মূর্খ তথাপি অসামাজিক হিসেবে কবিতা পড়া হয় না বহুকাল। ফলে ইদানীং কালের কবিতা বিষয় আমি নিতান্ত অজ্ঞ। শুধু তাই নয় নিতান্ত গদ্যময় জীবনের নিরাপত্তায় খুশিমনে থিতু। তা এহেন কাব্যচর্চার অভাবের সংসারে অনির্বাণের কবিতার বই ‘গাবলু ও সুপারম্যান’ এসে জুটলো। বইটি খুলেই আলটপকা ১৩ নম্বর পাতার কূপমণ্ডূক কবিতাটি নজরে এল।
“আকণ্ঠ কুয়োয় ডুবে আছে
যে মানুষ
সে জানে তার আকাশ বৃত্তাকার।
তাকে দিগন্তরেখার লোভ দেখিও না।”
পড়ে খটকা লাগলো যে আমার আকাশও কি বৃত্তাকার দেখছি বহুদিন? যে চিন্তা এতদিন টনক নড়ায় নি! স্মৃতি হাতড়ে মনে করার চেষ্টা করি আকাশের অন্য কোন আকার দেখেছিলাম কি না! কিন্তু এই স্মৃতিও খুব সহজে মনে পড়ার নয়। এ গত জন্মের আচ্ছন্নতা নিয়ে ইহজন্মে মাতৃ-জঠরে ভাসমান থাকার স্মৃতি। যা স্মৃতি আর বিস্মৃতির মাঝের গোধূলি!
যা হৃদয়েরও যে একটি মস্তিষ্ক আছে, হৃদয় যার খোঁজ রাখে না, তাকে মনে করিয়ে দেয়।
এই অস্বস্তি নিয়ে পাতা উলটে আবার এক জায়গায় মাথা আটকে গেল;
“বাইরে হাতুড়ি ঠুকছে কেউ।
মাথার ভেতর শব্দ ঢুকে আসে।
একসময় হাতুড়িও।
কিন্তু ঢুকে পড়া হাতুড়ি বা তার শব্দ বাইরে যায় না।”
শেষের লাইনটি এমন এক অপরিচিত নীরবতার আভাস দেয় যা এই মাঝবয়সে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যে নিস্তব্ধতা খুঁজতে যাওয়ার মানে এক প্রকার আহাম্মকি ধরে নিয়েছিলাম এতদিন। যে নীরবতার অভাব আসলে কোন অভাব নয় এই ধরে নিয়ে ডিসকাউন্টে নামী ব্র্যান্ডের কার্ডিগান কিনতে ছুটেছি গত দশটা ডিসেম্বর। এত কেনাকাটির মাঝে কখন ব্যক্তিগত শীত বিক্রি করে এসেছি খেয়ালই হয় নি। এর ঠিক পরেই ‘কেনাবেচা’ কবিতাটি পড়ে তাই কেমন বিরক্ত লাগলো।
“আসলে গোটা পৃথিবীটাই বিক্রেতা।
ক্রেতা সেই লোকটা যে বসে আছে
গড়িয়ার ঘুপচি দোকানে।
এই সত্য জানার পর
কী কিনিতে হইবে লিস্ট ফেলা গেল।
নতুন লিস্ট — আমার কী বেচার আছে।”
শীত বিক্রি করতে পারার সাফল্যের পর আমার কি বেচার আছে ভাবতে বসলে ভিক্টোরিয়ার কালো পরীটি ছাড়া ঝুলিতে কিছু নেই। হয়তো নতুন লিস্ট বানানোর সময় এসেছে। যেখানে মনগড়া কিছু বিকল্পকে সন্তর্পণে দুর্লভ আর বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে।
অনির্বাণের বইতে মেট্রোরেল নিয়ে একগুচ্ছ কবিতা আছে। কোনটার নাম সুইসাইড, কোনটা টেম্পল রান, কোনটা আবার নেতাজিভবন। মেট্রোরেল আর তার নিত্যযাত্রীদের মধ্যে এক দাম্পত্যজীবনের বোঝাপড়া তৈরি হয়। যা ন’টা-দশটার ভিড় আর তাড়াহুড়ো ঠিক মতো অনুধাবন করতে দেয় না। এই কবিতাগ্লি থেকে আমি যেমন খুশি কয়েকটা বিচ্ছিন্ন লাইন তুলে ধরছি। কেন এমন করছি? সে পরে খতিয়ে দেখা যাবে। আবার খতিয়ে দেখার তেমন কিছু নাও থাকতে পারে। কারণ দাম্পত্যে এমনটাই হয়।
“মেট্রোরেল আর তার যাত্রী – উভয়ই ছকে চলে।
মজার ব্যাপার হল মেট্রো আর তার যাত্রী দুজনেই
দীর্ঘ দাম্পত্যে থাকা পুরুষ ও নারীর মতোই
পরস্পরের ছক বোঝে।
যাত্রী জানেন কখন আসে মেট্রো, কখন ছেড়ে যায়,
প্ল্যাটফর্মের কোথায় দরজা,
কোন দরজা দিয়ে বেরোলে পাওয়া যাবে সিঁড়ি,
কোথায় এসকালেটর।
------------- -----------
মেট্রোর কামরাও তেমনি জানে
সুচরিতা রোজ শাড়ির সাথে মিলিয়ে দুল পরে
সিরাজ – সমস্ত বোতাম আঁটা ফুলশার্ট,
-------------------------------”
এরকম ভাবে পারস্পরিক বোঝা পড়া চলতে চলতে কবি জানাচ্ছেন,
“এই ছক মেনে নিতে নিতে
কিছু মেট্রো, কিছু যাত্রী,
(আবারো, দীর্ঘ দাম্পত্যে থাকা পুরুষ ও নারীর মতোই)
হঠাৎ বিগড়ে যায়।
সেইসব কামরা তখন দরজা বন্ধ করে না কিছুতেই,
বা ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে পড়ে সেন্ট্রাল আর চাঁদনির মাঝখানে।
আর সেই মানুষটি বিষ না খেয়ে, জলে ঝাঁপ না দিয়ে,
গলায় ফাঁস না লাগিয়ে
ঝাঁপিয়ে পড়ে চলন্ত মেট্রোর সামনে।”
এতো গেল সুইসাইডের নামচা। এরপর অনির্বাণ মেট্রো রেলের সঙ্গে তার ও তার মতো আরো অনেকের
সীমাহীন-মেয়াদি সম্পর্ককে একটি অতি জনপ্রিয় ভিডিওগেমের আদলে ঢেলেছেন। কবিতাটির নামও সেই ভিডিও গেমের নামে, ‘টেম্পল রান’।
“কিন্তু এ খেলা পুনর্জন্মমূলক।
মৃত্যু হলে জমানো সুধা ও মোহর চলে গিয়ে,
শূন্য থেকে শুরু হয় খেলা।
এছাড়াও খেলা থেমে যায়
ময়দান, চাঁদনি বা পার্ক স্ট্রিট এসে গেলে।”
এভাবে চলার পর এক জায়গায় দেখা যাচ্ছে,
“সকালের থেমে যাওয়া খেলা শুরু হয় আবার বিকেলে।
ময়দান, পার্ক স্ট্রিট থেকে সে খেলা গড়ায়
কালীঘাট, গড়িয়া বাজার।
তারপর আবার বিরতি।
দাবার ছকের মতো খেলা ও বিরতির এই নকশা
ছড়িয়ে পড়ে এক শীত থেকে আরেক শীতের দিকে।
অবশ্য কাকে খেলা বলে আর কাকে বিরতি
এ বিষয়ে নানারকম মতামত আছে।”
এইখানেই অনির্বাণ সেই চির ইনোসেন্ট গাবলুর মতো চলতে ছুটতে থামতে ও আবার চলতে সুপারম্যানের
আলোয়ান খুঁজে পেল যেন। আর আমার মতো অদীক্ষিত পাঠকের নৈরাশ্য আর নিন্দে প্রবণতায় খানিক উড়ান ভরে দিল। তৃতীয় দুনিয়ার আপাদমস্তক আধুনিক যে আমি, উত্তর-আধুনিকতায় ঠিক মতো ধাতস্থ হতে না পেরে তৎপরবর্তী মেটা-আধুনিকে আশ্রয় পাবার আশায় বসে আছি তাকে বিরতি ও খেলার মাঝখানে ছেড়ে দিল। এ এমন এক নব্য-অধুনাকাল যেখানে আমি ঠিক করবো কোনটা খেলা আর কোনটা বিরতি। নিজের স্থির করা বিরতিতে একটু খেলা শুরু করলে বেশ হয় ভেবে খেলা শুরু করব না। ঠিক যেভাবে আমার পূর্বসূরি আজকে রোববার ধরে নিয়ে ভেবেছিলেন জিলিপি কিনলে বেশ হয়। ভেবে জিলিপি কিনতে যান নি।
অনির্বাণের বেশ কয়েকটি কবিতা আছে বন্ধু অবিনাশকে নিয়ে। অবিনাশের সঙ্গে সে কখনও ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে তো কখনও কানামাছি। কুমিরডাঙা, লুকোচুরি এমনকি রুমালচোরও। সবকটা খেলার নিয়ম অবিকল এক রেখে নিয়মনিষ্ঠ ভাবে অনির্বাণ খেলে গেছে। আমাদের ছোটবেলার অহিংস প্রতিযোগিতার খেলা সব। তাই কুমিরডাঙা রুমালচোর বা লুকোচুরির নিয়মগুলো আবার চোখের সামনে উচ্চারিত হতে দেখে বেশ গা ছমছম করে। কানামাছি কবিতাটাই ধরা যাক,
“অবিনাশের চোখ বাঁধা। সেটাই সমস্যা। নইলে ওর আমাকে ছুঁয়ে দেবার কথা নয়। যা যা কথা ছিল ঠিকঠাক মেনেছি আমি। ফ্ল্যাট কিনেছি, ব্যাংকে টাকাপয়সা, ঘরে ঘরে ঠান্ডা মেশিন। এমনকি শনিবার শনিবার – হ্যাঁ তাও যাই। মাল্টিপ্লেক্সে। কিন্তু অবিনাশের চোখ বাঁধা। না বুঝে ছুঁয়ে দিলে কেলেঙ্কারি। লোকে বিশ্বাস করবে, বল?”
পড়তে পড়তে এক জায়গায় মনে হবে অবিনাশ কি অনির্বাণের সঙ্গে খেলছে না কি ওর বিরুদ্ধে? এরপরেই ‘লুকোচুরি’ কবিতায় –
“লুকোচুরি অর্থে ডাবল রোল – কিশোর কুমার। এক্ষেত্রে আমি ও অবিনাশ – ডাবল রোল বলা যায় কিনা নিশ্চিত নয়। আমি খেলাটাকে নিয়ে ফেলি সাউথসিটি মলে আর পালিয়ে বেড়াই এ দোকান থেকে সে দোকান। শেষবার অবিনাশ আমাকে নাইকির জুতো ভেবে ছেড়ে গেছিল, তার আগের বার প্রেস্টিজের প্রেসার কুকার। কিন্তু ব্র্যান্ড শেষ হয়ে আসছে ক্রমশ। ভাবছি মল ছেড়ে নীচে নামব – রাস্তায়।”
এভাবে অনির্বাণ অবিনাশকে তার ডাবলরোলের জন্য নির্বাচন করে, আর অবিনাশ লুকোচুরি আর কুমিরডাঙার নিয়ম অনুযায়ী কখনো অনির্বাণের রুমাল চুরি করে তো কখনও চোখে রুমাল বেঁধে অনির্বাণকে ছুঁয়ে ফেলে। দাবা খেলতে বসে অবিনাশ লুডোর নিয়মে ছক্কা ফেলে মাতামাতি করে। ওদিকে অনির্বাণ দেখছে দাবার সৈন্যবাহিনী স্থির দাঁড়িয়ে। “ওরা যুদ্ধ বোঝে আর রাশিবিজ্ঞানীরা বোঝে যুদ্ধ শুরু হবার প্রোবাবিলিটি কত। কিন্তু কবে ঠিক যুদ্ধ শুরু হবে কেউ জানে না।”
এই খেলাগুলোর মতোই অনির্বাণের কবিতায় একরকমের সমকালীন আন্তরিকতা আছে। উত্তরাধুনিক বিদ্রূপও আছে, তবে তা অপরকে নয় নিজের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া। তাই এই সময়ের সঙ্কুলানের সময় যেটুকু সময় দেওয়া সম্ভব অনির্বাণ কবিতার মারফৎ জীবনকে তা একনিষ্ঠভাবে দিয়ে চলেছে।
তাই বোধহয় তার লেখায় ‘সান্ধ্য ভাষা’ মুখ চেনা কিন্তু কখনও কথা বলা হয়নি’র মতো করে উঠে আসে।
“সান্ধ্য আলো একধরণের বিষণ্ণতার জন্ম দেয়। এ ধরণের বিষণ্ণতা দিনের অন্যান্য সময় বড়ো একটা দেখা যায় না। তীব্র দুপুরেরও বিষণ্ণতা থাকে কিন্তু তা মূলত সন্ন্যাসীর। সান্ধ্য বিষণ্ণতা গৃহীর – যে প্রতিদিন নিয়ম করে বাড়ি ফেরে এবং ফেরার পথে নিয়ম করেই এই জীবনের অর্থ কী – ভেবে আকুল হয়।”
আর এই আকুলতাই গৃহীকে কাঙাল বানিয়ে ছাড়ে। অনির্বাণ ওর কবিতার মধ্যে দিয়ে আমার মতো পাঠকের সঙ্গে এমন এক যোগাযোগ তৈরি করতে পেরেছে যা চরিত্রে খাঁটি আর ধর্মে অকপট। উচ্চারণে খোঁচা রয়েছে কিন্তু তীরের ধারালো দিকটা কবি নিজের দিকে ঘুরিয়ে রেখেছেন। পাঠকের দিকে বরং কবির খোঁচায় আহত মুখটা বিনয়ের সঙ্গে তুলে ধরা। এ এমন এক নতুন কবিতার সংস্কৃতির হদিস দিচ্ছে যা বিদ্রূপময় অথচ ভয়ানক আন্তরিক।