খবরের কাগজ আর টি.ভি.তে বড়ো করে জানানো হলো, 'নির্দিষ্ট ডেসিবেলের উপরের মাত্রার শব্দবাজি ফাটানো নিষিদ্ধ। ধরতে পারলে মামারা পেটাবে, কয়েকদিন মামাবাড়ির আদরও হতে পারে। তাই তাই তাই, নিষিদ্ধ বাজি ফাটাতে নাই। ভাগ্নেরা সব সাবধান, (ভাইপোদের কথা বলা হচ্ছে না।)"
অথচ শ্যামাপূজায় বাজি ফাটিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করা হবে না তাই কি হয়? যে শ্যামাঙ্গী মাতা মহাকালের বুকে পা রেখে দাঁড়িয়েছেন আর হাতে ধরেছেন বরাভয়মুদ্রা, কাল স্তব্ধ যাঁর সামনে তাঁর পুজোতে অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য আলোর উৎসব করাই চলে, কিন্তু বেমক্কা শব্দ করার কী সম্পর্ক তা আমার বোধগম্য নয়। বাজি, শব্দবাজির তান্ডবে মানুষসহ অবলা পশুপাখিদের (মানুষও খুব সবল নয় ) বিপদে ফেলার কারণটাই বা কী? অস্তিত্ব জানান দিতে আওয়াজ দেওয়া? কে জানে!
বাজির একমাত্র রূপ কিন্তু কেবল শব্দবাজি নয়। আতশবাজি রয়েছে আকাশ আলো করার জন্য। যার ব্যবহারটাই এই দিনে বিধেয়। কিন্তু সহসা উৎসাহে আতশবাজির মতো জ্বলে ওঠা বাঙালির এটি ব্যবহার করার উৎসাহ কম কেন?
শ্রদ্ধেয় বিনয় ঘোষের 'বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ' গ্রন্থে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে দুটি লাইন ছিলো:
"উৎসাহে গ্যাসের শিখা, দার্ঢ়্যে শালকড়ি।
স্বাতন্ত্র্যে শেকুলকাঁটা, ঘ্রাণে পারিজাত।।"
অর্থাৎ তাঁর সর্বকার্যে উৎসাহ অনির্বাণ ও স্থির দেদীপ্যমান গ্যাসের শিখার মতো ছিলো। আতশবাজির মতো ক্ষণস্থায়ী নয়। সে যাই হোক, কথা হচ্ছিলো শব্দবাজি নিয়ে। নির্দিষ্ট ডেসিবেলের মাত্রা অতিক্রম করে দুমদাম শব্দবাজি ফাটানোর ভীষণ বিরোধী ছিলেন আমাদের পাড়ার এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকুরীজীবি জেঠু। আমাদের বাড়ির পাশের গলিটা ঘুরে সামান্য রাস্তা আর চায়ের দোকান পেরোলেই ক্রিম রঙের দোতলা বাড়িটা পড়ে। নীচে কোল্যাপসিবেল গেট টানা। উপরের খয়েরি রঙা জানালা দুটো বন্ধ। ওই নীচের তলাটায় সপ্তাহে পাঁচদিন বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা, আবার রাত আটটা থেকে সোয়া দশটা টিউশন পড়ায় রোহনদা। ছোটোদের অল সাবজেক্ট, উঁচু ক্লাসে ইংলিশ আর ইতিহাস। চাকরীর অনেক চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই পেশাটাই বেছে নিয়েছে সে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাচটাও হয়ে উঠেছে বেশ বড়ো। সেদিন দুপুরে রোহনদার মুখোমুখি দেখা সেই অবসরপ্রাপ্ত জেঠুর সঙ্গে।প্রণাম করতে জানতে চাইলেন,
-- "কেমন চলছে?"
মাথা চুলকে রোহনদা উত্তর দিলো, "আপনাদের আশীর্বাদে ভালোই বেশ!"
-- "সে তো বুঝলাম, কিন্তু টিউশন তো আর ভবিষ্যত নয়। কিছুই তো করতে পারলে না জীবনে, এভাবে কদিন চলবে? না হে, রজতের পুত্রভাগ্যটাই খারাপ !"
গ্রীষ্মকালের দুপুরে সেদিন শব্দবাজি ফেটেছিলো খোলা রাস্তায়। আর মাথা নীচু করে এক ভাগ্যতাড়িত যুবক ফিরে গিয়েছিলো তার নিজের কাজে। সময় আর পরিস্থিতির পরিবর্তন সর্বদাই চলছে, মানুষ মানিয়েও নেয় সেইভাবে। অন্তত: সবদিক বিবেচনা না করে ডেসিবেল অতিক্রম্য শব্দবাজি ফাটানো কি বিবেচনার কাজ?
সবাই আবার শব্দবাজির ভয়ে রোহনের মতো মাথা নীচু করে না। বুড়িমার চকলেট বোমের পাল্টা দোদোমা ফাটতে দেখেছিলাম এক বিয়েবাড়িতে । উৎসব-আয়োজনের মধ্যে কেরালা কটন পরিহিতা এক গৃহস্থ-গৃহিণী তাকিয়ে আছেন নববধূর দিদির দিকে। নীলাম্বরী জারদৌসি আর মুক্তোর গহনায় সেই হাসিখুশি মেয়েটির দিকে চোখ সরু করে বললেন, "হ্যাঁরে, লজ্জা করে না তোর?"
ইষৎ হতচকিত হয়ে সে কারণটা জানতে চাইলে মহিলা বুঝিয়ে বলেন, ডিভোর্সী মেয়ে বোনের বিয়েতে এতো স্বাভাবিক থাকে কীকরে (এই ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে! )এবং জনতা জনার্দন ....ইত্যাদি ইত্যাদি। (হে স্রষ্টা, তোমার সৃষ্টি সততই বিস্ময়ের)
কিছুক্ষণ পর চক্ষুস্থির আত্মীয়বর্গকে আরেকবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়ে তরুণী জবাব দেয়, ওই বর্ষীয়সীর যদি এখানে বসে পরের বিষয়ে ভাবতে বা আদিরসাত্মক তামাশা করতে লজ্জা না করে, তাহলে সেও লজ্জার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। ট্রাম্পের শুল্কবাণের কারণে তৈলরাজনীতি টালমাটাল, তাই নিজের চরকায় দেবার পর উদবৃত্ত তেল থাকলে বিদেশমন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
সম্ভবতঃ, তিনি বুঝে গিয়েছিলেন নির্দিষ্ট ডেসিবেল অতিক্রম করে শব্দবাজি ফাটানোর পরিণাম।
তবে শব্দবাজির বহর দেখেছিলাম রাজপথে এক ঝঞ্ঝাটে। সমস্যাটা হলো বাইকে বসা দুই যুবক বেকায়দায় এক পথচারী ভদ্রলোকের খুব কাছে এসে ব্রেক কষে। ভাগ্যগুণে দুর্ঘটনা ঘটেনি। ভদ্রলোকের হাতের বাজারের ব্যাগ থেকে একটা সজনে ডাঁটা তুলে নিয়ে একজন সাহায্যকারী সপাটে বসিয়ে দিলেন এক টোটোচালকের মাথায়। কারণ সে ক্রমাগত ওই ভদ্রলোককে বলছিলো, "এগিয়ে গিয়ে সাইড দিন, এগিয়ে গিয়ে সাইড দিন। "
এই পরোপকারী ব্যক্তি বললেন,
-- "হতচ্ছাড়া, বেল্লিক, তুই ওদিক থেকে এলি বলেই তো দাদু এগিয়ে গিয়ে সাইড দিলেন! এক্ষুণি ধাক্কা খাচ্ছিলেন ভদ্রলোক ! তোদের রাস্তায় বেরোতে দেয় কেন?"
টোটোওলাও কিছু শব্দবাজি ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাইকের যুবকদুটি পরস্পরের সাহায্যে বাইকে উঠে বসে বললো
"এমন কিছু হয়নি দাদু, বাড়ি যান। আমরাও চললাম। সি ইউ।"
টোটোর সঙ্গে ঝগড়ার মধ্যেই আততায়ীগণ অন্তর্হিত হলো দেখে ক্ষুব্ধ বৃদ্ধ চেঁচিয়ে উঠলেন,
-- "হ্যাঁ বাবাসকল, শিগগিরি যাও... সৃজিত মুকুজ্জ্যে তৃতীয় পুরুষের ইস্ক্রিপ্ট লিকচে একন ! "
বস্তুতঃ এই শব্দবাজি ফাটার পর অনেকে ছমছমেস্তম্ভিত ও বিস্ময়বিম্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।
তবে খোদ ক্লাসরুমে শব্দবাজি ফাটতে দেখেছেন? সেভেন- এইটে যে খিটখিটে সংস্কৃতের স্যারের কাছে পড়তাম, তাঁর ক্লাসেই ফেটেছিলো। তাও আবার এই দীপাবলি সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই, তাই ব্যাপারটা মনে আছে।
স্যারের প্রশ্ন ছিলো অন্তিম বেঞ্চে অবস্থিত একটি দুর্লভ রত্নের কাছে , "বাংলা অনুবাদ করো, 'তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ"
কিছুক্ষণ এদিক - ওদিক ভেবে নিয়ে, ঝুনো নারকোলের মতো মাথাটা নাড়িয়ে তার উত্তর, "তুমি শুয়ে পড়ো মা, আমি জ্যোতির বাড়ি গমন করিতেছি।"
তারপর শুধু কাঠের স্কেলটা স্যারের হাতে আসার অপেক্ষা, শেষে হেডস্যার মাঝখানে এসে সেই অমূল্য প্রাণটিকে রক্ষা করলেন।
এরকম শব্দবাজির খোঁজ চোখকান খোলা রাখলে রাজনৈতিক বক্তৃতার মঞ্চ থেকে পাড়ার দোলমঞ্চ সবেতেই পাওয়া যাবে। তবে ডেসিবেল অতিক্রম করা (অর্থাৎ নিজের সীমা ছাড়ানো, যা একটি বদভ্যাস) তা বাদ দিয়ে 'বাঙালির শব্দবাজি' নিয়েই একটি সংকলন প্রকাশিত হতে পারে। পুজোর দিন শব্দদূষণের মাত্রা নাহয় আইন করে কমানো গেলো, কিন্তু বঙ্কিমবাবুর কথা অনুযায়ী বলতে গেলে
"এ শব্দবাজিসমূহের উৎকট দূষণপ্লাবনকে রোধিবে কে? হরে মুরারে!"
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।