গাড়ির বর্ণনায় এতটুকু বলা যায়ঃ গাড়িটি চলছে মন্থর; মন্থর। তার ওপর গাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে এমন এক বান্ধবীর অবির্ভাব যার সাথে অনেকদিন দেখা নেই, যে সীল মাছ পছন্দ করত। সীল মাছের মসৃণ ত্বক দেখার বাসনায় সে বিয়ে করেছিল চিড়িয়াখানার এক বড় কর্মকর্তাকে। তা, সেই বান্ধবীর ফিরে আসা তাই প্রতীকের কাছে গোলকধাঁধার মতো মনে হয়। পুরো ব্যাপারটা ছিল নিছক একটা দুর্ঘটনা। হয়তো কোনো আত্মীয়কে সি-অফ করতে এসেছিল সে। কিন্তু যখন সে প্রতীককে বলে, সে তার কাছেই এসেছে, অনেক পথ পাড়ি দিয়ে, ব্যাপারটা এমন যেন কোনো পোষা বিড়ালকে ফেউ-লোকেরা বস্তাবন্দি করে অনেক দূরে ছেড়ে এসেছিল আর সেই বিড়াল বিশ্বস্ত আত্মার মতো, কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তির গুণে পুরনো মালিকের কাছে ফিরে এসেছে - তখন পুরো ইতিহাসটি আবারো উঠে আসে। কী কারণে সে চলে গেলো? কেনই বা ফিরল? আর এমন একটা সময়েই বা কেন? যখন সে আটকুড়িয়া যাবে বলে সব কিছু গুছিয়ে এনেছিল। তার বাস তো ছাড়তে গিয়েও পেছন থেকে লাগাম টেনে ধরা গরুর মতো আটকে ছিল, যেন সময়ের দড়িটি ছিঁড়বে-ছিঁড়বে অবস্থা, এমন সময় তা লোহার শেকলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে; বাতাসের জলীয় কণা তার শরীরে প্রবল বেগে আছড়ে পড়ছে, মুহূর্তে মরিচা ধরে খয়ে যাচ্ছে, আবার কোনো দৈব কারসাজিতে নিকেলের হাসি হেসে শক্তপোক্ত হয়ে উঠছে ঝনঝনিয়ে।
প্রতীককে থাকতে বলা হয়েছিল, নাকি সে-ই থেকে যেতে চেয়েছিল—সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই সীল-মাছপ্রিয় নারী, রাতের মতো যে বর্ণচোরা, সে আবারো উধাও হয়ে যাওয়ায় গাড়িতে চড়ে বসা ছাড়া প্রতীকের আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। পুরো বিষয়টি নিয়ে প্রতীক একটাই ভারাক্রান্ত ছিল যে, কখন গাড়ি চলতে শুরু করেছে, কখন তা গলি-উপগলি পেরিয়ে প্রধান সড়কে উঠে এসেছে, কিছুই সে টের পায়নি। সামনের সারিতে বসে থাকা মেয়েটার চুড়ির শব্দে তার সম্বিত ফেরে; প্রতীক বুঝতে পারে গাড়ি চলছে। গাড়ি চলছে মন্থর; মন্থর। যেন প্রধান সড়ক দিয়ে একটা মেজাজি হাতি আপন মনে সময়ের গতিমুখ আটকে দিয়ে দিকশূন্যপুরে ছুটে চলেছে, লক্ষ্য তার স্থির, সেখানে আছে হরিৎ বনানী, মাঝে বিশাল মাঠ, ফসল কেটে ফেলার পর নাড়াগুলো খোঁচা খোঁচা দাড়ির মতো পড়ে আছে, তার উপরে সিলভারের গামলার মতো চাঁদ, চাঁদের ঠিক নিচে একটা তিলের মতো তারা, তার নিচে একটা কুটির, কুটিরের টানেই তারাটা জ্বলজ্বল করছে, নিচে ছুটে পড়বে কী না সেটাই ভাবছে হয়তো মনে মনে। “কী হচ্ছে? গাড়িতে কতো লোক! আলোও জ্বলছে? কী কর না?! এমন কথা শুনে প্রতীক আবারো গাড়ির মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে। আলাদীনের হারানো প্রদীপের মতো নিজের কান ফিরে পায়। সত্যিই তো অনেকদিন সে কানে কিছুই শোনে নি! সামনের সারিতে একটা ছেলে তার বান্ধবীর জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে ঘাটাঘাটি করছে, সে এমনটা করছে কামতাড়নায় নাকি তার চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ শোনার জন্য সেটা ভেবে প্রতীক একটু অন্যমনস্ক হয়। তার পরেও একটা লক্কর ঝক্কর শব্দ তার কানে বাজতে থাকে।
“গাড়িটা মনে হয় বেশ পুরনো”।
“হ্যা তাই হবে”—বৃদ্ধার কথার জবাবে বৃদ্ধটি তাই বলে ওঠে। তখন প্রতীকের মনে হয় গাড়িটা সত্যিই বেশ পুরনো, তার কলকব্জা নড়বড়ে, চালকের গিয়ারে হাতলটা সে স্পষ্ট দেখতে পায়, কেমন বেমানানভাবে মাথা ঝাকাচ্ছে একবার ডানে একবার বামে। সে যেন একটা পাহাড়ের এবড়ো থেবড়ো পথে ঢাল বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। লক্কর-ঝক্কর শব্দের সীমাহীন বিরক্ত ভুলতে প্রতীক মরিয়া হয়ে ওঠে—এই হচ্ছে কান থাকার বা কান ফিরে পাবার ধক্কি-ঝামেলা, না চাইলেও শুনতে হবে, যে রমণে মানুষ নিজে সক্রিয় নয় সেই রমণের শীৎকার ধ্বনি তাকে শুনতে হবে—এ যে কী বীভৎস রকমের কৌতুক তা বলে বোঝানো যাবে না। পাশের ঘরে কিংবা সঙ্গম শেষে একান্ত নারীটি বুকের উপরে লেপ্টে থাকার সময় নারী অন্য কোনো গুণমুগ্ধের সাথে ফিসফিস করে কথা বলবে তখন সেটাও শুনতে হবে—এ যে কী যন্ত্রণার! সবকিছু জিরাফের মতো উঁচু গলা বাড়ি দেখা যাবে, শোনা যাবে; কিন্তু বধিরের পক্ষে তা উপলব্ধি করা অসম্ভব। তারপরেও মানুষ যেহেতু জিরাফ নয়, চাইলে কানে সীসা ঢেলে দেয়ার সাহস যেহেতু অনেকের হয় না, সেহেতু মানুষকে চেষ্টা করতে হয় মেনে নেবার, অন্যান্য ইন্দ্রিয় দিয়ে নতুন করে নতুন কোনো উপলক্ষ খোঁজার। উপলক্ষ একটাই, প্রমাণ করা : “আমি ভাল আছি, সব কিছুর পরেও আমি দেখতে পারি”—এই সান্ত্বনাবোধ নিজের মধ্যে সঞ্চারিত করা। বাস্তবে জ্যান্ত মানুষের এই এক পরিত্রাণ। প্রতীক তাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। জানালাটা স্বচ্ছ কাঁচের, তবে ফ্রেমটি বেশ পুরনো, ফ্রেমের ফাঁকে বাদামের খোসা, একটু মাকড়সার জাল, ঝুল-কালি, এক কোণে জানালার কাঁচ সরানোর হাতল ক্লিপ। ক্লিপ চেপে জানালা খুলে প্রতীক ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা অনুভব করে। যেন দূরে কোনো জলাধার থেকে শতাব্দীর লুকানো হিম নিজের ডানা ফিরে পেয়ে বাতাসে কলকল করে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের দাঁত বাচ্চা শিশুর মতো আলতো, আবার কখনো দাঁতাল শুয়োরের মতো বসিয়ে দেয় কামড়, গালে তার প্রতিহিংসার চিহ্ন থেকে যায়। তারপর পথিক যখন আয়না মুখ দেখে তখন সে আর নিজেকে দেখে না, দেখে অই দংশন চিহ্ন। জানালার আধাআধি মুখ বাড়িয়ে দিয়ে গাড়িটির সামনের অংশ বাইরে দিয়ে দেখতে পায় প্রতীক। অন্য একটা গাড়ি পাশ দিয়ে চলে যাবার আগে ঝকঝকে আলোয় বাসটির গায়ে লেখা “খোদা ভরসা পরিবহণ” নামটি সে স্পষ্ট দেখতে পায়। “খোদা তাহলে এখানেও চড়ে বসেছে”—প্রতীক মনে মনে ভেবে একটা হালকা শ্বাস ছাড়ে। তখনই সে রাস্তার ওপারে চাঁদটাকে দেখতে পায়। তাদের গাড়িটির সাথে সমান তালে ছুটছে। গাড়ি জোরে ছুটলে সে দৌড়ায়, আবর স্পিড স্লো হলে সেও যেন ব্যরিকেড দেখে নিজের রথের চাকায় ব্রেক এঁটে দেয়। কিন্তু চাঁদের নিচে কোনো জ্বলন্ত তারা সে দেখতে পায় না। সেই তারা যার আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু হবে একটি পুণ্য-কুটির, তার নাম আটকুড়িয়া l প্রতীক ভাবে, তেমন চাঁদ-তারার যুগলবন্দি কেবল আটকুড়িয়াতে গেলেই দেখা সম্ভব। আর এতক্ষণে সে তার যাত্রার কারণ খুঁজে পেয়ে কিছুটা ভারমুক্ত হয়। ছুটন্ত চাঁদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবার যথেষ্ট যুক্তি পায় প্রতীক। এতক্ষণ চাঁদের সাথে সাথে যেন সেই নারীটি ছুটে আসছিল যে তাকে এক ঘনঘোর রহস্য ও আপেক্ষিকতা ছাড়া আর কিছুই দেয়নি, বারবার হঠাৎ এসে অনুসরণ করছে, কিন্তু কোনো দিক নির্দেশনা দেয় নি কখনো। প্রতীক তাই আটকুড়িয়া পৌছবার অপেক্ষা করতে থাকে। কত দূর আটকুড়িয়া? কত দূর?
“একটু জানালাটা লাগায়ে দিবেন, প্লিজ, আমার এজমার সমস্যা আছে”—যুবকের কথায় প্রতীক কিছুটা হতচকিত হয়। এতক্ষণ পাশাপাশি থেকেও প্রতীক তাকে দেখেনি। একবার আপাদমস্তক ছেলেটার দিকে চোখ বুলায় সে। যুবকটি যেন তার সামনে চাকুরি প্রার্থনায় এসেছে, বসে আছে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে, এখন প্রতীকের কর্তব্য তাকে চিমটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখা আর তার সর্ম্পকে একটা ধারণা তৈরী করে নেয়া। যুবকটি বেশ রোগা, জানালার বিপরীত দিকে সিটে হেলান দিয়ে মলিন মুখে বসে আছে। তার মাথার ওপরে সিটের ঈষৎ বাঁকানো অংশটা, তাতে সাদা কাভার চড়ানো, কাভারের একদিকটায় তেল চিটচিটে দাগ। সেই দাগের নিচ থেকে যুবক আবারো বলে—“প্লিজ জানালাটা টানে দেন, ঠান্ডায় আমার দম বারায়া যাচ্ছে”।
ছেলেটি অসুস্থ, বয়সের তুলনায় খুব বেশি অসুস্থ। ওই যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা টিফিন-ক্যারিয়ার থেকে বের করে কাবাব-পরটা খাচ্ছে তাদের থেকেও বেশি রোগা। জানালা বন্ধ করে প্রতীক পরিচয়পর্বটি সেরে নেবার চেষ্টা করে—“আমি প্রতীক”। এমন সময় যা হয় অন্য পক্ষও নিজের নাম বলে, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটে না। ছেলেটি সেই আগের মতো নির্বিকার, যথারীতি সিটের একদিকে তার মাথাটা কাত হয়ে থাকে, যেন মাথা নড়ালেই এই ভাঙা গাড়ির মতো তার মাথার ঘিলু গড়িয়ে পড়বে মাটিতে। অনেকক্ষণ পরে ছেলেটি নিজের বুকের বামপাশে দু-তিনটে আলতো কিল মেরে গলা-খাকারি দিয়ে প্রতীকের দিকে মুখ ফেরায়। এই মুখ ফেরানো যেন কোনো ধর্মযাজকের দিকে তাকানোর মতো। তারপর ছেলেটি বলে যে, সে সত্যিই অসুস্থ। ভীষণ অসুস্থ। প্রতীক বলে
“তা, এই শরীর নিয়া এই জার্নির ধকল কেনো?”
“না, আমি একটু চেঞ্জে যাচ্ছি”
“কোথায়?”
“নারায়নের ঘাট”
“সেটা আবার কোথায়? আমি আটকুড়িয়া যাচ্ছি। সেটা কি তার আগে নাকি পরে?”
“ঠিক বলতে পারবো না”
এমন সময় টিকিট চেকার এসে সিটের সামনে দাঁড়ায়। পরিষ্কার ছিমছাম চেহারা, শরীরে মেটে রঙের একটা জামা, দু’দিকেই পকেট, ডানদিকের পকেটে একটা সোনালী রঙের কলম। কলমটা পকেট থেকে বের করে টিকিট চেকার টিকিট দেখাতে বলে। তারপর টিকিটে সাইন করে তার জন্য নির্ধারিত অংশটি নির্দয়ভাবে ছিড়ে নেয়। এটা যেন কোনো যৌনদাসীর দুই মুনিব ভ্রাতার আধাআধি ফেড়ে ভাগ করে নেবার মতো ব্যাপার। বিষয়টা নিয়ে অন্য কিছু বোঝার আগে মেটে রঙের জামার ভেতরে থেকে লোকটি বলে ওঠে—“আটকুড়িয়া যাবেন! কিন্তু এই গাড়ি তো ওখানে যাবে না!”
প্রতীক বলে—“কী বলেন, আপনাদের কাউন্টারের লোক তো বলল, যাবে...”
“যাবে, কিন্তু আপনাকে বাইপাসে নামতে হবে, মূল শহরে এই গাড়ি ঢুকে না”
“তা ওখান থেকে মুল আটকুড়িয়া কতদূর?”
“আমি ঠিক জানি না, তবে খুব বেশি দূর হবে না হয়তো”
এবার চটে যায় প্রতীক—“মামদোগিরি পাইছেন?! যাবেন না! যাবেন না তো আপনাদের কাউন্টার থেকে টিকিট দিলো ক্যান?”
“আচ্ছা ভাই, চেইতেন না, ঠিক আছে একটা ব্যবস্থা হইবো”
“ব্যবস্থা হইবো মানে?”
“আপনারে যাওনের ব্যবস্থা কইরা দিমু। অইখানে নসিমন পাওয়া যায়, কী নসিমন বুঝলেন না, পাওয়ারটিলার দিয়া টেম্পো বানাইছে, হেরে কয় নসিমন, দশ-বিশ টাকা নিবো হয়তো ”
এবার আরো চটে যায় প্রতীক, তার এতো সাধের আটকুড়িয়া যাওয়ার খায়েশ, প্রতীক যেটাকে কায়দা করে বলে “দ্য জার্নি টু আটকুড়িয়া”; “দ্যা” নয় “দ্য”—তা, সেই একটিমাত্র ইউনিক যাত্রা; সেই সিলেবল নির্দিষ্ট আটকুড়িয়া, সেখানে যেতে এতো কেরফা! ভেবে, কিছুটা বিরক্ত হয় প্রতীক। রাগও। বলে—“আমি অত জানি না, মূল জায়গায় আমারে নামায়া দিতে হবে, নাইলে ঘারানি...”
এবার টিকিট চেকারের গলায় আপোষের সুর,
“আরে ভাই চেইতেন না, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনে রিলাক্স কইরা বসেন আর সিন-সিনারী দেখেন”
—বলেই সামনের সিটের যুবক-যুবতীর দিকে ইশারা করে। স্বভাবতই প্রতীকের চোখ সেখানে চলে যায়। মেয়েটি ছেলেটির কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঁজে আছে, ঠোঁটে কেমন কালসিটে, আর ছেলেটা তার পিঠের দিক দিয়ে হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে আছে, যেন বহু মূল্যবান কোনো নথি, কিছু হলে তার আস্ত থাকবে না। টিকিট চেকার সেই দিকে তাকিয়ে কৌতুকের স্বরে বলে—“যাত্রীরা টিকিট বাইর করেন, যারা টিকিট দিছেন তারা ঘুমাইয়া পড়েন, মেলা দূরের রাস্তা, স্টপেজ আইলে ডাইকা তুইলা দেয়া হবে, সমস্যা নাই, নো প্রবলেম, ডু ফুর্তি”। টিকিট চেকারের কণ্ঠে নিছক কৌতুক থাকায় একটু হেসে ওঠে প্রতীকের পাশে বসা রোগা ছেলেটি। এই প্রথম সে হাসলো। হাসলে মানুষকে কি আসলেই সুন্দর লাগে? টিকিট চেকার আবারো বলে—“নো চিন্তা, ডু ফুর্তি, পাকা ড্রাইভার, সময়ের আগেই পৌছাইয়া যাইবেন”। এইবার একটা কণ্ঠ ভেসে আসে, যেন ঝড়ের মধ্যে পড়া কোনো জাহাজের যাত্রীর উদ্বেগ শোনা যায়—
“কী বলেন মিয়া, অই ড্রাইভার আস্তে চালান”
তার স্বরের সাথে আরো অনেকগুলো কণ্ঠ বলে ওঠে—“ড্রাইভার আস্তে চালান”— “ড্রাইভার আস্তে চালান”
যেন তারা সবাই এতক্ষন ঘুমিয়ে ছিল, ঘুম ভেঙে দেখতে পেয়েছে তাদের জাহাজ ডুবে যেতে বসেছে। ড্রাইভার কিছু বলে না, বলে টিকিট চেকার—“সামনে রাস্তা খারাপ, ব্রেক কাম করে না”
“কাম করে না মানে!”
একটা হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাসে।
“কাম করে না মানে, এইখানে স্পিড কমাইলে বিপদ”
টিকিটচেকার আর কিছু বলে না, যেন অদৃশ্য বিপদ তার নিজের নাম শুনে দৈত্যের মতো সামনে এসে হাজির হবে, আর বাচ্চাদের মতো বড়দেরও ঘাড় মটকে খেয়ে ফেলবে ফ্রায়েড চিকেনের মতো।
এবার সত্যিসত্যি গাড়িটি জোরে চলছে। অন্তত তেমনটিই মনে হয় প্রতীকের। ইতিমধ্যে টিকিটচেকার তাঁর কাজ করে গেছেন, তাই ভেতরের বাতিগুলো নিভে গেছে যথারীতি। সামনের সিট থেকে আবারো চুড়ির রিনিঝিনি শব্দটা আসতে শুরু করেছে। প্রতীক সবকিছু পরিষ্কার শুনতে পায়, পাশের ছেলেটির বুকের ধুকপুকানির শব্দটিও। পাশাপাশি কেউ যেন কর্কশ গলায় কেশে ওঠে। প্রতীকের মনে হয় অনেকগুলো খেকশিয়াল কুকুরের ভয়ে লেজ গুটিয়ে কুইকুই করে পালিয়ে যাচ্ছে। জানালার বাইরে একটা মাত্র আলোর রেখা, পেছনের বাতির আলোর রেশ কাটতে না কাটতে সামনের দিকে আরেকটি বাতির ক্ষীণ আলো ঢু’ দিচ্ছে। আলোর উৎসের অবস্থানগত তারতম্য সত্বেও গাড়ির দ্রুত বেগ সব কিছুকে একটি সরল রেখায় টেনে আনছে। একটা মৃদু ঝাঁকুনিতে সবাই প্রায় ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকে। ইতিমধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে তেমনটাই ঘটেছে। প্রতীক ঘুমিয়ে গেছে না কি জেগে আছে তা আর খেয়াল করতে পারে না। সে দেখে আটকুড়িয়া, একটা হরিৎ বনানী, উপরে সিলভারের গামলার মতো চাঁদ আর অফুরান জ্যোছনা। এতো জ্যোছনা যে রুপালী জলের মতো ভারী অনুভবে ডুবে যাচ্ছে প্রতীক!
শ্বাস কষ্ট বেড়ে গেলে প্রতীক নিজেকে অনেকটাই সচেতন অবস্থায় আবিষ্কার করে। তাকে একদল মানুষ পানির ভেতর থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করছে। নিমীলিত চোখে সে দেখে, তাদের গাড়িটা রাস্তার পাশের খাদের পানিতে পড়ে আছে, গাড়িটার মাথার দিকটা পানির ভেতরে। পেছনটা ডলফিনের ল্যাজের মতো উপরে। প্রতীকের মনে হয় তার পায়ের দিকটা কোনো লোহালক্করের সাথে আটকে আছে। লোকগুলো যখন তাকে ধরে টানাটানি করছে, তখন খচ করে উঠছে। কলিজায় লবণ দেয়া মনে হয় একেই বলে! প্রতীক দেখে, পাশের ছেলেটি গলার দিক দিয়ে একটা রড ঢুকে সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। শলাকার সামনে কতক শালুকের খৈঅলা ডাটার জটলা। কিন্তু কোথাও কোনো রক্তচিহ্ন নেই। রক্তের কথা মনে হতেই প্রতীকের মনে হয়, তার পা দিয়ে একটা শীতল ধারা শরীরে ঢুকে যাচ্ছে, শরীর অবশ হয়ে আসছে, সে সময় তাকে নিয়ে টানাহেচড়াটাও মনে হয় বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ওঠে। কিন্তু সে টু শব্দটি করে না। মনে হয় তার শরীরে অসংখ্যা শীতলদেহী সাপ ঢুকে যাচ্ছে। শরীরের এমন অসংখ্য সাপ নিয়ে প্রতীক দেখে, উদ্ধারকারীদের একজন রডবিদ্ধ ছেলেটার জামার পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করে আনছে, অন্যজন ছেলেটা আঙুল থেকে খুলে নিচ্ছে সোনার আংটি। তারও পেছনে একটা ধস্তাধস্তির মতো ঘটনা দেখতে পায়, দুই উদ্ধারকারী নিজের মধ্যে দুর্বোধ্য আক্রোশে গালাগাল ছুড়ে দিচ্ছে। একজন বলছে—“নারে শালা মরে নাই, এলাও জিউ আছে”। আরেকজন বলছে—“অইস্ আগে মানিব্যাগ বের করি নেও, দেখেক তো ঘড়িটড়ি আছে নাকি হাতোত?!”
চেতনার প্রায় শেষ বিন্দুতেও প্রতীক বুঝতে পারে তার ঘড়ি, মানিব্যাগ, আংটি খুলে কে যেন তার জামা-কাপড় পর্যন্ত খুলে নিচ্ছে। প্রতীক সজাগ হবার চেষ্টা করে না, কেবল ছায়ামূর্তিদের কথা শোনে। তার মনে পড়ে কোনো একদিন সে আটকুড়িয়া গিয়েছিল অথবা যায় নি, তবে সেখানকার মানুষেরা এমন কথ্যভঙ্গিতেই কথা বলে। প্রতীক তাদের কথা শোনে। শরীর থেকে একে একে সব কাপড় চোপড় সরে যাবার পর প্রতীক কিছুটা হালকা অনুভব করে। কিন্তু তখনই তার মনে হয়, এই রকম ডুন্ডি অবস্থায় সে কী করে আটকুড়িযা যাবে? অনেক কষ্টে, পা-টা ছাড়িয়ে লোকগুলোর পেছন পেছন বেরিয়ে আসে প্রতীক।
“ভাই, ও ভাই, আমার জামা-কাপড়গুলা দিয়া যান!”—চেঁচাতে গিয়েও চুপ করে যায় প্রতীক। ওখানেই বসে পড়ে।
রিক্ত, নগ্ন, স্নাত। আর আকাশ থেকে একটা তিলের মতো তারা ছুটে বড় হতে হতে দ্রিম করে আছড়ে পড়ে মাটিতে।
আহ আটকুড়িয়া! আটকুড়িয়া!