দেশে নতুন দলের আবির্ভাব হল। জনসমাগম করা হল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে। সারাদেশ থেকে এত মানুষ কীভাবে গেল, এদের যাওয়া আসা, খাওয়া দাওয়ার খরচ দিলো করে এই প্রশ্ন করা বারণ! প্রশ্ন করা বারণ সরকারি গাড়ি কেন ব্যবহার করা হল, প্রশ্ন করা বারণ এই সব গাড়ির তেল খরচ কে দিয়েছে তা নিয়ে! নতুন দলের নেতাদের রাজাকারদের শাস্তিতে হাওমাও করে কাঁদতে দেখা গেছে, শিবিরের জনসভায় সব সময় একসাথে থাকব বলতে শোনা গেছে অথচ তাদেরকে জামাতের সমর্থক বলা যাবে না, কেন বলা যাবে না এই প্রশ্ন তোলা বারণ!
২০১৬ সালে ৫ বছরের বাচ্চা একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে এক নরপশু। যখন শিশুটিকে পাওয়া যায় তখন তার অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক, গায়ে ছিল সিগারেটের ছ্যাকার চিহ্ন, প্রজনন অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত। ধর্ষক ধরা পড়ে, শাস্তি হয় যাবজ্জীবন জেলের। সেই ধর্ষক জামিনে মুক্তি পেয়ে ধর্ষিতার বাবার সামনে দিয়েই গাড়ি করে বাড়ি ফিরেছে। একই গ্রামে বাড়ি, তাই চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছি এমন কুৎসিত প্রাণীটাকে, আসেপাশেই থাকছে এখন। শিশুটি শারীরিক ভাবে এখনও সুস্থ না, সারাদিন বাড়িতেই থাকে, ঘর থেকে বের হয় না। ধর্ষিতা সেই শিশুর বাবা অবাক হয়ে প্রশ্ন করছে 'বিচার তো পাইছিলাম, তাইলে এমন হইল ক্যানে? জনক জানে না এই প্রশ্ন করা বারণ!
রাজাকার ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের নামকরণ করা হয়েছে। আর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের নাম থেকে নাম কাটা গেছে জীবনানন্দ দাসের, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর! এমন কাজ কেন হচ্ছে এই প্রশ্ন করা বারণ। একে জামাত তোষণ, পাকিস্তান প্রেম বলা যাবে কি না সেই প্রশ্নও করা বারণ!
বছরের দুই মাস চলে গেছে, তৃতীয় মাসের শুরুতেই রোজা শুরু। সরকারি স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে গেল দীর্ঘদিনের জন্য। এক মাস রোজা, রোজার পরেই এসএসসি পরীক্ষা, সব মিলিয়ে ৭০ দিন স্কুল বন্ধ। এই লম্বা সময়ের ফাঁদে যে প্রশ্নটা হারিয়ে যাচ্ছে তা হচ্ছে বই কই? দুই মাস যাওয়ার পরে ক্লাস সিক্সের এই মফস্বল শহরের ছাত্ররা বই পেয়েছে তিনটি! সব বই হাতে কবে পাবে ছাত্ররা এই প্রশ্ন করা বারণ!
২৫ তারিখ বিডিআর বিদ্রোহের দিনকে জাতীয় শহীদ সেনা দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। এ বছর এই দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সেনা প্রধান বেশ কড়া কথা বলেছেন। বিডিআর বিদ্রোহে অন্য কোন পক্ষ না, বিডিআর সদস্যরাই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, এখানে কোন যদি কিন্তু নাই। তিনি এখানেই একে ফুল স্টপ করতে বলেছেন। যারা শাস্তি পেয়েছে তারা শাস্তির যোগ্য দেখেই শাস্তি পেয়েছে। যে প্রশ্ন কেউ করে নাই তাঁকে, সম্ভবত এই প্রশ্ন করা বারণ ছিল যে যদি শাস্তি পাওয়া যথার্থ হয় তাহলে কেন জেল খাটা আসামি, বিডিআর সদস্যরা মুক্ত হচ্ছে? একদিকে তাদেরকে মুক্তি দিচ্ছেন অন্যদিকে বলছেন তাদের অপরাধ নিয়ে প্রশ্ন নাই, তারা শাস্তির যোগ্য! এমন দুইমুখি কাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন করা বারণ!
ছাত্র জনতার লাশের ওপর দিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। অসংখ্য আহত ছাত্র জনতা হাসপাতালে। সাত আট মাস হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত আহতরা চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না সঠিক ভাবে। ছাত্রদের প্রতিনিধিরা এখন ক্ষমতায় আছে, সরকারের অংশ। অথচ নিজেদের পোশাক আসাকের প্রভূত উন্নতি করলেও তাদের দ্বারা এইটা সম্ভব হয়নি যে আহতদের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত হোক। এদের কাওকে হেলিকপ্টার করে শীতবস্ত্র বিতরণ করতে দেখে গেছে অথচ পঙ্গু ছাত্ররা রাস্তায় চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য আন্দোলন শুরু করেছে! অনেক পরিবারের অবসথাক খুব খারাপ, আর্থিক সাহায্য করার কথা ছিল এই সরকারের। এখন পর্যন্ত তা করতে পারেনি, দোষ দিচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে! কেউ তাদেরকে প্রশ্ন করেছে যে এইটার চেয়ে জরুরি কোন কাজটা আছে তাদের? এইসব প্রশ্ন করা বারণ!
যে শিবির নামের ট্যাগ দিয়ে বুয়েটে আবরারকে হত্যা করা হয়েছিল সেই শিবিরের নেতারা কেন আবরার হত্যার আসামিদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে আদালতে দাঁড়ায় এই প্রশ্ন কে করবে? যেমন কেউ প্রশ্ন করে নাই কীভাবে আবরার হত্যার এক আসামি জেল থেকে পালিয়েছে বহু আগেই কিন্তু কাওকে জানতে দেওয়া হয়নি! প্রশ্ন করা বারণ?
করোনার সময় চলছে। মানুষ আতঙ্কিত। লগ ডাউন চলে। বাংলাদেশের কুৎসিত চিকিৎসা ব্যবস্থা কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর মধ্যে একলোক তার হাসপাতালে বসে করোনার পরীক্ষা করাচ্ছে, টাকা নিচ্ছে, করোনা নাই এমন সার্টিফিকেট দিচ্ছে! ধরা খেলেন, দেখা গেল তিনি বিরাট ইমানদার লোক! আল্লা খোদা ছাড়া কথাই কয় না। আল্লার এই বান্দাকে জেলে দেওয়া হল। এতদিন জেলেই ছিলেন, এখন কে জানে কোন অলৌকিক বলে তিনি জেলের বাহিরে। কোন সেই অলৌকিক শক্তি? প্রশ্ন করা যাবে না এইটাও বারণ?
এমন শত শত প্রশ্ন আছে। কিন্তু কোন উত্তর নাই। কেউ জানে না কে দিবে উত্তর। এখন অবিশ্বাস্য রকমের সেন্সরশিপ চলছে দেশে। নব গঠিত দলকে প্রোমট করাই এখন সাংবাদিকদের প্রাত্যহিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় প্রশ্ন করবে কে? মব যখন সরকারেরই প্রশ্রয়ে চলে তখন মবের বিচার চাইবেন কার কাছে? তেমনই সরকারই যদি প্রশ্ন পছন্দ না করে তাহলে উত্তর পাবেন কই থেকে? এই চলছে এখন!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।