শনিবারের বাজারটা একদম ময়দানে মারা গেল। দিল্লিতেও ময়দান আছে, আছে কলকাতাতেও। কলকাতায় মেট্রো রেলে বলে নেক্সট স্টেসন ইজ ম্যায়ডান। কিন্তু বাংলায় বলে পরবর্তী স্টেসন ময়দান। দিল্লির ময়দানে আছে প্রগতি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ময়দানে প্রগতি নেই। প্রগতি আর উন্নতিকে কি সমার্থক বলা যায়? তাহলে বলব পশ্চিমবঙ্গের উন্নতি দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার ধারে। ত্রিফলা আলোর মতো। ত্রিফলা আলোর ডাণ্ডায় জড়ানো নীল-সাদা এলইডি টুনি বাল্বের মতো। উন্নতির আলোয় কিছুই দেখা যায় না – কিন্তু মিটমিট করে।
থাকি গুরগাঁওতে, চাকরি করি একটা বহুজাতিক সংস্থায়। ফাইভ ডে উইক হলেও, কোম্পানির বাতিক হল এমপ্লয়িদের চাঙ্গা রাখা। আর সেই কাজের তদারকির জন্যে আছে এইচ আর ডিপার্টমেণ্ট। অবাঙালিরা বলে হ্যাচ আর। ঠিকই বলে, আমরা যেন পোলট্রির ডিম, হ্যাচ করে বানিয়ে তুলবে ঝিম মারা সব মুরগি ছানা। কিছুদিন পরেই গোটা ১৭০/-, কাটা ২৩০/-।
আমাদের এই হ্যাচ আর ডিপার্টমেণ্ট, যার কর্পোরেট মাথায় আছে আম্রুৎ নেগি, ন্যাগ করার জন্য বিখ্যাত। ব্যাটা সব জানে। এমন কোন বিষয় নেই, এমন কোন ভাষা নেই জানে না। আমার সঙ্গে একবারই ছোটি সি মুলাকাত হয়েছিল। বলেছিল বাঙ্গালীদের হামি খুব রেসপেক্ট কোরে, বাঙ্গালি খুব মিশটি আছে। টাগোরের গান হামার ওয়াইফ পসন্দ করল। বিপোঁদে মোরে রকছা কড়ো এ নাহি মোর পরারথনা, বিপোঁদে হামি না জেনো কোড়ি ভোয়। আরে ওয়াঃ, কা বাত। হোয়েনএভার ইউ ফেস এনি ট্রাবুল, ডোন্ট গেট অ্যাফ্রেড। মায়ের চিকিৎসার জন্যে, আমি ছুটির দরখাস্ত করেছিলাম। তার জন্যে এত কথা! আরো বলেছিল, আপনার মামি হামাদেরও মামি। আপনাকে যেতে হোবে কেনো? হামি কঅলকাতার ব্রাঞ্চে কহিয়ে দিচ্ছে, সব ঠিক কোরে দেবে। কঅলকাতার বেস্ট নার্সিংহোম, বেস্ট ডক্টর। আমাদের কলকাতা উচ্চারণে “কোল” আছে, অবাঙালী উচ্চারণে “কল” আছে – যাকে গ্যাঁড়াকল বলা চলে। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বসে শোনা যায় “কঅলকাতা যানেওয়ালি ফ্লাইট গেট নাম্বার তেইশসে রওয়ানা হোগি...”। কলকাতার কোলে বেড়ে ওঠা বাঙালী, বাইরে গেলেই জাঁতাকলে পড়ে যায়। তা সে যাইহোক, আমার এবং মায়ের দুজনেরই ভাগ্য ভালো, শেষমেষ সেবারে আর যেতে হয়নি। মা দু একদিনের মধ্যেই রিকভার করে গিয়েছিলেন।
সেই নেগির ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক শনিবার অফিস ছুটি থাকলেও, আমাদের হাজরি দিতে হয়। সকাল দশটা থেকে বারোটা-সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। “জিনে কি তরিকা” আমাদের বাঁচার ক্লাস নেয়। বেঁচে তো সবাই আছে এই পৃথিবীতে - পিমড়ে থেকে হাতি, অ্যামিবা থেকে তিমি। কিন্তু সে জিনা কি আর জিনা, রে লাল্লু। “জিনে কি তরিকা”-র বাবা তেজকিরণ প্রতি শনিবার আমাদের ক্লাস নেন। কিভাবে আমাদের জীবনটা আরো সুন্দর হয়ে উঠবে। তিনি আমাদের ধ্যান শেখান, ইয়োগা শেখান, প্রাণায়াম শেখান। আমাদের মনের মধ্যে জমে ওঠা সারা হপ্তার যাবতীয় কাজের স্ট্রেস, তিনি টিপে টিপে বের করে দেন, টুথপেস্টের টিউব থেকে পেস্ট বের করার মতো। একবারে সবটা বের করে দিলেই হয়, কিন্তু তা নয় একটু একটু করে, প্রতি শনিবার।
বাবা তেজকিরণ আসেন, তাঁর সঙ্গে আসেন দুই সঙ্গিনী। পাক্কা দশটায় আমাদের অফিসের থার্ডফ্লোরের সেমিনার হলটাকে ফ্যাঁস ফ্যাঁস রুম ফ্রেশনারে ফ্রেশ করে নেওয়া হয়। সাজিয়ে তোলা হয় ফুল দিয়ে আর সারা হলের কোনায় কোনায় সুগন্ধী আগরবাত্তি জ্বেলে দেয় ওরা। দুই কন্যার পরনে সাদা খোলে নীল চিরুনি পাড় শাড়ি। গায়ে থ্রি কোয়ার্টার সাদা ব্লাউজ, কনুইয়ের একটু নিচে ফ্রিল দেওয়া হাতা। ভাবলেশহীন মুখে তারা যন্ত্রের মতো সব কাজ সেরে ফ্যালে। দশটা দশে আবির্ভাব হওয়ার পর, বাবা সিংহাসনে আসীন হলে, তারা বাবার পিছনে বসে – একজন ফার্স্টস্লিপ, অন্যজন লেগস্লিপ ফিল্ডারের মতো। অতটা না হলেও, একটু পিছনে, কোনাকুনি। তাদের দুজনার মতো রাম গরুড়ের ছানা আমি আর তৃতীয় দেখিনি। মুখ দেখলে মনে হয়, আমাদের নেগি সায়েবের মতো, বাবা তেজও তাদের বহুদিন ইনক্রিমেন্ট আটকে রেখেছেন; নয়তো বহুদিন তাদের লিভ অ্যাপ্লিকেশন পেন্ডিং রেখে দিয়েছেন।
সকাল দশটার মধ্যে আমরা যখন হলে পৌঁছাই, বাইরে জুতো খুলে, হাল্কা পায়ে উঠে বসি সাদা চাদর বিছানো, মেঝেয় পাতা ঢালাও গদিতে। আর নেগি সায়েবের চ্যালা রাজেশ পুনিয়া, বাবা তেজকিরণকে সঙ্গে নিয়ে হলে প্রবেশ করলেই আমরা হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়াই। জোড়হাত করে, আমরা সমস্বরে নমস্কার করে বলি, “পরণাম, মহারাজজী”।
এতগুলি সন্তানের গর্বিত পূজ্য বাবা দুই হাত তুলে আশীর্বাদ করেন, “জয়মস্তু, শুভমস্তু”। বাবার গোলগাল নির্দাড়িগোঁফ মুখে হাল্কা হাসি, চোখ সামান্য আবিষ্ট। মাথার কাঁচাপাকা চুল ঘাড় অব্দি, থাক-কাটা-কাটা। পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি। ম্যাজেন্টা রঙের চওড়া পাড় দেওয়া বাসন্তি খোলের ধুতি, ভাঁজ করে পরা। ফুলে সাজানো সোনালি নকশা করা ডিপব্রাউন সিংহাসনটা হলের পশ্চিম দিকে, মাঝখানে রাখাই ছিল। গদি আঁটা সেই সিংহাসনে বসে, তিনি দুই হাতের ইশারা করলে, আমরা সকলে বসি। সমঝদারকে লিয়ে ইশারা হি কাফি হ্যায়। বাবু হয়ে বসতে আমাদের অনেকের হাঁটুতেই কটমট, খটমট আওয়াজ হয়। তা হোক, গদিতে বসার পর, আমরা তাঁর বাণী শোনার জন্য উদ্গ্রীব হই। উদ্গ্রীব হই?! আচ্ছা, বাবা আচ্ছা, সত্যিকারের উদ্গ্রীব না হলেও, আমরা সেরকমই অভিনয় করি। আসলে প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিনিয়ত আমরা যে কত ভালো অভিনয় করি, সে কথা জানলে উত্তমকুমার-সৌমিত্রও শিউরে উঠতেন!
সকলের একজোড়া হ’লে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ জোড়া চোখে, আমরা বাবা তেজকিরণের মুখের দিকে চেয়ে থাকি। না ঠিক বললাম না, নিখিল চোমালের একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ছোকরা বছর কয়েক আগে বাইক অ্যাক্সিডেণ্ট করে, প্রায় মরতে বসেছিল। হাতে-পায়ে স্টিল প্লেট বসিয়ে, একটা চোখ খুইয়ে বেচারা এখন আমাদের সঙ্গেই চার্টার্ড বাসে যাওয়া আসা করে। আমরা সবাই বাবা তেজকিরণের দিকে তাকিয়ে আছি বললাম বটে, কিন্তু কিছু লোকের চোখ, বাবার সঙ্গী স্লিপের দুই ফিল্ডারের দিকেও থাকে। আমাদের সেকসনে কওশল সুমন নতুন ঢুকেছে, বছর খানেক হল। ছোঁড়া খুব ডেঁপো, মেয়েদের পেছনে খুব ঘুরঘুর করে। সে নাকি লেগস্লিপের মেয়েটির সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিয়েছে। মেয়েটির বাপের দেওয়া নাম নেহা পটেল, আর এখন বাবার আশ্রম থেকে দেওয়া নাম শান্তিমতী। খুব গরিব ঘরের মেয়ে। কোনরকমে ক্লাস টেন পাস করার পর আর লেখাপড়া করতে পারেনি। বাবা তেজকিরণের রাজকোটের আশ্রমে ওদের পরিবারের আসাযাওয়া ছিল। সেখানেই ও কিভাবে যেন বাবার চোখে পড়ে যায় এবং সেই থেকে আশ্রমে রয়ে গেছে। বছর খানেক ট্রেনিংয়ের পর, এখন বাবার সঙ্গেই থাকে, বাবার সেবা করে। অহর্নিশ সেবা মে হে।
“বহনোঁ অওর ভাইয়োঁ...আজ আমরা যে বিষয় শিখবো – সে বিষয় প্রত্যেক লেডিস ও জেন্টসের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী শিক্ষণীয় বিষয়। পরন্তু আমাদের দেশে যে শিক্ষাবেওস্থা আছে, তাতে এই শিক্ষা আমাদের দেওয়া হয় না। আমাদের দেশের বাচ্চারা পচ্চিমদেশের অনুকরণ করে যে শিক্ষা লাভ করে, তাতে তারা যে শুধু ভোগময় জীবনের প্রতি লালচি হয় তাই নয়, বরং পাপের দিকে নিরন্তর দৌড়তে থাকে। তারা কদাপি মনমে শান্তি পায় না, দিনরাত পয়সা, প্রমোশন, আলিসান ফ্ল্যাট, লেটেস্ট মডেলের দামি গাড়ি, বছরে একবার ফোরেন টুরের স্বপ্ন দেখতে দেখতে, অন্দরসে খোকলা হয়ে যায়, পরেসান হতে থাকে। বাড়তে থাকে স্ট্রেস – মান্সিক চাপ। মেরেকো আকসর পুছা যাতা হ্যায়, বাবা, ইস সে ক্যায়সে মিলেগি ছুটকারা? কেয়া মুক্তি কি কোই ভি উপায় নেহি হ্যায়? আমি বলি, কিঁউ নেহি, বেটা, অবশ্য উপায় হ্যায়। তোমার কাছে ইয়দি দোপলকা ওয়ক্ত থাকে, শান্ত হয়ে বসো দেখি আমার সামনে, মন দিয়ে শোন দেখি আমার কথা। আমাদের এই দেশেরই মুনি ঋষিরা সাদিয়োঁ পহেলে, এর মোক্ষম উপায় বাতলে দিয়ে গেছেন। আমরা সে কথা শুনি না। কিন্তু সেই উপায় ইস্তেমাল করে, পচ্চিমের সায়েবরা যখন সেই উপায়ের কথা ইংরিজিতে সাতকাহন করে বলে, তখন আমাদের গর্বে বুক ফুলে ওঠে। কিন্তু তাও আমরা সেই উপায়ের কথা চিন্তা করি না। সেই উপায় কী”?
ওপরের কথাগুলো বাবা তেজকিরণ স্যান্সক্রিট ঘেঁষা শুদ্ধ হিন্দীতে বললেও, আমি অধিকাংশই পাতি বাংলাতেই বললাম। হিন্দি বলা এবং লেখাতে আমার কচি নয়, বেশ ব্যথা আছে। তবু বাচালতা করা যার স্বভাব সে করবেই, আমি বলে ফেললাম, “যোগ”।
প্রসন্ন হাসিতে বাবা তেজকিরণের মুখ ভরে উঠল, বললেন, “অতি উত্তম। সহি জওয়াব। লেকিন যোগ নেহি বেটা, ই-য়ো-গা। আপনি বাঙ্গালি আছে, জরুর”। আমি হেসে ঘাড় নাড়লাম। তিনিও আধবোজা চোখের হাসিতে সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইয়োগা। আজ ইয়োগার মধ্যে আমি অন্য এক বিষয়ের কথা বলব, ধ্যান। আপলোগ সবাই মক্ষিকে তো দেখেছেন। মক্ষি কভি ফুলের ওপর বসে, কভি গন্ধা বিষ্ঠায় বসে, আমাদের এই চঞ্চল মনটাও ওই মক্ষির মতো ...
মাছির কথায় আমার মাছের কথা মনে পড়ল, আজ অনেকদিন পর বাজারে বেশ টাটকা মৌরলা পেলাম। এদিকে এসব মাছ বেশ কম আসে। আর এলেও এমন দাম হাঁকে, নেব কি নেব না, ভাবতে ভাবতে অন্য লোকেরা তুলে নেয়। তাছাড়া হরিয়ানভি যে বাই আমাদের কাজ করতে আসে কিংবা ঝিনিও, এই ছোটোমাছ সাফ করার তরিকাটা ঠিক জানে না। ঝিনি, আমার বউ, ছোটমাছ খেতে পছন্দ করে, কিন্তু নিজে রান্না করতে বিরক্ত হয়। দিন দশেক হল, দুর্গাপুর থেকে ঝিনির মা এসেছেন, সেই ভরসাতেই আজ সাহস করে মৌরলা মাছ কিনেই ফেললাম। শ্বাশুড়ি দুর্গাপুর থেকে আসার সময় একগাদা আমের, কুলের আর তেঁতুলের আচার, কাসুন্দি নিয়ে এসেছেন। তার সঙ্গে এনেছেন কল্যাণেশ্বরী মায়ের আর ঘাগরবুড়িমার প্রসাদীফুল ও প্রসাদ। কল্যাণেশ্বরী মা এবং ঘাগরবুড়িমা, দুজনেরই থানে ঝিনির মা মান্নত করে এসেছেন, এবার যেন আমাদের একটি ছেলে হয়। আমাদের বড়োটি মেয়ে, বুল্টি, বছর চারেক বয়েস। এখন ঝিনি আবার মা হতে চলেছে। দেরী আছে - সবে তিনমাস, ডেট আছে সেই নভেম্বরে। অফিসে এখনো কাউকে বলা হয়নি। বললেই বলবে, পার্টি দো - হুইস্কি, চিলি চিকেন, সেঁকাপাঁপড়, ডালমুট...। এখনই দুম করে খরচ করতে চাইছি না। ঝিনির চেকআপ, শ্বাশুড়ির আপ্যায়ন, বুল্টির নিয়মমাফিক ভ্যাক্সিন। তার ওপর সামনে ঝিনির ডেলিভারি, বুল্টির প্রেপ স্কুলে অ্যাডমিশান, অনেক খরচ...।
“চঞ্চল-চুলবুলি এই মনটাকে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপনা করতে হবে। তার কি উপায়? সমতল আসনে সরলদেহে আরামে বসতে হবে। সরলদেহ কা মতলব কেয়া হ্যায়? সমগ্রীবকায়। অর্থাৎ কিনা মাথা থেকে ঘাড়, মেরুদণ্ড বিলকুল সিধা টানটান করে বসতে হবে। তারপর দুই হাত নিজের কোলের ওপর উত্তানভাবে, একহাতের উপর অন্যহাত রাখতে হবে। উত্তানভাব কেয়া হ্যায়? হাতের তালুর উপরের দিকে খোলা অবস্থানকে উত্তানভাব বলে। আভি আপনা দো আঁখোকা নজর আপনা নাককে উপর ডালনে কি কোশিশ কিজিয়ে। ট্রাই টু কিপ ইয়োর ভিসন, অন ইয়োর ওন নোজ টিপ। কিজিয়ে কিজিয়ে, কোশিশ কিজিয়ে। আপ, সেকেণ্ড রো মে, থার্ড, হাঁ হাঁ আপ, অ্যায়সা ঝুকনে সে নেহি চলেগা, একদম সিধা ব্যায়ঠনা হোগা, মেরেকো দেখিয়ে, গওরসে দেখিয়ে...হাঁ আব সহি হুয়া...। আভি ধীরে ধীরে পুউউউরা শ্বাস লিজিয়ে, থোরা রুককে, পুউউরা ছোড়িয়ে। একদম ধীরে ধীরে। কিজিয়ে কিজিয়ে, কোশিশ কিজিয়ে”...
চোখ টেরিয়ে নাকের ডগায় দৃষ্টি রেখে, আস্তে আস্তে শ্বাস নিলাম বুক ভরে। ভুরুর একটু ওপরে, কপালের মাঝখানটায় কেমন যেন চিনচিন করে উঠল। এই চিনচিনে ব্যথাটা কি উপকারী ব্যথা? ছোটবেলায় এরকম কোন ব্যাথা লাগলে, মা বলতেন, ভালোই তো পোকাগুলো মরছে। খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে হাঁটু ছড়ে গেলে, মা তুলোয় ডেটল লাগিয়ে, হাল্কা ছোঁয়ায় মুছে দিতেন ক্ষতটা। ডেটল লাগলে আমি চিনচিনে জ্বালায় যখন আঁউ করে উঠতাম, মা বলতেন, অ্যাই চুপ, তুই কেন চেঁচাচ্ছিস? চেঁচাবে তো পোকাগুলো, যারা তোর কাটা ঘায়ে বসে বসে মরছে। আচ্ছা, আজ এই যে ভুরুর কাছটা চিনচিন করছে, আমি যদিও আঁউ করে উঠলাম না। যদি করতাম, মা কি বলতেন, অ্যাই চুপ, তুই কেন চেঁচাচ্ছিস? ভালই তো, তোর মনের পোকাগুলো মরছে!
এ ভাবে নাসাগ্রে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের ভেতরে গোল চৌকো নানারকম রঙের আকার, ভেসে বেড়াতে দেখলাম। আরেব্বাস। আমি মহাপুরুষ বা সিদ্ধপুরুষ হয়ে যাচ্ছি নাকি? এরকম কিছুক্ষণ করলে কি আমার মাথার পেছনে সোনালি বিশাল থালার মতো জ্যোতি দেখা যাবে? আমি কি এই সাদা চাদর বিছানো গদি থেকে ইঞ্চি ছয়েক উপরে উঠে শূণ্যে ভেসে উঠব? কিন্তু আগেকার দিনের মুনিঋষিরা তো হাজার বছর ধরে তপস্যা করে, তারপর সিদ্ধ-টিদ্ধ হতেন। এই হাজার বছরে নিশ্চয়ই কোন একটা ক্যাচ আছে। মুনি ঋষিরা হাজার বছর ধরে তপস্যা করতেন। কবিরা হাজার বছর ধরে পথ হাঁটতেন। হাজার ছাড়া কিছু হবার নয়। আমি তাহলে এই কর্পোরেট অফিসের হলে ঘন্টা দেড়েক, কি দুয়েক ধ্যান-ট্যান করে কোন সিদ্ধি লাভ করতে পারবো কে জানে?
“এসিকা পরিশ্রুৎ শীতল পওন, ফুলোঁকা মহক। ইস পবিত্র বাতাবরণকা পুরা মজা লিজিয়ে। ধীরে ধীরে, কোই জলদিবাজি নেহি, ধীরে ধীরে পুউউউরা শ্বাস লিজিয়ে। থোড়াসা - দশ সেকেণ্ড তক শ্বাসকো রোক লিজিয়ে, উসকে বাদ ফির ধীরে ধীরে শ্বাস ছোড়িয়ে...”।
পবিত্র বাতাবরণের কথায় মনে পড়ল। আমার দিদিমা ছিলেন বাংলা প্রবাদ আর নানান গল্পের আকর। তাঁর মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম। এখন মনে পড়ে গেল হঠাৎ। অনেক দিন আগে, হাটে মাছের সওদা শেষ করতে করতে, এক মেছুনির বেলা পড়ে এল। আর হবি তো হ সেদিনই হল প্রবল ঝড়বৃষ্টি। বৃষ্টি যখন ছাড়ল, সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ। সেই মেছুনির বাড়ি বেশ দূরের এক গাঁয়ে, অনেকটা পথ, ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। কী করে ফিরবে? সেই হাটেই ঝড়বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল এক মালিনীবুড়ি। তার ফুলের ঝুড়িতে তখনো পড়ে ছিল বিক্রি না হওয়া বেশ কয়েকটা বেলি আর জুঁই ফুলের মালা। বৃষ্টির ছাটে আর সন্ধ্যের ঝোঁকে সেই মালার ফুলের মন জুড়োনো সৌরভে ভরে উঠল চারদিক। মেছুনির আতান্তর দশা দেখে মালিনীবুড়ি বলল, আমার বাড়ি এই সামনেই পাশের গাঁয়ে, আজ রাত্তিরটা আমার বাড়িতে কাটিয়ে, কাল ভোরে না হয় চলে যাস তোর নিজের বাড়ি। মেছুনি হাতে যেন স্বর্গ পেল, রাজি হয়ে গেল এক কথায়। মালিনীবুড়ির মনটাও যেমন ভাল, বাড়িটাও ভাল। চারিদিকে নানান ফুলের বাগান, মাঝখানে ছোট্ট চাঁচের ঘর, খড়ের চাল। দুপশলা বৃষ্টির জলে, সতেজ ফুলের গন্ধে সেই বাড়ির পরিবেশ পবিত্র হয়ে উঠেছে। ওই মানে, পবিত্র বাতাবরণ। বুড়ি রাত্রে খাওয়ার সময় একটু দুধভাতের ব্যবস্থাও করে দিল। তারপর নানান সুখদুঃখের কথা বলতে বলতে তারা দুজনে শুয়ে পড়ল ঘরের দাওয়ায়। শোয়া মাত্র মালিনীবুড়ি ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু মেছুনির আর ঘুম আসে না। এপাশ ফেরে, ওপাশ ফেরে। উঠে ব’সে, কলসী থেকে জল গড়িয়ে খায়। দু-দুবার দাঁতে গুড়াখু ঘষল। সে নেশাও কেটে গেল। কিন্তু কিছুতেই আর তার ঘুম আসে না। নানান ফুলের গন্ধে তার মাথা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে লাগল। শেষে সে আর পারল না, উঠে গিয়ে উঠোনে ঢোকার মুখে বাগানের বাইরে, তার মাছের যে চুপড়িটা রেখে এসেছিল, সেটা নিয়ে এল। সেটা মাথায় দিয়ে শোয়া মাত্র, তার দুই চোখে নেমে এল ঘুমের জোয়ার। তার নাকে এখন মাছের আঁশটে গন্ধ, কাজ কী তার ফুলের সৌরভে? তখন এই গল্পটা শুনে এটাকে নিছক একটা গল্প বলেই মনে হয়েছিল। আজ এই পবিত্র বাতাবরণে লম্বা শ্বাস নিতে নিতে মনে হল, যার যেথা মজে মন। পবিত্র বাতাবরণ সকলের সয় কি! এই এখন যেমন আমার নাকে এসে ঝাপটা লাগছে মৌরলা ভাজার গন্ধ। এখান থেকে আমার ফ্ল্যাট অন্ততঃ বিশ কিলোমিটার তো হবেই। তাও আমি গন্ধটা পাচ্ছি। এই সময় ঘরে থাকলে চায়ের সঙ্গে এক প্লেট মুচমুচে মৌরলা ভাজা – আঃ। আজ শনিবারের ছুটির সকালটা মাটি করে দিল মাইরি। ঝিনি অবশ্য জানে মৌরলা ভাজা খেতে আমি ভালোবাসি। কিন্তু মনে করে তুলে রাখবে কি? ঝিনি কি মনে রাখবে আমি তাকেও ভালবাসি। তার গর্ভে বেড়ে উঠছে আমার ভালবাসার সৃষ্টি। সেটাও কি ভুলে যাবে? আমি কিছু বলে আসিনি, আজ মৌরলা দিয়ে কী করবে? কাঁচা লংকা চিরে দেওয়া মৌরলার ঝাঁঝালো সর্ষে ঝাল? নাকি সামান্য হলুদ আর কালো জিরে ফোড়ন দেওয়া অর্ধস্বচ্ছ পাৎলা ঝোল। দুটোই সমান উপাদেয়। ভাবতেই আমার মুখের ভিতরটা রসস্থ হয়ে উঠল।
“ইধর ইধর, হেলো, আপকা নজর মেরে পর কিঁউ? দাদা, বাঙ্গালীদাদা, আপকো বোল রহা হুঁ”।
বাঙ্গালীদাদা শুনে আমার চিন্তায় ছেদ পড়ল, আমি বাবা তেজকিরণের মুখের দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন এবং আমাকেই বলছেন।
“কেয়া, বাঙ্গালীদাদা কিস চিন্তনমে খো গয়ে থে আপ? মেরে পর নেহি, আপকা নজর নাককে উপর রাখনা চাহিয়ে। অওর শ্বাস লিজিয়ে লম্বা...”।
আমি আবার নাকের ডগায় দৃষ্টি দিলাম, আবার চিনচিন করে উঠল আমার ভুরুর কাছে কপাল। তারপর লম্বা শ্বাস নিতে নিতে মনে হল, সৌরভের পর থেকে অবাঙালীরা বাঙালী দেখলেই দাদা বলে আজকাল। এই দাদা ডাকের মধ্যে একটা ভালোবাসাও যেমন থাকে, তার সঙ্গে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে একটু সিমপ্যাথিও। ন্যায় বিচার না পাওয়া বা যোগ্য সম্মান না পাওয়া হিরো। এই হিরোর কথায় মনে পড়ল বাঙালীদের মনের মানুষ আর এক হিরো উত্তমকুমারকে। বাংলার বাইরে যাঁকে কেউই সম্মান দেয়নি। বড় হয়ে যখন শঙ্খবেলা দেখেছি, মাধবী আর উত্তমের সেই ডুয়েট - কে প্রথম কাছে এসেছি। সাদাকালো ঝাপসা ঝাপসা ছবি, ঝির ঝির করছে, কিন্তু নেশা হয়ে গিয়েছিল মনে আছে। তার কিছুদিন আগেই, আমি আবার প্রেমে পড়েছিলাম। সে এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার। সেই মেয়েটিকে ইউনিভার্সিটি থেকে তুলে নিয়ে চলে গেলাম ব্যাণ্ডেল চার্চের গঙ্গার ঘাটে। সেখানে নৌকো ভাড়া করে ভেসে পড়লাম দুজনে। হাতে হাত, চোখে চোখ। মেয়েটির চোখে লাজুক প্রশ্রয়ের হাসি। নৌকার মাঝি করিমচাচা (নামটা জানিনা, তবে মাঝিদের অন্য আর কোন নাম হয় নাকি?) দাঁড় বেয়ে নৌকাটাকে নিয়ে গেল মাঝদরিয়ায়, তারপর মাটিতে লগি গেঁথে বলল, যান, যান, গলুইয়ের মধ্যে যাইয়া বসেন। দ্যাহেন পর্দা ঝুলতাসে, পর্দা ফেলাইয়া দুটিতে আরাম করেন গিয়া। আমি বিড়ি খাইয়া একটুন জিরাই লই। কুন ভয় নাই বাবু, যান যাইয়া বসেন, আমি আসি। করিম মিঁয়ার নাও হক্কলে সিনে। কুন ভয় নাই। গলুইয়ের মধ্যে সেই মেয়ে আর আমি যেন মাধবী আর উত্তম কুমার। কে প্রথম কাছে গিয়েছি। পর্দা ঢাকা গলুইয়ের মধ্যে বসে ওই কাছে যাওয়াই সার হল, একটা চুমো অবদি খেতে পারিনি, লজ্জা কিংবা ভয়ে, কে জানে? মেয়েটির উৎসুক মুখের কাছে যতবার মুখ নিয়ে যাবো ভেবেছি, মনে হয়েছে, জ্যালজেলে পর্দার ভিতর দিয়া করিম চাচা নির্ঘাৎ দ্যাকতাসে। করিমচাচা বড়ো বড়ো বিড়ির টান দিতে আসে, আর দ্যাকতাসে গলুইয়ের অন্দরে ছ্যামড়া আর ছ্যামড়ি কিডা করে? সেবারের সেই চুমো মিস করলেও, কিছুদিন পরে এক নির্জন ঘরের নিরিবিলিতে বড়ো সুখের চুমো দিয়েছিলাম সেই মেয়েটিকে। একদম বুকের মধ্যে চেপে ধরে, অধরে অধর চেপে বহুক্ষণ। প্রথমবারের পর কিছুটা বিরতি, চোখে চোখ রেখে একে অপরকে আরো আরো ভালো লাগা, তারপর আবার। অস্ফুটস্বরে কানে কানে বলেছিলাম, তোর আর আমার মধ্যে এই দূরত্ব কোনদিন কী দূর হবে না? অবাক দুটি সরল নয়ন মেলে সে বলেছিল, আর কতো কাছে আসব বলো তো, কিসের দূরত্ব? আমি বলেছিলাম, তোর ওই উদ্ধত দুই বুক, কিছুতেই আমাদের কাছে আসতে দিচ্ছে না। আমার বাহুবন্ধন থেকে মুক্তি পেতে ছটফট করতে করতে বলেছিল, তুমি যাতা একটা অসভ্য হয়ে উঠছো দিনদিন। তার মুখে ফুটে উঠেছিল স্বর্গীয় লাজুক হাসি, অতএব আবার।
সেই মেয়ে আমার ঘরণী হয়নি, অনেক দূরে সে এখন অন্য পুরুষের স্ত্রী। হেমন্তর সেই গানের মতো, আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে। আজও দূর প্রবাসে অবসর সময়ে নির্জন রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে যখন বসে থাকি। যখন উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে ট্রেন এসে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। তখন কেন যে মনে হয়, এই ট্রেনটা চলে গেলেই দেখব সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। ষাটের দশকের গল্পে উপন্যাসে প্রায়ই এমন হতো! ডানহাতে মাঝারি আকারের একটা চামড়ার স্যুটকেশ, পরনে মেরুনপাড়ের বাসন্তী শাড়ি, গায়ে ম্যাচিং করা মেরুন ব্লাউজ। সেই মেয়েটি পায়ের কাছে সুটকেশ রেখে আমার বেঞ্চেই এসে বসবে। মাঝখানে আরও দুজন বসার মতো দূরত্ব রেখে। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করবে, তোমার মাথা ধরা রোগটা এখনও আছে? টাইগার বাম দিয়ে এখন কে তোমার কপালে হাত বুলিয়ে দেয়?
আজও শীতের নির্জন অরণ্যে একা একা পায়চারি করতে করতে কানে আসে পায়ের তলায় শুকনো পাতা ভাঙার আওয়াজ, ঠিক সেই মেয়েটির অস্ফুট কথার মতো। আজও প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দগ্ধ দিনশেষের এক পশলা বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে এলে, সেই মেয়েটির নিশ্বাসের গন্ধ পাই।
“বহনোঁ অওর ভাইয়োঁ...আভি সাধনা কে ওর, অওর এক কদম আগে বড়েঙ্গে। দৃষ্টি রহেগা নাক কে উপর, লম্বা লম্বা শ্বাস লেঙ্গে, মনসে সমুচা ভাওনা হটাকে, মনকো সির্ফ এক বিন্দুমে লানেকা কোশিশ করেঙ্গে। হামারা মন এক আশ্চর্য বিষয় হ্যায়, কভি ইধার, কভি উধার ভাগতা হ্যায়। কভি ভি এক জাগাপে রুক নেহি শকতা। কভি বিবিকা চিন্তা, কভি বাচ্চোঁকা চিন্তা, কভি দোস্তকে সাথ মস্তি বানানেকা চিন্তা, কভি কলিগকো ক্যায়সে লেগপুল করেঁ, ক্যায়সে বসকো খুশ করেঁ, ও চিন্তা। আভি ইয়ে সব চিন্তাকো দূর ভাগাকে, মনকো এক জাগা পে নিরুধ করনা হ্যায়। কঠিন হ্যায় জরুর, লেকিন নামুমকিন নেহি। লম্বা শ্বাসোঁকে সাথ হাম এক মন্ত্র উচ্চারণ করেঙ্গে, ও হ্যায় ‘ওঁম’”। বাবা তেজকিরণ নিজেই বার চারেক করে দেখালেন, তারপর বললেন, “কিজিয়ে কিজিয়ে, মেরা সাথ কোশিশ কিজিয়ে, বলিয়ে ওঁম...”।
দুই চোখের দৃষ্টি নাকের ডগায়, লম্বা শ্বাস তার মধ্যে আবার ওঁম। এতগুলো একসঙ্গে হয় নাকি? লম্বা শ্বাস নিতে গেলে দৃষ্টি সরে যায় আশেপাশে। দৃষ্টি ঠিক রাখতে গেলে লম্বা শ্বাস নিয়ে, শ্বাস ছাড়তে ভুল হয়ে যায়। আর ‘ওঁম’ বলতে গেলে হাতের উত্তান ভঙ্গি ভ্রষ্ট হয়ে, হাত চলে আসে হাঁটুর ওপর। অনেকদিন আগে দুহাতে নৌকোর বৈঠে বাইতে গিয়ে এমন হয়েছিল। বাঁহাতের দিকে নজর দিলে, ডানহাত থেমে যায়, আবার ডানহাতে নজর দিলে, বাঁহাত বৈঠে নিয়ে বসে থাকে। কিছুতেই দুটো হাত একসঙ্গে চালাতে পারিনি। নৌকো এক ইঞ্চিও এগোচ্ছিল না, উল্টোপাল্টা বৈঠের ঠানে মুখটা এদিক সেদিক ঘুরে যাচ্ছিল। শেষ অব্দি মাঝির হাতে বৈঠে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত, মাঝি গল্প করতে করতে দিব্যি দুহাতে সাবলীল বৈঠে টানতে লাগল। নৌকো এগোতে লাগল তরতরিয়ে, নৌকোর পাটায় বসে, মুগ্ধ চোখে মাঝির দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, এও তো এক সব্যসাচী। মাঝি তখন অনবরত বলে চলেছিল তার বহতা জীবনের কথা, উজানে বেয়ে চলা সেই নদীর কথা, যে নদীর সঙ্গে তার জীবন জুড়ে গেছে ওতপ্রোত। সে নদীর নাম বরাক – বয়ে চলেছে বদরপুর শহরের পাশ দিয়ে। অতএব দক্ষতা ব্যাপারটা কোনদিনই জন্মসূত্রে পাওয়া যায় না, অর্জন করতে হয়। সে এই ইয়োগার ধ্যানই হোক আর সেই নৌকো বাওয়াই হোক। সারা হপ্তা ইঁদুরের মতো দৌড়োদৌড়ি করে। এক শনিবারেই কি আর মন্ত্রের সাধন হওয়া সম্ভব? একে তো লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে, ফুসফুসের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। বেশ ছিল নিকোটিনের মোহ আবরণে আছন্ন হয়ে, প্যাকেটে দেখানো ঘরমোছা ন্যাতার মতো চেহারা নিয়ে। “এ মোহ আবরণ খুলে দাও, দাও হে” – বললেই কি আর হয়? খামোখা সুবাসিত অক্সিজেন পেয়ে বেচারা চমকে গেছে। কাশি আসছে খুক খুক করে, তার ওপর প্রায় ঘন্টাদুয়েক হতে চলল রক্ত হয়ে উঠছে নির্নিকোটিন।
“দাদা, আপনি কিন্তু ওঁম বলছেন না, অন্য কুছু চিন্তা কোরছেন”।
বাবা তেজকিরণ দেখি আমাকেই টার্গেট করে নিয়েছেন। আমি হাল্কা কেশে গলাটা সাফ করে নিয়ে, লম্বা শ্বাস নিতে নিতে বললাম ওঁওওওম। মন্ত্র বলব কি, ভেতর থেকে বড়ো বড়ো হাই উঠে আসছে। ডাক্তারেরা বলেন রক্তে অক্সিজেন কমে এলে নাকি হাই ওঠে, এতো লম্বা শ্বাস টেনেও অক্সিজেন কমল কী করে? এমন হাই উঠছে মনে হচ্ছে সাত রাত্তির ঘুমোইনি। এক আধটা রাত্তির না ঘুমিয়ে অনেক বার কাটিয়েছি, ছোটমামা, ছোটকাকা, দিদিদের বিয়ে, দাদাদের বিয়ে, বন্ধু বান্ধবের, কিংবা নিজেদের ঠাকুমা, দাদু মারা গেলে শ্মশানযাত্রায়। কিন্তু সাত রাত্তির ঘুমোইনি দুবার হয়েছিল। একবার কলেজের হস্টেলে গিয়ে র্যাগিং পিরিয়ডের সময় - সেটা ছিল বড়ো কষ্টের। আর একবার নিজের বিয়ের পর ফুলশয্যার রাত থেকে অষ্টমঙ্গলা পর্যন্ত – সেটা কী বলব, বলতে লজ্জা করে, বড় আনন্দের। সে কদিন অফিসে গিয়ে দুই চোখ ঝামড়ে ঘুম আসত, ফেরার সময় বাসের রড ধরেও ঢুলতাম, কিন্তু বাড়ি ফিরে, জুতো খুলতে খুলতে ঝিনি যখন হাতে এক গ্লাস জল নিয়ে সামনে দাঁড়াত, ঘুম দৌড় লাগাত পিছনের দরজা দিয়ে। সারা রাত কতশত গল্প, নানান রঙের দুষ্টুমি, কত তরিকার ভালোবাসা। আহা সেই ঝিনি এখন কেমন যেন হয়ে গেছে। আজকাল ভালোবাসা ব্যাপারটাকে বেশ ধোঁয়াটে আর ঝাপসা একটা অনুভূতি মনে হয়। ভাদুরে বর্ষার মতো। সারাদিন প্যাচপেচে ঘেমো চাঁদি জ্বালানো গরম, তার মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দু এক পশলা অপ্রস্তুত করে দেওয়া বৃষ্টি। আর সেই বৃষ্টি থেকেই আজ ঝিনির তিনমাস। এই যে আমাদের দ্বিতীয় সন্তান আসছে, সে কি আমাদের ভালোবাসার ফসল? নাকি আকস্মিক উত্তেজনায় হঠাৎ ঘটে যাওয়া! আজ আমার জন্যে, ঝিনি যদি মৌরলাভাজা আলাদা তুলে রেখে দেয়, তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের মধ্যে ভালোবাসা নামক নিরাকার ব্যাপারটা রয়ে গেছে। আমি কী জুয়ো খেলছি? মৌরলামাছ ভাজার সঙ্গে আমাদের দাম্পত্য ভালোবাসার ফাটকা?
“কুছ নেহি হো রহা হ্যায়। না, না, কুছ ঠিক নেহি হো রহা হ্যায়। এক কাম কিজিয়ে আপলোগ। আজ তো টাইম বিত চুকে হ্যাঁয়। আজ কা সেশন এহি খতম করতে হ্যাঁয়। আপলোগ হর দিন সুবে প্র্যাকটিস কিজিয়েগা জরুর। আগলে শনিবার হমলোগ ফির মিলেঙ্গে, ফির নয়া কুছ শিখনেকে লিয়ে। লেকিন ইয়াদ রাখিয়ে, যব তক মনকো নিয়ন্ত্রিত নেহি কর পায়েঙ্গে, তব তক মনমে শান্তি নেহি আয়েগা, মনকো এক হি কেন্দ্রমে স্থাপিত করনাহি হামারা মকসদ রহেগা। শুভমস্তু। সবকা মঙ্গল হো”।
বাবা তেজকিরণ বিদায় নেওয়ার পর, আমরাও সবাই উঠে পড়লাম। অশান্ত মনকে স্থির করার কর্পোরেট ধ্যানধারণার এই ধ্যান-ইয়োগায় যোগের থেকে বিয়োগটাই যে বেশি হল তাতে কোন ভুল নেই। রক্তে ফিকে হয়ে আসা নিকোটিনের মাত্রা যোগ করার জন্যে অফিস থেকে বেরিয়ে লম্বা একটা সিগারেট ধরালাম। আর এই ঠা ঠা করা রোদ্দুরে গুরগাঁওয়ের গরমে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা চিন্তা করতেই মন আগের থেকে অনেক বেশি অশান্ত হয়ে উঠল। মনে মনে আমাদের হ্যাচ আর হেড অম্রুত নেগির নামে অনেকগুলি বিশেষণ যোগ করলাম – কিন্তু সেগুলোর সবকটাই লেখার অযোগ্য!