শ্যামল দোকানের বাইরে লোকটাকে ইতি উতি ঘুরতে দেখছে কয়েকবার।
ঢুকবে ভেবেও ঢুকছে না যেন লোকটা। কিছু খুঁজছে নাকি বিশেষ কাউকে খুঁজছে? দেখতেও কেমন যেন ছন্নছাড়া। কোটরে বসা চোখ।
দোকানের সামনে লোকটাকে এভাবে ছুঁকছুঁক করতে দেখে শ্যামল ভাবল একটু ভিড় কমলে লোকটাকে কড়কে দেবে ভালো করে।
ওর দোকানে মেয়েদের ভিড়।
কাস্টমাররা ক্রমাগত ঢুকছে, বের হচ্ছে। দু একজন হুমড়ি খেয়ে ক্যাটালগ দেখছে। ইতি উতি দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও দু একজন।
এসবের মধ্যে একটা লোক উঁকিঝুঁকি দেবে সেটা উচিত নয়। এতে কাস্টমার বিরক্ত হতে পারে।
একটা বড় কারণ হল, শ্যামলের দোকানে একটা পর্দার আড়ালের কুঠুরিতে মেয়েরা ক্রমাগত ব্লাউজ, কামিজ, সালোয়ারের মাপ দিয়ে চলেছে।
পর্দার আড়াল থেকে সোমাদি উঁচু গলায় বলে চলেছে বিভিন্ন সংখ্যা। গলা, হাতা, ঝুল, মুহুরি, পুটের মাপ।
মেয়েরা শাড়ি, ওড়না সামলাতে সামলাতে বেরিয়ে আসছে খুপরি থেকে।
তারপর শ্যামল ওদের থেকে বুঝে নিচ্ছে হালফ্যাশনের হাতা - মাপমত লম্বা, ছোট, নাকি সামান্য ফোলানো। গলা কতটা গভীর হবে, বা ডিজাইন গোল, চৌকো নাকি নৌকোর মত চ্যাপ্টা।
শ্যামলের দর্জির দোকান এই চাঁদঘরাতে খুব পপুলার। প্রত্যেকটি বিলে মনোযোগ দিয়ে ব্লাউজ বা কামিজের বিবরণ লিখে নিতে হবে শ্যামলকে।
আসলে দর্জিই সেই একমাত্র পরপুরুষ যার সঙ্গে মেয়েরা নির্দ্বিধায় আলোচনা করতে পারে সামনের উচ্চাবচ উপত্যকার বিশেষ কারুকার্য সম্পর্কে। দেহের খাঁজ, মোড়, ওঠানামাকে আরও আকর্ষক করে তুলতে কোন আদ্যিকাল থেকে দর্জিই আমঔরতের যোগ্য দোসর।
এইসব মাপছাঁট হিরের কাটের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
কোন একটিতে সামান্য ভুল হলেও কাস্টমারের চোখ ছলছল করবে, মুখ গম্ভীর হয়ে যাবে। কড়া কথা শোনাতেও ছেড়ে দেয় না অনেকে। মনে হবে যেন এই ব্লাউজের অপছন্দের কাটিংই তাদের জীবনের একমাত্র সমস্যা। অথবা সামান্য একটি লেস বা বর্ডার বসানোর গরমিল যেন এক জীবন তছনছ করা দুর্ঘটনা।
আড়চোখে লোকটাকে দেখতে দেখতে এরকমই কোন একটা অর্ডার লিখে নিচ্ছিল শ্যামল।
হঠাৎ মুখ তুলে দু তিন জনের পিছনে একটি মেয়ের হাসি হাসিমুখ দেখে চেনা বলে মনে হল শ্যামলের।
মাপ নিতে নিতে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে খুব একটা দেখা হয়না। ওর এই আপাত নির্লিপ্ত ভাবটার জন্যই হয়তো মেয়েরা নিজেদের ইচ্ছে এতোটা খুলে ধরে ওর কাছে।
মেয়েটিও পেছন থেকে দু একজনকে সরিয়ে একটু সামনে এগিয়ে এসেছে। ওর ডান চোখের পাশের কালো তিলটা দেখতেই চমকের মত মেয়েটিকে চিনতে পেরেছে শ্যামল।
ছোট দাশগুপ্তদের মেয়ে বিপাশা।
বহুদিন, না বহুবছর পর এ পাড়ায় বিপাশাকে দেখল শ্যামল।
বিপাশাদের বাড়ী শ্যামলদের পাড়াতেই। বা বলা যায় বিপাশাদের বাড়ী ছিল শ্যামলদের পাড়াতেই। শ্যামলের মেজো বোন ইলার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত মেয়েটা।
তখনও পাড়াগুলোয় বিভিন্ন রকম বাড়ীতেই থাকতো। তখনো পাড়ায় পাড়ায় বহুতলের চল হয়নি। কেউ ভাড়া বাড়িতে, কেউ নিজের বাড়িতে। কেউ নতুন বাড়িতে, আবার কেউ নতুন বাড়ি করার স্বপ্ন নিয়ে পুরনো ভাঙা বাড়িতে। তখনও নতুন, পুরনো, ভাঙা, আধাতৈরি বিভিন্ন প্যাটার্নের বাড়ি নিয়ে এক একটি পাড়া তৈরি হত।
বিপাশাদের বাড়িটা ছিল শ্যামলদের পাড়ার একেবারে শেষ মাথায়। দাশগুপ্ত বাড়ী।।
দাশগুপ্তরা বড়, মেজ, ছোট তিনভাই থাকত বড়, মেজ, ছোট বাড়িতে। দাশগুপ্ত ভাইদের বাড়ীগুলো একেবারে অঙ্ক বইয়ের ‘বড় থেকে ছোট সাজাও’ এর পদ্ধতিতে সাজানো ছিল।
দাশগুপ্তদের তিন পুরুষের ফুটবলের গোলের জালের ব্যবসা। ব্যবসা ছোট নয়। ব্যবসার জাল ছড়ানো ছিল দেশ ছাড়িয়ে প্রতিবেশী দেশেও।
সেই জালের ব্যবসায় বাকি দুই ভাইকে গোল দিয়েছিলেন বড় দাশগুপ্ত। কোন বিপন্ন মুহূর্তে ব্যবসার অংশীদারী কিনে নিয়েছিলেন ভাইদের কাছ থেকে।
নিন্দুকে একথা বলতে পারবে না যে বড়ভাই অন্য ভাইদের ঠকিয়ে ব্যবসা কেড়ে নিয়েছিল। ছেলের নিউমোনিয়ায় বসা বুকের জল মেজো দাশগুপ্তকে আক্ষরিক অর্থেই জলে ফেলে দিয়েছিল। ছেলের অসুস্থতায় ব্যবসা থেকে নেওয়া কিছু অর্থের ফেরত হিসেবে মালিকানার অংশীদারির হাতবদল হয়ে গেছিল।
তবে মেজো দাসগুপ্ত একেবারে পথে বসেনি। দাসগুপ্ত বাড়ির এই ছেলেটিই একমাত্র কিছু লেখাপড়া করেছিল। আরও একটি দুর্মূল্য রত্ন তখনও তার ভাণ্ডারে ছিল। সরকারী চাকরির বয়স। এবং সেই শিকে তার ভাগ্যে ছিঁড়েও যায়। তাই ব্যবসা হারিয়েও মেজভাই কোন রকমে মধ্যবিত্তের শেষ আশ্রয়ের ডাল ধরে ঝুলে পড়েছিল। সরকারী কোন একটা দপ্তরে মাঝারি লেভেলের চাকরী পেয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু বিপাশার বাবার ব্যাপারটা অন্যরকমের। ওর দাদুর আমল থেকেই বিপাশার বাবা মদ খেত। ছোটছেলে বলে বিপাশার ঠাকুমার আলগা আদরের ভাগ ছিল। ক্রমশ মাতলামির মাত্রা বাড়তেই থাকে। সঙ্গে গাঁজা, চরস এসবও চলত।
বিপাশার জন্মের পরেও এই নিয়ে ওদের বাড়িতে বিস্তর ঝগড়া হত, ওর মা রাগ করে বাপের বাড়ী চলে যেত। শ্যামল বড় হয়ে উঠতে উঠতে সেসব শুনেছে অনেক।
তবে এসবে বিপাশার বাবাকে টলানো যায়নি। লাল টকটকে চোখে বিপাশার বাবার রাস্তার পাশ দিয়ে টলতে টলতে হেঁটে যাওয়ার ছবি এখনো ভেসে আছে শ্যামলের চোখে।
একবার বিপাশার মা না থাকার সুবিধায় কিছু টাকা দিয়ে ব্যবসার হাত বদল হয়ে গেছিল ওর বাবার সঙ্গেও। গোটা ব্যবসার মালিকানা নিয়ে বড় দাশগুপ্তরা জাঁকিয়ে বসেছিল। আর বিপাশারা সেই ওর ঠাকুমারই কিছু আর্থিক সাহায্যের দৌলতে জীবনযুদ্ধে কোনমতে টিঁকে ছিল মাত্র।
বড় দাশগুপ্তরা পাড়ায় মিশত না।
ওদের মেয়ে গাড়ি করে পিয়ানো শিখতে যেত। গাড়িতে লাফ দিয়ে উঠে হাতে ব্যাডমিনটন র্যাকেট আর পাশে বন্ধুছেলে নিয়ে হুশ করে বেরিয়ে যেত।
ওদের পাশে তখন শ্যামল, ইলা, বিপাশারা একেবারেই বেমানান।
দু একটা মেয়েকে টপকে সরিয়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিপাশা। মোটার দিকে গড়ন গড়িয়েছে। কিন্তু পুরনো আদলে চেনা যাচ্ছে বেশ।
“কেমন আছো শ্যামলদা?’’
“আমি তো ভালোই আছি। তোকে কত কতদিন পর দেখছি রে। কবে এলি এখানে? ’’ মুখে বিস্ময়ের কারিকুরি খেলিয়ে এগিয়ে আসে শ্যামল।
‘’সোমাদি তুমি একটু বাকিগুলো লিখে নিও’’ বলে ভিতরের দিকে হাঁক দেয় একবার।
‘’আবার কলকাতায় ফেরত এসেছি গো শ্যামলদা। ছেলে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এবার থেকে এখানেই থাকব।’’
“বাহ্! সেই কবে চলে গেছিস। তোর সঙ্গে তো আর দেখা হয়নি।”
“হাঁ, বছর আঠারো উনিশ হবে।” বিপাশা উত্তর দেয়।
বাড়ি চল না। মা খুশি হবে। বাবা তো নেই বছর দশেক হল।’’
সে জানি শ্যামলদা। মেজজেঠার থেকে সব খবরই পেতাম। আজ আর সময় নেই তবে পরের দিন মাকে নিয়ে আসব সেদিন জ্যেঠিমার কাছে যাব। বাবা চলে যাবার পর থেকে মা এই বাড়ি সারানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আর আমিও কলকাতা এসে গেছি, ভাবলাম এখানেও মাকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে থাকবো।”
শ্যামলের চোখে ধরা পড়ে বিপাশার পোশাকের কাপড়ের উচ্চমানের বয়ন। ত্বক মসৃণ, ছিমছাম গয়না। ভালোই আছে বিপাশা।
শ্যামল যে খুব নজর করে মেয়েদের দেখে তা নয়, তবে দীর্ঘদিন মেয়েদের বহিরঙ্গের সাজ পোশাকের প্রতি তার একটা মায়া তৈরি হয়েছে। মনোযোগের সঙ্গে না হলেও কেমন ভাবে যেন চোখ চলেই যায়।
বিপাশার শরীর থেকে চোখ সরিয়ে রাস্তার দিকে তাকায় শ্যামল। ভর সন্ধ্যের জমজমাট বাজারি ভিড়। দুপেয়ে, তিনপেয়ে, চারপেয়ে গাড়ির ভিড়ে এই সময়টায় বাজার সরগরম।
ওর নিজের দোকানেও লোকের কমতি নেই।
দোকান ছেড়ে ওরা দুজনে একটু এগিয়ে এসে মোড়ের সামনে দাঁড়ায়।
বিপাশাও বাজারের দিকে দেখতে থাকে। স্বগতোক্তির মত বলে, “কী ভীষণ চেঞ্জ হয়ে গেছে জায়গাটা তাই না শ্যামলদা?”
“তুই বহুদিন পরে দেখছিস বলে মনে হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনেই একটু একটু করে বদলেছে বলে হয়তো বুঝতে পারিনা।”
বিপাশা ঝলমল করছে।
“জ্যেঠুর… মানে তোমার দোকানটাও তো কত বদলে গেছে গো। মেজ জ্যেঠুর কাছে এখানের সব খবরই পেতাম অবশ্য।” বলে বিপাশা কেমন অর্থবহ হাসি হাসে।
এর মানে শ্যামলের দোকানের পরিবর্তনের গল্প মেজ দাসগুপ্তদের বাড়ি হয়ে বিপাশার পাহাড়ি শ্বশুর বাড়িতেও গিয়ে পৌঁছেছে।
পাহাড়ি শ্বশুরবাড়ি কথাটা মনে পড়তেই বিপাশার বিয়ে নিয়েও সে এক ধুম হয়েছিল বটে, সে কথাও মনে পড়ে গেল শ্যামলের।
জিজ্ঞেস করল শ্যামল, “তুই তাহলে এতদিন কোথায় ছিলিস? ছোটকাকার সঙ্গেও তো শেষ দিকে আর দেখা হল না।”
“বিয়ের পর প্রথম দু তিন বছর ছিলাম হিমাচলে, শ্বশুরবাড়িতেই। তখন ওর ঘন ঘন পোস্টিং চেঞ্জ হত। কিন্তু ছেলেটা জন্মানোর পর মুম্বাইতেই সেটল করি। এখন শ্বশুর শাশুড়ি দুজনেই মারা গেছে। বাবাও নেই। আমরাও কলকাতা চলে এসেছি। ছেলেটাকে কলেজে ভর্তি করেছি। কিন্তু খুব একটা পড়াশোনায় মন নেই। তবে আমার বরের মামার বিজনেসটায় ওদের সঙ্গেই বসবে। ওখানে আমাদের মানে আমার শাশুড়ির একটা ভাগ আছে তো!”
হড়বড় করে অনেক কথা বলে যায় বিপাশা।
হিমাচলে বিয়ে হয়েছিল বিপাশার। সেই একবারই বড় দাসগুপ্তদের নিজেদের বাড়ির উঁচুতলা ছেড়ে নিচে নেমে আসতে দেখেছিল পাড়ার লোক।
শ্যামল অবশ্য ওর মা’র কাছে শুনেছিল সেসব।
বি এ পাশ বিপাশার বিয়ের সম্বন্ধ চলছিল আশেপাশে। চায়ের দোকানের মালিক, অটো চালক, বা স্কুলের বেয়ারার মত সম্বন্ধে বিপাশার মা ওকে পাত্রস্থ করতে পারলে বাঁচে তখন।
কিন্তু বিপাশা কোন কারণে সেইসব বিয়েতে রাজি ছিলনা। বড় গিন্নির কোন এক সরকারি স্কুলের বেয়ারা ভাইয়ের সঙ্গে বিপাশা বিয়েতে রাজি না হওয়ায় তিনি বেজায় রাগ করেছিলেন।
কিন্তু আশেপাশের কোন ছেলের সঙ্গে বিপাশার আশনাই ছিল বলে কেউ জানত না। তবে জানা গেল, কদিন পরে। কলকাতার যে কলেজ থেকে পড়েছিল বিপাশা সেখানে একটি হিমাচলী ছেলের প্রেমে পড়েছিল সে।
কলকাতায় তার মামার বড় ব্যবসা। সেই মামার বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করত। কিন্তু ব্যবসায় বসার সুযোগ থাকলেও ইচ্ছে ছিলনা তার। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় বসছিল সেই ছেলেটি, আর বিপাশার কাছে দাবি করেছিল কিছুটা সময়।
প্রেমিককে সময় দিতেই নানান টাল বাহানায় সময় কাটাচ্ছিল বিপাশা।
কিছু সময়ের মধ্যে কোন একটা উঁচুপদের সরকারি চাকরি পেয়েও যায়। বিপাশার বিয়ে হয়ে যায় সেই ছেলেটির সঙ্গেই।
সে এক অদ্ভুত বিয়ে। তখন এইসব এলাকায় বিহারি, মাড়োয়ারি বা নিতান্ত দখিন ভারতের লোকজনের কথা শোনা গেলেও হিমাচলের লোকজন কেমন হয় সে সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না লোকজনের। বিপাশা বাঙালি মতে কনে সাজলেও বরপক্ষ এসে ওকে মাথার গয়না, নাকে বড় নথ পরিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল।
আর দিয়েছিল গা ভরা সোনার গয়না। ইলা এসে বলেছিল, সে এক এলাহি সওগাত।
বড় গিন্নি তখন পাড়ায় সকলের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাকে বলে গেছিল, “ও দেশে নিয়ে গিয়ে ঠিক বেচে দেবে মেয়েটাকে, যেমনি লোভীর মত ল্যা ল্যা করে বিয়ে করাচ্ছে বিপাশার মা। খবরের কাগজে বড় বড় করে বেরোবে সেই খবর, দেখবে তখুন।”
কিছু লোক হয়তো বিশ্বাসও করেছিল, বিপাশার বিক্রীত হবার খবর খুঁজেছিল কাগজে কয়েকমাস ধরে। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্যবশত সেই খবর আসেনি। বরং রোগাসোগা বিপাশা মোটাসোটা হয়ে বরকে নিয়ে এসে ওর বাপ মাকে নিয়ে গেছিল ওদের কলকাতার ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটটা খালিই পড়ে থাকত, তাই বাবামাকে সেখানেই নিয়ে চলে গেল বিপাশা।
বড় দাসগুপ্তদের মেয়েও অবশ্য আমেরিকা চলে গিয়েছিল তবে কে জানে ওখানে না কি ড্রাগ ওভারডোজ করে মরে গেছে। ছেলে এখন ব্যবসা সামলায়। তবে এখন আর সে ব্যবসা ভালো চলেনা।
কলকাতায় যাবার পর পর বিপাশার বাবা দু এক বার আসত।
এখানের বাড়িটা আগে থেকেই ভাঙ্গাচোরা, বাড়ি সারানোর ক্ষমতা ছিলনা তার। তবু বিপাশার মায়ের পরিচর্যায় গেরস্থ বাড়ির মর্যাদাটা ছিল। ওরা চলে যাবার পর কেমন যেন পোড়ো হয়ে গেছিল। মাতাল, গেঁজেল লোকটার খুব একটা বন্ধুবান্ধব ছিল না। ধীরে ধীরে আর আসেনি, কেউ লক্ষ্যও করেনি খুব একটা।
বিপাশাদের ভিটেতে ঢোলকলমির ঝোপে কখন যে ওদের স্মৃতি মুছে গেছে তা আর মনে নেই।
শ্যামলের দোকানের দিকে ফিরে মনোযোগ দিয়ে দেখছিল বিপাশা। আর শ্যামল দেখছিল সেই লোকটাকে। একটু যেন অপ্রকৃতিস্থ। মাতাল নাকি?
লোকটা একবারে দোকানের সিঁড়িতে উঠে দাঁড়িয়েছে। দোকান থেকে কারিগর অমল বেরিয়ে এসে লোকটাকে তাড়ানোর ভঙ্গিমা করল।
এত দূর থেকে ওদের কথা শ্যামল কিছু শুনতে পেল না।
“ভারি সুন্দর করে সাজিয়েছো দোকানটা। জ্যেঠুর আমলে তো হ্যাঙ্গারে কেবল সারি সারি প্যান্ট আর প্যান্ট বলো?” বিপাশা হেসে হেসে বলে।
বিপাশার কথাটা আবারও ওর দোকানের দিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে শ্যামল কথা ঘোরায়।
“তুই এই রাস্তার মোড়েই দাঁড়িয়ে থাকবি? বলছি বাড়ি চল। বৌদির সঙ্গেও দেখা হবে।”
বিপাশা বলল, না গো, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে কোথায় রাখতে গেছে জানিনা। এখুনি এসে পড়বে। পরের দিন যাবো নিশ্চয়ই তোমাদের বাড়ি। আমি তো বুঝিয়ে বলে দিলাম ছেনাঘোষের বাড়ির পাশের জমিটায় গাড়ি রাখতে। কে জানে কোথায় চলে গেল?
“আরে দূর! সে জমি কী আর আছে নাকি? ছেনাঘোষের জমিতে কবেই ফ্ল্যাট উঠে গেছে। পুরোনো কারখানার পেছনের মাঠ, মদ্রাজি লাইনের বস্তির সামনের ফাঁকা জায়গা সব ভরে গেছে রে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে। শুধু কী মাঠ! নুরে পুকুর, শ্যাম বোসের পুকুর, লালটে পুকুর সব বুজিয়ে বাড়ি হয়ে গেছে। বলছি বটে, চোখে পড়েনা কিন্তু এক একবার মনে হয় যেন চাঁদঘরার জমির চামড়া গুটিয়ে ভাঁজ পড়ে বুড়ো হয়ে গেছে। তোর গাড়ি রাখতে হয়তো ড্রাইভার অনেক দূর গিয়েছে।
তুমি কী এখন শুধুই মেয়েদের জামাকাপড় বানাও শ্যামলদা? সেই প্রশ্নটা করেই ফেলল বিপাশা।
শ্যামল মনে মনে যেন প্রশ্নটার আশঙ্কাতেই ছিল।
“হ্যাঁ ঐ সব রকমই আর কী!” ঘোরানো উত্তর দিল সে।
শ্যামল, শ্যামলের বাবা দুধকুমার দর্জি আর ওদের বসাক টেলার্সের রূপান্তরের খবর মেজ দাসগুপ্তর বয়ানে বিপাশার হিমাচলী জীবনে কী ভাবে পৌঁছেছে কে জানে? কিংবা আদৌ হয়তো বিপাশা জানেই না বসাক টেলার্স কে ঘিরে চাঁদঘরা বাজারের সেই রসালো গল্প।
ছোট একটা গাড়ি এসে এতক্ষণে ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে হর্ন দিচ্ছে।
বিপাশার গাড়ি এসে গেছে।
বিপাশা চলে গেল। বলে গেল পরের বার এসে শ্যামলদের বাড়ি যাবে।
দোকান এবার বন্ধ করতে হবে। তবু শ্যামল দোকানে ফিরে না গিয়ে, উল্টো দিকে ফিরে একটা সিগারেট ধরালো।
সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যেন অতীতের কোন এক ধূসর বিকেলের ঘোলাটে আকাশে মিশে যেতে থাকে।
এই শহর ঘেঁষা মফস্বলটার গায়ে আলগা আদরের মত লেগে থাকা গ্রামজীবনের মেঠো সুর এদিক সেদিক তখনও শোনা যেত। এলাকায় সবাই সবাইকে চিনত, দায়ে বিপদে ঝাঁপিয়েও পড়ত।
দখিন পাড়ার মানিকের চোদ্দ বছরের ছেলেটা যখন পিঠে রোঁয়া ওঠা স্কুল ব্যাগ নিয়ে উধাও হয়ে গেল, অনেকেই ছেলেটাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল। তখন অনেকে পালাত বম্বে, রুপোলী জগতের ইশারায়। এসব মফস্বল থেকে হারিয়ে গিয়ে প্রথমে সকলে যেত হাওড়া কি শিয়ালদা স্টেশন। তারপর বম্বের ট্রেন খুঁজত। মানিকের ছেলেটাকে খুঁজতে সবাই তাই প্রথমে গিয়েছিল হাওড়া, শিয়ালদহ। তারপর আত্মীয় স্বজনের বাড়ী, তারপরে মেয়েবন্ধুর খোঁজ। ছেলেটা, বা তার মেয়েবন্ধুর খোঁজ কিছুই পাওয়া যায়নি।
শেষ অবধি ছেলেটাকে পাওয়া গেছিল মালিপাড়ার ভাঙ্গা চণ্ডীমন্দিরের পেছনের গাছে।
ঐ বয়সে কেন যে ছেলেটা গলায় দড়ি দিয়েছিল কেউ বলতে পারেনি।
সে যাই হোক, এই চাঁদঘরার পাড়ায় পাড়ায় লোকে লোককে চিনত। একে অপরের দুঃখে সুখে দৌড়ে যেত।
এই বসাক টেলার্স তখন চালাত বাবা, দুধকুমার বসাক।
এতো জমজমাট না হলেও এই চারমাথার মোড়ে ছোটখাটো একটা বাজার ছিল। চেনা দোকানী, চেনা খরিদ্দার, সীমিত বেচাকেনা।
এই বসাক টেলারস ঘিরেও কিছু বয়স্ক মানুষ আড্ডা দিত। কিন্তু তখন দুধকুমার বসাকের দোকানটা ছিল ছেলেদের জামাকাপড় বানানোর দোকান। বাবা বানাতো শার্ট, প্যান্ট। পুরুষ কাস্টমার, পুরুষ টেলার। মেয়েদের ব্লাউজ বানানোর দোকানের রমরমা তখনও এই মফস্বলে বিরল। সালোয়ার কামিজ পড়ার চল ছিলনা। এছাড়া দু একটা বেনারসি টেনারসির ভালো ব্লাউজ বাড়িতেই মা, কাকিমারা বানিয়ে দিতেন।
জটলাটা সেদিন জমেছিল বসাকদের দোকানের উল্টোদিকে চায়ের দোকানে। শ্যামলও দোকান থেকে বেরিয়ে এসে দু একজন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিল।
শ্যামলের বন্ধুরা কেউ কেউ নতুন চাকরিতে ঢুকেছে, কেউ ব্যবসা শুরু করেছে। শ্যামলও ওর বাবার কাছে শিখে নিচ্ছিল ঝুল,হাতা, লম্বা, মুহুরির কাট।
সেদিন দোকানে কেবল শ্যামলের বাবাই নয়, আরো দু একজন কারিগরও ছিল।
গল্পের বিকেলটা যেন ছবি হয়ে শ্যামলের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। দেখতে পায় সেদিনের শেষ বিকেলের আবছা হলদেটে ক্যানভাস।
দিন শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু রাত নামেনি।
চায়ের দোকানে আঁচ উঠেছে। দু একজন ক্রেতা আসছে, বসছে পেতে রাখা নড়বড়ে বেঞ্চে। ভেতরের জোরালো লাইট জ্বালিয়ে দেবার আগে ছোট পুতুলের গায়ে জামা পরিয়ে দোকানের সামনে ঝুলিয়ে দিচ্ছে দোকানদার। মিষ্টির দোকানে চ্যাঙারীতে রাখা শিঙাড়া নিমকি ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে কারিগর।
মফস্বলী মোড়ের বাজারের সামনে দিয়ে আলগা হেঁটে হেলেদুলে চলে যাচ্ছে একটা আদুরে মেনিছানার মত আলসে শেষ বিকেল।
এমন সময়ে টেলারিং এর দোকানে একটা হইচই শুনে বাজারের লোকজন সেই দিকে তাকিয়ে দেখছে। একজন মহিলা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে উত্তেজিত ভাবে কিছু বলছেন।
দুধকুমার দর্জিও বেরিয়ে এসেছে।
দুজনেরই গলা চড়ছে।
দূর থেকে শ্যামলরা ঠিকঠাক শুনতে পায়নি। খুব একটা আমলও দেয়নি। ও তক্ষুনি বন্ধুদের সঙ্গ ছেড়ে গিয়ে ব্যবসার ক্যাঁচালে ঢুকতে চায়নি। ওসব তো লেগেই থাকে।
কিন্তু ঝগড়ার আওয়াজ কমলো তো নাই বরং উত্তরোত্তর বচসা বাড়ছে। জেন্টস টেলারস এর দোকানে একজন পৃথুলা মহিলার সঙ্গে কি নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে তা দেখতে এবার কেউ কেউ উঁকি মারতে শুরু করেছে।
একজন বলল, “মহিলা চাঁদঘরাতে নতুন। বামুনপাড়ায় ভাড়া এসেছে এরা।”
ওহ, নতুন লোক বলে অনেকেই ঠিক চেনেনা।
স্বামীর জামা প্যান্টের মাপ নিয়ে স্ত্রী দর্জির দোকানে লড়াই করতে এসেছে এরকম ঘটনা ঘটত না সচরাচর। তবে কী ছেলের জামা? কোন বিশেষ দামি কাপড়ের আদ্যশ্রাদ্ধ করেছে না কি টেলারিঙের দোকান?
লোকজন কান খাড়া করে কিছুটা গোলমালের আন্দাজ করতে চায়।
এরই মধ্যে চেঁচামেচি চরমে উঠেছে।
এবার শ্যামল দৌড়ে গেছে দোকানের চাতালে।
ওর বাবা যেন রেগে আগুন। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে তর্জনী উঁচিয়ে একবার ছেলেকে কিছু বলছেন আর একবার মহিলার দিকে ফিরে , মহিলাও থেমে নেই। তারও গলা সপ্তগ্রামে।
এই মুহূর্তেই অশান্তির চূড়ান্ত হয়ে গেল। দুধকুমার দর্জি দোকান থেকে বের হয়ে আসতে গিয়ে দোকানের দরজায় ধাক্কা দিয়েছে।
আর সেই ধাক্কায় মহিলাটি ঠিকরে গিয়ে পড়েছে রাস্তার ধুলোয়।
বাজারের লোকজন অবশ্য দৌড়ে গিয়ে ওঁকে তোলার আগেই মহিলা উঠে বসেছিলেন।
খুব একটা বেশী আঘাত শরীরে লাগেনি বটে। ধুলোবালি লেগে গিয়েছে সারা গায়ে । পড়ে যেতে গিয়ে নিজের দাঁত দিয়েই ঠোঁটটা কেটে গিয়েছে। মুখ থেকে রক্ত থুতু একসঙ্গে বেরিয়ে এসেছে।
সব থেকে বেশী পরিবর্তন সম্ভবত চোখে। চোখ দুটো অসম্ভব জ্বলছে।
“কী ধরণের অসভ্য আপনি? একজন মহিলার গায়ে হাত দিলেন!’’ রাগে, অপমানে, অপ্রস্তুত মহিলা যেন তখন আহত বাঘিনি।
এতক্ষনে অনেকেই দৌড়ে গেছে দোকানের দিকে। দোকান চত্বর তখন একেবারে ব্যাটলফিল্ড।
মহিলা পড়ে যেতে দুধকুমার দর্জি একটু ভেবলে গিয়েছিল।
সত্যিই তো আর সে মহিলাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে চেয়েছে তা নয়। দোকানে থেকে মহিলাদের জামাকাপড় তৈরি না করার দৃঢ় নিয়ম থাকলেও, মেয়েরা অহরহ আসে তার দোকানে। ছেলের সঙ্গে, ভাইয়ের সঙ্গে, স্বামীর সঙ্গেও।
বচসাও কী তাদের সঙ্গে কখনও বাধে না? কিন্তু ধাক্কা মেরে মহিলা কে ফেলে দেবার মত ঘটনা কখনো ঘটেনি।
খানিকপরে একজন কারিগরের মুখে শোনা গেল বিষয়টা
মহিলার ননদের কোন একটি বিশেষ শাড়ির ব্লাউজের বদখত নক্সাকে ম্যানেজ করতে না পেরে এই বসাক টেলার্সে এসেছিলেন ওঁরা। আজকেই কোন অনুষ্ঠানে সেই নির্দিষ্ট ব্লাউজটি তার পরে যাওয়ার কথা। আগে এসেছিলেন ঠিকদুপুরে দোকান বন্ধ হবার আগে।
সেই সময় দুধকুমার দর্জির ছেলে শ্যামল দোকান বন্ধ করছিল। কাকুতি মিনতিতে ভিজে গিয়েই হোক বা
ঠিক অতটা না বুঝেই বলে দিয়েছে বিকেলের দিকে আসতে। অথবা, হয়তো ভেবেছে দু একটা আড়ে- তিরছে সেলাই মেরে দিলেই যদি ওদের কাজটা মিটে যায় তাহলে ক্ষতি কী?
কিন্তু গোঁয়ার দুধকুমার দর্জি যে তার দোকানের কোন মেশিনে মেয়েছেলেদের জামা কাপড় ছোঁয়াতেই দেবে না।
সেলাই তো দূরঅস্ত্।
ওসব ছেলে ফেলে কী বলেছে, কীই বা আশ্বাস দিয়েছে সে কিছুই শুনতে চায়না।
এখন ভরা বাজারে তার ধাক্কায় মহিলা ভরা বাজারে ধুলো রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
ঘটনা কোনদিকে যাবে বোঝা মুস্কিল।
চেনা মানুষ হলে বাজারে উপস্থিত লোক এতক্ষনে সালিশি করতে ব্যস্ত হয়ে যেত। কেউ মহিলার পক্ষ, কেউ বা দুধকুমারের পক্ষ নিয়ে নিতেন।
কিন্তু এই ক্ষেত্রে মহিলাকে আহা, উহু করা ছাড়া খুব একটা এগোনো যাচ্ছে না।
মিষ্টির দোকানে একজন মহিলা সন্দেশ, মিষ্টির ট্রে মাজছিল। সে এসে মহিলাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে গেল। কিন্তু মহিলা হাত, পা, শাড়ি থেকে ধুলো ঝেড়ে ধীরে একাই উঠে দাঁড়িয়েছে।
গর্জন থামিয়ে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে চুপ করে গেছে সে, তবে চোখ তখনও রক্তবর্ণ।
ভিড়টাও চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছে।
দুধকুমারের দিকে আঙুল উঁচিয়ে মহিলা ধরা গলায় অভিশাপ দেবার ভঙ্গীতে বলল, “একদিন তোর দোকানে কেবল মেয়েদের জামা কাপড় তৈরি হবে, কেবল মেয়েদের।”
বলে ঈষৎ পা টানতে টানতে বামুন পাড়ার দিকে চলে গেল সে।
কথা, কথা, কথা।
তেমন করে বলতে জানলে শব্দ ব্রহ্ম হয়।
আর এতো অভিশাপ। একেবারে ব্রহ্মাস্ত্র।
ভিড়টা তখনকার মত ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও কথাটা একেবারে কিন্তু মিলিয়ে গেলনা।
ঘটনার পর দিন দুয়েক দুধকুমার দর্জি আর দোকানে আসেনি। গুম হয়ে ছিল। বাড়িতেও বেশী কথা বলত না।
তারপর আবার চেনা ছন্দে চলতে লাগল জীবন।
তবে দুধকুমার দোকানে আসলেও কেমন যেন অনিয়মিত হয়ে পড়ল নিত্যদিনের বহুবছরের অভ্যাস। ধীরে ধীরে সেই ফাঁকাস্থানে দোকানের মালিকের জায়গায় শ্যামল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
তবে আসল পরিবর্তন এসেছিল শ্যামলের কারিগর জীবনে, তার শিল্পীসত্ত্বায়।
সেই মহিলাকে ও নিজেই আসতে বলেছিল বলে দুধকুমার দর্জির প্রত্যাখ্যানটা তার বুকেও বেজেছিল কিনা আজ আর মনে নেই।
তবে এরপর সে বাবাকে লুকিয়ে অন্য একজন ওস্তাগরের কাছে সালোয়ার, কামিজ, ব্লাউজ বানানো শিখতে শুরু করেছিল।
বাইরের দুনিয়াটাও পরিবর্তিত হচ্ছিল দ্রুত।
পুরুষের পরিধানের বিভিন্ন নামী কোম্পানির তৈরি শার্ট প্যান্ট বাজারের দখল নিচ্ছিল। কমছিল অর্ডারি শার্ট প্যান্টের কদর।
দিন বদলে যাচ্ছিল। আগের তুলনায় অনেক বেশী মেয়েরা স্কুলে, কলেজে, অফিসে যেতে শুরু করেছে। শাড়ির পরিবর্তে সালোয়ার কামিজে নতুন প্রজন্মের মেয়েরা অনেক স্বচ্ছন্দ। বিভিন্ন ছাঁদের ব্লাউজও বাজারে এসেছে। মেয়েদের পোশাকের মার্কেট মাথা চাড়া দিচ্ছে।
চাঁদঘরাতেও দু একটা দোকান খুলেছে কেবল মেয়েদের পোশাকের জন্য। লাভও হচ্ছিল তাদের বিস্তর।
শ্যামলের কানে আসত সেসব টুকরো খবর।
তার নতুন শেখা বিদ্যে দিয়ে সে সেইসব চাহিদা, যোগান, লাভ, সমাজ, অর্থনীতি টুকরো জুড়তে শুরু করেছিল শ্যামল। দুধকুমারের অনুপস্থিতিতে দুটো একটা করে আধাচেনা মেয়েদের পোশাক তৈরি করতে শুরু করেছিল প্রথম দিকে।
চেনাজানা মেয়েদের অর্ডার নিত না। তাতে বাবার কানে কথাটা চলে যাবার সম্ভাবনা ছিল।
পারিবারিক ব্যবসা ছাড়া কিছুই তো জানা ছিল না শ্যামলের। আর শুধু ব্যবসার দায়ই বা কেন? শ্যামলের প্যাশনও ছিল এই দর্জির কাজ। শ্যামল নেশার মত ভালবাসত নিজের কাজকে।
তার নিজেরও কী ভালো লাগত সমস্ত শিল্পের কেবল অর্ধেক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে? কেবল পুরুষের পোশাক বানাতে বানাতে তার হাত থেকে ফস্কে যাচ্ছিল মেয়েদের পোশাক বানানোর সমস্ত অভিনব কৌশল।
আফসোস তো তার ছিলই।
তাই বাবার নিষেধের ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে শ্যামল উড়ান দিচ্ছিল বাকি অর্ধেক আকাশের সন্ধানে।
প্রথম দিকে দুধকুমার কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। হম্বিতম্বি, রাগ, দোকান কেড়ে নেবার প্রচ্ছন্ন হুমকি কিছুতেই কাজ না হতে দেখে শেষে হয়তো হাল ছেড়ে দিয়েছিল। বুড়ো অথর্ব রাজার মতই বোধহয় সরে গিয়েছিল যাবতীয় টানাপোড়েন থেকে।
শেষদিকে আর আসতেনও না নিজের দোকানে, বা বাজারের আড্ডায়।
আর শ্যামল ক্রমশ হাত খুলে মন ভরে বানাতে শুরু করেছিল মেয়েদের পোশাক।
বছর কয়েক পরে একদিন ব্যবসায়িক সমিতির বেঁকাচোরা নোটিশের বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেল তিনদিনের জ্বরে বৃদ্ধ দুধকুমারের মৃত্যুতে চাঁদঘরার বাজার একদিনের জন্য বন্ধ থাকবে।
শ্যামলের দোকান তখন রমরমিয়ে চলছে। বসাক টেলার্স ততদিনে চাঁদঘড়ার সেরা লেডিজ টেলার্স।
সেই বামুন পাড়ার মহিলার অভিশাপের জন্যই বসাক টেলার্স এর এই পরিবর্তন সে কথা বহুদিন বাজারের আনাছে কানাচে কান পাতলেই শোনা যেত।
শ্যামলের সিগারেট শেষ গিয়েছে। অলস পায়ে দোকানের দিকে ফিরে গেল ও। ভিড়ও ইতিমধ্যে একটু পাতলা হয়ে গেছে।
কাস্টমাররা এসে দু একটা অর্ডার নিয়ে গেল ।
সোমাদি চলে গেছে। শ্যামলও আজ একটু তাড়াতাড়িই দোকান বন্ধ করে। বিপাশার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে আজ পুরোনো দিনের কথাগুলোই মাথার মধ্যে ঘুরছে।
অমল তখনও ওর সঙ্গেই ছিল।
ওরা দোকানের শাটার নামিয়ে পেছন ঘুরতেই সেই লোকটাকে দেখতে পেল। সেই পাকানো দড়ির মত, সিড়িঙ্গে, নোংরা জামাকাপড় পড়া লোকটা খর দৃষ্টিতে শ্যামলদেরই দেখছে।
বিপাশা আসার পর লোকটার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল শ্যামল। লোকটা দোকানেও তো ঢুকে ছিল। অমলের সঙ্গে কী সব কথা ও বলছিল হাত নেড়ে নেড়ে।
শ্যামল জিজ্ঞেস করতে অমল বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আরে মাতাল একটা। ওর ছেলের একটা ছেঁড়াখোঁড়া প্যান্ট এনেছে। সেটা নাকি সেলাই করে দিতে হবে। আমি ভাগিয়ে দিয়েছি। সে তো যাবে না কিছুতেই। শেষে বললাম এটা মেয়েদের দোকান, ছেলের প্যান্ট সেলাই করিনা আমরা। তখন গালি দিয়ে চলে গেল।”
দোকান বন্ধ করে অমল চলে গেল।
শ্যামলও বাড়ি যাওয়ার পথ ধরল।
দোকান বন্ধ হতে মাতাল লোকটাও উল্টো ফিরে চলতে শুরু করেছে। শ্যামলের খানিক আগে আগেই যাচ্ছে লোকটা।
শ্যামল স্পষ্ট শুনল, মাতালটা এলোমেলো পায়ে টলতে টলতে চলছে আর মুখে বিড়বিড় করছে। “গুমর,হ্যাহ্ গুমোর। ঐ গুমোর গুয়ে যাবে তোদের। একটা বাচ্চার পেন্ত্উল সেলাই করে দিতে পারিস না ……।” মাতালের কথা জড়িয়ে গেল।
তারপর শরীর দুলিয়ে কিছুটা দূর এঁকেবেঁকে , থুক করে থুতু ফেলে বলল “ মেয়েছেলের বেলাউজ, পেনটুল সিলিয়ে সগগে যাবি তোরা?
এ……এ…… একদিন বেটাছেলের জামাকাপড় সেলাই করেই খাবি তোরা। এই একশোয় একশো বলে দিলাম, মিলিয়ে নিস।”
শ্যামলের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা রক্তের স্রোত বয়ে গেল।