দিনলিপির চেয়ে আমার চিন্তা ভাবনা সম্ভবত এখানে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন মনে হয়েছে লিখে গেছিলাম। বানান টানানে হাত দেওয়া দরকার ছিল, নেট থাকবে না ভয়ে যেমন ছিল অমনেই এখানে পোস্ট করে দিছি। নেট এখনও আছে তবে খুব দুর্বল। কোনমতে টিকে আছে, শ্বাস নিচ্ছে এমন অবস্থা।
জাফর ইকবাল নতুন করে কী বলবে? উনার এক মন্তব্যেই ঝড় বয়ে গেছে। দেশের প্রায় সমস্ত অনলাইন বুক শপ ঘোষণা দিয়ে উনার বই নামিয়ে দিয়েছে। তারা আর কেউ উনার বই বিক্রি করবে না। রকমারি, বুকস অফ বেঙ্গল সহ আরও অনেক গুলো। উনার আবেগ বুঝার চেষ্টা কেউ করেনি আবার উল্টো হচ্ছে উনি ছাত্রদের আবগে বুঝার চেষ্টা করেনি।
জাফর ইকবাল সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে লোকটা আজীবন মানুষের গালি খেয়ে গেছে। কেউই দেখতে পারে না। বাচ্চাদের জন্য বই লেখে। আমরা উনার কিশোর উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞানের বই পড়ে বড় হয়েছে। বড় হওয়ার পরে মুগ্ধ হয়ে উনার কলাম পড়েছি। আমার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসার পিছনে উনার একক অবদান আছে। আমার চিন্তা চেতনা তৈরি করতে উনার লেখা সাহায্য করছে। আমি কতখানি উনাকে পছন্দ করি তা এইটুকু বললে বুঝবেন, ক্লাস নাইনে যখন রেজিস্ট্রেশন হয় তখন আমাদেরকে স্কুল থেকে একটা ফরম দিয়ে বলা হয়েছিল নাম পিতা মাতার নাম লিখে আনতে। এখানে যে নাম দেওয়া হবে আজীবন সেই নামই থাকবে। আমি মুহম্মদ জাফর ইকবালের নামের মতো করে দিলাম নিজের নাম মুহাম্মদ সাদেকুজ্জামান। উনার যে মুহম্মদ, মুহাম্মদ না এইটা আমি খেয়ালই করি নাই। অনেক পরে খেয়াল করছি যে আরে উনার নাম তো মুহম্মদ! তখন খেয়াল করলে আমি মুহম্মদই দিতাম!
তো কথা হচ্ছে জাফর ইকবাল সিলেটে যখন কোপ খেল তখন বা তারপরে উনার ভিতরে একটা পরিবর্তন আসল। উনি নিজে খেয়াল করেছেন কি না জানি না। তবে পরিবর্তন আসছে। বাংলাদেশে কেউই কোপ খেয়ে বেঁচে ফিরে নাই, উনি ফিরেছেন, এখন দুইজন না চারজন পুলিশ নিয়ে সব সময় ঘুরেন। এই যে ব্যাপারটা এইটা সরকারের প্রতি কঠোর হতে তাঁকে বাঁধা দেয়, হয়ত অজান্তেই দেয়। উনার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনশন ভাঙ্গানোর জন্য সরকার জাস্ট তাঁকে ব্যবহার করল! উনি একটা বইয়ে কষ্ট পেয়ে লিখেছেন যে কেউ যদি কথা দিয়ে কথা না রাখে তাহলে কী করতে হয় তা তিনি জানেন না। সরকার তাঁকে কথা দিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে গেছিল শাহজালালের ছাত্রদের অনশন ভাঙ্গানোর জন্য। বিপদ শেষে সরকার ভুলে গেছে সব, একটা কথাও রাখেনি। উনি লিখেছেন শুরুতে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করতেন, যে মন্ত্রীরা তাঁকে কথা দিয়েছিল তারা তাঁর ফোন ধরেন না এখন আর!
এই যে এত বড় একটা প্রতারণা হল উনার সাথে, উনার পাশে কেউ নাই। উল্টা তাঁকে নিয়ে রসিকতা করে সবাই! জামাত শিবিরের পুলাপান আগে তাঁকে ব্যাঙ্গ করে ষাঁড় ডাকত। অদ্ভুত এক প্রজন্ম এসেছে তারা না বুঝেই শুধু মজা নেওয়ার জন্যই এখন তাঁকে ষাঁড় ডাকছে! আর এই আন্দোলনে উনার ওই কথার পরে তো যারা নিজেদের মুক্তা চিন্তার অধিকারী বলত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলত এমন মানুষও তাঁকে ষাঁড় বলে যাচ্ছে। কখন কোন ফাঁকে জামাতিদের ফাঁদে পড়ছে নিজেও জানে না এরা। হুমায়ুন আহমদেও যুদ্ধ করেনি অথচ মুক্তিযুদ্ধ না করার জন্য সব গালি খাইত হয় জাফর ইকবালের! কেন? এই প্রশ্নেই সব উত্তর লুকিয়ে আছে। কিন্তু সবাই এখন ব্যস্ত ব্যা ব্যা করতে!
আমরা যখন বড় হই তখন বিএনপি জামাত ক্ষমতায়। ৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় তবুও দাপট ছিল বিরোধী দলের। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসল বিএনপি জামাত জোট। এইটা বলে বুঝানো যাবে না যে একটা দল বা জোট জিতে এমন বিভীষিকা চালাতে পারে দেশ জুড়ে। শত শত হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ হল, লুট হল, ধর্ষণ হল। পূর্ণিমা ধর্ষণ সেই সময়ের আলোচিত ঘটনা। যার মা ধর্ষকদের বলেছিল বাবারা তোমরা একজন একজন করে আস, আমার মেয়েটা ছোট! আমারা এই সব দেখে সহজেই আমাদের পথ ঠিক করে নিতে পারছিলাম। ওই দল, ওই জোট আমাদের না এইটা পরিষ্কার বুঝে গেছিলাম। এর আগ পর্যন্ত বুঝিনি, এইটা একটা দল ওইটা আরেকটা দল, এই তো! তীব্র ঘৃণা তৈরি করে দিতে সাহায্য করছিল সেই সময়ের জামাত বিএনপি জোটের সব কাজকর্ম।
এরপরে দেখলাম জামাতের শীর্ষ নেতাদেরকে মন্ত্রী বানানো হল। তারা আবার চিহ্নিত রাজাকার। আমার মনে আছে আমাদের শেরপুরের নিউ মার্কেট মোড়ে বিশাল জন সমাবেশ। কামরুজ্জামানের সাথে কে কে ছিল মনে নাই তবে আলী আহসান মুজাহিদ ছিল। তার সে কী আস্ফালন! সরাসরি হুংকার দিচ্ছিল মাইকে। এইটা ২০০৮ সালের নির্বচনের সময়ের ঘটনা সম্ভবত। আমাদের বিচার করবে? করেন কত সাহস আছে আপনাদের! এমন সব কথা। এগুলাও আমাদেরকে, আমাকে পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করছে। এগুলা দেখে শুনে বড় হয়েছি। এখন আমার বুক সেলফে যত বই আছে তার মধ্যে অনেকখানিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের উপরে বই। মুক্তিযুদ্ধের বই পড়ার কারণও জাফর ইকবাল। তিনি একটা লেখায় লিখেছিলেন যে অল্প বই পড়ে যদি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চায় কেউ তাহলে এই চারটি বই পড়তে হবে, বলে তিনি চারটি বইয়ের নাম দেন। আমি যখন বই কেনা শুরু করলাম, তখন ওই লিস্ট ধরে চারটা বই কিনে নিলাম। এই শুরু হল আমার মুক্তিযুদ্ধের উপরে বই পড়া।
আমাদের প্রজন্মের অনেকের গল্পই এমন। কিন্তু সত্য হচ্ছে সময় বয়ে গেছে অনেকখানি। ২০০৮ সালে যে জন্ম নিয়েছে তার বয়স কত এখন? সে তো আগের কোন কথাই জানে না। তার জানার প্রয়োজন নাই। সে কেন আগে বিএনপি জামাত অত্যাচার করছে সেই গল্প শুনবে? সে দেখে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায়, নানা নয় ছয় করছে আওয়ামীলীগ। যে ছেলে ২০১৪ সালে এসএসসি দিয়েছে সে এখন কী করে? সে দেখে সব শোষণ আওয়ামীলীগই করছে। তাদের নেতারাই লুটপাট করে খাচ্ছে। সব দোষ আওয়ামীলীগের। এই প্রজন্মের কাছে বর্তমানটাই শেষ কথা। সর্বশেষ ১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের সময় কেউ কেউ আবার একটু চেতনা ফিরে পেয়েছিল। এরপরেও পার হয়ে গেছে প্রায় এক যুগ। তো যেটা হয়েছে তা হচ্ছে আমরা যেমন ওই সময় বিএনপি জামাত সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা নিয়ে বড় হয়েছিলাম এখনকার এই বাচ্চা বাচ্চা পুলাপান এরা আওয়ামীলীগের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বড় হচ্ছে, হয়েছে। হওয়ার ম্যালা কারণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, করবে না কেন?
বর্তমান এই পরিস্থিতি আরও তীব্র করে তুলল এই ঘৃণা। সরকার নতুন প্রজন্মের কাছে আর যেতে পারবে কি না আমার সন্দেহ আছে। মহা পরাক্রমশালি আওয়ামীলীগ সরকারকে এই যন্ত্রণা নিয়েই চলতে হবে। ২০৪১ সাল পর্যন্ত যে ভিশন দেখানো হচ্ছিল তাতে এই আন্দোলন বড় ধাক্কা হয়ে লাগবে। এবার কোনমতে উত্তরে গেলেও কতদিন টিকে থাকতে পারবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।