“মর, মর, মর, মর।”
“মর, মর, মর, মর।”
কর্কশ, বিরক্তিমাখা উচ্চস্বরটি একটানা অভিসম্পাত দিয়ে চলেছে।
তবে কণ্ঠস্বরের মালিক কেবল অভিসম্পাতেই দীর্ঘক্ষণ ভরসা ধরে রাখতে পারে না। অভিশাপে কাজ হওয়া বা না হওয়ার দ্বন্দ্বে না থেকে সেটি ফলবতী হবার নির্ভুল লক্ষ্যে নিশ্চিত হয়ে এবার বলতে থাকে, “মরবে, মরবে, ঠিক মরবে।”
কল্যাণী জানলার গরাদের ভিতর দিয়ে দেখে, সামনে শুকনো উঠোন পেরিয়ে বাইরের কালো মরচে ধরা গেটে মাথা ঘষছে একটা গর্ভবতী ঘেয়ো কুকুর।
এই নির্জন, একটেরে বাড়িটায় কে জানে কিসের আশায় ঢুকতে চাইছে প্রাণীটা।
এ বাড়ির এঁটোকাঁটা, ফেলে দেওয়া ভুক্তাবশেষেও তো তেমন স্বাদুটান নেই। দুটি নিরামিষভোজী আধবুড়ির খাবারের উচ্ছিষ্টে কিই বা থাকে?
সুবিমল চলে যাবার পর শাশুড়ি বলেছিলেন, “সবই আমার কপাল। একটা বোঝা বুকের ওপর ছিলই, আরেকটা বোঝার ওপর শাকের আঁটি জুটল। এবার সব আমার বুকের ওপর বসে ডাঁটা চেবোও। মাছ গেলা তো ঘুচে গেল।”
মা বলেছিল, “সেই আমার মতোই তোরও কপাল পুড়ল খুকু?”
মাকে আর বলা হয় নি, কল্যাণীর জীবন ওর মায়ের মত নয়। ওপরটা একরকম দেখালেও বাকিসব আলাদা আলাদা।
বাবার মৃত্যুতে মা যেমন ভেঙ্গে পড়েছিল, কল্যাণী আঘাত পেলেও ভেঙ্গে পড়ার মত কিছু হয়নি। বাবা যাওয়ার সময় মায়ের প্রাণের আনন্দটুকু শুষে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুবিমল চলে যেতে কল্যাণীর দৈনন্দিন যাপনের চেনাছকটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল কেবলমাত্র।
নিরাপত্তার অভাববোধও কিছুটা হয়েছিল বৈকি। অস্তিত্বের পাশ থেকে উঠে গিয়ে আস্ত একটা মানুষ সকালে বেরিয়ে রাতে ফিরে না এলে নিজেকে যেমন একটা অতল শূন্যে পাওয়া যায়, কল্যাণীরও খানিকটা সেরকমই হয়েছিল বটে।
তবে বাবা চলে যেতে মার মতো ভেঙ্গে পড়েনি সে। সুবিমল যে ওর প্রাণের কাছাকাছি ছিলইনা কখনো।
আবার বাবা মারা যেতে ব্রতকথার গরিব বামনিদের মত মামার বাড়িতে অপদস্থ হতে যেতে না হলেও ওদের হাতে টাকাপয়সা সেরকম কিছু ছিলনা। মামা এসেই বাবার সামান্য যা কিছু পুঁজির বন্দোবস্ত করে দিয়ে গিয়েছিল। মামা বলেছিল, “এই টাকায় কখনো হাত দিবি না দিদি, মেয়ের বিয়ে এই টাকা ভেঙ্গেই দিতে হবে।”
মা সেই টাকায় কখনো হাত দেয়নি। দু তিন ঘর ভাড়ার টাকা দিয়েই ওদের মা মেয়ের দিন চলত।
ওরা তখন কি খেত কেউ দেখতে আসেনি।
কোথাও গেলে বা বাড়িতে কেউ আসলে হয়তো মা আমিষ খেত না। কিন্তু বাড়িতে মা মেয়ের খাবারে ওরা অত বাছবিচার করতে যেত না। মাছ বা নিরামিষ এক তরকারী ভাতেই দিন কেটে যেত ওদের।
মার কেবল চিন্তা ছিল বছর চোদ্দর কল্যাণীকে কি করে বড় করবে, বিয়ে দেবে। সবাই বলেছিল মাথার ওপর থেকে বাবার ছায়া সরে গেলে মেয়েসন্তানকে সব ঠুকরে খায়।
কিন্তু সুবিমল চলে যেতে কল্যাণীর অত চিন্তা করতে হয়নি।
এঁরা সম্পন্ন গৃহস্থ। বেখেয়ালি ট্রাকটা জীবন্ত সুবিমলকে দেখতে না পেলেও সুবিমলের কোম্পানি ওর ভাঙাচোরা শবদেহের দাবী অস্বীকার করেনি। ওঁরা কল্যাণীর হাতে মোটা টাকা দিয়েছিলেন।
ওর কোলে তখন বছর ছয়েকের সুমন। ছেলেশিশু হবার স্বাভাবিক কবচ সুমনের ছিল। কিন্তু তার দরকার ছিল লালন পালনের পুষ্টিরস।
শাশুড়ি বলেছিলেন, “ছেলে মানুষ করা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবেনা। টাকা তো রইলোই। নিজেকে সামলে রেখো। কাঁচা বয়সে বেধবার মাথা থেকে স্বামীর ছাতা সরে গেলে তাকেই সবাই ঠুকরে খায়।”
এবং কল্যাণীর মাংস কেউ খাবার আগেই এই বাড়ির হেঁশেলে থেকে নিপুণভাবে তিনি কল্যাণীর মাছ মাংসের বরাদ্দ ছেঁটে দিয়েছিলেন।
সুবিমলের ছোটমাসী অবশ্য একবার বলেছিলেন, “ এইবয়স থেকে প্রোটিন খাওয়া বন্ধ করোনা কল্যাণী।”
শাশুড়ি বলেছিলেন, “তা সে তোর ছেলের বিধবাকে না হয় মুরগির ঝোল খাওয়াস। আমার বাড়িতে পাঁচটা ঝি চাকর রয়েছে, পাড়ায় ঢী ঢী পড়ে যাবে।”
ছোটমাসী মুখ কালো করে উঠে গেছিলেন।
পুত্রহারা মার কথা ধরতে নেই অবশ্য। কেউ ধরেওনি।
তবে শাশুড়ি সবটাই যে ভুল বলেছিলেন তা নয়। পিতৃহীন কিশোরীর ওপর মানুষের সামান্য হলেও মমত্ব থাকে। কিন্তু যুবতী বিধবাকে অনেকেই খোলা তিজোরি মনে করে। সেই তিজোরি হাঁটকানোর লোকের অভাব হয় না।
সুবিমল মারা যাওয়ার পর থেকেই বাড়িতে পিসতুতো খুড়তুতো দেওর, ভাসুরদের যাতায়াত বেড়ে গিয়েছিল।
ওরা বলত সুমনের জন্য ওদের সকলেরই মন কাঁদে। কিন্তু সুমনের সঙ্গে সময় কাটাতে কেউই আগ্রহী ছিল না। কেবল বারবার চা, জলখাবারে কাজ বাড়ত কল্যাণীর।
সব থেকে বেশি বাড়াবাড়িটা অবশ্য করে ফেলেছিল খুড়তুতো দেওর সম্পদ। মাসে তিন চার বার সুমনের টানে এবাড়িতে তখন তার নিত্য যাতায়াত।
কিন্তু কল্যাণীকে দেখতে পেলেই তার প্রস্রাবের বেগ এসে যেতে লাগল। কিন্তু তার জন্য সে বাড়ির কোন স্নানঘরই ব্যবহার করবে না। কল্যাণী ছাদে শুকনো কাপড় তুলতে আসলে সম্পদ মূত্র ত্যাগ করবে বাগানের পশ্চিম কোণে সুপুরি গাছের গোড়ায়। সেখান থেকে নিশ্চিত কল্যাণীর চোখে পড়া যায়। কল্যাণী বারান্দায় দাঁড়ালে ঠিক কোনাকুনি পৌরসভার পাকা ড্রেনটিকে সে ব্যবহার করবে। কখনো আবার কল্যাণী কলতলায় জামাকাপড় ধুতে এলে সম্পদ ঠিক ওর পাশটিতেই দাঁড়িয়ে পড়বে হয়তো। জল বিয়োগের বাহানায় নিজের পুংদণ্ডটিকে কোনমতে কল্যাণীকে দেখানোই তার লক্ষ্য।
বিবমিষায় কল্যাণীর গা পাক দিয়ে উঠলেও এই কথা ভাগ করে নেওয়ার কেউ এ বাড়িতে ছিল না। সম্পদেরও সাহস বাড়ছিল ক্রমাগত।
সেদিন কল্যাণীর ঘরের জানলার সামনাসামনি আশশ্যাওড়া গাছের ঝুপসি নিরিবিলিতে নিজের যন্ত্রটিকে দলাই মলাই করতে করতে হয়তো তার হুঁশ ছিল না। হুঁশ ফিরল, কিন্তু শুধু তার একার নয়। ততক্ষণে আইভিলতার চিতকারে গোটা পাড়াটাই জেগে উঠেছে।
আইভিলতা সুবিমলের বোন, শাশুড়ির বুকের ওপরের সেই আরেকটি বোঝা।
আইভিলতাকে কেউই হিসেবের মধ্যে ধরত না। । বাড়ির আধপাগল মেয়েটা যে ওর ওপর নজর রাখবে, তা সম্পদ ও খেয়াল করেনি বোধহয়। নির্লজ্জ সম্পদের পুরুষাঙ্গ খরখরে হাতে চেপে ধরেছে আইভিলতা। সঙ্গে সপ্ত গ্রামে চড়েছে তার গলা। সম্পদ তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টায় আছাড়ি পিছাড়ি করতে থাকে। কিন্তু আইভিলতার মুঠো করাল বাঁধন হয়ে চেপে বসেছে ততক্ষণে। সম্পদের সঙ্গে নিজের পারিবারিক বন্ধন বিস্মৃত হয়ে সম্পদের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে চলে সে।
কল্যাণী ঘরের জানলা বন্ধ করে লজ্জায় ঘৃণায় ঠকঠক করে কেঁপেছিল সেদিন।
কে জানে কি ভাবে সম্পদ পালিয়েছিল তবে আর ফেরত আসেনি কোনদিন।
গল্পটা হয়তো ছড়িয়ে পড়েছিল, বাড়িতে ভিড়ও কমতে থাকে এরপর থেকে।
আইভিলতার এই চিৎকার করে গালিগালাজ করার ঝোঁকটা তখন থেকেই শুরু।
না হলে তার আগে দিনে পাঁচ সাত বার চান করত। বাড়ির চৌহদ্দি বারবার ঝাঁটা মেরে কে জানে কি অদৃশ্য ময়লা সাফ করত। নর্দমায় বালতি বালতি জল ঢালত। কিন্তু এমনিতে নিজের ঘরে চুপ করে থাকতো, এভাবে গলা সপ্তমে তুলে চিৎকার করত না।
সুবিমলের মা অবশ্য ছেলের অকালমৃত্যু, মেয়ের অস্বাভাবিক আচরণের জন্য কল্যাণীর আধিদৈবিক অপয়া শক্তিকেই দায়ী করতেন, কিন্তু নিজেও হয়তো জানতেন এ তাঁর কেবলই বিড়ম্বিত ভাগ্যের পরিহাস। না হলে আইভিলতার এই অস্বাভাবিকতা যাকে সাধারনে ক্ষ্যাপামো বলে সে তো আর কল্যাণীর বৌ হয়ে আসার পরে হয় নি, বরং আইভিলতার কথা কিছুটা লুকিয়েই কল্যাণীর সঙ্গে সুবিমলের বিয়ে স্থির করেছিলেন এঁরা।
ঘরে অপ্রকৃতিস্থ, স্বামী-পরিত্যক্তা ননদ থাকলে সেই বাড়িতে হয়তো অনেক মেয়ের বাবাই মেয়ে দিতে চাইতেন না। সেইজন্যই হয়তো এঁরা পিতৃহীন মেয়ে এনেছিলেন।
সে দিক থেকে এঁরা ঠিকই ছিলেন।
একবার বিয়ে হয়ে গেলে স্বামী পাগল হলেও মেয়েদের মানিয়ে নিয়ে স্বয়ংসিদ্ধা হয়ে যেতে হয় সেখানে ননদ খ্যাপাটে এতো কল্যাণীর মতো পিতৃহীন মেয়ের কাছে নিতান্তই ছেঁদো যুক্তি।
আইভিলতা অবশ্য সেরকম কিছুই করত না।
বাড়ির পশ্চিমের দিকে উঠোনমুখো, একটেরে একটা ঘর বেছে নিয়েছিল আইভি।
দেখতে শুনতেও খারাপ ছিল না মেয়েটা। তখন ওর একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, তীক্ষ্ণ নাক, মাজা রং।
বাড়ির ভিতরে খুব একটা আসত না। ব্লাউজ টাউজে বোতাম বসানো, হেম সেলাই করা এইসব করত, হাতখরচটা ওর উঠে যেত হয়তো।
শাশুড়ি গজগজ করতেন, “ঝ্যাঁটা মারি অমন টাকার মুখে, সোয়ামিকে ছেড়ে এসে উনি পাঁচ টাকা রোজগার করে পাড়া ঢলাচ্ছেন।” বলতেন বটে তবে সবই আস্তে আস্তে। মেয়ের আগুন গরম চোখের দিকে তাকিয়ে ওসব বলার ক্ষমতা ছিল না তাঁরও।
কল্যাণীও মনে মনে ভয়ই পেত আইভিলতাকে। একটু এড়িয়েই চলত কখনো সেরকম ভাব ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
সারাদিন কি যে করত তখনও আর জানা হয়নি। সময়ও ছিলনা অবশ্য। শয্যাশায়ী শ্বশুরমশায়ের সেবা ছাড়া বাকি গোটা সংসারটাই কল্যাণীর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন শাশুড়ি।
আইভিলতা দুবেলা খাবার নিয়ে যেত রান্নাঘর থেকে। মা, বাবা, দাদা কারো সঙ্গেই বেশি কথা বলতো না। কল্যাণীকে তো বৌদি টৌদি বলে আদিখ্যেতার কোন প্রশ্নই ছিলনা।
সুবিমলের মা বলেছিলেন একবার, “ডিভোর্স তো হয়নি, কেবলই দিয়ে চলে গেল। বলল কিনা ছেলে থাকবে না বলেছে এই মেয়ের সঙ্গে। এ মেয়েও তেমন ঢেমনি। একটা কথা পেট থেকে বের করল না। ওরা ফের ছেলের বিয়ে দিয়ে দিল। ইনি বসে রইলেন আমার বুকের ওপর। ”
আইভিলতার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বিয়ে সুখের হয়নি। তাঁরা আর রাখবেন না বলে ওকে দিয়ে চলে গেছিলেন। সুবিমলের বাবা মা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মেয়ে আর ঐ বাড়ি ফিরে যায়নি।
কল্যাণী বিয়ে হয়ে এসেও দেখেছে, শাশুড়ি আর সুবিমল মাঝেমধ্যে আইভিলতাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।
-“তুই একেবারে ঘাড়ে গিয়ে ওঠ। নাকে খত দিইয়ে ছাড়ব আমি ছোটলোকগুলোর।” শাশুড়ি গজরাতেন।
-“তুই ফিরে যেতে রাজী থাকলে আমি কথা বলে দেখতে পারি। পাড়ার ছেলেরা হাতে রয়েছে আমার।” সুবিমল শান্ত গলায় বলত।
আইভিলতা মুখ টিপে চুপ করে থাকত।
প্রায়শই বসত এই দোষ আরোপ, চাপান উতোরের সভা। শাশুড়ির হুঙ্কার, সুবিমলের ঠাণ্ডা হুমকি আর আইভির নির্বাক উপস্থিতিতে কোন সমাধানে পৌঁছত না সেইসব বৈঠক। কল্যাণীর অবশ্য ওখানে দাঁড়ানোর হুকুম ছিলনা।
একদিন অবশ্য আইভিলতাকে ঝাঁঝিয়ে উঠতে শুনেছিল কল্যাণী। ঝাঁকড়া চুল পেঁচিয়ে, মা’র দিকে তেরছা তাকিয়ে হিস হিসে স্বরে বলেছিল, “ সব জেনে ন্যাকামি করো না তো! বিয়ে করব না, আগেই তো বলেছিলাম অনেকবার, তুমিই তো মরার নাটক করলে।”
শাশুড়ি চুপ করে গিয়েছিলেন। সুবিমল হাতের খবরের কাগজ আছড়ে ফেলে দিয়ে উঠে গিয়েছিল।
আর তারপর থেকে সেই আসর বসেনি।
কল্যাণী কিন্তু ভাবত, বিয়ের আবার সুখ কি? অসুখই বা কি? বিয়ে তো একটা গাড়ি। কারো ছ্যাকরা গাড়ি কারো রোলস রয়েস। কোন গাড়িটা গড়গড়িয়ে চলে কোনটা আবার ঠোক্কর খেতে খেতে। তবে তার জন্য কেই বা গাড়িটাই বাতিল করে বসে?
এসব অবশ্য কল্যাণী তখন ভাবত। এখন অবশ্য অন্য কথা ভাবে, এখন ভাবে কিছু ক্ষেত্রে সব ভেঙ্গে ছত্রখান হয়ে গেলেই বোধহয় ভালো হয়। পুরনো, জীর্ণ কিছু সরে গেলে তবেই নতুন কিছু তৈরি হবার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। নইলে তো ওপরে রংবেরঙের জামার তলায় কতোই না সম্পর্কের কঙ্কাল।।
কে জানে, আইভিলতা কি করে সেই গেরো ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিলো?
“হুস হুস” সামনের দিকের জানলা দিয়ে কল্যাণীও কুকুরটিকে তাড়িয়ে দিতে চান।
শাকসব্জির খোসা, আঠালো ফ্যানের মধ্যেও কিছু শুঁকছে প্রাণীটা।
সুবিমল চলে যাবার প্রথম ধাক্কাটা কেটে যেতে অবশ্য কল্যাণীরও মাঝেসাঝে মাছের গন্ধে খেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু এখন আর করেনা।
অভ্যাসে সবই হয়।
সুবিমলও তো কল্যাণীর একটা অভ্যাসই ছিল। ওদের মধ্যে গভীর প্রেম কখনোই ছিল না। কিন্তু একটি নিরবচ্ছিন্ন দাম্পত্যের অভ্যাস তো ছিল। অভ্যাস বিষয়টা এমন ভাবে জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জুড়ে থাকে যে সেটাকেই জীবন বলে ভ্রম হয় কখনো কখনো।
কল্যাণীরও ছিল, অভ্যাস। সুবিমলের অভ্যাস। সুবিমলের চা, সুবিমলের জামা কাপড়, সুবিমলের খাওয়া দাওয়া, ঘুম, যৌনতা এই সব কিছুই ছিল কল্যাণীর অভ্যাস।
এই অভ্যাসটাই জীবন ভাবত ও। এই অভ্যাসের বাইরের কল্যাণীকে সে নিজেই চিনত না।
সেই বৃষ্টিদুপুরেও তো কল্যাণী দৌড়ে ছাদে গিয়েছিল অভ্যাসের বশেই। তন্দ্রাছন্ন চোখে জানলার বাইরে মোষের মত একগুঁয়ে মেঘের হাঁকডাকে তার মনে হয়েছিল ছাত ভর্তি সুবিমলের জামাকাপড় বুঝি ভিজে গেল। ছাতে পা দিতেই বৃষ্টির জলের টুকরো বর্শার ফলার মতো এসে গিঁথে গিয়েছিল কল্যাণীর শরীরে।
আর তক্ষুনি সম্বিৎ ফিরে এক চিলতে ফাঁকা ছাত দেখে মনে পড়ে গিয়েছিল, সুবিমল মৃত।
এই খালি পড়ে থাকা ছাদ আসলে ওর জীবনের মতই শূন্য, ধু ধু।
সেদিনই প্রথম কল্যাণী নিজের জন্য কেঁদে উঠেছিল। সুবিমলের জন্য আত্মীয় পরিজনদের ফরমায়েশি শোক জ্ঞাপনের কান্না নয়, এ তার একেবারে নিজস্ব। আকাশের বৃষ্টির জলের সঙ্গে কল্যাণীর চোখের নোনাজল মিশে গিয়েছিল।
হতাশার নিঃশ্বাসে গুমরে উঠে ও ভেঙ্গে পড়েছিল বুকভাঙা হাহাকারে।
সেদিন শক্ত দুটো হাত ওকে সামলে নিয়েছিল। অকস্মাৎই এমন একটা উষ্ণ আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল যা ছিল ওর কল্পনার অতীত। নিজের যাবতীয় অসহায়তা সঁপে দিয়েছিল সেই আশ্রয়ে।
সেই থেকেই শুরু হয়েছিল কল্যাণীর অন্য একটা জীবন। একান্ত নিজের যাপন। সেইদিন সেই স্পর্শে যেন কল্যাণীর কাঁটাওয়ালা সবজে ক্যাকটাসের মত জীবনের গায়ে সবার অলক্ষ্যে ফুটে উঠেছিল একটি আনন্দের ফিরোজী ফুল।
কুকুরটা চলে গেছে। কতক্ষণই বা শাকসব্জির খোসার গন্ধ শুঁকবে?
আইভিলতার কটুকথার বর্ষণ বা ঝাঁঝ কোনটাই কমেনি। এই নির্জন দুপুরটাকে ফালা ফালা করে কাটছে।
মাঝে মধ্যে কল্যাণীরও বিরক্ত লাগে বটে। এই অকারণ গালিগালাজ কি যে ভালো লাগে আইভিলতার?
দত্তবাড়ির মেজবৌ ধমাস করে কল্যাণীদের দিকের জানলাটা বন্ধ করে দিল।
ওরাই বা কি করে?
সেভাবে কারোকেই দোষ দিতে পারে না কল্যাণী।
পাশের দত্ত বাড়ির মেজছেলের শরিকি ঘরগুলো পড়েছে কল্যাণীদের দিকেই। মাস দুয়েক আগেও দুপুরে খেয়েদেয়ে মেজবৌ মাঝেসাঝেই কল্যাণীদের ফাটা রোয়াকে এসে বসত।
-“কাকিমা আপনি বলেই সহ্য করছেন এসব। আমরা হলে কবেই বিষদাঁত ভেঙে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম।” তিতিবিরক্ত মেজ বৌ কখনো কখনো অভিযোগের সুর তোলে।
-“ ওভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিতে তো পারা যায় না মেজ বৌ। আইনের বলে এই বাড়ি আইভিলতারও অর্ধেক হক আছে।”
-“কে জানে কাকিমা, আপনি একটু শক্ত হলেই কিন্তু ওর এতোটা বাড় বাড়ত না। আগেপিছে কেই বা আছে ওর? ছেলের মাস্টারমশাই পড়াতে আসলে ভয়ে ভয়ে থাকি কখন এসব শুরু হয় কে জানে। আপনার তো সংসারটাও তো ছারেখারে গেল। কে জানে ওরই চোখ লেগে কি না! কি করে যে সহ্য করেন আপনি। ”
বিষণ্ণ দুপুরের শুকনো উঠোনের ধুলোরং এখন যেন লেগে থাকে কল্যাণীর ঘোলাটে চোখের তারায়।
মনে মনে সে ভাবে, কবেই বা আর সুখের সংসার ছিল কল্যাণীর?
সুবিমল কথা বলতেন কম। অফিস থেকে ফিরে যতটুকু বলতেন তা মায়ের সঙ্গেই। ঘরে ঢুকে কল্যাণীর সঙ্গে মাংসে মাংসে ঘষাঘষির সম্পর্ক।
সুমনের জন্মের পর আর সেটুকু বাঁধনও তো ছিলনা।
তারপর তো সে চলেই গেল।
সুবিমল বেঁচে থাকতেও তো ওদের মনের মিল হত না। এই যে গ্রহ নক্ষত্রের মত একটা মাপমত দূরত্ব রেখে নিজের নিজের আবর্তে নিত্য ঘুরে চলা, এইকি সংসার?
নাকি কল্যাণীর কপালটাই ওইরকম? ছেলেটাও তো বাইরে বাইরেই রয়ে গেল।
ছোট থেকেই ওকে হোস্টেলে দেওয়া হল। কল্যাণী একেবারেই চায়নি। সুমন ওর কাছে থাকলে হয়তো ওর জীবনটা অন্যরকম হত।
শাশুড়ি বললেন,“ বাপমরা ছেলে, ওখানে থাকলেই ভালো মানুষ হবে। নইলে তোমাকে তো আবার বিশ্বাস নেই। জম্মেই বাপকে খেয়েছো, আমার ছেলেটাকে খেলে, কখন আবার নিজেরটাকে খেয়ে বসবে।”
শিউরে উঠেছিল কল্যাণী।
ঘরমুছুনি মেয়েটা ঘর মুছতে মুছতে বলেছিল, “ঠাগমার মুখে কিছু আটকায় না! তুমি দুক্ষু করোনা কাকি। ব্যাটা হারানো মা’র কতা ধরতে নেই।”
তা ধরেওনি কল্যাণী।
কিন্তু সুবিমলের মায়ের এই অপমানে ওর আত্মায় সেই ক্যাকটাসের খোঁচা ফিরে এসছিলো, আর কল্যাণী ফিরে গিয়েছিল ওর আনন্দের কাছে, নিরাময়ের কাছে।
নিরাময় শুশ্রূষা হয়ে মায়া আর প্রেমের আদরে মুছিয়ে দিয়েছিল কল্যাণীর যাবতীয় বেদানালাল লাঞ্ছনা।
তবে কল্যাণীর ছেলেটা হারিয়ে গেল। শরীরে না হলেও, মনে।
বাইরে থাকতে থাকতে কেমন যেন বাড়ির থেকে টান আলগা হয়ে গেল।
স্কুলের হস্টেল থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হস্টেল, সেখান থেকেই চাকরি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল।
ঠাকুমার জন্য একটা টান ছিল ছেলেটার, তা শাশুড়িও তো চলে গেছেন বেশ কয়েক বছর। আর ওর সঙ্গে আইভিলতার কোন স্নেহ-সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
এখন বৌ নিয়ে আসে মাঝে মাঝে, তবে থাকতে আসে না।
মুখে বলে “এই ক্ষ্যাপাটে বুড়ির চিৎকারে কোন ভদ্রলোক থাকতে পারে? তুমিও এবার চল মা আমাদের সঙ্গে।”
মেজবৌ গজগজ করে চলে।কিন্তু চাইলেই কি আর সব করা যায়? নাকি সব বলা যায়?
এই যে যেমন মেজ বৌ এর জানলা বন্ধ করে রাখার যে কারণ, সেই কথাটিই কি সম্পূর্ণ সত্য? সম্পূর্ণ সত্য বলে কি কিছু সত্যিই হয়?
মেজবউএর কথা হয়তো ওর মতো করে ওর কাছে সত্য। কিন্তু কল্যাণীর কাছে আবার সেই সত্য অন্যরকম বেশে দেখা যায়।
মেজবৌ এর ছেলের মাস্টারটি আসে বটে, কিন্তু ওর ছেলেটি তখনো স্কুলে। আর মেজকত্তা তো সেই কোন সকালেই অফিসে বেরিয়ে যায়।
মেজবৌ কি এই বাড়ি থেকে ভেসে যাওয়া কুকথার জন্যই ঘরের জানলা দরজা বন্ধ করে রাখে? মাস্টার ছাত্র ফেরার একঘণ্টা আগে থেকে এসে কাকেই বা পড়ায়?
আজকাল মেজ বৌয়ের আনাগোনাও কমেছে।
আসলেও দুপুর গড়াতেই উসখুস করে। আগের মত গড়ানে বেলায় গা এলিয়ে নিশ্চিন্তে দুপুর কাটাতে পারেনা।
একদিকে আইভিলতার ঝগড়ায় হয়তো লাভই হয়েছে মেজবৌয়ের।
ছেলের অঙ্কের মাষ্টারের কঠিন ঐকিক নিয়মের পাটীগণিতে ভারি মজেছে মেজ বউ। এই ছুতোয় মাস্টার আসতেই তড়িঘড়ি সব জানলা গুলো বন্ধ করে দিতে পারছে।
কে জানে কোনদিন যদি মেজকত্তার হঠাৎ গ্যাস অম্বলে বুক জ্বলে ওঠে? বা পা মচকে যায়? বা ভালুক জ্বরে কেঁপে অফিসের কাজ মাঝপথে রেখেই ঘরে ফিরে আসে সে?
তখন আইভিলতার এই চিৎকারের কারণে জানলা বন্ধ রাখার অজুহাতটা কাজে লেগে যাবে মেজবৌয়ের। তবে মেজ বৌয়ের জানলা বন্ধ রাখায় খুশীও হয়েছে কল্যাণী।
কল্যাণীরও খানিকটা সেরকমই ভালো লাগে। খুব একটা কারো নোকঝোঁক পছন্দ হয়না ওরও। এইরকম সবার থেকে একটু আলগা থাকতেই ভালো লাগে এখন।
সেই আগে থেকেই বরাবরই খুব লুকিয়ে সন্তর্পণে মিলিত হতে হত ওদের। শাশুড়ির কড়া নজর তো ছিলই। তবে শুধু তিনিই বা কেন? বাড়ির বিধবা বৌয়ের এই বেচাল কেউই মেনে নিত না।
ওর নিজের মনেও তো সন্দেহ ছিল। ছিল অপরাধবোধের ঘুনপোকার নিরন্তর কাটাছেঁড়া। কিন্তু সুমন হস্টেলে চলে যেতে আস্তে ধীরে মনের সেই দ্বিধাগুলো সরে গিয়েছিল।
সুমন চলে যাবার পর ও নিজেই কতবার ইশারায় ডেকে নিয়েছে তাকে।
সিঁড়ির নীচের কেরোসিন গন্ধ অন্ধকারে, বা কয়লা ঘরের কালোগুঁড়ো মাখা বস্তার ওপরে ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে, কল্যাণীর শরীরের আনাচ কানাচ খুঁজে বেড়াত তার আঙ্গুল। সেই স্পর্শের প্রেমার্ত আকুতিতে আমূল কেঁপে উঠত কল্যাণী।
কই সুবিমলের সঙ্গে মিলনের সময় তো এমনটা কখনো হয় নি ওর!
এই মিলন সুবিমলের সঙ্গে সঙ্গমের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।
সুবিমলের একতরফা দখলদারির বিপ্রতীপে এই মিলনে অপরপক্ষ প্রতিটি ধাপে কল্যাণীকে সময় দিচ্ছিল, সম্মতি নিচ্ছিল প্রতিটি গাঢ় মোক্ষণের বাঁকে। কল্যাণীও ভেসে যাচ্ছিল সেই ম্যাজিকে।
আগে কখনো মনে হয়নি এই চামড়া, মাংস, রসের গতানুগতিক মেলামিশিতে লুকিয়ে আছে এমন বেদনানিবিড় আনন্দ। নিজের শরীরের গভীরে, রক্তে, স্নায়ুতে, রক্তে, লালায় এমন উত্তাল মাদকতা, এমন পিচ্ছিল উল্লাস ও কামার্ত বিবশতা মিশে ছিল তা যেন কল্যাণীর নিজের কাছেই ছিল রহস্যে ঢাকা। তার সঙ্গে মিলিত হতে হতে অবরুদ্ধ শীৎকার চাপতে চাপতে কল্যাণী বহুদিন উত্তেজনার নাগরদোলায় পাক খেয়েছে কয়লাঘরের অন্ধকারে।
এখন আর এতো লুকোচুরি ওর ভালো লাগে না।
ঘেয়ো কুকুর, পড়সি মেজবৌ কিংবা ব্যাঙ্গালরের ছেলে সব বেলা গড়ালেই বিদেয় হলে স্বস্তি পায় মনে মনে।
আজ ঈশান কোণে মেঘ জমেছে, মত্ত ঐরাবতের শুঁড় ফুলে উঠছে, যেন তৈরি হচ্ছে জল দিয়ে তোলপাড় করে দেবে চারধার।
কামিনী ফুলের গাছটা ভরে ফুল এসেছে। গন্ধে চারিদিক মাতোয়ারা।
কল্যাণী একটু সাজবে আজ। তেমন কিছু নয়, একটু কাজল দেবে চোখের কোণে। চুলটা গুছিয়ে বেঁধে পাটভাঙ্গা শাড়ী পড়বে। বুকের খাঁজে, বাহুমূলে আতর দেবে খানিকটা।
কল্যাণী জানে আজ রাতে আসবে ও। এইরকম ঝড় বাদলের রাত ওর খুব পছন্দের। আইভিলতার।
আদরে, আশ্লেষে ভরিয়ে দেবে কল্যাণীকে।
দুজনে একসঙ্গে একই ঘরেই থাকতে পারে। কল্যাণী বলেও ছিল। দুটো বুড়ি একসঙ্গে থাকলেও বা কেই বা কি বলবে? ছিলও কদিন ওরা একসঙ্গে। কল্যাণী ফুলদানিতে ফুল রেখেছিল। বিছানায় পেতে দিয়েছিল সাদা নীলের স্বপ্নাতুর চাদর। কিন্তু শরীর জাগেনি আইভির। তেমন করে জাগাতে পারেনি কল্যাণীকেও।
ও আবারও চলে গিয়েছিল নিজের একটেরে কুঠুরি ঘরে।
দস্যুটা ওরকমই। ও বলে, “ওসব স্বামী স্ত্রীর মত আদেখলে থাকাথাকি আমার পোষায় না। আমাকে ওসব নিত্যিদিনের ঝামেলায় জড়াস না।”
ও আসবে ইচ্ছেমত। কল্যাণীকে নিয়ে সুখের নাগরদোলায় উঠবে, নামবে।
তারপর আবার ফিরে যাবে ঐ উঠোনের ধারের পশ্চিমের ঘরটায়।
ঘরের সামনেটা ঝ্যাঁটা দিতে দিতে কোন ঘেয়ো কুকুর বা ঘাড় চাঁচা রোগা শালিখের দিকে তাকিয়ে তীব্রসুরে চেঁচিয়ে উঠবে, “মর মর মর মর।”