আজকে স্বাধীনতা দিবস। ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের সময় যখন বিএনপি সিদ্ধান্ত নেয় তারা জামাতের সাথেই থাকবে, এবং শুধু থাকা না, জানপ্রান দিয়ে থাকাই তাদের একমাত্র লক্ষ হয়ে গেল তখন একবার আমি কোথায় জানি লিখেছিলাম বা বলে ছিলাম যে এই যে যা হয়ে গেল এরপরে কোনদিন বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে আমাদের ইতিহাস বইটা হবে দেখার মতো। বিএনপি তো বিএনপি, তারচেয়েও ভয়ংকর শক্তি এখন ক্ষমতায়। এবং যা শঙ্কা ছিল মনে তা খাপে খাপ মিলে গেছে। যে সময়টাকে নিয়ে শঙ্কা ছিল সেই সময়ই এখন অতিবাহিত হচ্ছে বাংলাদেশে। আর তেমন এক সময়েই আসল স্বাধীনতা দিবস।
স্বাধীনতা দিবসের দুই একদিন আগেই কিছু কুৎসিত কাজ করে ফেলল সরকার মহাজন। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হল বঙ্গবন্ধু সহ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া চারশজনকে মুক্তিযোদ্ধা বলা যাবে না যেহেতু তাঁরা কেউ সরাসরি সম্মুখ সমরে লড়াই করে নাই! এই যুক্তি দিয়ে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী বলা হবে এখন থেকে, মুক্তিযোদ্ধা না। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযোদ্ধা বললেই কী আর না বললেই কী? একই কথা খাটে তাজউদ্দীন আহমেদসহ বাকি শীর্ষ নেতাদের ক্ষেত্রে। প্রশ্নটা হচ্ছে এদের চেষ্টার! কী আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে যদি কোন ভাবে ছোট করা যায় এঁদেরকে। কোনভাবে যদি আরেকটু নামানো যায় তাঁদের অবস্থান থেকে। এরা যে সূত্র দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাপ মাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাতিল করছে সেই সূত্রে তো মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানীকেও মুক্তিযোদ্ধা বলা যাবে না! তিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করেছেন? এখন দেখেন তো শুনতে কেমন লাগে যে যাকে সেনাপতি বানানো হল যুদ্ধের তিনিই যোদ্ধা না! দারুণ না?
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এখানেই থামেন নাই। গতকাল জানিয়েছে সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানে বঙ্গবন্ধু সহ পাকিস্তান আর্মির আত্মসমর্পণের যে ভাস্কর্য ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার কোনটাই আর নতুন করে তৈরি করা হবে না কেন? এইটা না কি জুলাইয়ের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক! বঙ্গবন্ধুকে না হয় এদের ছাগলপনার স্বার্থে আলাদা করেই ধরলাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ভাস্কর্য কোন যুক্তিতে জুলাই চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক হয়? আমার বুঝার কথা না, কারণ আমি জুলাই চেতনা কী জিনিস তাই এখন পর্যন্ত বুঝি নাই।
স্বাধীনতা দিবসর আগ মুহূর্তে ফাইজলামি এখানেই থামে নাই। বঙ্গবন্ধু এভেনিউয়ের নাম পরিবর্তন করে শহীদ আবরার ফাহাদ এভিনিউ রাখার সিদ্ধান্ত পাকা করা হয়েছে! আসুন সকলে ধন্য ধন্য বলি তারে! বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আগের নাম ছিল জিন্না এভিনিউ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এর নামকরণ করা হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। এখানেই আওয়ামীলীগেরপ্রধান কার্যালয়। তো এর পরিণাম যে সুবিধার ছিল না তা তো অনুমেয়ই ছিল। কিন্তু তাই বলে আবরার? আবরারকে এবার স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, সেখানে না থেমে এখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের নাম করা হচ্ছে তার নামে? আবরার কে? যে মনে করত ভারত ইচ্ছা করে পানি ছেড়ে দিয়ে বন্যায় বাংলাদেশের মানুষকে বিপদে ফেলে! যে মনে করত আওয়ামীলীগ সরকার ইলিশ দিচ্ছি মাগনা মাগনা, ভারতকে খুশি করতে আর এদিকে দেশের মানুষ ইলিশ খেতে পারছে না! বুয়েটের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে যার চিন্তা ভাবনার দৌড় হচ্ছে এই পর্যন্ত তাকে আরেক ছাগলেরা পিটিয়ে মেরে ফেলায় এখন সে স্বাধীনতা পদক পাচ্ছে মরণোত্তর, ঐতিহাসিক রাস্তার নাম হচ্ছে তার নামে! এইটাও আর কিছু না, বঙ্গবন্ধুকে ছোট করার প্রয়াস।
যাক, এবার ইতিহাস নিয়ে যে ফুটবল খেলা হচ্ছে সেই প্রসঙ্গে যাই। স্বাধীনতা দিবস এগিয়ে আসতেই নানান জন নানা ভাবে ইতিহাসের ক্লাস নিচ্ছে। এতদিন তো তাদেরকে কেউ কথা বলতে দেয় নাই, তাই এখন মুখ খুলেছে সবাই। এক পক্ষ বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে বাঙালি আর কয়টা মরেছে, বাঙালিই বিহারিদেরকে কচুকাটা করেছিল আগে! আরেক পক্ষ বলে যাচ্ছে আওয়ামীলীগের কোন যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিল না। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। তাই শেষ মুহূর্ত আলোচনা চালিয়ে গেছেন, যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন নাই, তাই এত মানুষ মরেছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে যারা বলছে বিহারিদের কচুকাটা করেছে আওয়ামীলীগের কর্মীরা তারাই বলছে আওয়ামীলীগের কর্মীরা অস্ত্র জোগাড় করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছে! যে কোন একটা ক, দুইটাই কস কেন? প্রস্তুতি নিছিল না নেয় নাই?
একটু ইতিহাসের গল্প বলে রাখি এখানে। এই কথা গুলো প্রায়ই শুনতে হয় আমাদেরকে। বঙ্গবন্ধু কেন আগেই স্বাধীনতা ঘোষণা দিল না, কেন শেষ মুহূর্ত আলোচনা চালিয়ে গেল ইত্যাদি। এই ইত্যাদির গল্প বলি।
বঙ্গবন্ধু নিজে বেশ অনেকবার জানিয়েছিলেন যে তিনি ছয় দফার ভিত্তিতেই স্বাধীনতা আনবেন। তিনি ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার বাসায় আওয়ামী লীগের চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও খন্দকার মোশতাককে ডাকেন। সাথে ডাকেন চার যুব নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, ও তোফায়েল আহমেদকে। সেখানে তিনি এই আটজনকে জানান যে তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায়ই স্বাধীনতার জন্য চেষ্টা করবেন। কিন্তু পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। তখন তিনি এই আটজনকে একটা ঠিকানা মুখস্ত করান। কী ঠিকানা? সানী ভিলা, ২১ ডঃ রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ণ পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা-৭০০০২১।এই বাড়িটা হচ্ছে আওয়ামীলীগ নেতা চিত্তরঞ্জন সুতারের। চিত্তরঞ্জন সুতার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আগেই তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেন সব কিছু বন্দোবস্ত করে রাখার জন্য। বঙ্গবন্ধু শুধু চিত্তরঞ্জন সুতারকে না, এরপরে আবার তিনি সিরাজগঞ্জ থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডাক্তার আবু হেনাকে কলকাতা পাঠান। আবু হেনা গিয়ে সব কেমন চলছে, কীভাবে কী করতে হবে সব বুঝে আসেন। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন কোন পথে ভারত থেকে অস্ত্র আসবে। চুয়াডাঙ্গা ঝিনাইদেহ দিয়ে অস্ত্র ঢুকবে জানানো হয়। তাঁদেরকে বলা হয় প্রতিরোধ ভেঙে গেলে তারা আটজন যেন কলকাতায় চলে যায়। সেখানে অপেক্ষা করে আছেন চিত্তরঞ্জন সুতার!
এই মিটিঙেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই আটজনই হবে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে হাই কমান্ড। দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। মনিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আর্মির সাথে যোগাযোগ রাখার, তাদেরকে বের করে নিয়ে আসার। তোফায়েল আহমেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয় জেনারেল ওসমানীর সাথে যোগাযোগের। তাঁর মাধ্যমে অবসর প্রাপ্ত অফিসারদেরকে সাথে নেওয়ার কাজ করে তোফায়েল আহমেদ। সারাদেশের ছাত্রলীগের দায়িত্ব নেন আব্দুর রাজ্জাক। এদের প্রত্যক্ষ পদক্ষেপে প্রস্তুতি এগিয়ে যায়। ঢাকায় যাদের বাসায় অস্ত্র ছিল তা সংগ্রহ করা হয়, বন্দুকের দোকানে যা অস্ত্র ছিল তা নিয়ে নেওয়া হয়। সিরাজুল আলম খান যুদ্ধকালীন সময়ে বেতার ব্যবহারের জন্য একটা বেতার যন্ত্র প্রস্তুত করেন। সিগনাল কোরের শওকত আলীর সাথে যোগাযোগ করা হয়, তিনি কথা দেন তিনি সাহায্য করবেন প্রয়োজন হলে। আমরা এখন জানি তিনি সাহায্য করেছিলেন। তিনিই আরেকজনের সাহায্যে প্রচার করেন, - “This is may be my last massage, from today Bangladesh independent." I call upon the people of Bangladesh where ever you might be and whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved." এর জন্য মূল্যও দিতে হয়েছে তাঁকে, চরম নির্যাতন করে মারা হয় তাঁকে। নির্মেলেন্দু গুণ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার জন্য তাঁকে অবশ্যই বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেওয়া উচিত। আমার নিজস্ব মতও তাই। আজকে যখন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সন্দেহ করা হচ্ছে তখন আসলে শওকত আলীর এই ঘটনা, আত্মত্যাগ, বীরত্ব সব কিছুকেই বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে।
তো কথা হচ্ছে প্রস্তুতি ছিল না যারা বলেন তারা কোন যুক্তিতে বলেন? প্রস্তুতি ছিল বলেই পুরো এপ্রিল মাস, কোথাও কোথাও মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত একটা আধুনিক সমরাস্ত্র দ্বারা সজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে এই যোদ্ধারা। বাঙালি পুলিশ, ইস্ট বেঙ্গল রাইফেল, ছাত্র জনতার যারা প্রস্তুত ছিল যুদ্ধের জন্য তারা সবাই প্রাথমিক প্রতিরোধ করে যায়।
আজকে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন দেশের জনগণকে ফেলে রেখে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান চলে গেছেন! যাকে গেরেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যিনি ইচ্ছা করলেই পালিয়ে যেতে পারতেন কিন্তু শুধু মাত্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আটক হয়েছিলেন এই ভেবে যে তাঁকে যদি না পাওয়া যায় তাহলে পুরো ঢাকা জুড়ে তাঁকে খোঁজার অছিলায় সব লণ্ডভণ্ড করে দিবে, কী পরিমাণ মানুষ মরবে, মারবে তার কোন হিসাব থাকবে না। শুধু মাত্র এই চিন্তা থেকেই তিনি ধরা দেন। এমন ভাবে বলা হচ্ছে যেন তিনি পাকিস্তানে খুব আরামের জীবন কাটিয়েছেন। রবার্ট পেইনের লেখা টর্চার্ড অ্যান্ড দ্য ড্যামড (নির্যাতিত ও অভিশপ্ত) গ্রন্থে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বন্দিজীবনের নির্মম চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। শুধু বঙ্গবন্ধুর কারাগারের জীবন অংশটুকু নিয়ে বাংলায় আলাদা বই করা হয়েছে। তাঁর ম্যাসাকার বইটাও মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চরিত্র বুঝতে অন্যতম সেরা বই।
যাই হোক, আমরা জানি এগুলা হচ্ছে এখন যেদিকে বাতাস সেদিকেই নৌকা বাওয়া আলাপ। চিন্তার কথা হচ্ছে বাতাসকে নিয়েই। বড্ড খারাপ দিকে বাতাস বইছে, সবাই সেই বাতাসে গা ভাসাচ্ছে। চোখ সবার সিংহাসনের দিকে। সেখানে পৌঁছাতে নিজের আত্মা বিক্রি করে দিতেও আপত্তি নেই কারো।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।