কয়দিনের গোমড়া মুখ ঝেড়ে বাইরে ঝকঝকে রোদ। তাতেই কীনা কে জানে, ঝাঁঝিয়ে ওঠে স্টিভ- ‘নো নো ক্লিন ইনসাইড,ক্লিন ইনসাইড!’
ওকে, ওকে। মাস তিনেকের বিউটিশিয়ানের চাকরিতে তানিয়া জেনে গেছে ও কী বলতে চায়।
একটা সময় ছিল যখন নাউয়া বেটারা যখন ক্ষুর-কাচি চামড়ার বেল্টে ঘষে নিতে ব্যস্ত, তখনই কর্তা একটু গলা খাকারি দিয়ে বলে নিতেন- যোগেন আজ কিন্তু অধঃকর্তণ।
‘আজ্ঞে’- বলে আলাদা ক্ষুর কাচি ঝুলি থেকে বের করে চোখে ডাটভাঙ্গা পুরু চশমাটা পড়ে নিত যোগেন।
ছোটবেলা এই গল্প অনেক শুনেছে তানিয়া। শুনেছিল যোগেন বুড়ার কাছ থেকেই। যোগেনকে তানিয়া ডাকত- নাউয়া দাদা বলে। সেই কবেকার কথা, যখন বড় একটা বান এল, তলিয়ে গ্যালো ভাটির সব পাকা ধান। আকাশটাও নেমে এসেছিল বুক-কুঁজো হাঁটু বরাবর। আজ যখন ইউরোপজুড়ে বন্যার তোড়, তখন বইক্যার বিলে পালক নয় মানসপটে ভেসে ওঠে সারিসারি লাশ। এই সুদূর লন্ডনে, রাজ-বরকন্দাজের দাঁড়িয়ে থাকা দালানের ফাঁকে ঝকঝকে অজগরের মতো এঁকেবেঁকে চলা কংক্রিটের এভিন্যুয়েও ভেসে আসে তার কটুগন্ধ। যোগেন নাউয়্যাকে মনে পড়ে।
তানিয়া ভাবে, ঠিক কীসের আসায় দেশান্তরী হয় মানুষ? কাকে বলে শেকড়? কেনো এসেছিল যোগেন কাপালি চর-নরসুন্দরা থেকে তিন মাইল উজানে? একখানে যেটা উজান অন্য জায়গার তুলনায় সেই একই জায়গা হতে পারে ভাঁটি। যেখানে কাঁটাতারের ওপার থেকে ধেয়ে আসে জলজ হাতি আর আথালিপাথালি লিলুয়া বাতাস। গাঁয়ের নাম উজানডাঙ্গা।
তানিয়া দুই হাতে দুই ফালি সুতো দিয়ে বানানো চিমটা মতো লোম উটপাটনের অতি সাধারণ হাতিয়ারটা ট্র্যাশবক্সে ফেলে ড্রয়ার থেকে বের করে নেয় লোমকাটার ইলেকট্রিক মেশিন। ইচ্ছে, বেজায়গার লোমগুলোকে খানিক ছেঁটে ওয়াক্স টেপ দিয়ে তুলে ফেলা। কিন্তু স্টিভ দ্বিতীয়বারের মতো ঝাঁঝিয়ে ওঠে- ‘নো নো ক্লিন ইনসাইড, ক্লিন ইনসাইড!’
হয়তো তৃতীয়-চতুর্থ কিংবা তারওচেয়ে বেশি বার।
প্রথম যখন তানিয়া এসেছিল এই গর্জিয়াস পার্লারে,তখন স্টিভের নাম শুনে আর বেশবাস দেখে অনেকের মতোই ভুল হয়েছিল ওর। সেদিন কী কারণে জানি,তানিয়ার কলিগ মেহেরনেগারের সাথে কী নিয়ে যেন স্টিভের বেদম চেচামিচি। দেখে,তানিয়া ভয়ে কুঁকড়ে যায়,মেয়েটার কি চাকরির মায়া নাই! এখানে কাস্টমার মানে ‘মাই লর্ড’ অথবা ‘ইয়োর হাইনেস’। প্রথম যেদিন লেবানিজ শেঠের বাড়িতে হাউজকিপিং-এর কাজ নিয়েছিল তানিয়া সেদিন,কাদেরই বলেছিল, দেখো ওদের কোনো অতিথির সাথে রাফ বিহেভ করিও না। আর দোকান-টোকান হলে তো কথাই নাই। কাস্টমার ফার্স্ট। কেউ কমপ্লেইন করলে নগদে রাসটিকেট!
সেইদিন তানিয়ার ভুল ভাঙ্গে। মনে হয় সেটা ছিল বড়দিনের আগে অথবা পরের কোনো শনিবার। স্যাটারডে নাইট পার্টি টাইম। স্টিভের সাথে হট্টগোল দেখে শেষমেষ পার্লারের মালিক মধ্যপ্রাচের ইমিগ্রান্ট বিলখিছ তাকে বলেছিল- ‘তানি, উড ইউ হেন্ডেল?’
‘কেন নয়?’
মানুষকে সাজাতে ভালোই লাগে তানিয়ার। সেই কবে মরিয়মের বিয়ের সময় স্নো-ফেস পাউডার আর লিপিস্টিকে কনে সাজিয়েছিল তানিয়া। সেবারও বান এসেছিল, বুনো শুয়োরের মতো পানি ঢুকে পড়েছিল রাজধানীর নিম্নাঞ্চলেও। তাই কালো মানুষ আর বুকের হাড় গোনা ছেলেপুলেরা এসে উঠেছিল ওদের কলেজে। ব্যাস ক্লাস বন্ধ। অগত্মা আজিমপুর কলোনির খালার বাড়ি ছেড়ে তানিয়াকে ফিরতে হয়েছিল উজানডাঙ্গায়। টাউনিয়া-বেটি গ্রামে আসায় কেতাদুরস্ত কনে সাজানোর ভার পড়েছিল ওর ওপর। তখন অবশ্য তানিয়ার সাজানোর অভিজ্ঞতা তেমন একটা ছিল না। কেবল রাজধানীর পাড়া-মহল্লার সস্তা পার্লারে তারই মতো ছিন্নমূল চাকমা কিংবা গারো মেয়েদের কিচিরমিচির কথার মধ্যে ডুবে যেতে যেতে ভ্রু প্লাক করা আর সবচেয়ে সস্তা ফেসিয়াল। মাশকারা লাগানো, পেডিকিওর, মিনিকেওর, ফাউন্ডেশন লাগিয়ে পার্টি কিংবা ব্রাইডাল মেকাপ; সেসব অভিজ্ঞতা আরো অনেক পরে। অবশ্যই সেগুলো আজিমপুরের মতো কোনো আড়ম্বরহীন এলাকার পাড়া-মহল্লার ভারতীয় নায়িকার পোষ্টার সাটানো নিম্নমানের পার্লারে।
তানিয়া আর আপত্তি করে না। স্টিভের দিকে একটা ক্যান্ডিমার্কা হাসি দিয়ে গুনগুন গান ধরে- ‘বিয়ার সাজন সাজো কন্যা লো; ওরে জামাই মিয়া আনছে জেওর পান্না লো..’। মিনিট দুয়েকের মধ্যে সে অধঃ উটপাটনের কাজটি সেরে ফেলে। স্টিভের অদ্ভূত শারীরিক গঠন তাকে বিরক্ত, উত্তেজিত কিংবা অবাক করে না। কারণ, তানিয়া এখন জেনে গেছে- এটা ক্রস কানেকশন। দেখতে মেয়ে হলেও এর একটা পুরুষাঙ্গ আছে। বুকে সিলিকন ব্রেস্ট। লোকালি বলা হয় সী-মেল। অবশ্য প্রথম দিন খুব ঘিনঘিন করেছিল তানিয়ার। কাজটা সেরে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে বারবার হাত ধুয়েও রিরি ভাবটা কাটছিল না। সাথে বেধড়ক চমকানি। তখন তানিয়াকে লজ্জায় আরো ডালিমরঙা করেছিল নেগার। ভাঙ্গা ভাঙ্গা সিলটি বুলিতে বলেছিল: ‘অখন কিতা খইবা? আমি হুদাহুদি কাইজ্জা করি?’
এরপর থেকে অবশ্য স্টিভদের বন্ধুবান্ধরা এলেই তানিয়ার খোঁজ পড়ত। বলতে গেলে, ওদের কাছে সে ছিল জাদুর কাঠিওয়ালা বাদামী পরি! কারণ, চিমটা দিয়ে নয়, তানিযা ভ্রু প্লাক করে চীনা মেয়েদের মতো সুতা দিয়ে; আর সবচেয়ে পজেটিভ দিক অধঃউটপাটনে ওর কোনো আপত্তি নেই। যাকে বলে ‘বিদিক’ প্রফেশনাল। এরপর থেকে স্টিভরা এলে দূরে দূরে থাকত নেগার। স্টিভরা ওর পেছনে লেগেই থাকত। ওকে ডাকত- ‘হেই ইউ, স্ল্যাটি নিগার’ বলে। সিলটি আর নেগার দুটো শব্দকেই বিকৃত করে ওরা অবমাননাকর গালিতে রূপান্তরিত করেছিল। নেগারও কম যায় না। আঘাত করত ওদের শারীরিক উদ্ভটত্ব নিয়ে, বলত-‘ইউ ব্লাডি পার্ভার্টাস, ডামেস্ট ক্রিয়েচার অব গড’।
এমনিতেই রাফ নেগারকে একটু ভয়ই পেত তানিয়া। একদিন জিজ্ঞেস করতেই বলেছিল: ‘ভয়? কেনো? এত সস্তা লেবার ইললিগাল মাইগ্রান্ট ছাড়া আর কোথায় পাবে মালিক?’
‘যদি পুলিশ ধরে?’
‘ধুর; এখানকার কেউ আমাকে হাত লাগাবে না।’
বেশি না ভাঙলেও তানিয়া পরে নিজ থেকেই জেনেছিল, নেগার ব্রিকলেন ম্যাসিভের মেম্বার। হ্যা লন্ডনেও বাঙ্গালী গ্যাং! যারা পাঙ্ক সেজে রকবাজি করে। ভাবা যায়! মেইন স্ট্রিম সিটিজেনদের সাথে মেলামেশা না করা, দাড়িটুপি-হিজাবে ছয়লাব একটা কমিউনিটিতেও গ্যাং থাকতে পারে।
শুধু ব্রিকলেন ম্যাসিভ না, স্টিফানি গ্রীন পসি, বেঙ্গল টাইগারস, বেথনাল গ্রীন বয়েজ , ক্যানন স্ট্রীট পসি ও শ্যাডওয়েল ক্রু এরকম ২৬-২৭টা গ্যাং আছে লন্ডনে। ওদের ফ্যাশনেবল জামা, জুতা, ব্র্যান্ডের কাপড় আর হাতের দামী মোবাইল সেট দেখলে কারো মনে হবে না এদের পূর্বপুরুষরা একদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে সেই সুদূর সিলেট থেকে এসেছিল বাবুর্চি নয়তো আরদালি হয়ে। তারপর শেকলের মতো একটা হুকের সাথে আরেকটা হুক, এভাবে চেইন মাইগ্রেশনে এখন পুরা ইস্ট লন্ডন সাবাড়। দেখলে মনে হবে, এইটা ছোটখাটো বাংলাদেশেরই রেপ্লিকা; ব্যাংল্যান্ড। সে যাই হোক। বিদেশ-বিভুঁইয়ে আজ বাঙালীরা প্রতিষ্ঠিত, দেখে তানিয়ার ভাল লাগে।
মনে পড়ে বাবা হেদায়েতুল্লার কথা। যে লন্ডন থেকে দেশে গিয়ে বিয়ে করেছিল তানিয়ার মা আকলিমাকে। শোনা যায়, উজানডাঙ্গার বর্ষার ঘনকালো মেঘ, জলে মেঘের চকচকে ছায়া আর তারো চেয়ে গভীর চোখের আকলিমার প্রতি হেদায়েতুল্লার ছিল সত্যিকারের প্রেম। কিন্তু এও শোনা যায়, দশ কানি জমি বিক্রি করে মেয়েকে জামাইয়ের সাথে বিলাতে পাঠানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তানিয়ার নানা আক্কাস মোড়ল কোনো এক আষাঢ় মাসের সন্ধ্যায় পাহাড়ি ঢলের কালো জলে প্রপিতামহের জুব্বাপরা নূরানী ছায়ার পেছনে ছুট দিয়েছিলেন। ভাগ্যের কি পরিহাস। আজ সেই হেদায়েতুল্লার মেয়ে বাস করে তার শহরেই। হয়তো পাশাপাশি থাকে, হয়তো মরে গেছে। তবু বাংলা টাউনের গলিপথ ধরে যেতে যেতে একটু বয়স্ক লোক দেখলে একটা অদৃশ্য আয়নায় নিজের সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে সে। এই বিড়ম্বনাটুকু বাদ দিলে এখানে এসে আপাত স্বাধীন একটা পরিবেশ পেয়ে যারপরনাই খুশি তানিয়া।
শেষদিকে আর পারছিল না তানিয়া। সারাক্ষণ নুনলাগা জোকের তড়পানি। অব্যক্ত কষ্ট। শরীরে অসম্ভব জ্বালা! কেউ কি নেই? যদিও সে বিয়ের পিড়িতে বসেছিল গোবেচারা আর ডাকাত স্বভাবের রাজ্জাকের সাথে। বিছানা কাঁপত রাতে,ঝড় বইত আর তানিয়ার শরীরে কথা বলত বুনোজল। তবু সন্ধ্যায় ভাটির জলে লাল করে ফোটে শতকোটি কৃষ্ণচূড়া। ও ভাসত বইক্যার বুক ফুড়ে জেগে থাকা শিমুল-তমালে অথবা ইটপাথরের রাজধানীর সংসদের লেকের পানিতে চলে যেত জুনিপোকাদের দেশে। ওর পরিচিত পুরুষরা বলে,ওর শরীরে কীড়া আছে। একপুরুষে ওর পোষায় না। তবু তো প্রায় ৪টা বছর রাজ্জাকের সাথে ঘর করেছিল সে। মাঝে ভাগনে জিসানের বন্ধু জাফরের সাথে খানিক পরকীয়া,বাড়িওয়ালার সাথে ঈদ শপিং;তারপরেও তো ডাকাবুকা ডাকাত স্বভাবের মানুষটির সাথে টানা ৪ বছর। কত স্মৃতি!
নগরেও বৃষ্টি নামে;হয়তো উজানডাঙ্গার থেকেও বেশি। তখন আজিমপুরে খালার বাড়িতে থেকে কলেজ চালানো সদ্য কৈশোর পেরুনো এক যুবতী রাতবিরাতে চুপিচুপি চলে যায় পাশের ঘরে সাবলেট থাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কাদেরের কাছে। সেকি বৃষ্টি! হাঁটুজল জমে যেত আজিমপুর, পলাশীর মোড় থেকে শুরু করে চানখারপুলের বিরানির দোকানগুলোতে।
পথ ডুবে যায়,ড্রেন নিখোঁজ,কেবল কবর ফলক ভেসে থাকে;আত্মপরিচয়। শুধু তানিয়ারই কোনো ঠিকানা নাই;পরিচয় নাই; নিয়ন্ত্রণ নাই নিজের জীবনের। সেই কাদের যখন ৬ বছর পর আবারো যোগাযোগ করে বলল আসতে চায়, তখন আবারও ভাটিঅঞ্চলে বান নামে। গরুছাগল ভেসে যায়,ধানক্ষেত ডুবে যায়; কোথাও মা নেই;মা নেই। কোথাও মা নেই;মা নেই।
নানার দেয়া কিছু ভিটেমাটি তো ছিলই;মায়ের মৃত্যু পর স্বজনদের বাঁকা কথা,আড়ালে আবডালে ছিনাল অপবাদের বাইরে এই জমি বেচা টাকা তানিয়াকে সাহস যোগায় সাগর পাড়ি দেবার।
‘এখানেও সাগর আছে। কাছেই। আগে তো এখানটায় ডক ছিল। এখন শুধু পুরনো অ্যাংকর,স্মারক জাহাজ আর জাদুঘর।‘- এক রোববার তানিয়াকে নিয়ে টেমসের ধারে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছিল কাদের। এতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, বড়ফরাঙ্গি মেরেও কিচ্ছু হয়নি কাদেরের। চাকরি নাই,বাকরি নাই,বন্ধু নাই, একটা একরুমের কামরা বাড়ি। আজিমপুরেও, এখানেও। আজিমপুরে ওর রুম শুধু ওর ছিল, আর এখানে ও আশ্রিত। আশ্রিতা সিনেমাটার কথা মনে পড়ে। আশ্রিত নামে একটা সিনেমা হলে কেমন হত?- তানিয়া ভাবে। ভাবে আর এক কামরার বাসা থেকে আকাশ দেখে; দেখে নারী চরিত্রের মতো বিচিত্র লন্ডনের আনপ্রেডিকটেবল বৃষ্টি।
ভিজতে ভিজতে তানিয়া আবারো খড়কূটোর আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। দরিয়া ওকে টানে, টানে সমুদ্র। কিন্তু ক্রীতদাসের মতো লেবানিজ মাইগ্রান্ট শেটের বাড়িতে হাউজ কিপিং তাকে সমুদ্র দেখার সুযোগ দেয় না। সেই সুযোগ আসে গর্জিয়াস পার্লারে চাকরি পাবার পর। আরো নির্দিষ্ট করে বললে ‘ব্লাডি স্ল্যাটি’ নিগারের হাত ধরে।
সাগরের লবণ গায়ে মাখতে মাখতে, সব শুনে নেগার বলে- ‘কাদের তোমাকে ইউজ করতেছে। একসাথে স্ল্যাট আর সার্ভেন্ট দুটোই পেয়েছে সে। সো সিলি তানি! পিটি অন ইউ।’
প্রথমে মানতে চায়নি তানিয়া। অথবা হয়তো মেনেছিল। অথবা জানত আগে থেকেই। কিন্তু ওর তখন উদার হাবার দিন। এত স্বাধীনতা! যা ইচ্ছে করা যায়! দেখার কেউ নাই, বারণ-মানা নাই। আসলে তখনো শীত আসেনি আর মনটা ছিল রোদ্দুরপ্রবণ। কাদের আছে, থাকবে; ও যার সাথে ইচ্ছে মুভ করতে পারছে; হ্যাংগ আউট করতে পারছে। কষ্ট শুধু পাউন্ডের। পুরুষাঙ্গসহ নারী অবয়বের স্টিভ গং নিচুশ্রেনীর যৌনকর্মী হলেও ভালই টিপস দেয়। হয়তো তানিয়ার ভেতরের অবদমিত ও বেহায়া আগুনটাকে দেখে ফেলেছে বলে।
কেমন করে দেখা মেলে গুপ্ত আগুনের? একেবারে লুকানো; চকিত আগুন?- ভাবে তানিয়া। আগুন কেনো বোঝে না দেবালয়? বোঝে না শুড়িখানা। শরীর সেতো শুধুই শরীর। শরীর দুললে মন পেখম মেলে দেয়, আঙুলের টোকায় বেজে ওঠে সেতার। সেই টোকা স্টিভের হোক আর স্টেফিনির হোক। সুর থাকলে যে কোনো টেমস পাড়ি দেয়া যায়, বুক সমান বইক্যার বিলে ঠায় দাড়িয়ে ঘেমে উঠা যায় অবলীলায়।
মন্দ নেই তানিয়া। প্রবলেম বলতে শুধু- স্টুডেন্ট ভিসা রিনিউ করার ঝক্কি। ভিসা টিকিয়ে রাখতে একের পর এক নাম সর্বস্ব কলেজে পাতাবাহারের মতো সাবজেক্টের সেমিস্টার খরচ। মাঝে মাঝে মন বিদ্রোহ করে। কিন্তু এই দুইশ’ মন চাপ মাথায় করে যখন ডেরায় ফিরে দেখে, কাদের বসে আছে নোনিগোপাল কিংবা হুলোবিড়ালের মতো- সত্যী বলতে কী তখন বেশ লাগে তানিয়ার।
এত স্বাধীনতা তবু একটা বাধাধরা খুটিঁ তানিয়ার লাগেই। ভাল লাগে ব্রিকলেন। বাঙালীরা আসার আগে ব্রিক লেন ও আশপাশের অঞ্চলে একসময় ছিল ইহুদিদের বসবাস। ওদের মূল ব্যবসা ছিল বেকারি ও জুয়েলারি সপ। ধীরে ধীরে ওরা ব্রিটিশ সমাজের মূলধারায় মিশে গেলে,শূন্যস্থান পূরণ করে সভ্যতার বাক্য পূর্ণাঙ্গ রাখল বাঙালীরা। কাদামাটি মাখা মানুষ দিয়ে নতুন করে ভরে উঠল ইহুদিদের খুপড়ি কামরা কিংবা চিলতে বাড়িগুলো। লম্বাফালি ব্যালকনিতে শোভা পেতে লাগল শুকাতে দেয়া ভেজা চেক লুঙ্গি, লাল পেটিকোট। বেকারিগুলো হয়ে গেল বাংলাদেশি রেস্তোরা আর শাড়ির দোকান। আজকের লন্ডনের সবচেয়ে বড় মসজিদ গ্রেট লন্ডন মস্ক, এই ভবনটি একসময় ছিল ইহুদিদের স্পাইটালফিল্ড সিনাগোগ।
এখানে আবহাওয়ার মতো মানুষ বদলায়। পরিবর্তন মেনে নেয়। এমনকি তানিয়াকেও। দেশে যেটা সহজ ছিল না। এখানে সে তার ভেতরের ডালপালাগুলোকে, পাউন্ডের কষ্টসমেত শাসনহীন বাড়তে দিতে পারে। মাসে দু-মাসে একবার বাংলা রেস্তরার ঝালকারি। তখন ক্ষণিকের জন্য উজানডাঙ্গা মনে পড়ে; মনে পড়ে পাহাড়ি ঢল; কূলহীন বিলে গুড়ো লাল আকাশের ভেঙ্গে পড়া।
পথে নামলে আবার সব সচল। চাকা ঘুরে। এরমধ্যে গাড়ি দাবড়ে কাদেরকে নিয়ে যায় পুলিশ। ওর ভিসার মেয়াদ আগেই শেষ হয়েছিল। তাই ডিপোর্ট ছাড়া আর কোনো গতি নাই। এতে করে অখণ্ড স্বাধীনতা নিয়ে লন্ডনের বাঙ্গাল গ্যাংগুলোর কোনো কোনোটির সাথে তানিয়ার মেলামেশার সুযোগ হয়। যারা সামুরাই তলোয়ার, কিচেন ছুরি ও মাংস কাটার ছুরি দিয়ে মারামারি করে। কিন্তু মজার ব্যাপার ওরা কেউ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না। এটা কি ঢাল-তলোয়ারের রাজসিকতা? হয়তো গ্যাংবাজি করলেও অস্ত্র চালানোর সাহস এখনো হয়ে ওঠেনি ওদের। কতো বিচিত্র মানসিকতা। এদের কেউ কেউ নামাজ পড়ে,পর্ক খেতে চায় না। অ্যালকোহলও না। কিন্তু ড্রাগ নেয়। ড্রাগ ওদের কাছে বিনোদন।
স্টিভ বলে,‘এইসব নাটিভ পাঙ্কদের ইসলামিক মৌলবাদীরা মদদ দিচ্ছে। সেই কারণেই তো অলিম্পিকের সময় ওরা ব্রিকলেন থেকে সব সাদা চামড়ার যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করে দিতে চেয়েছিল।’
সত্যমিথ্যা না জেনে তখন নেগারের মতো স্টিভকে গালি দিতে ইচ্ছে করে তানিয়ার।
বেচারা নেগার। ওর সাহচর্যও বেশিদিন ভাল লাগে নি তানিয়ার। যদিও শুরুটা ছিল অপ্রত্যাশিত, অন্যরকম, স্বাধীনতার নতুন উন্মোচন। কিন্তু ওর সাথে পোষালো না বেশি দিন। মেয়েটা মোটা বলে নয়, পাঙ্ক বলেও নয়। অইযে বিনোদনের জন্য হেরোইন; ওটা সাপ্লাই দিত সে; গ্রাসরুট লেভেলের ড্রাগ ডিলার। পুলিশ শেষ পর্যন্ত ওকে জেলে পুরেছে। সাত বছর।
কথায় বলে, যে খায় চিনি তারে যোগায় চিন্তামনি। তাইতো ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতেই কাদেরের জায়গায় তানিয়ার এক কামরার বাসায় আসে রিফাদ। সামনে মাসে রাজ্জাক আসবে। হ্যা তানিয়ার স্বামী; যার সাথে শেষ পর্যন্ত ছাড়াছাড়া হয়নি। সেই ডাকাত রাজ্জাক- বিছানা কাঁপত রাতে, ঝড় বইত আর তানিয়ার শরীরে কথা বলত বুনোজল। তবু সন্ধ্যায় ভাটির জলে লাল করে ফোটে শতকোটি কৃষ্ণচূড়া। ও ভাসত বইক্যার বুক ফুড়ে জেগে থাকা শিমুল-তমালে অথবা ইটপাথরের রাজধানীর সংসদের লেকের পানিতে চলে যেত জুনিপোকাদের দেশে।
রাজ্জাকের বাবা-মা খুব করে ধরলো- ‘মা টাকা যা লাগে নাও; ওকে নিয়ে যাও। এখানে থাকলে আবার উচ্ছন্নে যাবে।’
তানিয়া ‘না’ করে না।
স্টুডেন্ট ভিসা টেকাতে আরেকটি ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হতে হয়েছে ওকে। টাকার টানাটানি। লন্ডনের নারীর মতো আনপ্রেডিকটেবল বৃষ্টিভেজা লম্বা ফালির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তানিয়া ভাবে, রাজ্জাক এলে এবার আয়ারল্যান্ড থেকে ঘুরে আসবে। ওখানে এখন দারুণ সবুজ; রৌদ্র ঝলমল। আবার ভাবে, এবার নিজের বাপের ওপর শোধটা নিয়েই নেবে নাকি? ওর মায়ের প্রতি অবিচারের প্রতিশোধ! ভাবে, টাকা নিয়ে রাজ্জাকের ফোন না ধরলেই তো হলো! কে ওর টিকি ধরতে পারবে?
বৃষ্টির দকম বাড়ে। ঘরে ঢোকে তানিয়া। খুব অগোছালো। ‘বিয়ার সাজন সাজো কন্যা লো... ওরে জামাই মিয়া আনছে জেওর পান্না লো...’ গাইতে গাইতে তানিয়া ঘর গুছাতে লেগে যায়। আর মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে আসে স্টিভের সেই ট্রেডমার্ক ডায়ালোগ... ‘ক্লিন ইনসাইড- ক্লিন ইনসাইড’!
ঘরটা অগোছালো হয়েছে খুব। মনে কালি। জমেছে ক্ষোভ। শরীরে শিরশির। আপনা থেকেই ফুলে ওঠে বুক। ঠিক কী ভেবে না-ভেবে আজ খুব হাসিতে ফেটে পড়ে তানিয়া...