা তুলে পাড়ের মাটি ছোঁয় আর ঝপাং ফের জলে পড়ে যায়। ওকে বারবার ঘাটের দিকে যাওয়ার কথা বলছিলাম আমরা, আঙুলের ইশারায় দেখাচ্ছিলাম ঘাটের দিক। কিন্তু অবুঝ প্রাণীটা বোধহয় সেটা বুঝতে পারছিল না। ও শুধু সামনা সামনি মাটিটা ছোঁয়ার জন্য আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছে।
কুড়ি নাকি তিরিশ মিনিট? কতক্ষন এভাবে টিটো লড়েছিল জানিনা। একসময় মনে যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে ও। “ মারাত্মক ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে ও! কোলাপ্স করে যাচ্ছে!’ কোন স্যার যেন বলে উঠল। হেডস্যার হতভম্ব হয়ে গেছেন। “ডুবে যাচ্ছে ও!” ক্লাশ ফাইভের একটা বাচ্চা কেঁদে উঠলো। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল নাইন টেনের মেয়েরাও। শেষ বারের মত নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় মুখটা জলের ওপর তুলল টিটো আর ঠিক তখনই ঝপাং করে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাদা জামা খাকি প্যান্ট পরা একটা ছেলে। টিটোকে জাপটে ধরে ভাসতে লাগল, সাঁতরে পাড়ের দিকে এসে একটা হাত বাড়ালো। মদন এক হাতে রতনের সেই হাতটা ধরল, মদনের অন্য হাত ধরল সনাতন, সনাতনের অন্য হাত অনন্ত।
পাড়ে উঠে ভিজে জামা কাপড়ে আছে রতন। তার গাল চেটে জল মোছার চেষ্টা করছে টিটো! আমাদের ফার্স্ট বয় সেই অপূর্ব নিজের জামা খুলে রতনের মাথা মুছিয়ে দিচ্ছে। সেই থেকে বাঘা টিটো ভক্ত হয়ে গেল রতনের। টিফিনের ঘন্টা দেওয়া আর ছুটির ঘন্টা দেওয়ার ফারাকটা কে না জানে? ছুটির ঘন্টা পড়ে একটানা টিং টিং টিং টিং আর টিফিনের সেই টিং টিং ঘন্টা পড়ার আগে ঢং ঢং করে চারবার ঘন্টা পড়ে। টিটো কান খাড়া করে থাকে টিফিনের ঘন্টার জন্য। চেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায় বাড়ি থেকে। এরপর টিফিন হলেই টিটোকে ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ হল। বাস লরি বাঁচিয়ে টিটো টিফিনে স্কুলে হাজির হয়, ব্যাক বেঞ্চার টিমের সাথে খেলে। রতনের ওপর ভার পড়ে টিফিনের পর টিটোকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার।
সেবার বন্ধ হয়ে গেল নীলেশ্বরের গাজন। রাত জাগছে গোটা গ্রাম। হ্যাজাক আর ডে-লাইট জ্বালিয়ে মস্ত একটা মঞ্চ তৈরি হচ্ছে রতনের জন্য। শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে কফিন বন্দী রতনকে নিয়ে উড়ান ভরেছে ভারতীয় বায়ু সেনা। সিআরপিএফের আ্যপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়ার পর আমার বাড়িতে এসেছিল রতন। হাসতে হাসতে বলেছিল, “আমি শালা ব্যাকবেঞ্চারই রয়ে গেলাম বুঝলি। ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেব কিন্তু শালা কপাল দেখ, আধা সেনা হয়ে গেলাম।” আমি তখন নামী ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির এম আর।
দমদমে বায়ুসেনার বিমান নামবে ভোর চারটায়। তারপর আধাসেনার সাঁজোয়া গাড়িতে বডি আসবে আমাদের গ্রামে। ঠিক হয়েছিল গ্রামের শ্মশানেই দাহ করা হবে রতনকে। কিন্তু হেডস্যার বললেন, “কখনই না! সাধারণের শ্মশানে নয়, ও বীর। বীরের জন্য যোগ্য সমাধি হবে স্কুলের পুকুর পাড়। ওখানেই হবে রতনের শেষ কাজ।”
হেডস্যার তখন রিটায়ার্ড তবুও তাঁর কথার ওপর কথা বলে কে? তাই মঞ্চ বাঁধার কাজ চলছে স্কুলের মাঠেই। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রতনকে ওখানে কিছুক্ষণ রাখা হবে। রতনের শেষ পোস্টিং ছিল কাশ্মীরে । গতকাল দুপুরে খবরটা পৌঁছানোর পরই থেমে নীলেশ্বরের গাজনের বাজনা। শ্রীনগর থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে সোপিয়ানে জঙ্গিদের গুলির লড়াইয়ে শহিদ হয়েছে আমাদের রতন। এডিএম, আ্যডিশনাল এসপি, তদারকি করছেন রিথলেয়িং শিরোমনি। সিআরপিএফের খড়গপুর ব্যাটেলিয়নের কমাডেন্ট ও অন্যান্য আধিকারিক, জওয়ানরা পৌঁছে গেছেন সকাল সকাল। বিশাল জনস্রোত সামলাচ্ছেন স্বয়ং ওসি।
রতনের দেহ নিয়ে সাঁজোয়া গাড়ি ঢুকলো দুপুর বারোটায়। গোটা গ্রাম কাঁদছে। মঞ্চের ওপর সাদা ফুল আর মালায় ঢেকে আছে রতন। “ কই, আমার রতন কই?” কাঁপতে কাঁপতে মঞ্চে উঠে এলেন ষোড়শীরঞ্জন স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক হরিপদ মিত্র। জাতীয় পতাকায় মোড়া কফিনের ওপর যেন আছড়ে পড়লেন।
“আমার রত্ন, আমার মানিক! আমার সোনা। মাই ব্রেভ হিরো! তুই আমার নাম দিয়েছিলি হারা মিত্র, তাইনা? এভাবে আমাকে হারিয়ে দিয়ে চলে যাবি বলেই?” মঞ্চেই জ্ঞান হারালেন হেডস্যার। তাঁকে ধরাধরি নামিয়ে আনা হল।
দু’জন জওয়ান কফিনের ওপর থেকে জাতীয় পতাকা তুলে ভাঁজ করে তুলে দিল রতনের শোকার্ত বাবার হাতে। রতনকে নিয়ে গিয়ে শোয়ানো হল পুকুর পাড়ে সাজানো চিতায়। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সশস্ত্র জওয়ানদের হাত যন্ত্রের ওপরে উঠল তারপর একে একে শূন্যে গর্জে উঠল রাইফেল গুলো। গান স্যালুটে কেঁপে উঠল আমাদের গ্রাম। জ্বলে উঠলো রতনের চিতা। পেনশনের টাকায় শ্বেত পাথরের সমাধি সহ রতনের একটা আবক্ষ মর্মর মূর্তি গড়ে দিলেন হেডস্যার।
ভট্টাচার্য্য বাবুর বারান্দায় পাতা চেয়ারে হেডস্যার বসে আছেন উদভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে। একটু পরে হিমুদা এল। হেডস্যারকে ধরে নিয়ে যেতে যেতে ফিসফিস করে বলল, আ্যলঝেইমার্সে ভুগছে রে। ওষুধ খাওয়াছি কিন্তু খুব বেশি কাজ করছে না। মনে হচ্ছে সাব-কর্টিক্যাল ডিমেনশিয়াও শুরু হয়েছে। হেডস্যার বিড়বিড় করতে করতে চলে যাচ্ছেন হিমুদার হাত ধরে। গ্রামের প্রতিষ্ঠা পুকুর থেকে চড়কের পাট তুলে সার দিয়ে নীলেশ্বরের মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভক্তার দল। গাজনের বাজনা বাজছে। ভক্তার দল বলছে , “জয় বাবা ভোলানাথ, বাবা মহাদেবের চরণে সেবা লাগে।” মনে পড়ে যায় আজ তো চড়ক। আজই তো…! হেডস্যার কী তবে পুকুরের পাড়ের দিকেই যাচ্ছিলেন? আমি কল্পনায় শূন্য আকাশে চড়ক পাটের মাথা খুঁজি! কত ওপরে উঠে গেছে রতন?
শ্রদ্ধেয় নরেশ বাবু,
এক লহমায় আশির দশকের স্কুল জীবনে পৌঁছে দিলেন আপনি।
চোখে জল এসে গেল।
মাটির গন্ধ পেলাম।
গ্রামীণ স্কুলের নিবেদিত প্রাণ ওই পাগল মানুষ গুলির জন্যই আজ আমরা এই জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছি।
আজকের যুগে এই নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক দের বড়ই অভাব।
আপনার লেখনী সচল থাকুক।
প্রণাম