এই যে লাল শার্ট—তুমি কে? এই যে হাতঘড়ি—তুমি কে?
এই যে কাঠের পা, ঘাস, শুকনো পদচ্ছাপ—কে তুমি? চিহ্ন! চিহ্ন!
আমার মা ফার্মগেট চিহ্নিত করে রাখে একটা ব্যানার দিয়ে। যাতে লেখা ‘গরু-ছাগলের বিরাট হাট’। পাশ দিয়ে দুইটা বড় বিল্ডিং, তারপর টুকরি-মাথায় কয়টা বেঞ্চি, কিছু গাছ, হ্যাঁ পার্ক, তারপরেই চক্ষু হাসপাতাল। মায়ের চোখে সমস্যা। মা আমাকে চিনতে পারো তো মা? মা-মা! বারবার বলার পরও তার এই বাতিক যায় না। আরে বাবা, অই ব্যানার যে আজীবন থাকবে না—এই জানা কথা তারে কে বোঝায়? এমন তো হইতে পারে একদিন দেখা গেল—সামনে দিয়ে কালো বিড়াল পথ কেটে যায়নি, বাম চোখ সকাল থেকে থেকে-থেকে নাচেনি, আমার মা যাকে বলে চৌখ নাচানি, বলে ডাইন চৌখ নাচলে সুসংবাদ আর বাম চৌখ নাচিলে তোর কপালোত শনি। এমন তো হতে পারে সব পূর্বাভাসের দেবতারা, চিহ্নগুলো উধাও হয়ে গেছে! তখন? মা তারপরেও নাখালপাড়াকে চিনে রাখে ‘এইখানে ভাল হাতের কাজ করা হয়’, ইন্দিরা রোডকে ‘বনসাই প্রশিক্ষণ’ আর নিজের বাসাকে চিনে রাখে তিন রোড আগে একটা মস্ত বড় খাড্ডা দিয়ে। আমার ভয় করে। মা আমাকে চিনতে পারো তো মা? আমি তোমার লাল, মা, আমি তোমার লাল, লাল পান্না। আমি বলি মা পান্নাতো সবুজ। তবু মা টাকা জমায়, বুড়া বয়সে তাকে কে দেখবে? কে? এর কাছ থেকে চেয়ে, আধিয়ারের কাছে তিন ছটাক ধানের প্রাপ্য বুঝে নিয়ে, বাপের পকেট কেটে, আমাদের গিফটের টাকা জমানোর নাম করে, আমার সুন্নতের কচকচি নতুন ২ টাকার বান্ডিলের কথা এইমাত্র মনে পড়ল, এইভাবে নিজের পাত থেকে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য সরিয়ে রাখে মা। ‘মা আমি তো আছি’—বলতে পারি না। বলতে পারি না, মা এক ভয়ানক রূপসীর হাত থেকে পালিয়ে আছি, ওরা আমাকে মিষ্টি খাওয়াইতে চায়। মা সুরা পড়ে, ফুঁ দেয়, আমার চোখে মুখে লেপ্টে যায় বর্ণমালা। মা আমার হাতে লেখে ‘পুত্র’, চোখে লেখে ‘নীল’, হাতে-পায়ে ফোঁড়ার দাগের একটু নিচে লিখে দেয়— ‘৮ সোনারগাঁও জনপথ রোড, উত্তরা, মাস্কট প্লাজা থেকে সোজা পশ্চিমে একটা ৪ রাস্তা, তারপরে আরেকটা ৪ রাস্তা, দুই তিনটা বাড়ির পর একটা তিন ডাবগাছঅলা বাড়ি’—যাতে লোকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারি এই আমার বাড়ির ঠিকানা।
মা আমার শরীরে লেখে ১, ২, ৩, ৪, ৫, ডাবল, রাউন্ড, নেলসন, রেশনাল ফিগার। আমি বলতে পারি, এই আমাদের ফোন নম্বর। আমি ঘুড়ি গুনতে শিখি। সূর্য দেখি। মা বলে লাল। পানি চাই। মা বলে নদী, কক্সবাজার।
আমারও লিখতে মন চায়। মনে হয় লিখে লিখে চিহ্ন দিয়ে পৃথিবীটা নিজের নামে করে নেই। আমার বন্ধুরা ঈর্ষা করে। চোখ টাটায়, বলে—কী রে লাগে নাই? আমি বলি—না। একটুকু না? বলি—না।
আমার হাতের তালুতে ব্লেড দিয়ে কেটে লেখা একটা বর্ণ ‘পি’। আমার নামে নাম ‘পান্না’। পান্না কোনো মেয়ের নাম হইতে পারে? আমি অবাক হয়ে নিজেকে দেখি—দেখি একটা লাল ফ্রক। নতুন একটা চিহ্ন পাই আমি। কিন্তু একদিন উধাও হয়ে যায় সে। আমি জানি মামাবাড়িতে বেড়াতে আসা যায়, কিন্তু সবসময়, আজীবন থাকে না কেউ। পরের বছর অবশ্য কিসামত তেওরাগা থেকে ফিরে এসেছিল পান্না। কিন্তু ততদিনে আমরা সেইখান থেকে সরে আসি, পুরনো দাগ তুলে মা আমার হাতে নতুন ঠিকানা ঘষে ঘষে লিখে দেয়। ততদিনে আমি নতুন বড় স্কুলে যাই। পড়ি। ছড়া চিনতে শিখি, বানান করে লিখতে পারি ‘টিফিন, পিরিয়ড’।
টিফিনে বন্ধুদের আবার চোখ টাটানো ল করি—‘কী রে লাগে না? ভয় করে না’?
আমি বলি, না। তখন আমার হাতে গোটাগোটা অরে লেখা ‘বীথি’। বীথি আমাকে পাত্তা দেয় না। একটা সাইকেল থাকলে কি পাত্তা দিত?
সাইকেল ধার করে বীথিদের পাড়ায় যাই। এক নজর দেখি ওদের লাইনের সামনে একটা আতাগাছ। কুলের মতো আতা ফল। বন্ধুরা বলে—‘মাতারিটা তোকে বাল দিয়াও পুছে না, আর তুই হাত কাটিস!’
আমি ওদের কষ্ট বুঝি। ওরা তো হাত কাটতে পারে না! সাহস নাই। এইভাবে আমি পারি, আর পারে আমির খান, ‘কেয়ামত সে কেয়ামত’ ছবির নায়ক। নায়কের মতো আমি কেবল চিহ্ন রাখি, যেখানে-সেখানে নাম লিখি। আমার নাদানিতে ওরা আমাকে অবশ্য মাঝেমাঝে ‘বাচ্চা’ বলে উপহাস করে। আর সত্যিসত্যি আমি একটা বাচ্চা হয়ে যাই। বাবা কান ধরে উঠবস করায়। পাগলের মতো গজরায়—‘কে লিখলো দেয়ালে? কে? কয়দিন আগে চুনকাম করাইলাম, এই শুয়োরের বাচ্চা পানি আন, মুছ এখ্খুনি মোছ।’
একটা নার্সারি পড়া বাচ্চা দেয়াল থেকে ‘খুশি’ শব্দটা মুছে ফেলে। কিন্তু পিঠে চেলাকাঠের দাগ মুছতে ভুলে যায়। আমি ভুলে যাই, আমি এক কাস নিচে পড়ি বীথির থেকে। ও আমাকে পাত্তা দেবে না। ছোট ভাইয়ের সাথে কেউ ভাব করে? প্রিন্স এই কথা বলছিল, যখন সেলিনা, আইজুদ্দীনের তিন কী চার নম্বর মেয়ে, অই যে আক্তারা চাচীর ছোট বোন, তাকে ছ্যাঁকা দিয়েছিল, তখন। আমি সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি। প্রিন্স তবু কাঁদে, আর আমি ‘কান্না’ লিখতে শিখি। (পরে অবশ্য এপন্ডিসাইটিস বাস্ট হয়ে বিনা নোটিশে মারা গেছিল সেলিনা।)
চেখের সামনে না থাকলে নাকি মনের বাইরে চলে যায়, প্রিন্স বলছিল। আমি কি বীথির ক্ষেত্রে তাই হতে দিতে পারি? তা যতই বীথির ভাই আমাকে তাড়া করুক, কুত্তাবিলাইয়ের মতো মাইর-ডাং দেক, আমি দাগ মুছে যাবার আগে আবারো লিখি ‘বী-থি’। অনেকদিন পর দেখা হলে বন্ধুরা জিগায়—‘কীরে তোর শারমিন বীথির খবর কি’? আমি বলি—জানি না।
শুনে ওরা হাত টানে। বলে—তাইতো বলি, তুই কেন তার কথা জানিস না? তা এইটা কি লিখছিস? এন না জেড? এন’তে কে রে? তোদের পাড়ার অই নাজু আপা? আগে হলে আমি গরুচোরের মতো মুখ করতাম। কিন্তু আমি আর সেই ছোট্ট খোকাটা নাই। সপ্রতিভ এক কিশোর বলে ওঠে—না, এইটা জেড, জেড ফর জিনা। আবার দেখা গেল জিনার ভাইদের সাথে ক্রিকেট খেলছি, হঠাৎ মনে হইল চোখে পড়ে গেছে, তখন দূরে দূরে বুঝায়া দেই এইটা এন আদ্যরের একজন, তাদের পুতুপুতু বোনটি নয়। বলিং মার্ক ঠিক করে গুনে গুনে এগার ধাপ পেরিয়ে হাত ঘুরায়ে বল করি। কখনো বোল্ড, কখনো তুলাধুনা। আসলে আমি তখন উচ্ছলতা লিখি। লিখি ‘বড় হইতে চাই’, বাচ্চু ভাইয়ের মতো বড়। আমরা তখন নীলু আপাকে দেখে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিতে চাই।
এভাবে একদিন আমি বিষণ্ণতা লিখতে শিখি। শিখি ব্যর্থতা লিখতে। মনে হয় মা ছোটবেলা থেকে আমার শরীরে যত শব্দ, অর, বাক্য লিখে চলেছে তার সব কিছুতেই প্রচ্ছন্নভাবে এই শব্দগুলো লুকিয়ে ছিল। মা বাবাকে বিয়ের আগে চিঠি লিখতো অপু সম্বোধনে। বাবা মাকে ডাকতো ‘আলো’। হ্যাঁ আলো, লাভম্যারেজ বলে কথা! মা বাবার চিঠি বান্ডিল করে কালো ট্রাঙ্কে রাখে। আর আমি স্কুল থেকে ফিরে মায়ের কান্নার সাথে সুর করে কাঁদি। মা চিঠি দ্যাখে, পুরনো চিঠি আর আমার কপালে লিখে দেয় ‘সুবাস’।
মা রাগ করে আমি ধর্ম মানি না বলে। বলে—‘তুই কি মরবি না কোনোদিন? অন্তত শুক্কুরবার নামাজটা পড়।’
মা আমি কী পড়ব? আমি তো বাল্মীকি। আখ্যান লিখি, রামায়ণ লিখি। আমি লক্ষ্মণরেখা ভেদ করতে চাই। কিন্তু সবখানে যে ছদ্মবেশী আততায়ী ? মা, আমার ভয় করে মা। মা মা!! এমনিভাবে, একদিন আমি আবিষ্কার করি, যাদের নাম আমি লিখে রেখেছিলাম হাতের চিটোয়, কাটা অরে, তাদের সাথে আমার ভাব হয়নি, হলেও থাকেনি। কেন? এটা কি ‘গরু-ছাগলের বিরাট হাট’-এর মতো কোনো অদৃশ্য ব্যানার? কোনো সিলমোহর? ‘আর হবে না, এখন আমি স্বাধীন, মুক্ত’—বলে কোনো গুপ্ত সংকেত কি লিখা থাকে তাতে? যখন আমি ফুল বলি তখন কি আসল ফুল মারা যায়? একদিন আমার মধ্যে একটা নতুন শব্দ লিখে দেয় কেউ, লিখে দেয় ‘ঘোর’। আমি ঘোরের সাথে ঘর করতে চাই। মা বলে—তোর বাপ চায় না অই মেয়ের সাথে তুই মেলামেশা কর। তোর বাপের ধারণা, অই মেয়ের সাথে তুই ভালো থাকবি না।’
আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু, কিছু তো করার নাই। আমার ভালো লাগে না, আবার চলেও না। পরী আমাকে মিষ্টি খাওয়াতে চায়, বলে—তোমাকে আমি আমার দেশে নিয়া যাবো, অইখানে রেলগাড়িতে করে দার্জিলিং যাওয়া যায়। আমি মনে মনে স্বর্গ দেখার লোভে পড়ে যাই। কিন্তু পরীর তো অনেক দাবিদার। রহিম বলে, করিম বলে, আরিফ বলে সবাইকে পরী একই স্বপ্ন দেখায়। আমার বড় অভিমান করে। কিন্তু ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’। আমি হাসি। তবু মনে-মনে মনে করি একদিন ঠিক হয়ে যাবে। আমি তখন রাত লিখি। দিন লিখতে পারি না। খালি ‘রাত’ লিখি। পরে পরী চলে যায়। আসে না, আসে না। অনেকদিন পর সে এলে আমি ‘দিন’ লিখতে পারি। কিন্তু আরিফ, রহিম, করিমরা ফিরে আসে, নতুন নামে। এইবারো পরী ওদের সময় দেয় বলে আমি নিশ্চিত হইতে পারি। আমি লিখতে পারি ‘কোনো কিছুই বদলায় না’। কিন্তু যখন আমি লিখতে পারি ‘ঘটনা’, তখন আমি অবশ্যই লিখতে পারি ‘কারণ’। তাই সবশেষ গত রাতে আমি ঠিক করছি আবার হাত কাটবো। হাত কেটে লিখবো প-রী। তাহলে পরীর অলীক জগৎ থেকে আমার নিস্তার। আগে তো তাই ঘটছে। যাদের নাম লিখলাম, তারা কেউ থাকে না। যারা চিহ্নের আওতায় আসে তারা সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে উঠে যায়; হয়ে যায় এক্তিয়ার বহির্ভূত। আমি খুশি হয়ে উঠি। চেঁচাই খুশিতে—‘মা দ্যাখো আমি বড় হয়ে গেছি। তুমি কি এই চাইছিলে? আমার শরীর জুড়ে দিস্তা-দিস্তা রিম-রিম নগ্নতায় তুমি কি লিখছিলে বড় হ। আমি বড় হচ্ছি মা। মা, আমি তোমারে দেখে রাখবো মা, তিন ছটাক ধানের জন্য তোমাকে আর কাজিয়া করতে হবে না।’
মাকে আঁকড়ে ধরে কাঁদি। হালকা লাগে বলে মনে হয়। মনে হয় মা আমার হাতে আবারো লিখে দিচ্ছে ‘লাল-পান্না’। কিন্তু তারপরেও আমার মন কেমন কেমন করে। ব্লেড বসিয়ে হাতে আজ কতদিন বসে আছি। কাটতে পারছি না। লিখতে পারছি না ‘প-রী’। মাত্র কয়টা এদিক ওদিক টান, তারপর আকর্ষণকে কেবল চিহ্ন করে দেয়া। একেই কি অভিজ্ঞতা বলে না? যাকে তুমি রক্তে মেশাও তার উপস্থিতি আর আদলে থাকে না। সে হয়ে যাবে কেবলি চিহ্ন। এভাবে অনেকদিন, হয়তো একমুহূর্তে আমার সাথে স্কুল-বন্ধু, কলেজের বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়, পাড়ার বন্ধু সবার দেখা হয়ে যায়। তারা বলে—‘দেখি তোর হাত দেখা’। আমি দেখাই—‘হাত নাই’। সত্যিই নাই। দেখি—পশ্চিম আকাশে একটা অদৃশ্য হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনবরত রক্ত ঠিকরে আকাশে লিখে দিচ্ছে ‘সন্ধ্যা’। তাই দেখে সিংড়া ফরেস্টের পাশের এক মফস্বল জেলা শহরের কোয়ার্টারের বাড়ি থেকে মা তার ছেলেকে ডাকে—‘ঘরে আয় লাল, ঘরে আয়, সন্ধ্যার বাতাসে ভূত থাকে। ১৬ টা হাত দিয়ে এই ভাবে তোর ঘাড় মটকে দেবে! আয় শিগগিরি...’
--------------------------------------------------------------------------------------------
গল্পটি কাগুজে গুরুতে প্রকাশিত।