সব দিক বিবেচনা করলে, জহিরকে আমার কাছে মনে হয়, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের (স্বাধীন-সার্বভৌম স্বনির্ভর বাংলাদেশের আশাভঙ্গের) সবচেয়ে শক্তিশালী ইন্টারপ্রেটর। তার গল্পে যুদ্ধপরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক চালচিত্রের যে সন্নিবেশ ও চিত্রময়তা দেখতে পাওয়া যায় তা এক কথায় অতুলনীয়। সেখানে নিত্য হয়ে ওঠে যুবকের আর্তনাদ (পারাপার), মধ্যবৃত্তের নির্বিবাদ ভন্ডামি ও বিষাদপূর্ণ একঘেয়েমি জীবন যন্ত্রণা (চতুর্থ মাত্রা; আগারগাও কলোনিতে নয়নতারাফুল কেন নাই), আছে মহল্লার রাজনীতি (এই সময়), তাতে পিষ্ট মানুষের নাভিশ্বাস ইত্যাদি অপরাপর বিষয়গুলো। ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’ যে বন্ধ হয় নি তা তিনি এই নামে গল্প লিখে জানিয়েও দিয়েছেন। গল্পটিতে ক্ষমতা রাজনীতির নানান সময়ের নানান স্তরের বহিপ্রকাশকে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। আর এ বিষয়ে তার মন্তব্য বা উপপাদ্য হলোঃ গরীব বা ক্ষমতাহীনদের মানে বিলাইদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় নাই, হয় না। গল্পের শেষে নিজের জবানিতে মন্তব্য করার মতো করে তাই তিনি বলেন— “ এই খেলার শেষ নাই, খেলোয়াড়ের শেষ আছে, খেলোয়ার খেইল ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু খেইল জারি থাকে।....। কেবল বিলাইরা ইচ্ছা করে খেলা ছেড়ে যেতে পারে, ইন্দুররা পারে না; বিলাই খেলতে চাইলে ইন্দুরকে খেলতে হবে”। ক্ষমতা-রাজনীতির এই তামার-বিষ সম্পর্কে জহির এতোটাই নিশ্চিত যে, “ইন্দুর বিলাই খেলা” গল্পে একটি বিরল ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি যে তির ছুড়েছেন তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরব কিছুটা ম্লান হয়েছে কিনা সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবে জহিরের এমন দুঃসাহস চমকিত করে। যুদ্ধ থেকে যখন মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ফিরতে শুরু করেছেন, মানুষ যখন স্বপ্ন দেখছে শান্তি ও স্বস্তির; হয়তো সমৃদ্ধিরও, ঠিক তখনই জনৈকা খতিজা’র অভিজ্ঞতার কথা জহির বলছেন এভাবে—
তারা রাস্তায় নেমে আসে এবং মাসুদ আর মুনিরকে ঘিরে ধরে, তারা তাদের আগ্নেয়াস্ত্রে হাত বুলায় ... এবং তখন খতিজা সিলভারের জগে করে শরবৎ বানিয়ে আনে, বলে, তুমাগো লাইগা বানাইছি, খাওন লাগব, তুমরা আমাগো ভাই না? ....। খতিজা হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাবর্তনে শরবৎ বানিয়ে খাওয়ায়, কিন্তু এই শরবৎ খাওয়ার পরেও, এক সপ্তাহের ভিতর একদিন সন্ধ্যা বেলা শামসুল আলম খতিজাদের বাড়িতে আসে এবং তার বাপ অব্দুল জলিলের কাছে রাজাকারদের ভাত খাওয়ানোর কারণ জানতে চায়, এবং সে যখন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারে না, তখন শামসুল আলম বলে, আপনে আমার লগে আহেন। মহল্লার লোকেরা বলে যে, তখন খতিজার নসিব পুনরায় তাকে প্রতারিত করে, সে ভেতর ঘর থেকে বের হয়ে এসে বলে, আমার বাপমায়ের দুষ নাই, রাজারকাররে ভাত আমি খাওয়াইছি। শামসুল আলমের হয়তো এ সব গল্প জানা ছিল; সে নিজেকে সংবরণ করতে পারে না, বলে, তাইলে তুমি আহ আমার লগে, এবং খতিজার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। তারপর, শামসুল আলম দক্ষিণ মৈশুন্দির গলির মুখে তাদের দোতালা বাড়ির ছাতের চিলে কোঠায় খতিজাকে তিন দিন আটকে রাখে; এই খবর যখন প্রকাশিত হয়, তখন মাসুদ এবং মনির হোসেন এসে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। শামসুল আলমের বাপ, সিরাজ ব্যাপারি, এই ঘটনার পর কোন একদিন খতিজার বাসায় আসে এবং আব্দুল জলিলের কাছে শামসুল আলমের সঙ্গে খতিজার বিয়ের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, খতিজার দেহ মনে শামসুল আলমের জন্য কিছুই অবশিষ্ঠ ছিল না; ফলে, আব্দুল জলিল কিছু বলার আগেই খতিজা ভিতরের ঘর থেকে বের হয়ে আসে এবং বলে, আপনে যান! —ইন্দুর বিলাই খেলা
এই গল্পে জহির কেবল খতিজাকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখার কথা বলেছেন। নির্যাতন কিংবা অন্য কিছু(?!)—সে বিষয়ে মুখ খুলেন নি তিনি। কিন্তু যখন তিনি খতিজার মুখে দিয়ে বলান—“আল্লার কাছে বিচার দিছি। আল্লায় বিচার করবো”— তখন বিষয়টা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। আর গল্পের শেষে যখন দেখি, শামসুল আলম যে ছিল মুক্তিযোদ্ধা, সামান্য মশার কামড়ে তার মৃত্যু হচ্ছে, আর মহল্লার লোকেরা বিষয়টাকে রিলেট করছে খতিজার অভিশাপের সাথে; তখন কী বলবো, একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয়। জহির ছাড়া এভাবেই কঠিন ধাক্কা আর কে দিয়েছেন?
এভাবেই জহির তুলে ধরেছেন চালচিত্র, তা যতই রূঢ় হোক। এক অর্থে বলতে গেলে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সততাপূর্ণ স্পিরিট তিলে-তিলে নষ্ট হয়ে যাবার কথাই বেশি বলেছেন তিনি। এই বিষয়ে একটু আগাগোড়া চোখ ফেরাতে চাই। “পারাপার”— প্রথম গল্পগ্রন্থের এই নাম — গল্পটিতে জহির ধরতে চেয়েছেন সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের যুব-সমাজের আশাভঙ্গের সূত্রপাতটাকে। গল্পটি যে সময়ের পটভূমিতে লেখা দেশে তখন একদিকে দিকভ্রান্ত ভবিষ্যৎ যাত্রা, অন্যদিকে পাঞ্জাবি এলিটের জায়গায় রঙ বদলে চলে আসা বাঙালি এলিট। প্রবল-প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠা এই নব্য-বণিকদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হতে হয় গল্পের মূল চরিত্র ওলি’কে। আর তখন ওলি যেন হয়ে ওঠে অসহায় যুব সমাজের প্রতিনিধি। তারপর এই অসহায়ত্বকে টেনে আরো এক্সটেনশন করে ‘এই সময়’ পর্যন্ত বিস্তৃত করেন জহির।
তদন্তকারী পুলিশ অফিসার তার নোট বইয়ে সব টুকে নেয়, তারপর সে যখন এরশাদ সাহেব, মওলানা জব্বার, মালেকা বানু, মেজর ইলিয়াসকে বিষয়টি সর্ম্পকে জিজ্ঞেস করে তারা বলে যে, তিন ভাই ভাল ছেলে। ...। তখন মহল্লার লোকেরা প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা তিন ভাই এবং অন্যান্য গণ্যমান্য লোকের দিকে তাকায়, তারা কিছু বলতে পারে না।—এই সময়
দেখা যাচ্ছে, “পারাপার”-এর নির্যাতন এ গল্পে এসে বিস্তৃত হয়েছে আরো তৃণমূল পর্যায়ে। হয়ে উঠেছে আরো বেশি নির্মম; প্রাণঘাতী। তাই “এই সময়”-এ এসে জহিরকে লিখতে হয়েছে, পাড়ার মাস্তাদের (তিন ভাই—আবু, হাবু, শফি) হাতে নিহত মোহাম্মদ সেলিম নামের এক কিশোরের কথা। একটি অসম বয়সী কিশোর-যুবতীর প্রেমের ট্রাজেডীর আড়ালে জহির এই গল্পে যে ম্যাসেজটি দিয়েছেন তা হলো, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ষোলকলা-পূর্ণ হয়েছে। কারণ, স্বাধীনতা বিরোধী মওলানা জব্বার (জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বদু মওলানার এক্সটেনসশন), এরশাদ সাহেব, মালেকা বানু আর মেজর ইলিয়াস, সবাই আজকে গাঁটছড়া বেঁধেছে।
এই উদার ও মধ্য ডানপন্থী রাজনৈতিক ধারাক্রমের পাশাপাশি বাংলায় রয়েছে বামপন্থী আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাস। সেখানেও রয়েছে নানা চরাই-উৎরাই, স্বপ্ন-বিভক্তি; ও মলিনতার বালিয়াড়ি। তাই, কোথাও কোনো যাওয়া নেই, নেই ফিরে আসার পথ। “ধুলোর দিনে ফেরা”য় বিষয়টি ধরেছেনও জহির। গল্পটিতে যুগপৎ ভাবে এগিয়ে চলেছে প্রেম ও রাজনৈতিক অবনমনের ইতিবৃত্ত। গল্পের মূল চরিত্র আব্দুল ওয়াহিদ যিনি কিনা একজন সশস্ত্র মার্কসিস্ট ছিলেন, শেষ পর্যন্ত তিনি নিজ গ্রাম সুহাসিনীতে ফিরে আসেন। তারপর, ছোট্ট ছোট্ট ক্যামেরা ফ্ল্যাশের মতো অনেকগুলো বিষয় উন্মোচিত হতে থাকে। আর গল্পের শেষে, বিরোধী গ্রুপের হাতে খুন হন আব্দুল ওয়াহিদ। ওয়াহিদকে খুন করার পর যখন ঘাতকেরা বার্তা রেখে যায়—শোধ নিয়ে গেলাম, তখন বাংলার চরম বামপন্থীদের মধ্যে মতভেদ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের যে চিত্র আমরা পাই, তা দেখে জহিরের রাজনীতি সচেতনতার সর্বব্যাপকতার পরিচয় পাওয়া যায়। গল্পে, আব্দুল ওয়াহিদের মৃত্যুর কথা লিখলেও, এই নকশালী কিংবা মার্কসিস্টদের প্রতি জহিরের এক ধরণের টান আছে বলে মনে হয় (প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, জহির ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, মেনন গ্রুপ)। সে কারণেই হয়তো, আমরা দেখি, আব্দুল ওয়াহিদ গোলাপ গাছের সাথে নিয়মিত রুটিন করে কথা বলেন, ময়নাপাখিকে কথা শেখানোর চেষ্টা করেন। তখন এই বিষয়গুলোকে নিম্নবর্গের মানুষের স্বশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার প্রতীক বলে মনে হয়। লেখকের নিজের মন্তব্য এখানে স্মরণ করা যেতে পারে—
যারা একদিন স্বপ্ন দেখেছিল, তাদেরকে ব্যর্থ বলতে পারি না আমি। গল্পের ভিতরে বা বাস্তবে মরে যাওয়াই ব্যর্থ হয়ে যাওয়া না ...। এমনকি স্বপ্ন ও প্রচেষ্টার ব্যর্থতার পরেও, আমাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো তৈরিতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই স্বপ্ন ও প্রচেষ্টার ফলাফল একেবারে অদৃষ্টিগ্রাহ্য না।...। তারপরও আমি বলছি না যে, অব্দুল ওয়াহিদরা সফল ছিল, তারা সফল ছিল না, কিন্তু সেটাই শেষ কথা না। —শহীদুল জহিরের সাক্ষাতকার, কথা (কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ)।
এসব সরাসরি রাজনৈতিক প্রভাবক ও প্রভাবান্বিতদের প্যারালালি আরেকটি বিষয় জহির এড়িয়ে যাননি কখনো—তা হলো, মানুষের মধ্যে এবসার্ডিটি ও সামুষ্টিকরণের বিপরীতে ক্রমবর্ধমান একাকত্বিবোধ। এর ফলে মানুষ হয়ে পড়ছে রাজনীতি-বিযুক্ত। রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক অথবা ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ অথবা অন্য কোনো কারণেই হোক মানুষ আজ বড় একা, (স্বাধীন বাংলা বড় একা), তার দুঃখটাও একার। এই একাদের সংখ্যা অনেক। বাড়ছে আরো। তাদের মুখে হাসি নেই, চোখে কান্না নেই, জীবনে যন্ত্রণা নেই, খোঁজ আছে প্রাপ্তি নেই। আবার সুখের ভারও নেই এদের। দিন দিন মানুষ যেন বন্দী হচ্ছে গোলক-ধাঁধায়। ধাঁধা মানুষকে বিভ্রান্ত করে, রহস্য মানুষকে নিজের সাথে খেলায়, যে খেলার নাম বাঁচা-বাঁচা খেলা, তা আবার নতুন খেলার সুযোগ দেয়। জহিরের অনেক গল্পই সে খেলার কথা বলে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে “ডুলু নদীর হাওয়া” গল্পটির কথা। সেটাও তো খেলা! আবার ‘চতুর্থ মাত্রা’র আব্দুল করিমও খেলেন। প্রতিদিন একই কাজ, গ্লাস ভাঙা, সেই ভাঙ্গারি নিয়ে বাচ্চাদের মারামারি, প্রতিদিন পেপার বিক্রি, তারপর পেপার শেষ হয়ে গেলে উল্টো পেপারওলার কাছ থেকে বেশি দামে পেপার কিনে, সেই পেপার কম দামে বিক্রি করা... এসবই খেলা, নিজের সাথে নিজের বাঘবন্দী খেলা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মানুষ যেভাবে একা ও খণ্ডিত হয়েছে তা তার একান্ত গৃহকোণ অথবা সামান্য চিলেকোটাটিতেও, তার বেশ কিছু গল্পভাষ্য আমরা জহিরের কাছ থেকে পেয়েছি। এই সব মনোটনাস একাকীত্বের বর্ননায় জহির বেশ হিউমারাস হয়ে ওঠেন। তার হিউমারে আমরা হাসি, মজা পাই, কিন্তু আসল বিষয়তো—বিষাদ! এই বিষাদ দেখি “আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই”-এর আবদুস সাত্তারের চোখে। এই অব্দুস সাত্তার হলো “চতূর্থ মাত্রা”র আব্দুল করিমের আরেকটি ফর্ম, যে কীনা সংসারে থেকেও সংসারের বাইরে, অফিস-বাড়ি, বাড়ি-অফিস, কলুর-বলদের মতো কেরানি-জীবন। কোনো হাসি নেই, রঙ্গ নেই, কেবল পথে পড়ে যাওয়া আছে; পড়ে গিয়ে কাঁদা যায় না। অন্যের হাসির পাত্র হয়ে তাদের হাসিতে যোগ দেয় সাত্তার, হয়তো ঠোট ঈষৎ স্ফুরিত হয় মাত্র, আর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে—“পইরা গেলাম”।
এভাবে, “জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা” হয়ে “পারাপার”; তারপর “ধুলোর দিনে ফেরা” হয়ে জহিরের রাজনৈতিক অবজারবেশনের যে যাত্রা— “এই সময়” গল্পে এসে তা স্পর্শ করেছে সর্বসাম্প্রতিক উপরিতল। আরেকটি শাখা পল্লবিত হয় অবদুস সাত্তার, আব্দুল ওয়াহিদ (তিনিও সফল নন), আব্দুল করিমদের নিস্ক্রিয়-নিস্প্রভ জীবন যাত্রায়; যেখানে কোনো নয়ততারা নেই, গোলাপ ফুল নেই, নেই কথা-বলা ময়না পাখি। যা আছে তা হলো, মোহাম্মদ সেলিমের মতো আক্ষেপ— “আইজকা ফুল ফুটে নাই, ... ফুল আনা পারিনিকা”।
এরই নাম হয়তো চাপচাপ অসহায়ত্ব; মৃত্যু অথবা প্রকল্প: মৃত্যু-কল্প।
(সমাপ্ত)