মাগুরায় ৮ বছরের শিশু আছিয়ার সাথে যা হয়েছে তার সাথে তুলনা করা যায় এমন আর কিছু মনে হয় নাই। বর্বরতার চরম সীমা অতিক্রম করা একেই বলে। মানুষ না অন্য কিছু এই কাজ করতে পারে বুঝে আসে না। হতভম্ব হয়ে যেতে হচ্ছে শুধু। ( এই সংক্রান্ত একটা খবরের লিংক নিচে দিলাম, যারা জানেন না তাদের জন্য। আমার লেখার শক্তি নাই!)
কিন্তু আসল বিপদটা আমার মনে হয় অন্য জায়গায়। শিশুর সাথে যা হয়েছে তা ইতিহাসে কালে ভদ্রেই হয়ত এমন হয়। কিন্তু একবার বড় বোনটার কথা ভাবুন। তার সাথে যা হয়েছে বা হচ্ছে তা কিন্তু অতি সাধারণ ঘটনা। কত শত শত এমন নারী এমন করে সংসার করে চলছে তার কোন লিখিত হিসাব নাই। পুরো নষ্ট একটা পরিবার, যারা সবাই মিলে ছোট্ট একটা শিশুর সাথে যা করেছে তা অবর্ণনীয়, তারপরেও সেই শিশুর বোনকে সেই পরিবারেরই সংসার করতে বলা, তার নিজের মা চিন্তা করছে তবুও সংসারটা থাকুক, স্বামী সংসার ছাড়া নারীর কী হবে? এই যে পরিস্থিতিটা এইটা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। রেপিস্ট একটা পরিবার হলেও সেখানেই সংসার কর! কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই তাই শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী, ভাসুরের পাশবিক নির্যাতন মেনে নিয়ে এই বাংলাদেশে কত নারী ঘর করছে? এ থেকে বাঁচার উপায় নাই। নারীকে ঠিকঠাক মানুষই মনে করে না যে সমাজ তারা এদের জন্য কোন উপায় বের করবে এইটা বিশ্বাস যোগ্য না। এত বছরেও হয়নি, এখন হওয়ার কোন আলামতও দেখি না।
পৃথিবীতেই পুরুষ হয়ে জন্ম নেওয়া হচ্ছে এক ধাপ এগিয়ে থাকার সুযোগ নিয়ে জন্ম নেওয়া। আর বাংলাদেশে মুসলিম পরিবারে পুরুষ হয়ে জন্মানো হচ্ছে রীতিমত লটারি জিতে দুনিয়ায় আসার মত। নারী জন্মের পর থেকেই বৈষম্য নিয়ে বড় হয়, ভিন্নধর্মী হলে তো কথাই নেই। ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ বলে হুঙ্কার দেওয়া লোকগুলো আজ পর্যন্ত নিজেদের ঘাড়ে দোষ নেয় নাই। ৯০ % জনসংখ্যা যেমন শক্তি তেমনই দায়ও যে তাদেরই বেশি এইটা বুঝে না বা বুঝতে চায় না। হুঙ্কার দিয়ে ইভটিজারকে থানা থেকে মুক্ত করে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেয় এই বদমাশ গুলোই। একটা গণ জরিপ করা গেলে দেখা যাইত এই ঘটনারও পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে বহু শুয়োরের বাচ্চারা। ওই নারীর মানে বড় বোনটার কী কী দোষ আছে তা বলে দিত, কেউ বলত আরে আরেক কেস, পুরোটাই সাজান দেখেন গিয়া! ক্লাস থ্রির শিশুরও দোষ বের করে প্রমাণ করে দিত সব দোষ আসলে নারীরই।
কী দিয়া অবস্থার উন্নতি করবেন? এই দেশের মানুষ নষ্ট হয়ে গেছে, চিন্তা নষ্ট হয়ে গেছে। উত্তরণের উপায় কী কে জানে! অনেকেই হুমায়ুন আজাদের একটা কবিতার লাইন খুব শেয়ার করে, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। হুমায়ুন আজাদের একটা প্রবন্ধও আছে যেখানে তিনি সম্ভাবনার কথা লিখেন নাই, লিখেছেন সব নষ্টদের অধিকারে গেছে! মানে শেষ কাহিনী! তাই আমারও আর কিছু বলার নাই।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে সবাই এক জোট। যে সুযোগ পাওয়া মাত্র ধর্ষণ করবে সেও গলা ফাটায় ফেলছে এখন। এগুলা সমাধান না। হুজুগ যেদিকে সেদিকেই দৌড়, চিন্তা করার ক্ষমতা নাই। যারা খুব চিৎকার করছে তাদেরকে জিজ্ঞাস করেন যে তারা নারীর পোষকের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে কি না? দেখেন ওই ধর্ষণ বিরোধী মাহফিল থেকেই কয়জন বলে তারা নারীর পোশাকের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে! নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করবে না এইটা কয়জনের মুখ দিয়ে বের হয় দেখবেন একটু? দুঃখজনক হচ্ছে শুধু পুরুষ না, যে নারীরা আন্দোলন করছে তারাও অনেকেই বিশ্বাস করে না। তাদের মধ্যে বিশাল সংখ্যক নারী আছে যারা মনে করে পোশাক একটা কারণ ধর্ষণের জন্য। যে নারীর মামলায় এক বীর পুঙ্গব শাহবাগ থানায় ঢুকেছিল তিনি নিজেই এগুলায় বিশ্বাস করেন না। এমন প্রমাণ তার পূর্বের নানান কর্মকাণ্ডে পাওয়া যায়। নিজের ওপরে যখন আসছে বিপদ তখন তার মনে হইছে এইটা একটা বিপদ, থানায় যাওয়া দরকার।
সরকার দেখলাম আইন করছে! যথারীতি একটা পক্ষ বাহাবা দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। অথচ আগের আইন কী ছিল তা জানার প্রয়োজন মনে করে নাই কেউ। আগেও আইন কঠিনই ছিল। সমস্যা আইনে না রে ভাই, সমস্যা আইন প্রয়োগে। সমস্যা আমাদের মানসিকতায়। এইটা কেমনে বদল করবেন?
জনপ্রিয় কিন্তু আমার পছন্দের মতবাদ না হচ্ছে ধর্ষক পাইলেই ধরে মেরে ফেলা! কঠিন কঠিন উপায়ে ধর্ষককে মেরে ফেলার নানা ইভেন্ট দেখতে পাচ্ছি দুই একদিন ধরে। শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি, কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু তা অবশ্যই বিচারিক প্রক্রিয়ায়ই করতে হবে। যে মববাজি চলছে দেশ জুড়ে সেই মববাজিতে নতুন আরেকটা হাতিয়ার যুক্ত হওয়া ছাড়া আর কোন কাজ হবে না এই তরিকায়। এখন আওয়ামীলীগ বলে মারে পরে দেখা গেল হুদাই ধর্ষক বলে মারছে, লাভের লাভ এই হবে। এইটা তরিকা না।
কঠিন শাস্তি দিবেন, পাথর ছুঁড়ে মারবেন এইটাও সমাধান না। যে দেশ গুলোতে ধর্ষণ কম সেই দেশগুলোতে অবস্থা কী? কোন তরিকায় তারা এইটা নিয়ন্ত্রণ করছে? প্রকাশ্যে কল্লা কাটা, প্রকাশ্যে লিঙ্গ কাটা সমাধান না। যখন মানুষের মত দেখতে এই প্রাণীগুলা পাগলা কুত্তা হয়ে যায় তখন আর তাদের মধ্যে কিছুই কাজ করে না, পরে কল্লা কাটবেন না কি কাটবেন এইটা তখন মাথায় থাকে না। সে জাস্ট আকামটা করে বসে। কুত্তা যেন পাগলা না হয় বা কুত্তা কেন পাগলা হয় এইটা বের করতে হব। না হলে শাস্তির ভয় পেয়ে অপরাধ করবে না, দেশে অপরাধ কমে যাবে এমন আশা করা মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ভয়ে হয়ত সাময়িক টুকটাক কিছু কমতে পারে কিন্তু লম্বা রেসে এইটা কোন কাজেই আসবে না। আমি জানি না, যাদের কাছে এই সব বিষয়ে ডাটা আছি তারা ভালো বলতে পারবে। তবে আমার কাছে এইটাই মনে হয়।
নারীর প্রতি যে পরিমাণ অবহেলা, অসম্মান দেখানো হয় আমাদের সমাজে সেখানে এমন অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়া খুব আশ্চর্য ঘটনা না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মোরাল পুলিশ বসে থাকবে, কে কী পরল, কে কখন বাড়ি ফিরল, কখন কার সাথে কোথায় গেল ইত্যাদি নিয়ে এই মোরাল পুলিশ প্রতিনিয়ত তাদের কার্যক্রম চালাবে আর সবাই মিলে আশা করবে দেশ থেকে ধর্ষণ, নিপীড়ন সব উঠে যাবে তাহলেই কাম হইছে! ধর্ষণ হচ্ছে চূড়ান্ত অপরাধ। এর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত নারীকে যে পরিমাণ অপমান অপদস্থ হয়ে চলতে হয় সেই সমাধান না করলে কোন কাজই হবে না। চার রাস্তার মোড়ে পাথর মেরে ধর্ষককে মারলেও হবে না।
কয়েকদিন ধরে বেশ কয়েকটা কুৎসিত ঘটনা ঘটে গেল। এইটা আকাশ থেকে হুট করে আসে নাই। একটু পিছন ফিরে দেখেন, এই কয় মাসে কী পরিমাণ নারীদেরকে হেনস্তা করা হয়েছে। আমি নিজেই লেখছি কতবার যে সারা দেশে নারীর জন্য রেড এলার্ট জারি হয়েছে। পোশাক নিয়ে কথা বলছে, কেউ কেন সিগারেট খাচ্ছে বলে অপমান করছে, কেউ হেনস্তা হচ্ছে বোরকা পরে নাই কেন দেখে, কেউ জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচছে কারণ ওই সময়ে তিনি কেন সেখান গেছেন! সমতা বজায় রেখে, কোন বৈষম্য না রেখে সকল ধর্মের, সকল বয়সই নারীকেই হেনস্তা করে যাচ্ছে একটা বিশাল সংখ্যার মানুষ। এগুলা যখন হচ্ছিল, এগুলা যখন বাড়ছিল তখন প্রশাসন, সরকার মহাশয় চুপচাপ দেখেছে, কোথাও কোন পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টা শাহবাগে যাকে আটক করে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে তৌহিদি জনতা তাকে ছাড়িয়ে এনেছে, ফুলের মালা গলায় দিয়ে বীরোচিত সংবর্ধনা দিয়েছে, বুকে তুলে দিয়েছে কোরান শরীফ! ধর্ষক ছাড়া পায়, ফুলের মালা গলায় দিয়ে ইভ টিজার মুক্তি পায় যে সমাজে সে সমাজে ধর্ষণ বেড়ে গেলে যে আশ্চর্য হবে তাকে দেখে আশ্চর্য হওয়া জায়েজ আছে না? কঠিন আইন করেই লাভ কী যদি আপনি বদমায়েশ গুলোকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করার ব্যবস্থা করে দেন!
যে হেনস্তা গুলো হয়েছে সেগুলোই শেষ ছিল না, সেগুলার শেষ পরিণতি হচ্ছে এমন বর্বরোচিত ধর্ষণ গুলো। যদি সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না আসে তাহলে এগুলা আরও বৃদ্ধি পাবে, কামান দিয়াও ফেরাতে পারবেন না। লিঙ্গ কর্তন, পাথর মেরেও পারবেন না। এখন বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? যারা করবে তারা ইসলামিক মবের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস রাখে না।
এইখানে এসেই বিগত সরকারের কথা এসে যায়। কেন তখন এই মতালম্বিরা চুপ করে ছিল? কিসের ভয়ে? আমি আমি সহ আরও বহু মানুষ লীগ সরকারকে গালি দিয়ে গেছে মৌলবাদের প্রতি যথেষ্ট কঠোর না হওয়ার কারণে। কিন্তু এখন যত এই পরিস্থিতি দেখছি, যত এদের আস্ফালন চোখে পড়ছে তত মনে হচ্ছে যে কৌশলেই হোক, এদেরকে যে চুপ করিয়ে রাখা হয়েছিল তার জন্য একটু সাধুবাদ তারা পেতেই পারে। আমরা যা চেয়েছিলাম তা পাইনি। তা সম্ভবত রাজনৈতিক ভাবে বাংলাদেশে সম্ভবও না। সব নাকচ করে দিবে, সবাইকে বাদ দিয়ে দিবে এইটা আমাদের চাওয়া হলেও এইটা বাস্তব সম্মত না। আমাদের যেহেতু রাষ্ট্র চালাতে হয়নি তাই আমরা চিল্লাফাল্লা করে গেছে কেন এদের সাথে এত দহরম মহরম! অথচ এই বিপুল শক্তিটাকে কিছুটা প্রশ্রয় দিয়ে, অনেকটাই গলায় পাড়া দিয়ে এদেরকে চুপ করিয়ে রাখা হয়েছিল। সঠিক ছিল না ভুল ছিল এই তর্ক এত বছর আমরাই করেছি। কিন্তু এখন আর তর্ক করতে ইচ্ছা করে না। কারণ যতদিন যাচ্ছে তত স্পষ্ট হচ্ছে সেই কৌশল খুব একটা ভুল ছিল না। কিংবা হয়ত ভুলই ছিল। লম্বা দৌড়ের জন্য হয়ত ভুল ছিল। আমরা শান্তিতে ছিলাম এইটা তো ঠিক?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।